তৃতীয় যাম। (শেষ অংশ)

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০২/২০০৯ - ১১:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছুটির দিন বলে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। সবাই মানে ফিরোজ আর নীলু, চিত্রা পাশে দাঁড়িয়ে পরিবেশন করছে। সকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল এক পশলা, তাতে গরম কমেনি। বরং এখন একটা ভ্যাপসা আবহাওয়া, সিলিং ফ্যানের বাতাসেও সে ভাবটা কাটছেনা।

ফ্ল্যাটের লম্বা বারান্দায় পাতা খাবার টেবিলে বসে নীলু দর দর করে ঘামছে। তার গরম একদম সহ্য হয়না। তার উপর মাথার চুল লম্বা হওয়াতে সে আরো বেশী ঘামছে। মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে ফিরোজ বললো,‘চিত্রা, নীলুকে একটা তোয়ালে-টোয়ালে কিছু একটা এনে দাওতো। ওতো ঘামতে ঘামতে মারাই যাবে মনে হচ্ছে।’

চিত্রা মৃদু মুখ ঝামটা দিল,‘ঘামুক। এতবার বললাম চুল কাটতে, আমার কথা কি শুনবেন তিনি? তিনি আবার কবি হয়েছেন, চুল লম্বা না হলে নাকি আবার ওনাদের মাথা থেকে কবিতা বেরোয় না।’

নীলু চিত্রার কথা শুনে অর্ধ-নিমীলিত চোখে হাসে। সে আয়েশ করে মুরগীর হাড় চিবোচ্ছিল।
চিত্রা আবার মুখ ঝামটা দিলো। ‘তুই হাসছিস কেন গাধা?’

নীলু ফিরোজের দিকে থাকিয়ে বলে,‘দুলাভাই, ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন? মেয়ে মাত্রেই জেলাস। একটু না হয় চুলটা লম্বাই রাখলাম কয়েকদিন। আমার এই চুল দেখে জেলাস হওয়ার কোন মানে হয়? তাওতো আজকে চুলে তেল দিইনি।’

ফিরোজ ডালের বাটির দিকে হাত বাড়ায়। ‘সেটা নাহয় বুঝলাম শালাবাবু, কিন্তু তোমার আপা যে কথাটা বললো সেটা কি সত্যি?‘
‘কোন কথা দুলাভাই?‘
‘ওই যে তোমার কবিতা লেখার কথা।’
‘কবিতা লেখা খুব কঠিন জিনিস দুলাভাই। আমার মতো সলিমুদ্দি যদি কবি হতো তাহলে তো আর কথাই ছিলনা।’
‘কি যে বলো নীলু, আমি তো শুনি বাংলাদেশ তো কবি দিয়ে ছেয়ে গেছে।’
‘সে সব দিন আর নেই দুলাভাই। কবিতা লেখার ব্যাপারাটা আজকাল শিল্পসম্মত হতে হবে। ওই জল পড়ে পাতা নড়ের দিন শেষ।’
‘কবিতা শিল্পসম্মত হতে হবে? সেটা আবার কি জিনিষ?’
‘কেউ আজকাল আর কবিতা লেখেনা দুলাভাই, সবাই এখন কবিতা নির্মান করে।’
‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে কবিতা লেখাটা যেন একটা মালটিস্টোরীড ভবন তৈরী করার মত জিনিষ। তার জন্য ইঞ্জিনিয়ার, রাজমিস্ত্রী, লোহা সিমেন্ট লাগবে।’
‘প্রায় তাইই। আপনাকে ডিকশনারী নিয়ে বসতে হবে। ভুল শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। একটা উদাহরন দেই। চুলের বনে পথ হারানো যাবে না, চুলের অরণ্যে পথ হারাতে হবে।’

খাবার পরপরই নীলু জামা কাপড় পালটে বেরিয়ে যায়। তার নাকি গ্রুপ-স্টাডি আছে। চিত্রা খেতে বসে। ফিরোজ ছুটির দিনে একটু ঘুমায়। আজ গরম বলে সে একটা হাতপাখা নিয়ে বারান্দার এক কোণায় বসলো।

চিত্রা খেতে খেতে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের আড়াই বছর বিয়ে হয়েছে। চিত্রা তখন বিএ পড়ছে। ছোটমামা এই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। বাবা-মার খুব বেশী ইচ্ছে ছিলনা তখন চিত্রার বিয়ে দেওয়ার।

কিন্তু ছোটমামা নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইলেন। ‘ছেলেটা ভাল, দুলাভাই। সেলফ-মেড ছেলে, বড়লোকের আদরের দুলাল না। এইসব ছেলেরা মানুষের কষ্ট বোঝে। তার উপর ছেলেটির তিনকুলে কেউ নেই। সংসারে শ্বাশুড়ি-ননদের মুখ ঝামটা থাকবে না। আমি আপনাকে বলছি দুলাভাই, চিত্রামা এর কাছে ভাল থাকবে। স্বামীর ভালবাসা পাবে। সব সময় টাকা-পয়সা দেখলে হয়না।’

মাস খানেকের মধ্যে বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেল। তখনই বিয়েটা হয়ে যেত, শুধু চিত্রার পরীক্ষার জন্য কয়েক মাস দেরী করতে হোল। সেই সময়টাতে চিত্রা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কোথা থেকে কি হয়ে যাচ্ছে তা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সে যন্ত্রের মতো কলেজ যায়, ক্লাশ নোট নেয়, তারপর বাড়ি ফিরে পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে।
কলেজের বান্ধবীরা খবর শুনে একই সাথে উত্তেজিত এবং দুঃখিত হয়েছিল।

কেউ বললো,‘তুই তো তাহলে ঢাকা চলে যাবি। আর কি আমাদের কথা মনে থাকবে তোর?‘
কেউ বললো,‘কি মজা তোর। বরের সাথে থাকতে পারবি সব সময়। শ্বসুর-শ্বাশুড়ির উপদেশ শুনতে হবেনা।’

শুধু একদিন ক্লাশের সবচেয়ে ফাজিল মেয়ে ঝরণা চিত্রাকে একা পেয়ে বললো,‘তুই আসলে একটা হোপলেস মেয়ে। মামা এসে দুদিন ঘ্যানঘ্যান করলো আর অমনি তুই বিয়েতে রাজী হয়ে গেলি। একটা প্রেম করলি না, একটা ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরালি না, পরে নাতি-নাতনীদেরকে কি গল্প শুনাবি? এখনো দুমাস সময় আছে, চট করে ছোটখাটো একটা প্রেম করে ফ্যাল।’
চিত্রা একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল,‘যাহ্‌ কি বলছিস এসব। আমি কোনদিন প্রেম-ট্রেম নিয়ে ভাবিনি।’
ঝরণা চিত্রার চিবুক নেড়ে বলেছিল,‘আহা, ন্যাকা! বিছানায় শুয়ে শুয়ে কারো কথা কোনদিন চিন্তা করিসনি? ভাবিসনি তোর বর দেখতে কেমন হবে? ফর্সা, না শ্যামলা? গোঁফ আছে কি নেই?’
‘না ভাবিনি। সত্যি।’
ঝরণা রেগে গিয়েছিল। ‘তুই একটা মিথ্যুক।’

খেতে খেতে চিত্রা আনমনে হাসে। সেদিন কি সে ঝরণাকে সত্যি কথাটা বলতে পেরেছিল? এক অর্থে সত্যি, এক অর্থে সত্যি না। বিয়ের আগে দু এক বার কি সে ভাবেনি তার ভাবী স্বামীর কথা? কিন্তু যতবারই সে চিন্তা করেছে, কখনোই সে লোকটির চেহারা কেমন হবে সেটা কল্পনা করেনি।

মনে মনে সে ভেবেছিল বিয়ের রাতটিতে সে বৌ সেজে বড় একটি ঘোমটা দিয়ে খাটের উপর বসে থাকবে। পায়ের শব্দে টের পাবে যে পুরুষটি আস্তে আস্তে তার কাছে আসছে। লজ্জা আর আনন্দে সে তার মাথা আরো নীচু করে ফেলবে। লম্বা ঘোমটার জন্যে তার দৃষ্টিতে পুরুষটির কোন কিছুই ধরা পড়বেনা। পুরুষটি তার একদম কাছে এসে দাঁড়াবে। শুনশান নীরবতার মধ্যে চিত্রা তার গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাবে। চিত্রার বুকের ভেতর হূতপিন্ডের ধুপধুপ আওয়াজে যেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

এমনি সময় দুটি হাত এসে পড়বে চিত্রার হাতে। ঘোমটার ভিতর চিত্রা সে স্পর্শে চমকে উঠবে। আড়চোখে তাকিয়ে সে দেখতে পাবে একজোড়া ফরসা হাত ধরে আছে তার আঙুলগুলো। বাঁ হাতের অনামিকায় একটি ছোট্ট পাথরের আংটি, পাথরটির রং লাল।
তার হাত ধরে পৃথিবীর সবটুকু ভালবাসা দিয়ে পুরুষটি গাঢ়স্বরে তাকে ডাকবে,‘চিত্রলেখা, ও চিত্রলেখা।’

সে ডাক শুনে চিত্রার চোখে জল আসবে। সে ডাক শুনে চিত্রার ভেতরটা মোমের মতো গলে যাবে।

‘চিত্রা, আজকে বিকেলে নিউমার্কেটে যাই চলো। বাসার ভিতরে তো গরমে আর টেকা যাচ্ছেনা।’ হাতপাখা বাতাস করতে করতে ফিরোজ হঠাত কথা বলে ওঠে।
চিত্রার চমক ভাঙে। কি সব ছেলেমানুষী চিন্তা হচ্ছে।

‘হ্যাঁ, চলো যাই।’ প্লেটে পানি ঢেলে চিত্রা উঠে পড়ে।
‘তুমি তো দেখি কিছুই খাওনি। কি সর্বনাশ। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’ ফিরোজ হাঁ হাঁ করে ওঠে।

চিত্রা ফিরোজের অস্থির হওয়া দেখে হেসে ফেলে। ‘আমার শরীর ঠিকই আছে। আর একবেলা কম খেলে আমার কিচ্ছু হবেনা। রাতের বেলা বেশী করে খেয়ে পুযিয়ে দেব। তুমি আমার সব ব্যাপারে একটু বেশী অস্থির হয়ে যাও।’

ফিরোজ চিত্রার দিকে এগিয়ে আসে। চিত্রার গালে আলতো করে হাত রাখে। ‘তোমার ব্যাপারে অস্থির হবো না কি মুকুন্দ চৌধুরীর জন্য অস্থির হবো?। তুমি ছাড়া আর আমার কে আছে বলো?’
চিত্রা ফিরোজের দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা বড় ভাল, মানুষটার মনে অনেক ভালবাসা, অনেক মায়া। সব সময় পরিস্কার করে বলেনা হয়তো, কিন্তু চিত্রা ঠিকই টের পায়।

অবশ্য মুখে এসবের কিছুই বলে না চিত্রা। শুধু জিজ্ঞেস করে,‘মুকুন্দ চৌধুরী লোকটা আবার কে? তোমার কোন বন্ধু?’

বিয়ের পর ঢাকাতে চলে আসবার কারণে পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়না আর। বাবা মায়ের সাথেও দেখা হয় শুধু ঈদের সময় বাড়ি গেলে। এরই মধ্যে একদিন দেখা করতে এলো রুনা, তখন চিত্রা রান্নাঘরে। প্রথমে কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পায়নি সে। পরে দরজা খুলে রুনাকে দেখে তো সে অবাক।
‘আরে রুনা তুই!’ হলুদ-মরিচ-মশলা মাখা হাতেই রুনাকে জড়িয়ে ধরে চিত্রা।
‘আয় আয় ভিতরে আয়। কেমন আছিস তুই? কতদিন দেখিনা তোকে! আমার বাসার ঠিকানা পেলি কিভাবে তুই?’ চিত্রা কথা বলেই চলে।

রুনাকে বসার ঘরে নিয়ে ফ্যান চালিয়ে দেয় ফুলস্পীডে। যা গরম। উলটোদিকের চেয়ারে বসে চিত্রা খেয়াল করলো যে রুনার মুখটা কেমন শুকনো লাগছে। রুনা ছিল তাদের ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, তার পিছনে ছেলেরা সর্বক্ষণ লেগেই থাকতো। রুনা অবশ্য প্রথমে কাউকেই তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। পরে সে তাদের চেয়ে দুবছরের সিনিয়র সোহেল ভাইয়ের প্রেমে পড়ে। সোহেল ভাই ছিল মস্ত ছাত্র রাজনীতিবিদ।

‘তোকে দেখে খুব ভাল লাগছে রে চিত্রা। কতদিন পর দেখলাম তোকে।’
‘তুই ঢাকায় কি মনে করে?’
‘একটা চাকরির ইন্টারভিউ দেবার জন্যে এসেছি। কাল সন্ধ্যেবেলা ফিরে যাবো। আসবার আগে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। খালাম্মার কাছ থেকে তোর ঠিকানা নেবার জন্য।’
‘ওম তাই নাকি? আম্মার সাথে তো কালকেই কথা হোল ফোনে। আম্মাতো কিছু বলেনি আমাকে। যাকগে-তোর কথা বল। সোহেল ভাইয়ের কি খবর? উনি কি এখনো রাজনীতি করে যাচ্ছেন?’
সোহেলের নামোল্লেখে রুনার মুখ আঁধার হয়ে আসে। ‘ওর কথা বলিস না তো।’
‘ওমা-কেন? তোদের মধ্যে কি ঝগড়া-ঝাঁটি হয়েছে নাকি? বিয়ের আগে সব ঝগড়াগুলো শেষ করে ফ্যাল। তাহলে বিয়ের পর শুধুই প্রেম আর ভালোবাসা থাকবে।’
‘ওকে আমি বিয়ে করছি না চিত্রা। ও এখন অনেক বদলে গেছে। ও এখন শুধু টাকা চেনে। টাকার জন্যে ও এখন যা খুশী তাইই করবে। এখন বুঝি রাজনীতিও সে করেছে পয়সার জন্য। আদর্শের জন্যে না।’
‘কি বলছিস তুই?’
‘একদম সত্যি কথা বলছি। সে এক লোককে নিয়ে একদিন এসেছিল আমার কাছে সিনেমার নায়িকা হবার প্রস্তাব নিয়ে। বদলে আমাকে ওই লোকটিকে একটু খুশী রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে পারিস তুই? এই লোককে বিয়ে করা যায়? এই লোককে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়?’

চিত্রা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। সোহেল ভাই ছিল তাদের রোল মডেল। অনেক মেয়েই এই কারণে রুনাকে রীতিমত ঈর্ষা করতো। এখন রুনার দিকে তাকিয়ে চিত্রার কান্না পেলো। স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কি বিশাল পার্থক্য!

বিকেল বেলা আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমতে শুরু করলো। চিত্রা বারান্দার গ্রীল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার মন ভাল নেই। ফিরোজ ক’দিনের জন্য অফিসের কাজে বাইরে গেছে। আজ নীলুও বাসায় ফিরবেনা। তার নাকি কালকে খুব বড় একটা পরীক্ষা আছে, আর তার জন্য তারা কয় বন্ধুরা একসাথে বসে পড়াশুনা করবে।

সাধারণতঃ এই সময় ফিরোজ অফিস থেকে ফিরে আসে। তারপর তারা দুজনে মিলে বারান্দায় বসে চা খেতে গল্প করে। নীলু থাকলে সেও যোগ দেয়। কিন্তু আজ এক একা তার নিজের চা বানাতেও ইচ্ছে করছেনা।

সেদিন রুনা চলে যাওয়ার পর চিত্রা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে স্বপ্ন থাকে। কিন্তু কতজন মানুষের জীবনে স্বপ্ন আর বাস্তবের মিল হয়?

ফিরোজ একজন অ্যাভারেজ মানুষ। মাপা সুখ দুঃখ। চিত্রা জানে আজ এই মেঘলা আকাশ দেখলেই ফিরোজ বলতো,’চিত্রা, খিচুড়ী খেতে ইচ্ছে করছে।’ এই রকম মেঘলা আকাশ যদি পর পর দশদিন থাকে, সে হয়তো দশ দিনই এই একই কথা বলবে। কোনও দিন সে বলবে না,‘চিত্রা, চলো আজকে দুজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজি। তোমার মুখটিতে বৃষ্টির ফোঁটা জমলে কেমন দেখায় সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।’

চিত্রা কি এমনি একজন মানুষের স্বপ্ন দেখেছিল? চিত্রার কল্পনাতে যে মানুষটি ছিল কেমন ছিল সেই মানুষটা? চিত্রা জানে না। চিত্রা শুধু জানে মানুষটার হাত দুটো খুব সুন্দর। ফর্সা, লম্বা, একটু মেয়েলী ধাঁচের হাত দুটো। বাঁ হাতের অনামিকায় একটি ছোট লাল পাথরের আংটি।

চিত্রা চোখ বন্ধ করে সেই হাতের স্পর্শটি মনে করবার চেষ্টা করে। হাতদুটো কি নরম ছিল? নাকি বলিষ্ঠতায় কঠিন ছিল? চিত্রার কল্পনায় মানুষটির গলার স্বর ছিল গাঢ় অথচ কোমল, এবং দয়ালু। মানুষটিও কি তার গলার অওয়াজের মতোন?

কে সেই মানুষ? তাকে কি চিত্রা চেনে? কোনদিন কি তার সাথে চিত্রার দেখা হবে?

সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হোল। আকাশে মেঘ আর বিদ্যুতের যুগলবন্দী শুরু হয়েছে। আজা সারা রাত ঝড়বৃষ্টি হবে নিশ্চয়ই। চিত্রা সব দরজা জানালা ভাল করে বন্ধ করে শোবার ঘরে গেল। আজ তার খেতেও ইচ্ছে করছেনা। ঘরের বাতি নিভিয়ে সে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। আজ আমার মন খারাপ করার দিন, ভাবলো সে।

চিত্রার যখন ঘুম ভাংলো, তখন সে ঠিক ঠাহর করতে পারলোনা যে ক’টা বাজে। চোখ খোলার আগেই তার নাকে এলো একটি চমতকার সুগন্ধ। অনেকটা চাঁপা ফুলের মতো গন্ধ, কিন্তু চাঁপা ফুল নয়।
ঘুম ভাঙ্গার পরই অভ্যেসমত সে বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখা অ্যালার্ম ঘড়িটার দিকে তাকায় সময় দেখবার জন্য। কিন্তু ঘড়িটি সেখানে নেই। চিত্রা বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকায়। নিশ্চয়ই এটা নীলুর কাজ, তাকে না বলে ঘড়িটি নিয়ে গেছে।

চিত্রা চিত হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে সময় ঠাহর করার চেষ্টা করে। তখনই সে ব্যাপারটা খেয়াল করলো।

তাদের শোবার ঘরটি জুড়ে এক অদ্ভুত আলোর বন্যা। এই আলো প্রখর অথবা চাপা নয়। আলোটিকে দেখলে মনে হয় যেন কোন মায়াবতীর হাতের প্রদীপশিখা। এই আলোতে দৃশ্যমান সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে যায়, আর অদৃশ্যমান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাতে শোবার আগে চিত্রা সব জানালা দরজা ভালো করে বন্ধ করে শুয়েছিল। তাহলে কোথা থেকে আসছে এই আলো?

চিত্রা এদিক-ওদিক তাকায়। দেখতে চেষ্টা করে আলোটির উৎসমুখকে। কিন্তু অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়না। চিত্রার অবাক লাগে। এই আলোটি তবে কিসের? সেকি তাহলে স্বপ্ন দেখছে?
হঠাত বিদ্যুত চমকের মতো সে গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারে।

আলোটি জ্যোতস্নার আলো। এই সেই জ্যোতস্না যে নীলুর কথামত রাত্রির তৃতীয় প্রহরে তস্করের মতো সিঁদ কেটে ঘরে ঢোকে। চিত্রা বুঝতে পারে যে নীলু তাহলে ঠিকই বলেছিল। এমন জ্যোতস্না পুর্ণিমা রাতেও দেখা যায় না। এই আলোতে কি তাহলে আমার স্বপ্নটিকে দেখা যাবে? দেখা যাবে স্বপ্নের মানুষটিকে?

মৃদু একটি শব্দে চিত্রার চমক ভাঙ্গে। সে পাশ ফিরে তাকায়।

অলৌকিক আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চিত্রার বিছানাটি। তার মধ্যে চিত্রা দেখতে পায় তাকে। চিত্রার পাশেই শুয়ে থাকা মানুষটিকে।

হাল্কা নীল শোবার জামা-পাজামা পরে কাত হয়ে শুয়ে আছে মানুষটি। চিত্রার দিকে পিছন ফিরে। নিজের শরীরের উপর রাখা আছে তার হাতটি। ফর্সা লম্বা এবং একটু মেয়েলী ধাঁচের আঙ্গুলগুলো ঈষত ভাঁজ হয়ে আছে। অনামিকাতে একটি ছোট পাথরের আংটি। জ্যোতস্নার মৃদু আলোয় পাথরটির রং ভাল করে বোঝা যায়না। কিন্তু চিত্রা জানে যে পাথরটির রং লাল।

প্রবল আবেগে চিত্রার বুকের ভিতর উথাল-পাথাল করে। স্বপ্নের কাছাকাছি এলে মানুষেরা কি করে? চিত্রা অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকায়।

মানুষটি এবার একটু যেন নড়ে ওঠে। চিত্রা চমকে ওঠে। সে বুঝতে পারে মানুষটি এবার পাশ ফিরবে। সে বুঝতে পারে এবার মানুষটি গাঢ় স্বরে তাকে ডাকবে,‘চিত্রলেখা, তুমি কি জেগে আছো?’

চিত্রা ভূতগ্রস্থের মতো দ্রুত বিছানা থেকে নেমে যায়। দৌড়ে চলে যায় জানালার কাছে। একটানে খুলে দেয় সে জানালাটি।

মুহুর্তের মধ্যে ভোজবাজির মতো উধাও হয় তস্কর জ্যোতস্না। মিলিয়ে যায় স্বপ্নের জগত। হারিয়ে যায় বিছানার উপরের মানুষটি। ঘরের মধ্যে এখন শুধু অন্ধকার, নিকষ কালো অন্ধকার। বাস্তবের কাছে স্বপ্নেরা চিরটা কালই হেরে যায়।

জানালার শিক ধরে চিত্রা বাইরে তাকায়। রাতের আকাশে তখন ঝড়ের প্রবল তান্ডব। সামনের রাস্তার ওপাশের বড় গাছটি ভয়ংকর ভাবে দুলছে। যে কোন সময় সেটা ভেঙ্গে পড়তে পারে। আকাশের বুক ফালা ফালা করে দেয় বিদ্যুতের আলোময় জিভ। প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো কোথাও। কানে তালা লাগে সে আওয়াজে।

ধারালো বল্লমের মতো বৃষ্টির ফোঁটা বিদ্ধ করে চিত্রার মুখটিকে। পানির ধারায় ধুয়ে যায় তার চোখের জল।

চিত্রা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। সে চিতকার করে বলে, ‘আমার নাম চিত্রলেখা না। আমি কখনোই কারো চিত্রলেখা ছিলাম না, আমি কখনো কারো চিত্রলেখা হ’তে চাইনি। আমার নাম চিত্রা, শুধুই চিত্রা।’

বহু হাজার বছর ধরে কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হতে পৃথিবীর মানুষেরা স্বপ্নের মুখোমুখি হওয়াটা সেই কবেই ভুলে গেছে।

তা না হলে কেউ কখনো এমন কাজ করে?

(এই লেখাটি গত বছর উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত "পড়শী" পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।)


মন্তব্য

সচল জাহিদ এর ছবি

জাহিদ আপনার দু'টি লেখাই পরলাম প্রথম অংশ ও শেষ অংশ। অনেকটা স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। লেখাটি বেশ ভাল লাগলো। ইচ্ছে করছে আপনার কল্পনার জগতের জোৎস্না দেখতে ।
____________________
জাহিদুল ইসলাম
এডমনটন, আলবার্টা, কানাডা


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি নিজেও দেখতে চাই সে জ্যোৎস্না। কত রাত সে চেষ্টায় কেটেছে নির্ঘুম।

[=red]_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

-

বাস্তবের কাছে স্বপ্নেরা চিরটা কালই হেরে যায়।
দারুণ বলেছেন জাহিদ ভাই।
পুরো গল্পটাই দারুণ লেগেছে। চলুক
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

জাহিদ হোসেন এর ছবি

"বাস্তবের কাছে স্বপ্নেরা চিরটা কালই হেরে যায়" এই লাইনটি লিখতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। সত্যিকথা সব সময়ে ভাল লাগেনা।
আপনাকে ধন্যবাদ লেখাটি পড়বার জন্যে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

প্রথম পর্বের ভালোলাগাটুকু শেষ পর্যন্ত থাকলো।
আমার একটা প্রশ্ন ছিলো, 'এটা কি কোনো উপন্যাসের প্লট ছিলো?'
কিছু কিছু জায়গায় অমন মনে হলো। স্রেফ আগ্রহ অন্য কিছু না।
ধন্যবাদ।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার কাছে ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগলো।
এইটুকু প্লটে উপন্যাস? আমিতো প্রথমে ভেবেছিলাম অণুগল্প জাতীয় কিছু একটা লেখার। কিভাবে যেন বড় হয়ে গেল।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

কাল রাতেই দুই পর্ব একসাথে পড়েছিলাম। খুব ভালো লাগছে। স্বপ্নমাখা একটা গল্প। কিন্তু এত কম লিখলে চলবে না।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

কম লিখতে পারলেও তো হোত। এখন কিছুই লেখা হচ্ছে না। চারিদিকে সবাই কেমন যেন ভয়েভয়ে আছি। কি হবে, কি হবে? দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে লেখা বের করা বড়ই দুঃসাধ্য।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

তানবীরা এর ছবি

ভালো লেগেছে, খুব ভালো।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।