ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি...০০৪

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: রবি, ০৯/১২/২০১২ - ৬:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাতাসে শীতের গন্ধ । প্রকৃতিতে রংয়ের উৎসব শেষ করে পাতাদের ঝরে পড়াও শেষ । বাদামী রংয়ের শুকনো পাতা মাড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোথা থেকে ভেসে এল অনেক দিন আগের এই রকম শীতের কোন ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতার গন্ধ...নজরুলের সমাধির পাশে লাইব্রেরীর গেইটে লাল রঙ্গা বাস থেকে নেমে কলা ভবন পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতাম ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতা । একটু ছিড়লেই সেই পাতা থেকে বের হ’ত অদ্ভুত এক সৌরভ...কোথা হতে ভেসে এলো ফেলে আসা দিনের গায়ে লেগে থাকা সেই সৌরভ...আর তার হাত ধরে চলে এল বন্ধুর মত বন্ধুদের স্মৃতিরা...

...

ইচ্ছে ছিল কিছু জনগুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে গুরু গম্ভীর আলোচনা করব । যেমন, আসন্ন “ফিসকাল ক্লিফ” এর সংকট কাটাতে ওবামা এডমিনিস্ট্রেশনের কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত । তাছাড়া, রাজবধু ক্যাথেরিনের “মর্নিং সিকনেস” উপশমেরও কিছু উপায় বাতলে দিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু কিসের কি ? সচলায়তনের “অর্বাচীন” পাঠকরা এখনো সেই পরিমান “পরিনত” হয়ে উঠেনি । তাই এই সব “এডাল্ট” বিষয় এবারেও দেয়া গেল না । ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা থাকল...

এই সব অদরকারী স্মৃতির কোন পরম্পরা নেই । তবু যদি নষ্ট করার সময় থাকে, তাহলে প্রথম, দ্বিতীয়তৃতীয় পর্ব এখানে ।

১১.

গত পর্বে আমার সেজ ভাইয়ের শিক্ষানীতি সম্পর্কে কিছু আভাষ দিয়েছিলাম । এই পর্বে একটু বিশদে বলি । আমার সেজ ভাইয়ের শিক্ষানীতি আপাত দৃষ্টিতে খুবই সহজ ও সংক্ষিপ্ত । দুটি মাত্র পয়েন্ট । এক. মুখস্থ করা যাবে না । যা কিছু “বলা কওয়া” (মুখে ও খাতায়) করব, তা আমার নিজের ভাষায় তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে । অন্যের ভাষায় গরগর করে উদ্গার করা যাবে না । দুই. তৈরী থাকুন, এটি বেশ দুর্বোধ্য (ক্রমশঃ ধুঁয়াশা কেটে যাবে) । যে কোন পরিস্থিতিতে সত্যাচারন করার সাহস অর্জনের অনুশীলন জারী রাখতে হবে । এক কথায়, “ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ” বলতে হবে । জানি না, আম্রিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট এল গোরের সঙ্গে সেজ ভাইয়ের কি খাতির ছিল !

আসুন এবারে তার শিক্ষানীতির ব্যবচ্ছেদ করি । এর সঙ্গে শার্লক হোমসের ইনডেক্স পদ্ধতির কিছু প্রয়োগ দেখতে পাবেন । একবার ওয়াটসন হোমসকে তামাম জনতা জানে এমন এক প্রশ্ন করে বেমক্কা “জানি না” জবাব পেয়েছিল । হোমস ব্যাখ্যা করেছিল, “আমার মস্তিষ্ক অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ জায়গা । আমি অদরকারী জিনিষ অগোছালো রেখে হাতড়ে মরি না । দরকারী জিনিষ ইন্ডেক্স করে গুছিয়ে রাখি, যাতে সময়মত স্বল্প আয়াসে খুঁজে পাই ।” ভুমিকা শেষ, নাউ লেটস ফেস ইট ।

নয় ভাইবোনের মধ্যে আমি হচ্ছি সর্বকনিষ্ট । আমি আক্ষরিক অর্থেই বড় হয়েছি, “মাথায় রাখি না উঁকুনের ভয়ে / মাটিতে রাখি না পিঁপড়ার ভয়ে” । সেই আমাকে সেজভাই কেন প্রথম চড় দিয়েছিল বলে মনে হয় ? আমি তখন ছয় । সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াই রিনা, খোদেজা, সালমা, খোকনদের সাথে । গ্রামের ধারের নদীর পার থেকে শামুক কুড়িয়ে এনে পাথরে ঘষে ঘষে স্বনির্মানিত “পিলার” (প্রাকৃতিক খোসা ছিলানি) বানাই । গাছ থেকে সদ্য পাড়া আমের কস মুছে সেই পিলার দিয়ে আমের খোসা ছিলি । অতঃপর বাড়ি থেকে “চুরি” করে আনা লবন, সরিষার তেল ও আম (কচু পাতায়) মেখে খাই । দিনের শেষে ঘুমাতে গেলেই শুধু একটা সমস্যা দেখা দিত । সারাদিনের খড়ের গাঁদায় লুটোপুটিটা তখন মাথা চাড়া দিত, আমার পিঠ চুলকাত । তখন কাউকে না কাউকে আমার পিঠ চুলকাতে হ’ত ।

সেই রকম এক দিনে আমার এগার/বার বছরের বড় বোন (আমার দ্বিতীয় বোন, যাকে ছোট’পা ডাকি) আমাকে অত্যন্ত তমিজের সাথে পুকুর পাড়ের চাড়া খেলার (অনেকটা বোলিং / জ্যাঙ্গার মত । চাড়ার ওপর চাড়া রেখে অন্য চাড়া দিয়ে দান দান তিন দানের মধ্যে সেই চাড়ার “পিরামিড” ভাঙ্গা) আসর থেকে নিয়ে আসছিল (গাও গোসল করে খাওয়ার বেলা প্রায় অতিক্রান্ত তখন) । আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম তার “আস্পর্ধা” দেখে । আমাকে ছাড়া যে চাড়া খেলার আশু উন্নয়ন ব্যহত হবে তা কি সে জানে না ? তো বিরক্তির এক পর্যায়ে আমি তাকে আমার ঝুলি থেকে সবচেয়ে “নিরীহ” গালিটি উচ্চারন করেছিলাম, “...র বাচ্চা” । পর মুহুর্তে আমার বাম গালে সজোরে চপেটাঘাত !

বিস্মিত আমি তাকিয়ে দেখি সেজ ভাই কোথা হইতে আবির্ভুত ! আমার মা ততক্ষণে রান্না ফেলে রসুই ঘর থেকে ত্রস্ত্য চলে এসেছেন । ছোট’পা ততক্ষণে আমাকে কোলে নিয়ে নিয়েছে । আমি বিস্মিত হয়ে কাঁদতে ভুলে গিয়েছি । সেজ ভাই অক্ষম রাগান্বিত ও বিস্মিত কন্ঠে বলেই চলেছে, “আম্মা, ও গালি দিয়েছে । আম্মা, ও গালি দিয়েছে । আম্মা, ও গালি দিয়েছে । আম্মা, ও গালি কোথায় শিখল ?” ও এই কথা ? তো আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হ’ত, আমি সবিস্তারে আমার ঝুলির অন্য গালিগুলিও শানে নুজুলসহ বলে দিতাম । তা না করে মারার কি দরকার ছিল ?

এবারে আসুন তিয়াত্তর নম্বর চড়ের ঘটনায় । তখন আমি সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী । এলজেব্রার হাতে খড়ি । একদিন স্কুল ফেরত সেজ ভাইয়ের সঙ্গে প্রাত্যহিক হোমওয়ার্ক করতে বসছি । সামনের জানালায় “হাতি মার্কা” মেঘটা বুঝি চলেই গেল আমার আকাশ থেকে । সে তো আর জানে না ঘরের ভেতরে আমি জ্বলছি হোমওয়ার্কের “হোমানলে” ! সেজভাইয়ের কি কথায় ফিরে আসি এই মর্ত্যলোকে ... উগরে দেই সদ্য শেখা “এ প্লাস বি হোল স্কয়ার” ফর্মুলা । সেজভাই জিজ্ঞেস করে, “এর মানে কি ?” । এ আবার কী প্রশ্ন ! সবাই জানে, এটি এলজেব্রার প্রথম সুত্র । সেজভাইয়ের ফলো আপ প্রশ্ন, “সুত্র মানে কি ?” এবারে আমি আমি নিশ্চুপ আর সেজ ভাইয়ের হুংকার ও চপেটাঘাত, “কতবার বলেছি না বুঝে কিছু মুখস্থ করবে না ? পরীক্ষার খাতায় নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ বিদ্যা উগরে দেয়ার নাম জ্ঞানার্জন না ।” (আমি কি একবারও বলেছিলাম, আমি জ্ঞান অর্জন করতে চাই ? আমি শুধু একটু ভদ্রস্থ কিছু নম্বরযুক্ত খাতা বাড়ি আনতে চেয়েছিলাম !) । তারপর শুরু হ’ল এলজেব্রার ইতিহাস, কিভাবে এই জিনিষ ধরাধামে আবির্ভুত হইল ও কি কি তার প্রয়োগ । আমার “হাতি মার্কা” বিকেলের পুরোটা নিয়ে নিল শুকনো এলজেব্রা । কিন্তু মাথার মধ্যে খোদাই করা হয়ে গেল কিভাবে সুত্র মুখস্থ না করেও সকল সুত্রের সমাধান করা যায় (পাওয়ার, কো-এফিশিয়েন্ট, প্লাস-মাইনাস ইত্যাদির সকল শুলুক সন্ধান সহকারে, মায় করোলারিগুলো শুদ্ধ) ।

এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন হোমসের ইন্ডেক্স পদ্ধতির প্রয়োগ ? আমার মস্তিষ্কের খোপে খোপে সকল জ্ঞান (!?!?!?) আছে । শুধু ঠিক ইন্ডেক্স নম্বরটি জানতে হবে । সেটা হ’ল সেজ ভাইয়ের চড়ের নম্বর । আর্কিমিডিসের “ইউরেকা” প্লবতা আছে একশ একান্নতে, নিউটনের থার্ড ল আছে দুইশ চৌষট্টি নম্বরে । এই সেদিন আমার “মীরজাফর” ভাই (যে আমার সিক্রেট ডায়রী “পাবলিক” করে দিয়েছিল । তাকে কোন এক সুশীল শৈশবে ডাকতাম “দাদামনি” । সে সব পাঠ চুকে গিয়েছে । এখন তাকে বড়রা আদর করে যে নামে ডাকে, সেই নামে ডাকি “তোতেল” । ধরতে পেরেছেন ? তার নাম আসলে “সোহেল” ) কাজ ফেরত অসময়ে ফোন করে চমকে দিল । ঘটনা কী ? তার হাইস্কুলগামী কন্যার হোমওয়ার্কে “ফরেন এইড” লাগবে (সে নিজে তখন “সুপার বল” দেখবে, কাজেই আমাকে ধরিয়ে দিল ফোনে) । ভ্রাতৃকন্যা বলতে শুরু করল, “Tom is travelling from New York to Los Angeles. It is about 4400 KM. How far is LA from NY in meter?” আমার মাথায় বাতি জ্বলে উঠল - আ হা ! বাদল বরিষন সেই দিনের একশ এগার নম্বর চড় ! পরিষ্কার দেখতে পেলাম মিলি-সেন্টি-ডেসি-মিটার/লিটার/গ্রাম-ডেকা-হেক্টা-কিলো । বুঝেছেন তো রবীন্দ্রনাথ কেন “আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে...” লিখেছিলেন ? আমার মত নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের সাহস যোগানোর জন্য । স্বদেশী আন্দোলন ফান্দোলন সব “ঝুট” থিওরী ।

১২.

এবারে আসুন একটি “জীবনমুখী” ট্রান্সলেশনের ঘটনায় । আমি নির্ঘাত জানি এর কবলে পড়েন নি এমন কেউ নেই । এটি পি এইচ ডি ডিগ্রির কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষার মত । এই বাক্যটি শুদ্ধুভাবে ইংরেজী করতে পারলে আপনি মাধ্যমিকে পাশ করেছেন, নইলে নয় । মনে পড়েছে ? সেই অমোঘ ট্রান্সলেশন – “ডাক্তার আসিবার পুর্বে রোগি মারা গেল” । আমার জন্য এই বাক্যটি ছিল ভয়াবহ এক দূঃস্বপ্ন ! ঘুমের মধ্যেও আমি শিউরে উঠতাম এই বাক্যের তাড়নায় । এডাল্টহুডে ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে শুধু এর কাছাকাছি দূঃস্বপ্নের দেখা পেয়েছিলাম ( ফ্রন্ট মিরর, রিয়ার ভিউ মিরর, ব্লাইন্ড স্পট, হুইল, ব্রেক, এক্সেলারেটর, ট্রাফিক লাইট, গতিবেগ, পথচারী, অন্য গাড়ি, পেছন থেকে ছেলের জিজ্ঞাসা “মা, আমি কি আজকে wiiতে খেলতে পারি ?”... ভীষন গোলক ধাঁধা । কার পরে যে কার “রাইট অফ ওয়ে” ?!?!?!) ।

যাই হোক, ট্রান্সলেশনের রাইট অফ ওয়ের কথাটা শেষ করি । সেজ ভাইয়ের উপদেশ মত “বড় সমস্যাটি”কে ছোট ছোট দু’টি বাক্যে ভাঙ্গা গেল, “The patient died.” ও “The doctor arrived.” তারপর দেখতে হবে কোনটি আগে, কোনটি পরে । যেটি আগে সেটি পাস্ট পারফেক্ট (কোন গুনে সে “পারফেক্ট” ?) ও যেটি পরে সেটি সিম্পল পাস্ট টেন্স (বিশ্বাস করুন, মোটেও সে “সিম্পল” নয়) । যেহেতু রোগি ষড়যন্ত্র মুলকভাবে আগে কর্ম সম্পাদন করেছে, তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পাস্ট পারফেক্ট করে দিতে হবে, “The patiend had died.” এই বারে আসুন “before” ও “after” এর গ্যাঁড়াকলে । যে ঘটনাটি আগে ঘটেছে তাকে বাক্যের আগে দিলে তারপরে before দিয়ে পরের বাক্যাংশ জুড়ে দিতে হবে...সেজভাই আরো কি কি ভাবে এই ট্রান্সলেশন শিখিয়েছিল ইন্ডাংশন পদ্ধতিতে, আমার কিচ্ছু মনে নেই । তবে এটা জানি এর চেয়ে ঢের ভাল হ’ত যদি আমাকে এই অমোঘ ইংরেজী বাক্যবন্ধটি মুখস্থ করতে দিত । আমি অনায়াসে সেটি খাতায় উগরে দিতে পারতাম (এবং পুর্ণ নম্বর পেতাম) । কিন্তু সেই স্বাধীনতা আমার ছিল না । আমি ডাক্তার এবং রোগি দু’জনের এই রাইট অফ ওয়ের ধারাবাহিকতার গোপন রহস্য কখনোই ভেদ করতে পারতাম না (এখনো পারি না)। ফলে অনেক নিদ্রাহীন রাত্রি যাপনের পরেও পরীক্ষার খাতায় আঁকিবুকি এঁকে লিখতাম “The doctor arrived before the patient had died.” “The patient had come before the doctor died.” “The doctor had died after the patient arrived.” “The patient had arrived after the doctor died.”...এভাবে ডাক্তার ও রোগিকে নিয়ে অনেক পারমুটেশন-কম্বিনেশন করার পরেও কোন সুরাহা করতে পারতাম না । অনেক কাঁটাছেড়ার পরে শেষ পর্যন্ত্য ধুচ্ছাই রোগি ও ডাক্তারের জন্য এক “ব্যবস্থাপত্র” লিখে দিতাম (এক যাত্রায় দুই ফল ভাল না এই বিবেচনাবোধ আমার ছিল), “The patient and the doctor came and died together.” (এই রে ! “টুগেদার” বানান ঠিক আছে তো ? ছেলে এই সেদিনই আরেকবার ভুল ধরিয়েছিল । নির্ঝর...কোথায় যে থাকে ছেলেটা ? মায়ের বানানগুলো একটু দেখে দিবে না ? আমাদের সময়ে আমরা কত বাধ্য, অনুগত ছিলাম ! ) ।

১৩.

এবারে আসুন সেজভাইয়ের শিক্ষানীতির দ্বিতীয় পয়েন্টে । এর খেসারত জীবনভর দিয়ে যাচ্ছি । কয়েকটি ঘটনার কথা বলি, তাহলেই দেখবেন এই ধরনের ভাই থাকার কি বিপত্তি ।

ঘটনা একঃ টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হয়ে গিয়েছে । আমি অপ্রত্যাশিতভাবে উত্তীর্ন হয়েছি । এক শুভ দিনে ক্লাসে এসে হানিফ স্যার ঘোষনা করলেন, “কাল তোমাদের ফর্ম “ফিল-আপ” করা হবে । বাসায় জিজ্ঞেস করে জেনে এসো তোমাদের জন্ম তারিখ । সন, মাস ও তারিখসহ ।” স্যার বেশ জোর দিলেন সন, মাস ও তারিখের ব্যাপারে । আমি তো তাজ্জব । ক্লাস টেনে পড়া “আলোকপ্রাপ্ত” মেয়ে আমরা, নিজেদের জন্ম তারিখ জানি না ?!?! বাসায় কেন জিজ্ঞেস করতে হবে ? শিবানী আমাকে এই রহস্যের সমাধান দিল । ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফর্মে কেউ আসল জন্ম তারিখ দেয় না । এই “জন্ম তারিখ”টি যেহেতু সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, কাজেই সবাই সেখানে বয়স কমায় (চির নবীন থাকার একটি ব্যর্থ প্রয়াস আর কি ! তাছাড়া, সরকারী চাকরীর কি যেন একটি বয়সের ফাঁদ এর সঙ্গে জড়িত ছিল ) । আমি বাড়ি এসে সেজভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার জন্ম তারিখ কি হবে ফর্মে ?”

আমার যুধিষ্ঠির ভাইয়ের জবাব, “এই প্রশ্ন কেন ? তুমি তো জান সেটা ।”

আমি শিবানীর কাছে পাওয়া গোপন জ্ঞান খুলে বলতেই, তার জবাব, “জীবনের প্রথম এমন একটি গুরুত্বপুর্ণ কাগজে তুমি মিথ্যা কথা লিখবা ? ভেবে দেখ, তোমার জন্মলগ্নটির মত একটি দিনকে তুমি মিথ্যা দিয়া ঢেকে দিবা ? না, তুমি সঠিক জন্ম তারিখ দিয়েই জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা দিবা ।” রায় ঘোষনা হয়ে গেল । ফলাফল ? আমার ক্লাসের সবার চেয়ে কাগজে কলমে আমি ঠিক দু’বছরের বড় (কি অদ্ভুত, ক্লাসের সিংহ ভাগের জন্ম তারিখ জানুয়ারীর এক তারিখ !) ।

ঘটনা দুইঃ বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল খাতা জমা দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে । আমি কিছুতেই ব্যাং আঁকতে পারছি না (আপনারা তো জানেনই আমার অংকন পারদর্শীতার কথা) । না, পারছি না বললে ভুল হবে । আঁকছি, কিন্তু সেটাকে দেখে কেউ ব্যাং বলে চিনতে পারছে না । আমার কি দোষ বলুনতো ? এই পর্যায়ে তোতেল আমাকে বুদ্ধি দিল ট্রেসিং পেপার দিয়ে ব্যাং আঁকতে । কিন্তু আমার সেজ ভাই সে প্রস্তাব নাকচ করে দিল । আমাকে স্বহস্তে ব্যাং এঁকে, তা পরিবেশন করতে হবে । আমার ব্যাং,আমার ব্যাংই হতে হবে । অন্য কারুর ব্যাংকে আমি “নিজের” বলে দাবী করতে পারব না । তো কি আর করা, আমি আঁকলাম ব্যাং । প্র্যাক্টিক্যাল খাতার প্রচ্ছদ উল্টালেই প্রথম পাতায় সেই ব্যাং । টিচার প্রচ্ছদের ভারী পাতা উল্টালেন, এক ঝলক দেখেই তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলেন, “তোমার ব্যাংতো ভারী সুন্দর ! সুঁচালো মুখ আর ডানা দেখে আমিতো ভয় পাচ্ছি যদি উড়োজাহাজের মত উড়ে যায় ? এই খাতা খুব সাবধানে ভারী ইটের নিচে রেখে দিও । নইলে উড়ে যেতে পারে কিন্তু ! ”

এবারে আসুন সাম্প্রতিক ঘটনায় । সচরাচর আমি কাজে যেতে গণ যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি । কদাচিৎ স্বহস্তে চালিত মোটরগাড়ি যোগে কাজে যাই (যেমন ধরুন, বদ্যি বাড়িতে যাওয়ার শমনে সাড়া দিতে হয় যেদিন) । এই পোড়ার দেশে যেখানে সেখানে আপনার মোটর পার্কিং করবেন, সেই স্বাধীনতা নেই । অফিসের সামনে একবেলার জন্য গাড়ি ভিড়িয়ে রাখতে হলে আপনাকে আট ডলার গুনতে হবে । আমি হয়তো “ফিসকাল ক্লিফে”র এই আকালের দিনে ল’ব্লজের পার্কিংলটে গাড়ি রেখে অফিস অভিমুখে রওনা দিলাম, পেছন থেকে সেজভাইয়ের ভার্চুয়াল কন্ঠ বলতে শুরু করেছে, “এটা কি হ’ল ? তুমি তো ল’ব্লজে আসো নি, এখানে কেন পার্ক করলে ?” আমি নির্বিকার হেঁটে যাই রাস্তা পেরিয়ে...প্রবেশ পথ, লবি ছাড়িয়ে চার তলার কিউবিকলে চলে যাই...গণকযন্ত্রও খুলে বসি...এক ঘন্টা যায়, দু’ঘন্টা যায়...আমার সামনের গণক যন্ত্রের মনিটর ঝাঁপসা...আমি কিচ্ছু দেখতে পাই না...সেজভাই নাছোড়াবান্দার মত বলেই যাচ্ছে “এটা কি হ’ল ?”...ধুত্তোরী ছাই...আমি ফিরে যাই ল’ব্লজের পার্কিংলটে...গাড়ি এনে পার্ক করি অফিসের পার্কিংলটে...সেজভাইয়ের শিক্ষানীতির গুষ্টি উদ্ধার করে পার্কিং মেশিনে ক্রেডিট কার্ড ঢুকাই...মনে মনে সেজভাইকে একটা কড়া চিঠি লিখি, “ফেরত ডাকে আমার আট ডলার পাঠাও । এই আকালের দিনে আমার আট ডলারে কত কিছু কেনা যায় জানো ? তোমার শিক্ষানীতি দিয়ে কী কেনা যায় ?”...

১৪.

এই উত্তরের দেশে ঝুপ করে ফুরিয়ে যায় শীতের দিনের আলো । কাজ শেষে বাসে উঠে বসি । নাগরিক আলোর ব্যস্ততা পেরিয়ে বাস এগিয়ে চলে...এক সময় সারি সারি বিপনি বিতানের ঝলমলে ক্রিসমাসের আলোকসজ্জা ছাড়িয়ে যায়...অটোয়ার সাবার্বের পথ ধরে বাস...বেশ কিছুটা পথে কোন আলো নেই...দু’ধারে বিস্তীর্ণ মাঠ...শুনশান আঁধার পেরিয়ে এগিয়ে চলি...বিভ্রমে পড়ে যাই...কবেকার কোন এক শীতের রাতে ধান কাটা মাঠে শামিয়ানা টানিয়ে বসেছে গানের আসর...দূরের গাড়ির হেডলাইটকে মনে হয় সেই আসরের হ্যাজাক বাতি...চারিধারে শীতের দিনের পোকারা ঘিরে ধরেছে...

বাসের জানালায় গেরুয়া বসনের এক বোষ্টমী...এলোচুল তার খোলা...এক হাতে দোতারা, আরেক হাতে খঞ্জনী...পান খাওয়া খনখনে গলায় গেয়েই চলেছে সেই বোষ্টমী...“আমি আমারে দিয়া তোমারে / আমি তোমার কে হই গো দয়াল ?”... বোষ্টমীর বন্ধ দু’চোখে জলের ধারা... মার গায়ে লেপ্টে পড়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি আমি... বোষ্টমী, তুই চলে যা...উনত্রিশ বছর বয়সে বড় আপাকে ক্যান্সার এসে হাত ধরে নিয়ে গেল...আব্বা চলে গেল...মাও...একবার শেষ দেখার সময়টুকু দিল না তোর “দয়াল” আমাকে...তোর এই গানের ধাঁধা নিয়ে চলে যা তুই...আমি বেশ ভাল আছি উইন্টার টায়ার, ছেলের স্কুলের সায়েন্স প্রজেক্ট, রাশি রাশি বিলের চিঠি আর বদ্যিবাড়ির শমন নিয়ে...এই সব ভুল ভাল ধাঁধা ভাবার সময় নেই আমার...আমাকে আর জ্বালাস নে তুই...চলে যা বোষ্টমী তুই...চলে যা...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি একজন অমানবিক 'বস' মানুষ। দাঁত বের করে দিয়ে পুরো পোস্ট পড়িয়ে শেষে এসে এভাবে কলজে মোচড় না দিলে চলতো না আপনার?? চরম উদাস ভাইয়ের রোগে মনে হয় আপ্নাকেও পেয়েছে। রেগে টং

এই সিরিজ শেষে এটাকে একটা বই বানিয়ে ছেড়ে দিয়েন।

ফারাসাত

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ ফারাসাত আপনার মন্তব্যের জন্যে । ভাইরে, আমি মোটেই লিখিয়ে নই । নিজের দেখার বাইরে, বুঝার বাইরে কিচ্ছু লিখতে পারি না ।

ব্লগের সবটুকু হাসি যেমন সত্য, কলজে মোচড় দেয়া কষ্টটাও তেমনই সত্য । মাঝে মাঝেই এই বোষ্টমীর পাল্লায় পড়ে যাই তখন এই জীবন নামের "খেলাঘরের খেলা" তুচ্ছ হয়ে যায় ।

বই ? এবারে কিন্তু না হেসে পারছি না । আপনি জানেন আমাদের কালের লেখক ও গায়কদের অবধারিত মিত্যু ছিল যক্ষারোগে ? আমাকেও সেই পথ দেখাচ্ছেন ? আপনি কিন্তু লোক ভাল নয় মন খারাপ

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

“The patient and the doctor came and died together.” - এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান হতেই পারে না। চোখ টিপি

আপনার সেজ ভাইকে ভালো লাগলো। এখনকার অভিজ্ঞতায় দেখি, খাতাভরা নাম্বার বা ভালো গ্রেডিং থাকলেই বেশিরভাগ বাবা-মা খুশি থাকেন। মন খারাপ

“আমি আমারে দিয়া তোমারে / আমি তোমার কে হই গো দয়াল?" - আচ্ছা এক লাইন ঢুকিয়ে দিলেন মাথায়। এই গান শুনিনি আমি। শুনতে খুব বেশিরকম ইচ্ছে করছে...

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

“The patient and the doctor came and died together.” - এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান হতেই পারে না।

কে বলেছে হতে পারেনা?? আমি এর থেকে ভালো সমাধান দিতে পারি। তবে ইংরেজীতে নয়, আরবীতে।
"ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন" দেঁতো হাসি

ফারাসাত

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

শিমুল, ফারাসাত খুব ভাল একটা সমাধান দিয়েছে দেঁতো হাসি

গানের কথা বলছেন ? এই সব গ্রামের বোষ্টমীদের কাজই এই রকম ধাঁধা ঢুকিয়ে দেয়া । একবার এদের পাল্লায় পড়লে সারা জীবন এই রকম ধাঁধার পেছনেই ছুটতে হয় ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

তানিম এহসান এর ছবি

আপনার ভাইয়ের জন্য শ্রদ্ধা।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ । সেজভাইকে পৌঁছে দেব আপনার সহৃদয় মন্তব্য । ভালো থাকুন ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

তিথীডোর এর ছবি

ইয়ে বিদ্যা/ শিক্ষা রিলেটেড তো, বোধহয় সেজন্য একটু কম টেনেছে এই পর্বটা। [মাথা চুলকানোর ইমো]

গানের লিঙ্কটা দেয়া যায়?
জীবন যখন শুকিয়ে আসে ক্রমাগত, আশ্রয় খুঁজি ওখানেই। হাসি
কখনো চন্দ্রবিন্দু, কখনো সঞ্জীব চৌধুরী, কখনো মৌসুমী ভৌমিক আর রাত্রিদিনের রবীন্দ্রনাথ। এই আজীবন সুরের খেয়ায় কান্না মেঘে দিবস যাপন...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

কম টেনেছে

কুচ পরোয়া নেই । পড়েছো যে এতেই আমি খুশী ।

গানের লিঙ্ক খুঁজছো ভইন ? এ গানতো ইউ টিউবের অনেক অনেক আগের জমানার । এ গানের এই দু'টো লাইনই আছে আমার সংগ্রহে । যার কাছে ছিল পুরোটা, তিনি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন এমন এক দেশে যেখানে আমি আর কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারি না ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

কৌস্তুভ এর ছবি

হ, আপনি একটা 'অভিশাপ'!

আর শিক্ষাপদ্ধতির জন্য আপনার সেজভাইকে একটা স্যালুট।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

দাঁড়ান, দাঁড়ান কৌস্তভ । একটু ব্যবচ্ছেদ করি ।

অভিশাপ = অভির সাপ / শাপ ?

আমি তো অভির (a.k.a. ইশতিয়াক রউফ) খালা । সাপ / শাপ তো নয় ...

সেজভাইকে স্যালুট পৌঁছে দেব । অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

তমসা  এর ছবি

তৈলাক্ত বাঁশ আর বান্দর ব্যাটা কত নম্বর ইনডেক্সে ? কিংবা চৌবাচ্চা ?
লেখার জন্য শুধু পাটালিতে হবে না, গুড়ের জালা আনতে হবে।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

এই হল সমস্যা । লোকজন কোন কিচ্ছু ভুলে না ... মন খারাপ

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

babunee এর ছবি

ইস আমার যদি এরাম একটা ভাই থাকত। আফসুস ।
সেজ ভাই কে অনেক পছন্দ হইসে। আর লেখাটা উত্তম জাঝা! লেখা -গুড়- হয়েছে

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

বাবুনি, অনেক অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

কিন্তু সেজভাইকে কি কারনে পছন্দ হ'ল তা ঠিক বুঝা গেল না । আমাকে মারের সাগর পাড়ি দেয়ানোর জন্য ?

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

শেষটা পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ
ভালো থেকেন জোহরাপু।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

সাফিনাজ, মন খারাপে মন খারাপে কাটাকাটি ।
মন থাকলে তো মন খারাপ হতেই হবে । তা নইলে আর মনের কাজ কী ?

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আহা, চমৎকার স্মৃতিচারণ ! চলুক
আপনার সেজ ভাই আমাতেও ভর করেছেন।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য ও সহৃদয় মন্তব্যের জন্য ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

রানা মেহের এর ছবি

আপনার এই পর্বটা অনেক ছুঁয়ে গেল

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ রানা'দি । মানুষ আমরা আছিইতো এই জন্য । একে অপরের দূঃখকে ছুঁয়ে দেয়ার জন্যইতো...

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

মর্ম এর ছবি

আম্মু বলে খারাপটা ভুলে গিয়ে ভালোটা মনে রাখতে। পারা তো মুশকিল, তবু এ লেখাটার পয়লা অংশটাই মনে রাখার চেষ্টা করব হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, মর্ম । অনেক ধন্যবাদ ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।