একটি ডায়েরির জন্য আক্ষেপ!

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল্লাহ এ.এম. [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২১/০৫/২০১৯ - ৬:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল দিল্লী ভ্রমনের। ভ্রমনকালে দিল্লী এবং এর সন্নিহিত অঞ্চলের বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখার বাসনা যেমন ছিল, তেমনি আরও একটি গোপন বাসনাও ছিল, দিল্লীতে সত্যি সত্যি কোন বিখ্যাত রকমের "দিল্লী কা লাড্ডু" পাওয়া যায় কি, না তা একটু খুঁজে দেখা। নব্বই দশকের মাঝের দিকে অনেকটা হটাৎ করেই কলকাতা থেকে দিল্লী যাওয়ার পাকা বন্দোবস্ত করে ফেললাম। যাযাবরের বিখ্যাত "দৃষ্টিপাত" এবং নিমাই ভট্টাচার্যের "রাজধানী এক্সপ্রেস" পড়া ছিল। দুটোতেই কলকাতা থেকে দিল্লী যাত্রার দুরকম বর্ননা আছে, একটি বিমানে, অন্যটি ট্রেনে। আমার কাছে নিমাইয়ের বর্ননাটিই মনে ধরেছিল। সুতরাং এক বিকেলে দিল্লী গমনের উদ্দেশ্যে হাওরা ষ্টেশনে গিয়ে ভারতখ্যাত রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম।

টু টায়ার কামরার টিকেট, অর্থাৎ মুখোমুখি দু'জন করে বসার উপযোগী দুটি সীট এবং মাথার উপরে মুখোমুখি দুটি বার্থ। দিনের বেলায় এবং রাত দশ'টা অবধি দুজন মিলে নিচের সীটে বসা, আর রাত দশ'টার পরে বাধ্যতামূলকভাবে একজনের উপরের বার্থে গিয়ে শোয়া, এই হলো ব্যাবস্থা। আমি কামরায় উঠে দেখলাম আমার সীটের এবং মুখোমুখী সীটের অন্য যাত্রীরা আগেই এসে গেছেন। লাগেজটি ঠিকমতো রেখে জানালার পাশে আমার সীটে বসে হাওড়া ষ্টেশনের কর্মব্যাস্ততা দেখতে দেখতে ট্রেন ছেড়ে দিল। কিছুক্ষন বাইরের কোলকাতা দেখলাম, তারপর সহযাত্রীদের দিকে মনোযোগ দিলাম। আমার সাথে সীটে বসেছেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক, আর সামনের সীটে সিঁথিতে সিঁদুর দেয়া একজন প্রৌঢ় ভদ্রমহিলা এবং একজন সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুনী। তাদের কথপোকথন শুনে আমি মনে মনে বেশ খুশী হয়ে উঠলাম, কারন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে তাদের বাড়ী ঢাকার তাঁতীবাজার, লক্ষীবাজার কিংবা নারায়নগঞ্জ না হয়েই পারে না। অল্প অল্প করে তাদের সাথে আলাপচারীতা শুরু হলো, আরও খানিকক্ষণ পরে পরিস্থিতিটা বেশ সহজ হয়ে উঠলো। তখন আমার মুখোমুখি সীটের ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কোথা থেকে আসছেন? যা উত্তর করলেন, তাতে আমি বেশ বোকা বনে গেলাম। তিনি বললেন ডিব্রুগড়, আসামের ডিব্রুগড়। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ডিব্রুগড়ে সেটেল করেছেন? উনি বললেন, না তো! বলেন কি! আপনারা যে এ্যাকসেন্টে কথা বলছেন, ডিব্রুগড়ের সবাই কি সেভাবেই কথা বলে? এবার আমার পাশের ভদ্রলোক বললেন, ডিব্রুগড়ের বাঙ্গালিরা এভাবেই কথা বলে। আমার ঘোর আর কিছুতেই কাটতে চায় না, কোথায় রইল ঢাকা নারায়নগঞ্জ, আর কোথায় ডিব্রুগড়, কথ্য ভাষায় এতটা মিল রয়ে গেল কি ভাবে!

এর পরে গল্প বেজায় জমে উঠলো, প্রধান বক্তা এবং আলোচক মুলতঃ সেই ভদ্রমহিলা, যিনি ততক্ষনে আমার মাসীমা হয়ে গেছেন। আমরা সময় সুযোগ মত কিছু কিছু বলছি। মাসীমা এবং তার স্বামী দুজনই ডিব্রুগড়ের কাছে কোন একটি কলেজে পড়ান। তাদের একমাত্র মেয়েটি, যে এখন আমাদের সহযাত্রী, ঐ কলেজেই পড়ে। এর মাঝে ট্রেন কতৃপক্ষের সরবরাহকৃত নাস্তা এবং পরবর্তীতে ডিনার কখন সাবার করলাম ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। দশটা বাজতে খুব একটা দেরী নাই, তখন আমরা কে কেন দিল্লী যাচ্ছি সে প্রসংগ উঠলো। আমার উদ্দেশ্য জানার পর মাসীমা আমার প্রতি নানা পরামর্শ এবং উপদেশ বর্ষন করলেন। আমিও তাদের দিল্লী যাত্রার উদ্দেশ্য জানতে চাইলাম। তাদের মানে, মাসীমা, আমার সীটের পার্শ্বযাত্রী তার স্বামী অর্থাৎ কাকাবাবু(মেসো মশাই আমাদের আমার জন্য বেশ খটোমটো, তাই কাকাবাবু) এবং তাদের একমাত্র কন্যা, এই তিনজনের। আমার প্রশ্নের পর তাদের সবার মাঝে এক অদ্ভুত ধরনের নিরবতা নেমে এলো। আমি অবাক কৌতুহলে উত্তরের অপেক্ষা করছি। বেশ খানিকটা পরে মাসীমার দিকে নির্দেশ করে কাকাবাবু ধরা গলায় বললেন, ওর ইউটেরাসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে, তারই চিকিৎসার জন্য দিল্লী যাচ্ছি।

এমন সম্ভাবনার কথা আমি কল্পনাও করি নাই, ঘটনার আকস্মিকতায় তাই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এই অল্প কয়েক ঘন্টায় মাসীমা এমনভাবে আপন করে নিয়েছেন যে স্বজন হারানোর আশঙ্কায় যেন মনটা আমার ব্যাকুল হয়ে উঠলো। আমাদের গল্পের জমজমাট আসরটার করুণ পরিসমাপ্তি ঘটলো, ভগ্ন হৃদয়ে আমি উপরে যেয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার নিদ্রাভাগ্য অসাধারন, সাধারনতঃ শয্যাগ্রহন মাত্র নিদ্রাদেবী আমার দায়িত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু সে রাতে ব্যতিক্রম ঘটলো, আমার আর চট করে ঘুম আসতে চাইলো না। ভেবেছিলাম সকালে দেরী করে উঠবো, যাতে মাসীমার সাথে আর কথা বলার তেমন সময় না থাকে। কিন্তু সকালে যখন বেয়ারা ব্রেকফাষ্ট সরবরাহ করছে, তখন মাসীমা আমায় ডাকলেন, বললেন তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে আসতে। আমি জেগেই ছিলাম, ফ্রেস হয়ে এসে সবার সংগে ব্রেকফাষ্টে শরীক হলাম। আমার নাস্তার পালা শেষ হলো খুবই অস্বস্তির সংগে, মাসিমা'ও আর কালকের সেই উচ্ছল মাসিমা নেই। চা খেতে খেতে প্রায় নয়টা বাজলো, সাড়ে দশটায় ট্রেন নিউ দিল্লী ষ্টেশনে পৌঁছার কথা। সবাই প্রায় চুপচাপ বসে আছি, আর আমাদের পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। হটাৎ প্রানের মাঝে কি যেন তাগিদ বোধ করলাম! আমার মুখের তালা খুলে গেল!! আমি বললাম, মাসীমা- আপনার অসুস্থতার কথা শুনে কাল রাত থেকেই মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, মন খারাপ করে কি লাভ! আপনার যে অসুখটি ধরা পড়েছে, তার কারনে হয়তো জীবনের আমোঘ বাস্তবতাটির কথা আপনার এবং আমাদের বেশী করে মনে পড়ছে। কিন্তু এই বাস্তবতা তো আপনার একার নয়, আমার, এমনকি এ জগতের সকল মানুষ, সকল প্রানীর জন্যই চরম সত্য। তবুও এখন চিকিৎসা ব্যাবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, স্রষ্টার কৃপায় আপনি হয়ত আরও অনেক দিন বাঁচবেন। তারপরও একদিন সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতেই হবে, সবাইকেই যেতে হবে! মৃত্যুর শারীরিক যন্ত্রনা ছাপিয়ে আপনার কাছে হয়তো কাকাবাবু আর আপনার মেয়ের সংগে বিচ্ছেদের মানসিক কষ্টটাই প্রধান হয়ে উঠবে। কিন্তু আমার অনুরোধ, যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবেন, ততদিন আপনার অসাধারন স্বতস্ফুর্ত ভাবটা বজায় রাখবেন। আপনার ঠিকাণাটা আমায় লিখে দিন, আমি প্রতি মাসে অন্ততঃ একটি করে চিঠি আপনাকে লিখতে চাই, যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে। মাসীমা আমার হাত দুটি তার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললেন, কেন এভাবে মায়া বাড়ালি! এসব মায়ার বাঁধন ছেড়ে এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে মন চায় না, খুব কষ্ট লাগে। তুই লিখিস, খুব ভাল লাগবে, আর একটিবার যদি আসিস ডিব্রুগড়ে, খুব খুশী হবো। এরপর তিনি আমার ডাইরীতে সুন্দর হস্তাক্ষরে তাদের ঠিকাণাটি লিখে দিলেন। এর কিছুক্ষন পর ট্রেন ধীরে ধীরে নিউদিল্লী ষ্টেশনে এসে থামলো। আমারা যে যার গন্তব্যে চলে গেলাম। বিদায়ের আগে মাসীমা বললেন, তোর চিঠির জন্য অপেক্ষায় থাকবো, আর তুই অবশ্যই একবার আসবি কিন্তু। আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম- অবশ্যই!

দিল্লীতে সেবার অপ্রত্যাশিতভাবে আমার হ্যান্ডব্যাগটা খোয়া গেল, তার মধ্যে অন্যান্য কিছুর সাথে সেই ডাইরীটাও ছিল, ফলে সেই সংগে মাসীমাদের ঠিকাণাটাও আমি হারিয়ে ফেললাম। স্মৃতি থেকে শুধু দুটো নামই মনে করতে পারলাম, রঞ্জনা সরকার আর ডিব্রুগড়। জীবনে কতবার কত কিছু হারিয়েছি, কিন্তু সেই ডাইরিটার জন্য যেমন হাহাকার এখনও বোধ করি, তেমনটা আর কোন কিছুর জন্য নয়। অনেকবার ভেবেছি ডিব্রুগড়ে গিয়ে সেখানের সব কলেজ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি তাঁকে পাই কি না। কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠে নি। জানি না এতদিন পর তিনি আর বেঁচে আছেন কি না, তবে এখনও মাঝে মাঝে মাসীমার কথা খুব মনে পড়ে, তখন তার মায়াভরা মুখটি আমার চোখে ভেসে ওঠে। তিনি যেন ভ্রুকুটি তুলে বলেন, কিরে? তুই তো চিঠি লিখলি না? তুই একবার আসলি না তো? আমি তখন অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে অস্ফুটে বলি- ক্ষমা করে দিও মাসীমা!


মন্তব্য

abol_tabol এর ছবি

কয়েকটা উপায় এখনো আছে চেক করার :
১. গুগল সার্চ ইঞ্জিন এ খুঁজে দেখা
২. ফেইসবুক এ সার্চ করে দেখা
৩. https://www.reddit.com/r/assam/ এ একটা পোস্ট দিয়ে দেখতে পারেন ডিব্রুগড় এর কেউ ওখানে আছে কিনা। তারপর তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।

করবী মালাকার এর ছবি

শিরোনাম যাই হোক, দিল্লী ভ্রমণ দেখে ভাবলাম ভ্রমণ কাহিনী। পড়া শেষে বিষণ্ণ হল মন এবং লেখাটি ভাল লাগল।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

দিল্লী গিয়ে দিল্লী কা লাড্ডু খুঁজে পাইনি আমি। ভাবলাম আপনি পেয়ে গেলেন কিনা। কিন্তু পরের কাহিনী তো মর্মে আঘাত করলো।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অবনীল এর ছবি

মনটা বিষন্ন হলো আবার মানুষে মানুষে কত সহজে আপন হয়ে যায় কখনো কখনো সেটা চিন্তা করেও কেমন যেন একটা ভালো লাগাও কাজ করতে থাকলো। আসলেই অনলাইনে যদি কোনভাবে খোজ পাবার উপায় থাকতো, টেলিফোন ডিরেকট্রী বা ওরকম কিছু ! যাহোক লেখা খুবি সুন্দর হয়েছে।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।