আমার ছোটকালের গল্প

আলমগীর এর ছবি
লিখেছেন আলমগীর (তারিখ: রবি, ১১/০৫/২০০৮ - ১২:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(লেখাটা গত সপ্তায় সচলে এসেছিল। আসার ২০ কি ৩০ মিনিটের মাথায় দুর্বৃত্তপনার কবলে পড়ে হাওয়া হয়ে যায়। আজ বাড়তি কিছু যোগ করে নতুন করে পোস্ট করলাম।)

সময়টা এখনকার মতো অত অস্থির ছিলো না। মাঝে মধ্যে ছেলেধরাদের গুজব শোনা গেলেও কখনও তাদের কারো সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। দুই দুইটা ভাই রেখে, কন্যা সন্তানের অপেক্ষায় থাকা বাবা-মাকে হতাশ করে দিয়ে আমি আসি। সে যাই হোক, বাবা গণ্ডাখানেক চাকরি আর ব্যবসার চেষ্টা দিয়ে সুবিধার করতে না পেরে কৃষক বনে যান। গণি মিয়ার মতো অত গরীব চাষী না হলেও খুব ধনীও না। জয়লা হবার পর ফিতা লাগানো ঢিলা প্যান্ট পরে ঘুরাঘুরি করি আর একটু আধটু স্বরেঅ স্বরেআ শিখি। ঢিলা প্যান্ট পরার সুবিধা হলো না খুলেই জলবিয়োগ করা যায়। সেই সুবিধার ইতি ঘটল একদিন অসাবধানতাবশতঃ 'গিট্টু মাইরা' ফেলার পর, তাও জায়গামত কানি আঙুলে! এরপর শুরু হলো ইংলিশ প্যান্ট, বাবার অব্যবহৃত ফুল প্যান্ট কেটে বানিয়ে দেয়া। ইংলিশ প্যান্ট পড়ে সাইড দিয়ে ইয়ে করা যায় না, জিপার (চেইনই বলতাম সেসময়) খুলে করতে হয়। সেই জিপারও একদিন যথাস্থানে আটকে গেল। জান যায় অবস্থা।

প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হই সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে। হেডমাস্টার সহ আরো কয়েকজন শিক্ষক দেখা গেল বাপের হয় পরিচিত না হয় বন্ধু। ফুপুর বাড়ী স্কুলের কাছেই, তবে মাপমতো কোন ফুফাত বোন ছিলো না।

হেডমাস্টারের বাড়ী বরাবরের মতোই স্কুলের খুব কাছে। উনার দুই কন্যার বয়স প্রায় আমার মতোই। পড়েও আমাদের আগে পরে কোন ক্লাসে। আমরা প্রায় প্রতিদিনই টিফিনের সময় পানি খাবার জন্য চলে যাই। ছাত্র ভালো ছিলাম, রোল নাম্বার এক। বিটলামি করার কোন উপায় ছিলো না। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নিরঞ্জণ পাল, আমাদের বাড়ীর ধারেই রাস্তার উল্টো পারে পালপাড়ায় থাকত। বন্ধুদের মধ্যে মোক্তার, হাসান, ঝরুর নাম মনে পড়ে; আর বান্ধবীদের মধ্যে সরিফা আর হালিমা। বন্ধু বা বান্ধবী তখন যদিও স্পর্শকাতর শব্দ। মোক্তার ছিল সবচেয়ে চাল্লু। সে দেখি সরিফার সাথে ভাব বাচ্যে কথা বলে। ঘটনা খোঁজ করে দেখা গেল, আসলে সে হালিমাতে অনুরক্ত। মাঝে মধ্যে খাতার মধ্যে কী যেন চালাচালিও করে। আমার উৎ সুক্য দেখে একদিন একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। আমার হাটু আর বুকের কাঁপ আর থামে না। বাড়ী এসে কোথায় গিয়ে পড়ব সেটা খুঁজে পাই না। পাটশোলার গাদার মধ্যে ঢুকে সেই কাগজ খুলে দেখি গুটি গুটি হাতে লেখা:

চিরল চিরল তেতুল পাতা, তেতুল বড় টক
তোমার সাথে ভাব করিতে আমার বড় শখ।

আরো কয়েকটা এরকম পদ ছিলো এখন আর মনে নাই। সেই মোক্তার কদিন পর দেখি খাতার মধ্যে বিশ টাকা পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়া স্কুলে আসে। সে সময় দশ পয়সা দিয়ে আইসক্রিম, পঁচিশ পয়সা দিয়ে মালাই পাওয়া যায়। বিষয় কী- হালিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, "সোনার চেইনই বানাইয়া দিমু"। সে প্রেম আর বেশী দিন আগায়নি। মোক্তার স্কুলের পাঠ চুকিয়ে সদরে ঘড়ি মেরামতির দোকান খুলে বসে। বহু বছর পরে একদিন দেখা হয়, কথার ফেরে জিজ্ঞেস করি হালিমার কথা। জানা গেল, হালিমা হাসানের মামী হয়েছে। খুবই দুঃখের কথা- যে হাসান কিনা তাদের চিঠি আদান প্রদান করত!

প্রতিবার পরীক্ষার আগে বাবা মা বলে দেন, প্রশ্ন ভাল কইরা পইড়া তারপরে লেখা শুরু করবা। তাই করিও, কিন্তু প্রশ্ন সহজ দেখে কোনটা আগে কোনটা পরে লিখব- সে বিবেচনার জন্য সময় নষ্ট করতে পারি না।

পঞ্চম শ্রেণীর সমাজ বিজ্ঞান পরীক্ষা। সব পারি, ধপাধপ লিখতে থাকি। একটা প্রশ্নে জাতীয় পতাকা আঁকতে হবে। আঁকা আঁকিটা পেন্সিল দিয়ে করতে হয়, সময় নষ্ট তাই ফাঁকা জায়গা রেখে বাকী সব প্রশ্নের উত্তর লিখে যাই। লেখা শেষ হইলে ভাল কইরা রিভিশন দিবা- বাবার এই কথা আর মনে থাকে না। সময় শেষের আগেই খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে যাই। স্কুলের মাঠটা পের হলাম কি হলাম না, বুকটা ধক করে উঠে, পতাকাতো আঁকলাম না! খাতা তো আর দ্বিতীয়বার দিবে না! যদিও পরের দিন পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনি সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষক আমার খোঁজ করেছিলেন, পতাকার জন্যেই।

এ ঘটনাটা এত করে মনে রাখার একটা কারন আছে। সেটা খুব করুণ। সমাজ বিজ্ঞানের সে পতাকার জন্য ১০ নম্বর আমি হারাই, পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় হয়ে যাই, নিরঞ্জণ প্রথম হয়। আরে বাবা তোর প্রথম হওয়ার কী দরকার, তুই তো সেই হাড়ি পাতিলই বানাবি না কী, মনে মনে বলি। একবার পরীক্ষায় প্রথম হলে আজীবন একটা বোঝা টানতে হয়, সেটা থেকে আপাততঃ মুক্তি পাই। কিন্তু বাবা আমার মানতে নারাজ। আমার পড়ার বই সব ছুঁড়ে ফেলে দেন। কোন ধরনের প্রহার উনি অবশ্য করেন না, তবে বগলের নীচে দাবা করে বোরো ক্ষেতে নিয়ে চলেন। পড়াশোনার দরকার নাই, তুমি হালচাষ কর, নেও আইল বান্ধ দেখি। জীবনের প্রথম চোটটা পাই।

পড়া আসলে বন্ধ হয়নি আমার। পরের দিন থেকেই বৃত্তি পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে যাই। পরীক্ষার দিন শতশত মানুষ দেখে খুব ভয়ই হয়। প্রথম দিনের পরীক্ষায় আসে "মনে করো যেন" কবিতার শেষ আট লাইন।

সেই যে-
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মানে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছ পালকি তে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ায় প'রে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।

পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা পড়ে গেছে, খাতা স্টেপল আর রিভিশনের সময়। আমার স্কুলের হেডমাস্টার মুঠোর মধ্যে একটা কাগজ গুঁজে নিয়ে আসেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন কবিতা ঠিক মতো লিখতে পেরেছি কিনা (সে বারই প্রথম উল্টোদিক থেকে কবিতা লিখতে বলা হয়)। আমাকে বলতে বলে যাচাই করে নেন। নকল করার প্রথম পাঠটা আর নেয়া হয়েও হয় না আমার।

নিরঞ্জণ আসলেই আর পড়াশোনা করতে পারেনি, মূলত আর্থিক কারনে। মোক্তার আর হাসানের সাথে বহু বছর কোন সাক্ষাৎ হয়নি। হালিমা, সরিফা যথারীতি গৃহবধু। পড়াশোনায় সময় নষ্ট করার চেয়ে কাটাকুটি করলে দ্রুত নাম ছড়াবে, এটা প্রথম বুঝে নজরুল। ওর বাবাকে আমি চাচা বলি, এমনি এমনি না। ওনার সাথে আমার বাবার দোস্তি হয়েছিলো। মুখের কথার দোস্তি না, একেবারে মজমা করে, গামছা ধরে, মোল্লা দিয়ে পড়িয়ে দোস্তি। সেই চাচা ছিলেন রেশনের ডিলার। সে সুবাদে মিহি চিনির ভাল জোগান ছিলো আমাদের ঘরে। নজরুল পরে পৌরসভার কমিশনার হয়েছিল। এখন বোধ করি জেলে।

আজহার নামে ছেলেটা আমাকে প্রথম সিনেমা দেখায় হলে গিয়ে। ছবির নাম ছিলো জনি। নায়ক নায়িকা বা কাহিনী কোনটাই আর মনে নেই। সেই আজহারকে আরেক দিন দেখি গরুর গাড়ির চালকের আসনে। মনে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। আমাদের কারো যে জীবিকার জন্য কাজ করতে হয় সেটা আমার মাথায়ই আসেনি সে সময়। আজহার আমাকে বিড়ির ট্রেনিংটাও দিয়েছিলো, কিন্তু আমি রাখতে পারিনি।

স্কুলের রাস্তা একটু আগ বাড়িয়ে মোড়ের মধ্যে ছিলো লেবু চাচার মনোহারি দোকান। গোটা মাইল পাঁচের মধ্যে অতবড় দোকান আর ছিলো না। কালো রঙের ছোট ভাত বর্শি, নাইলন সুতো, সীসা আর ফাতনার জন্য ময়ুরের পাখ- এগুলোর ছিলো আগ্রহের সামগ্রী। শীত শেষে যখন ঘুড়ির মৌসুম আসত, তখন চার টাকা দিয়ে বিড়াল মার্কা সুতার রিল কিনতাম এ দোকান থেকেই। মাঞ্জা দেয়ার জন্য কর্পুর, মেথি আর এরোরুট বার্লি। লেবু চাচার দোকান এখন বিলুপ্ত, সেখানে এখন হেন ধরনের দোকান নেই যা হয়নি।

আমার বড় দুই ভাই আমার এক ক্লাস করে উপরে থাকত। সবার বড় যিনি, তিনি একবার খারাপ করে মেজ জনের সহপাঠী হয়ে যান। হাইস্কুলেও তারা এক ক্লাসে ছিলেন। উপরের ক্লাসে বড় ভাই থাকার সবচেয়ে বড় বেদনা ছিলো অন্যত্র। সে সময় সব বই বাজার থেকে কিনতে হত। ডিসেম্বর এলেই বাজারে নতুন বই চলে আসত। কিন্তু সে বই আমার কেনা হতো না বড় ভাইদের পুরোনো বই থাকায়। শুধু বই না, ঈদ এলে জামা কাপড়ের বেলাতেও রিসাইক্লিং চলত ছোটদের উপর দিয়ে। পুরোনো বই আমি নতুন করে মলাট লাগিয়ে নিতাম। তবে ভাগ্য দুএকবার একআধটু প্রসন্ন হয়েছিলো, সিলেবাস বদলে যাবার ফলে। আরো একটু ভালো হয়েছিলো, ভিন্ন হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সুবাদে।

সে গল্প পরের কিস্তির জন্য তোলা রইল।

(আমাকে সচল ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না। অতিথি একাউন্ট দুর্বৃত্তপনার শিকার হওয়ায়, বিশেষ ব্যবস্থায় নিজ নামে লেখার এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।)


মন্তব্য

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

চমৎকার।
আমিও প্রথম হলে যে সিনেমা দেখেছিলাম -নাম ছিল 'জনি'। আমি তখন সপ্তম শ্রেণি। নায়ক ছিল সোহেল রানা আর নায়িকা সুচরিতা।

---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

মুশফিকা মুমু এর ছবি

চিরল চিরল তেতুল পাতা, তেতুল বড় টক
তোমার সাথে ভাব করিতে আমার বড় শখ।

এত্ত কিউট গড়াগড়ি দিয়া হাসি

-------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অতিথি লেখক এর ছবি

আলমগীর ভাই, জিপার নিয়ে আমার ছোটবেলার কষ্টের স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন। আল্লাহ বাঁচাইছে!

সচল না হলেও সচলের মত লিখতে পারছেন। কম কি? হেহেহেহে।

অচল তথা অতিথির একাউন্টে login করতে পারছিলাম না সকালে (বাংলাদেশ সময়)। এখন রাতে login করতে পারলাম।

ফেরারী ফেরদৌস

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আলমগীর ভাই, কবে সচল হইলেন? কী যে খুশি লাগছে! কিন্তু শেষের প্যারাটার মানে কি?

আলমগীর এর ছবি

হইনি ভাই। এটা প্রভিশনাল ব্যবস্থা। ব্যাখ্যা এখানে
আপনার স্ট্যাট সাইট দেখলাম, ভাল উদ্যোগ। কমিউনিকেশনে PhD করতে এসে গত তিন বছর ধরে কেবল স্ট্যাট পড়ছি!

ধুসর গোধূলি এর ছবি
আলমগীর এর ছবি

"ভালই তো হচ্ছিল, হঠাত থেকে গেলেন কেন?"

মেমরি ভাল:)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।