কয়েকছত্র প্রান্তিকপত্র

নজমুল আলবাব এর ছবি
লিখেছেন নজমুল আলবাব (তারিখ: সোম, ৩০/১১/২০০৯ - ৩:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


প্রান্তিক নিয়ে এতো লেখা হয়! ঘুরে ফিরে এই জায়গাটার কথা আসে। আসে স্বপনের চায়ের দোকানের কথা। সুনামগঞ্জের উদার হাওর আমার জীবনে যেমন জড়িয়ে আছে জননীর ওমের মতো, প্রান্তিকও বুঝি তেমনটাই!

বালক বয়েসে মেলায় যেতাম। কৈশোরে গেলাম নাটকের ঘরে। স্কুলঘরের মতো টিনের চালের ঘরটা কোন ফাঁকে এমন মায়ায় জড়ালো? কোন ফাঁকে মিশে গেলো এমন জীবনের গল্পে?

সেভাবে আমার সাথে প্রান্তিকের সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিলো না। নিতান্তই এক কর্মী হিসাবে আমি সেখানে ছিলাম। কোনো গরম গরম ভাবনা ছিলো না মাথায়। দেশ সমাজ পাল্টে দেয়ার ধারণা নিয়ে সেখানে যাইনি। মঞ্চে উঠে কাঁপিয়ে দেবো, ফাটিয়ে দেবো তেমনটাও মাথায় ছিলো না। সম্ভবত জেনেটিক কারণে গিয়েছিলাম সেখানে! (এই জিন জিনিসটা কি???) বাপ এইসব করতেন বলে শুনেছি। ভাই আমার ঠিক আগে আগে সেখানে গিয়েছে।

এই জিন ভূত ছাড়া আর কি ছিলো তবে? সম্ভবত আড্ডা। সম্ভবত মানুষের টান।

প্রান্তিকের ভাঙা টিনের চালের নিচে এ নাটক করছে, তো ও করছে আবৃত্তি, আরেকজন হয়তো গান তুলছে গলায়... কী সরগরম সেখানে। তুমি যাও, মিশে যাও। মিশে যাও আনন্দ নগরে।

রাস্তার একদিকে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল, আরেকদিকে প্রান্তিক। প্রথম-প্রথম হোস্টেলের সামনের দোকান থেকে চা আনতে হতো। নাট্যকর্মী হওয়ার কঠিনতম পরীক্ষা শুরু হতো এই চা এনে। ফ্লাস্ক হাতে নিতে নিতে অনেকদিন শুনতে হয়েছে, যাও, এখনতো ফ্লাস্ক পাচ্ছো, আমরা কেটলি দিয়ে রিকাবীবাজার থেকে চা আনতাম! তবে সেই পরীক্ষা বেশিদিন দিতে হয়নি। স্বপন একটা চা এর দোকান খুলে বসলো বারান্দায়। প্রান্তিক তার পূর্ণতা পেলো বুঝি এই চায়ের দোকানের মাঝ দিয়ে।

নাটকের ঘরে কী হত? কথাকলি শুধু নাটক করতো না। কবিতা, গান সবকিছুই ছিলো সেখানে পাঠ্য। আমি নিতান্তই বেসুরা মানুষ। বাপ কি সাধে অসুর বলে ডাকে? আমি বসে বসে সেইসব জিনিসপাতি দেখি। গানের দলে লোকজনের পেছনে বা কবিতার কোরাসে মাঝে মাঝে শেষ মানুষটা হয়ে বসে থাকি। এ এমনি এক বসে থাকা যে, না বসলেও কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না কারো। এই করে করে আধা যুগ পার করেছি হে...

আমি এ ঘরে যাই, ও ঘরে যাই। প্রান্তিকের উঠানে পাঠক ফোরাম পরে বন্ধুসভার আড্ডা হয়। সেখানে গিয়ে বসি। কেউ চা খেলে, পাশে বসে থাকলে এক কাপ জুটে যায়। এই করে করে বেশ ছিলাম।

প্রান্তিকে যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো, পাকে চক্রে যে কয়টা বন্ধু জোগাড় হয়েছিলো (এইটাও একটা আজব ঘটনা, অন্তত আম্মার কাছে, আমার বন্ধু হতে পারে এটা তিনি এখনও সেভাবে বিশ্বাস করেন না) সবকটাই এখানে আসতো। এক ঢিলে আসলে অনেক পাখিই মারা হতো সেখানে। নাটক হলো, কবিতা হলো, আড্ডা হলো, বন্ধু হলো, গুল্লি হলো, মাল হলো, কুলখানি হলো... কতো কতো হলোরে!

প্রান্তিকে আমরা কেউ সাইকেল চালিয়ে যেতাম, কেউবা মোটর সাইকেল করে। কেউ যেতো রিক্সা চড়ে আর কেউ কেউ পায়ে চড়ে। রাতে বাড়ি ফিরতে গেলে এ তাকে ও একে দিয়ে আসতো বাড়িতে। পরিচিতরা কোন কারণে আমাদের দরকার পড়লে সোজা প্রান্তিকে চলে আসতেন। এমনকি একবার আমার মা, অসুস্থ মামাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সোজা চলে এসেছিলেন প্রান্তিকে। কথাকলির রুমে একটা ইম্প্রোভাইজেশনের কাজ চলছিলো। সেখানে কোরাস থেকে প্রশ্ন আসছে কেমন আছেন... কেমন আছেন... বাইরে থেকে উত্তর আসলে, তোমরা কেমন আছো জানি না, তোমাদের মা ভালো নাই!!! মামাকে ডাক্তার দেখানো থেকে হাসপাতাল সবকিছুই করা হলো, করে দিলো কথাকলি'র মানুষজন। আমাদের জননীরা এমনি নিশ্চিত থাকতেন প্রান্তিক নিয়ে, এমনি নির্ভরতা ছিলো কথাকলি নিয়ে। (এখনও আছে)। আবারো বলি বেশ ছিলাম আমরা।

গত মাসে একজন রক্ত দরকার বলে ফোন করলো। টুকুদাকে ফোন দিলাম আমি। মিনিট পনেরোতে ব্যবস্থা হয়ে গেলো। রক্তের এই ব্যাংকটা প্রান্তিক থেকেই গড়ে উঠেছে। বিষয়টা এমন পর্যায়ে ছিলো যে, অনেকেই জেনে গিয়েছিলো সেটা। রক্তের দরকার হলে সন্ধানীর কাছে না গিয়ে প্রান্তিকে হাজির হতো!

এইভাবে টুকরো টাকরা গল্প বলতে থাকলে বিশাল একটা কিছু দাঁড়িয়ে যাবে। সেটা করে লাভ কি? নাই, কোনো লাভ নাই। তাই একদিন হুট করে প্রান্তিক ভেঙে পড়ে, না ভেঙে পড়ে না, তারে চুরমার করে দেয়া হয়। ইঁট-কাঠের নির্মাণটা টুকরো টুকরো হয় আর সাথে আমাদের হৃদয়।

এই একটা ঘটনা সিলেটের সাংস্কৃতিক আন্দোলনরে কতটা নিয়ন্ত্রণ করেছে আর কতোটা পিছিয়ে দিয়েছে তার হিসাব দেয়ার ক্ষমতা আমার নাই। আমি শুধু আমারটাই জানি। আমি জানি এরপর থেকে রোজ বিকালে বসার একটা জায়গার জন্যে আমরা হন্যে হয়ে ঘুরেছি। নাটকের রিহার্সালের জন্যে একটা ছোট্ট খুপড়ি খুঁজতে খুঁজতে সিনিয়াররা ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমরা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছি, বিচ্ছিন্ন হয়েছি, একজন আরেকজনের কাছে শুধুই পরিচিত একজন হয়েছি...


আবার যখন ২০০৮ এ কথাকলি হাঁটি হাঁটি পা পা করে পুনর্যাত্রা করলো, তার আগে আমাদের অনেক কিছু বদলে গেছে। আমাদের কেউ এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড়কর্তা, কেউ বড় ব্যাংকার, শেয়ারের বাজারে কারো কারো দেদার ইনকাম, শহরের কেউকেটা ঠিকাদার সেও আমাদেরই ঘরের মানুষ। বিকাল চারটায় রিহার্সাল, তাই সবকিছু ফেলে রেখে, সে হোক চাকরি, দোকানদারী বা প্রেমিকার সাথে ডেটিং... সব ফেলে রেখে আসতে হতো। চারটার পরে ২/১ মিনিট দেরি হলেও রুমে ঢোকা যেতো না। কোনদিন ঢুকে পড়লেও চোরের মতো বসে থাকতে হতো। সেইসব দিন আর নাই। এখন রিহার্সালের সময় দিতে হলে আগে কথা বলে নিতে হয়। আমাদের কেউ যাই সাতটায়, কেউ যায় সাড়ে সাতে আর কেউবা আটটায়। তাও সেটা যে নিশ্চিতই হবে তাও নয়। পাঁচ মিনিট আগে কিংবা একেবারে না জানিয়েও এখন আমরা অনুপস্থিত থাকতে পারি! ডিরেক্টর বসে থাকেন, আমরা আসি না! জীবন আমাদের এমনই ভাড়ুয়া বানিয়েছে অথবা নাটক আমাদের আর সেভাবে বুঝি টানে না!


পায়লট এর আসল নাম কি? না কেউ বলতে পারবে না। প্রান্তিকের কোন মানুষই সেটা জানে বলে মনে হয় না। যে কথাকলির মেম্বার সে, তারাই জানে না! হ্যা পায়লটের নাম আমরা কেউ জানি না, তাকে সবাই পায়লট ডাকে। স্টেডিয়াম মর্কেটের একটা ফ্রিজের দোকানের ঠেলা চালাতো সে। বয়েসী মানুষ। মাঝে মাঝে তাকে দিয়ে সেট বা এটা সেটা টানানো হতো। এখনও আমার চোখে ভাসে, পায়লটকে টানা হ্যাচড়া করছে শিপন, অডিটোরিয়াম নিয়ে যাবার জন্যে। আগের রাতে নাটক হয়েছে। সেট পড়ে আছে, সেগুলো প্রান্তিকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু পায়লট যাবে না। নাটকের মাল টেনে পয়সা বেশি পাওয়া যাবে না। রিতিমতো চিল্লা ফাল্লা করছে সে। স্টেডিয়ামের দিকে পেতে রাখা স্বপনের বেঞ্চে বসে বসে আমরা মজা দেখছি। ফোড়ন কাটছি, জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে শিপন আর পায়লট আরো চেতছে। সম্ভবত ঠেলা ড্রাইভার হিসাবে তাকে পাইলট বলে ডাকা হতো ঢং করে, পরে সেটা পায়লট হয়ে যায়। এই কাজটা প্রান্তিকেরই করা অসংখ্য পুঙগাম্যানশনের একটা। তো সেই পায়লট কোন ফাঁকে ফ্রিজের দোকান ছেড়ে কথাকলির রুমে ঢুকে গেলো সেটা আমি অন্তত খেয়াল করিনি। আমাদের বাড়িতে কিভাবে সে ঢুকেছে তাও খেয়াল করিনি কেউ। শহর থেকে ৮ কিলোর বেশি দুরের গ্রামে থাকা আমার বাড়ি অব্দি সে এসে পড়ে। আব্বা, আম্মা সবার সাথে তার প্রবল খাতির। নাটক করতে লন্ডন যাওয়ার মতো অসম্ভব স্বপ্নের কথাও সে আব্বার সাথে গল্প করে!

প্রান্তিক ভেঙ্গে গেলে, তারও পরে স্বপন শহর সিলেট থেকে গ্রামে চলে গেলে কিংবা মরে গেলেও সেভাবে আমরা চায়ের অভাব অনুভব করি না। কারণ পায়লট আমাদের সাথেই থাকে। এখন যারা নাটক করতে আসে তাদেরকে ঘর ঝাড় দেয়ার কথা বা চা আনতে বলার মতো অবস্থা আর নাই। তাছাড়া আমাদের স্থায়ী কোন বসারই যায়গা নাই। তাই এসব কাজের জন্যে আমাদের আছে পায়লট। সে জানে কে কোন পান খাবে, চায়ের রং জানে সে, জানে সিগারেটের ব্র্যান্ড।

রিহার্সাল থাকুক বা না থাকুক প্রান্তিকের রুমগুলো সরগরম থাকতো। এখন সেরকম কিছু নেই। আমার মতো একেবারেই একলা মানুষ যারা আছে দু একজন। যাদের শেষ পর্যন্ত কোন বন্ধুতাই আর টিকে থাকে না। তারা সন্ধ্যার আবছায়া মিলিয়ে গেলে জড়ো হই পংকী ভাইর দোকানে। সে দোকানের কয়েকটা চেয়ার আমরা দখল করে চা গিলি, পান চিবুই, সিগরেট টানি। আর মাঝে মাঝে রিহার্সাল থাকলে চেয়ে চিন্তে ভিক্ষে করে পাওয়া মদন মোহন কলেজ কিংবা স্টেডিয়ামের কোন রুমে বসে গেজাই।


মাঝখানে কিছুই ছিলো না। এখন একটা দুটো করে সংসার আবার জুড়ছে আমাদের। হারমোনিয়ামটা টিকে ছিলো। নতুন করে বানাতে হয়েছে নাল, ঢোল আর একেবারেই নতুন যোগ হলো নাকাড়া। কর্তাল, মন্দিরাও জোগাড় হয়েছে। সবকিছু টানা হ্যাচড়া করে আমরা একবার যাই মদনে, তো আরেকবার যাই স্টেডিয়ামে। দু যায়গাই যখন হাতছাড়া হয়, তখন পায়লট সেসব নিয়ে যায় লিটন ভাইর বাসায়, আর আমরা আবার আসর পাতি পংকী ভাইর দোকানে। রিকাবী বাজার পয়েন্টে আবার হৈ হৈ জমে উঠে। যে আমরা চেয়ে চিন্তে চায়ের বিল জোগাড় করতাম, সেই আমরাই এরে তারে চা গিলাই। আর বিল দেয়ার সময় অবাক হয়ে দেখি আমাদের মাঝে সবচে ছোট যেজন, নয়ন (কলেজে সবে ভর্তি হয়েছে), সে বিলটা আগেই দিয়ে দিয়েছে!!!

কথাকলি কিংবা প্রান্তিকের রুমে ম্যাট বিছানো থাকতো। সেখানে ছড়িয়ে বসে, শুয়ে আমরা তাল ঠুকতাম আর অন্য কেউ একজন ধরতো গান। এখন সেটা হয় না। আমরা চেয়ারে সাহেব হয়ে বসি। আমাদের নরোম কাপড়ের দামি প্যান্ট যাতে নষ্ট না হয়, জুতোর পালিশটা যাতে ঠিক থাকে সেটা সবসময় খেয়াল রাখি। শামীম ভাই মুড ভালো থাকলে গান ধরে। চেয়ারে বসে বসে আমরা মাথা দুলাই, মাঝে মাঝে গলা মিলাই। মোবাইল ফোনে কথা বলি, এস এম এস পড়ি... আমাদের বিন্যস্ত করে কাটা চুল, আমাদের পরিপাটি শার্ট, তার কলারের নিচে বাঁধা টাই...। মাথা দুলাই তবু আর সেই ভাব আসে না।

প্রিয় প্রান্তিক, আমরা আর ভালো থাকি না সম্ভবত...


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমরা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছি, বিচ্ছিন্ন হয়েছি, একজন আরেকজনের কাছে শুধুই পরিচিত একজন হয়েছি...

এইসব কিভাবে লেখেন আপনিই জানেন! পঞ্চবটিকা!!

নজমুল আলবাব এর ছবি

ধন্যবাদ আরেফীন ভাই।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

উজানগাঁ এর ছবি

হায় ! অসহ্যসত্যগুলো কী সহজভাবে বলে গেলেন আপনি!

নজমুল আলবাব এর ছবি

এই সত্যের ভেতরেইতো বসবাসরে ভাই।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি:
প্রিয় প্রান্তিক, আমরা আর ভালো থাকি না সম্ভবত...

-এখানেই কথকের যাবতীয় কষ্ট জমাট-বরফ হতে দেখি।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নজমুল আলবাব এর ছবি

এই কষ্ট জমে বরফ হয় না জুলিয়ান দাদা। এইগুলা কঙক্রিটের চেয়েও বেশি শক্ত।

আপনি অনেকদিন পরে। মিস করি আপনাকে। আছেন কেমন?

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

আরিফ জেবতিক এর ছবি

মাথা দুলাই তবু আর সেই ভাব আসে না।

হ, তবে দোষটা মাথার না, দোষটা ভাবের।

নজমুল আলবাব এর ছবি

হ,
আমিতো তাই কইলাম।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

রণদীপম বসু এর ছবি

নস্টালজিয়া, বার্ধক্যে সুস্থ থাকার প্রয়োজনীয় বটিকা !

আপনার পোস্টগুলোর আউটপুট উত্তম। একেকটা পোস্ট একেকটা উৎবচন-এর জন্ম দেয়।

আচ্ছা, প্রান্তিক মানে শামসুদ্দীন ছাত্রাবাসের বিপরীতে সামান্য ভিতরে সেই পুরনো টিডশেড বিল্ডিংটা না ?
(পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি থেকে বলছি)
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নজমুল আলবাব এর ছবি

তাইলে দুইটা উৎবচন হইলো আমার পোষ্ট থেকে। গুড। দুই'শ টেকা কিন্তু পাওনা হয়ে গেলো দাদা। আশা করি দিতে কার্পন্য করিবেন না। দেঁতো হাসি

আপনি ঠিকই ধরেছেন। সেটাই। তবে এখন আর নাই। প্রান্তিক ধ্বংশেরও হয়ে যাচ্ছে দশ বছর। ৯ বছর ক্রস করছে।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

রণদীপম বসু এর ছবি

২০০৭ সালে ছাপানো ইয়া বড়ো একটা কবিতার বদলে পত্রিকা থিকা আমারে দিলো একশ' পঁচিশ টাকা এই সেদিন। আর আপনে একটা বচনের মূল্য হাঁকাইতেছেন একশ' টাকা !
নাহ্ ! আপনের লগেও মুলামুলি করোন লাগবো দেখতেছি ! তাড়াতাড়ি ফিক্সড রেইটে আসেন, দুই হাজার এগারো সাল কাছাইয়া যাইতেছে !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নজমুল আলবাব এর ছবি

কই পত্রিকা, আর কই নজমুল আলবাব! কিসের সাথে কিসের তুলনা করেন দাদা? ধুর আপনার কাছ থেকে টেকা নেওনও অপমানের। যান মাপ করে দিলাম।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সাইফ তাহসিন এর ছবি

ভালো লাগল আপনার লেখাটা, ছুয়ে গেল।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নজমুল আলবাব এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ তাহসিন।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

অপু ভাই, পোষ্টটা পড়ে কিছুক্ষন কাদলাম। স্বপন দা, মনু ওদেরকে মিস করবো সারাজীবন। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে হারিয়েছি। প্রান্তিক হারিয়েছি নিজেদেরই কারণে। প্রান্তিক মিশে আছে আমার/ আমাদের রক্তের অনুতে পরমানুতে।

আমি সারাজীবন ঋণী থাকবো প্রান্তিকের কাছে। সেখান থেকে আমি পেয়েছি আমার সব বন্ধু, বড় ভাই, আত্নার আত্নীয়দেরকে।

আমি সারাজীবন মানষ বাবুকে ক্ষমা করবো না। ক্ষমা করবো না আরিফুল হককেও। সাথে আরো যারা জড়িত ছিলেন।

আমি মৌলভীবাজারে বসে বসে গ্রুপের মানুষদেরকে এক করার চেষ্ঠা চালাই। বারবারই ব্যার্থ হই। তারপরও চেষ্ঠা চালাই। কিন্তু আর বুঝি পারবো না আমরা এক হতে। আসলেই এখন আর আমাদেরকে নাটক টানে না। আমরা খুব বেশী তথাকথিত প্রফেশনাল হয়ে গেছি। সবাই এখন বড় বেশিই ব্যাস্ত।

আমরা কি পারবো না আবার এক হতে????

লেখাটা খুব ভালো হয়েছে।

নজমুল আলবাব এর ছবি

পারবি, আবার হবে। হাল ছাড়িস না। আমারে দেখ। যতই তড়পাই, মচকাই না।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খুব আবেগ দিয়ে লেখা। লেখাটায় 'প্রান্তিক' নিয়ে আপনার ভালোবাসা, সেটা ভেঙে যাওয়ার কষ্ট, সবই পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। আপনার অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে গেলো, অপু ভাই।

কতো স্বপ্নই তো ভেঙে যায়, হারিয়ে যায়; তার কয়টাই বা আর ফিনিক্সের মতো আবার জেগে ওঠে বলেন! ভালো থাকেন। হাসি

নজমুল আলবাব এর ছবি

ধন্যবাদ বিডিয়ার। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়াই এইসব বেঁচে থাকা।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রান্তিক চত্বর

ধর্মীয় ঐতিহ্য ভাঙলে জাতিসংঘ নড়েচড়ে বসে
বস্তি উচ্ছেদ হলে হরতাল ডাকে বিরোধী দল
নাটকের মহড়া তুলে দিলে এদেশে কিছুই ভাবে না কেউ

এ তো এক মামুলি বিষয়
কিছু লোক বিকেলে এসে গোল হয়ে বসে
বাঁশ দিয়ে বাড়ি- কাঠ দিয়ে কুড়াল আর রং দিয়ে দিগন্ত বানিয়ে ওরা সংলাপ মুখস্থ করে
মঞ্চে প্রবেশ ও প্রস্থান আয়ত্ত করে
হাত-পা নাচিয়ে; গলা বাড়িয়ে-কমিয়ে রাগারাগি করে- মারামারি করে; বিপ্লব কিংবা ভালবাসা করে
মরে কেউ- কেউ মারে- কেউ এসে হাসে ও হাসায়
চটের দেয়ালে আলো ফেলে মঞ্চে নিজেই নিজেকে হাত তালি দিয়ে বাহাবা জানায়
তারপর আবার একসাথে বসে বিড়ি ও বাদাম ভাগাভাগি করে খায়

এদের মহড়া ভেঙে দিলে কী আর এমন আসে যায় জাতি ও দেশের

যায় না
কিছুই যায় না কারো। শুধু কিছু মানুষের পোড়ে মন
ভাগাভাগি করে স্বপ্ন দেখার মানুষেরা হতাশায় ভোগে ভাগাভাগি করে
বিকেলে ছাড়া-বাড়ির পরিত্যক্ত বিড়ালের মতো এরা এই ঘর থেকে ওই ঘরে যায়
একা একা কাঁদে
অন্ধকারে জ্বলে চোখ। ঝরে জল। পড়ে মনপোড়া গরম নিঃশ্বাস
একা

মন বসে না

মন বসে না কোথাও। কিচ্ছু ভাল্লাগে না। ভালো থাকতে পারে না কেউ
জমে না নাটক- জমে না আড্ডা- জমে না দৈনিক হাসি আর প্রেম

জানে না কেউ
নাটুকে লোক ছাড়া অভিধান কিংবা সংবিধানও জানে না প্রান্তিকের মৌলিক সাকিন
২০০৫.১০.১৬
বাজারিবাটু ২০০৬

০২
প্রান্তিকের একটা বড়ো দিক হলো প্রান্তিক থেকেই শুরু হয়েছে অসংখ্য মানুষের লেখালেখি

আর প্রান্তিক বোধহয় একটা বড়োসড়ো লেখার দাবিদার
হয়তো যৌথ লেখা

নজমুল আলবাব এর ছবি

প্রান্তিক বোধহয় একটা বড়োসড়ো লেখার দাবীদার বলে থেমে গেলে কি চলবে? তুমি ছাড়া আর কেউ এটা করবে বলে মনে হয় না। সাথে আমারে পাবা। এই যে ধরে নাও এই গৗণ লেখাটাই শুরু। এবার তুমি আসলটা শুরু করো।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মনটাই খারাপ হয়ে গেলো... ধুরো...

_________________________________________

সেরিওজা

নজমুল আলবাব এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমিও একদিন প্রান্তিকে বসে চা খেয়েছিলাম... লেখাটা ভালো লাগলো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নজমুল আলবাব এর ছবি

ধন্যবাদ নজুভাই।

দেশের যে প্রান্তেরই নাট্যকর্মী হোক না, সিলেটে গিয়েছে আর প্রান্তিকে যায়নি, এটা হয়নি কখনো।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অমিত আহমেদ এর ছবি

প্রান্তিককে না চিনেও লেখাটা পড়ে বিষাদ ভর করে রাখলো। অপু ভাই, এখন যা আছে তাই কিছুদিন পরে স্মৃতি হয়ে যাবে। মনে হব এই ক'দিন আগেও তো ভালো ছিলাম। তাই আজকের জন্য, কিংবা কালকের জন্যই না হয় বেঁচে থাকি। কী লাভ বলেন পুরানো স্মৃতি ঘেঁটে?


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফ্লিকার | ইমেইল

নজমুল আলবাব এর ছবি

প্রান্তিক আসলে সেরকম কিছু না অমিত। এর সাথে অনেক অনেক মানুষের স্বপ্ন জড়িয়ে। এই লেখাতেই দেখো শান্ত এসে কমেন্ট করেছে, লীলেন ভাই কবিতা দিলো। আরো অনেকেই এই লেখাটা পড়বে। হয়তো তড়পাবে, হয়তো কাঁদবে।

ভালো থেকো।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

আসলে অমিত ভাই, প্রান্তিক আমাদের কাছে ছিল অন্য কিছু। প্রান্তিক আমাদের কাছে কখনও স্মৃতি হবে না। প্রান্তিককে আমরা সারাজীবন বুকে ধরে রাখবো।

ঐ যে লীলেন ভাই বলেছে প্রান্তিক থেকে লেখা শুরু করেছে অনেক জন মানুষ। এই সচলেই দেখেন, আরিফ ভাই, লীলেন ভাই, অপু ভাই, রানা আপা, রাজীব ভাই, অর্জুন মান্না... এরা সবাই কোন না কোনভাবে প্রান্তিকের সাথে জড়িত।

আমরা কি না করেছি প্রান্তিকে? সকাল ১০টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা/ ১টা পর্যন্ত প্রান্তিকে কাটিয়েছি, ডিম আর ছোলা দিয়ে স্বপন দার খিচুড়ী, চা, বিষ্কুট এগুলো ছিল যেন অমৃত। নাটক, কবিতা, গান এগুলোর পাশাপাশি চলতো ক্যারাম বোর্ড খেলা, ক্রিকেট খেলা, আড্ডা...............

সবচেয়ে বুকে বাজে এই যে স্বপন দা, প্রান্তিক ভেঙ্গে দেয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই উনি মারা গেলেন। যারা এই প্রান্তিককে ভেঙ্গেছে ওরা কি পরোক্ষভাবে জড়িত না এই মুত্যুর জন্য?

প্রান্তিকের সামনের রাস্তা দিয়ে যখন যাই, স্বাভাবিকভাবে মুখ ঘুরে যায় প্রান্তিকের দিকে। কি অবস্থা আমার প্রান্তিকের? মনে হয় যেন একটি কবরখানা। আসলেই সিলেটের নাট্যাঙ্গনের কবরখানাই এখন এটি।

একটি ঘটনা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। যেদিন প্রান্তিক থেকে আমাদের পুরোপুরি বের করে দেয়া হয় সেদিন ছিল বাংলা বছরের শেষ দিন। পহেলা বৈশাখের দিন সন্ধ্যায় আমি আর বাবু গেলাম প্রান্তিকে, দেখি জায়গাটা অন্ধকার আর চারিদিকে বাশের বেড়া দেয়া আবার তার উপর গাছের ডাল দিয়ে রাখা, যেন কোনভাবেই আমরা ওখানে যেতে না পারি। কি লাভ হলো ওদের আমাদেরকে এই জায়গাটা থেকে বের করে দিয়ে?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রান্তিক ভাঙা হলো দিনে
রাতে প্রান্তিকে ভিটাতে শুধু ভাঙা ইট

কারা আছে কারা নেই কেউ জানে না

হঠাৎ করে এক কোনায় জ্বলে উঠলো একটা মোমবাতি
তারপর আরেকটা
তারপর আরো

প্রতিটা ইটে একেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো কেউ একজন

কাছে গিয়ে দেখা গেলো হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে দর্পণের এজাজ আলম

০২

মাঝরাত
মোমবাতি নিভে গেছে
এক কোণায় একটা গুমরে কান্নার আওয়াজ
কে?
কথাকলির এফ
হেরোইন আক্রান্ত হবার পরে যে বলেছিল যেদিন ছাড়তে পারবে সেদিনই ফিরবে আবার নাটক
আর নাটকের জন্যই ছাড়ার চেষ্টা করছে সে
সে কাঁদছে

তার আর ফেরার কোনো জায়গা রইল না

০৩

রাত আরো গভীর

হঠাৎ একটা আধাভাঙা সিনিয়র মাতাল গলা
একজন মানুষকে টানতে টানতে নিয়ে আসছেন ভাঙা ইটে- দ্যাখেন স্যার আমাদের কইলজা দেখেন। আমাদের মাথার খুলিগুলো দেখেন

যাকে টেনে আনা হয়েছিল তিনি তখন পৌরপিতা। এখন মেয়র। মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন এক নাট্যকর্মী

এই সবই প্রান্তিক...

জেবতিক রাজিব হক [অতিথি] এর ছবি

নাটক হলো, কবিতা হলো, আড্ডা হলো, বন্ধু হলো, গুল্লি হলো, মাল হলো, কুলখানি হলো... কতো কতো হলোরে!

অনে...ক দিন পর 'গুল্লি আর মাল-এর উদাহরণ সহ সংজ্ঞা এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ' মনে পড়ে গেলো। তোর মনে আছে দোস্ত?

নজমুল আলবাব এর ছবি

দেঁতো হাসি
মনে থাকবে না মানে? এইসব সজ্ঞা, উদাহরণ এবং উভয়ের মাঝে পার্থক্য নিরুপণে কি আমি, তুই ছিলাম না?

মনে পড়ে, সবকিছুই মনে পড়ে। এসবকি ভুলা যায়?

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

স্কুলে ছুটিছাটা বেশি থাকে বোধহয়, নাকি একই থাকে, শুধু তখন এক দুদিনের জন্য ছুটে আসা যেত। কিন্তু এখন ব্যস্ততা এতো যে ক্লাস ছুটি ব্যস্ততা কমায় না এতটুকু। তাই দীর্ঘ ছুটি ছাড়া আর আসতে পারিনা সিলেটে।

১৬ই ডিসেম্বর, ২১শে ফেব্রুয়ারী- দিনগুলো তখন প্রায়ই সিলেটে কাটতো। প্রান্তিকের সাথে পরিচয় তখনই।
বিশেষ অনুষ্ঠানে শিশু শিল্পীর প্রয়োজনে প্রান্তিকের সাথে পারিবারিক সংশ্লিষ্টতাসূত্রে ডাক পড়তো।
শৈশব আর সদ্য কৈশোরে পা দেয়া কিছু ছোট ছোট মুখ গোল হয়ে বসে কবিতা আবৃত্তি করতাম। জীবনের প্রথম বেতার নাটকের রিহার্সেল প্রান্তিকে বসে করেছি, সিলেট বেতারের এক শিশু-কিশোরভিত্তিক নাটিকার জন্য।

ভাবছি, আবেগমাখা এ লেখার শক্তিইবা কম কিসে।
“‘কথাকলি” পা দিতে চলেছে ২৫ বছরে, জানাই অভিনন্দন।
আপনাদের এই পথ চলায় রইলো শুভ কামনা হাসি

-------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

নজমুল আলবাব এর ছবি

প্রান্তিক চত্বর আসলে সবাইকে খুব সহজে আপন করে নিতো। যে কেউ মিশে যেতে পারতো এর ঘাস মাটির সাথে। প্রান্তিকে যারা আসতো তাদের সবারই পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতো এর সাথে।

শুভকামনার জন্যে ধন্যবাদ মউ।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

মুস্তাফিজ এর ছবি

সময়ে সবই বদলায়।
.........................................
I think what I think because that's how I am. You think what you think because that's how you are.

...........................
Every Picture Tells a Story

নজমুল আলবাব এর ছবি

সময়ে সবই বদলায়। কিন্তু জোর করে বদলে দেয়াটা মানা যায় না বড়ভাই।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লেখা নিয়ে কিছু বলবো না বাউল।

একটা আইডিয়ার কথা মাথায় এলো। নাট্যায়তন বলে একটা জিনিষ হলে কেমন হয়? ধরেন বছরে একটা বা দুইটা নাটক করবে এর কলাকুশলীরা। গাইড হাউস বা মহিলা সমিতিতে, বা অন্য কোনো উন্মুক্ত স্থানে। সব কুশীলবই তো আছে আমাদের, তাহলে কেনো কেবলই পেছনের সময়ের জাবরকাটা! কেনো সেই সময়টাকে সামনে এনে ধরা যাবে না!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

আপনার আইডিয়া ভালো। কিন্তু একটা সমস্যা আছে। যদি নাটকই করতে হয় তাহলে কেন নিজের দলেই নাটক করছি না? নাটক করার জন্য অন্য কোথাও কেন যাবো?

নজমুল আলবাব এর ছবি

শান্ত বলে দিয়েছে।
আসলে কনসেপ্টটাই অন্যরকম।
এই যে আমি এখন খুব বিজি নাটক নিয়ে। আমরা ২৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করতে যাচ্ছি। এইসব কাজে শান্তও অংশ নেবে। অংশ নেবে কি? সে কিংবা তার মতো আমাদের আরো অনেক বন্ধু যারা অন্য গ্রুপে কাজ করে, তারা না থাকলে উৎসব করাই কষ্টকর হয়ে যাবে।
এই যে সম্পর্ক আমাদের, এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপ মিশে যায়, এসবই হয়েছে প্রান্তিক চত্বরের জন্যে। এই চত্বরটা আমাদের একি সূত্রে বেঁধে দিয়েছিলো। তাই গত নয় বছরে জন্ম নেয়া গ্রুপ এর সাথে আমাদের বা তাদের ভেতরের সম্পর্ক আর প্রান্তিক থাকা অবস্থায় গড়ে উঠা গ্রুপের আন্তঃসম্পর্ক এক রকম না। আমাদের মাঝে যে রকম একাট্টাভাব আছে, আছে সহমর্মিতা তা এখনকার গ্রুপ কিঙবা আমার বা শান্তর গ্রুপে আসা নতুন ছেলেটার মাঝেই নাই। প্রান্তিক চত্বর নিয়ে তাই এতো হা হুতাশ আমাদের। আসলে আমাদেরকে একেকজন নাটকের মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে গ্রুপ যতটা কাজ করেছে তার চে কোন অংশে কম খাটনি ছিলো না প্রান্তিক চত্বরের।
প্রান্তিক নিয়া এজন্যই এতো বেদনাবোধ। এতো কান্না।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।

নজমুল আলবাব এর ছবি

ধন্যবাদ, নাম না জানা অতিথিকে।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

হাসিব এর ছবি

বাঙালির সংগঠন টিকে না কেন ?

নজমুল আলবাব এর ছবি

প্রান্তি টিকে ছিলো। দুই দশক টিকে ছিলো। তারপর তারে বাইরের মানুষ ভেঙে দিয়েছে। এখানে রাজনীতির দোষ হাসিব ভাই। মহান চারদলীয় শাসনের প্রথম ছোবল ছিলো এটি।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

হিমু এর ছবি

নাটোরের লাঠি-বাঁশি সমিতির কথা মনে পড়ে গেলো। চারদলীয় জোটের এম্পি দুলু ক্ষমতায় যাবার সাথে সাথে এই কার্যকর সংগঠনটিকে বলাৎকার করে হত্যা করেছিলো।

আরো পেছনের দিকে তাকালে এদের চেহারা স্পষ্ট হয়, বোঝা যায় এরা কোন বাপের গোয়া দিয়ে বের হয়েছে। আইয়ুব চেষ্টা করেছে, ইয়াহিয়াও। পারেনি।

এই পোস্ট আরো গুছিয়ে, আরো তথ্য দিয়ে, সম্ভব হলে আরেকটু কম আবেগ দিয়ে লিখে রেখে যাওয়া দরকার নজমুল আলবাবের ছেলের জন্যে। সে তার পিতার সঙ্ঘপ্রীতির কথা জানবে, পরাজয়ের কথা জানবে, হি উইল নেইম হিমসেল্ফ আউরেলিয়ানো, অ্যান্ড হি উইল উইন থার্টি টু ওয়ারস।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

রানা মেহের এর ছবি

প্রান্তিক একটা কষ্টের নাম অপু

যেদিন ভাঙা হলো প্রান্তিক
আমি বিশ্বাস করিনি
এখনো করিনা

দেশ বলতে যে কয়টা জিনিস মনে আসে
প্রান্তিক তার একটা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নজমুল আলবাব এর ছবি

তুইতো বাইরে তাই দেশ ভাবলে প্রান্তিকের কথা মনে আসে। আমি এই শহরেই থাকি। সকাল বিকাল বদলে যাওয়া প্রান্তিকের সামনে দিয়ে যাই। তবু পুরনো সেই টানটা এখনো রয়ে গেছে। এখনও আমার কাছে এই শহর মানে প্রান্তিক চত্বর।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

প্রান্তিকের কথা এতো শুনেছি। এর সাথে আপনাদের এই ভীষণভাবে জড়িয়ে থাকাটা অদ্ভুত এক ধরণের ভালোলাগার জন্ম দেয়। সেইসাথে আরো কিছু... বোঝাতে পারবো না ঠিক কিরকম ফিলিংস... মনে হয় আমিও কি ছিলাম কখনো কোনোভাবে...?
ওইখানে...

...........................

কেউ আমাকে সরল পেয়ে বানিয়ে গেছে জটিল মানুষ

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নজমুল আলবাব এর ছবি

প্রান্তিকের লোকজনের সাথে যারই পরিচয় হয়, তাকেই এই না জানা চত্বরটার বিষয়ে নানান গল্প শুনতে হয়। আপনার মতো দু'একজনের হয়তো ভালো লাগে। বাকিরা যে বিরক্ত হয়, সেটাও বুঝে না এই পাগলেরা।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

একুশ তাপাদার [অতিথি] এর ছবি

প্রান্তিক ভেঙ্গে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে আমি সেখানে গিয়েছিলাম.....তাই প্রান্তিকের মজা উপভোগ করার আগেই ভাঙ্গনের আর্তনাদ শুনেছি সিনিয়রদের কাছে , প্রান্তিকের প্রেম না পেলেও বিরহ পেয়ে গেলাম!!!

দারুন লেখা অপু ভাই!

নাহিদ পারভেজ এর ছবি

প্রান্তিকটা অক্ষত থাকলে বর্তমান জীবনটা এত ভারী হতনা নিশ্চিত...
এখন ফেসবুক এ জিংগা পোকার এর জুয়া একমাত্র বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছি...
প্রত্যেকটা অলস সময় অর্থহীন, শুধুমাত্র প্রান্তিকটা না থাকায়...
আমি সব সুকুমারবৃত্তি থেকে ছুটি নিয়েছি দীর্ঘদিন এর জন্য । বড় খারাপ লাগে এখনকার সময়টার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা টাকে..এর থেকে এই ভাল পালিয়ে থাকা..
থিয়েটার এর কাজ করার চেয়ে বেশীরভাগ মানুষের বড় কথা বলাটাই জরুরী মনে হয় ।
এর থেকে এই পালিয়ে থাকাই ভাল...
শুধু শুধু কেন এই লেখা টা লিখলা অপু ভাই? আমি সজ্ঞানে এসব থেকে দুরে থাকতে চাই।
তুমিও টাকা পয়সা কামাও..লেখ..যা খুশী কর । বাবাইরে নিয়ে ঘুরতে যাও..
জীবন থেকে আর সবার মত স্ফূর্তি নেওয়া শুরু কর ।
প্রান্তিক ,অডিটরিয়াম,পঙ্খী ভাই,সম্মিলিত,আমাদের একেক জনের গ্রুপ ..ওয়েবসাইট,বারান্দা,স্বপনদার স্মৃতি,মনুর হাসি,সেট ,লাইট..সব ছুড়ে ফেলে দাও..
ওরা পারলে,আমরা গুটিকয় পারবো না কেন?
নাটক আর সংগঠন এসব কথা শুনলে এখন ভয় লাগে..আর কাপুরুষ এর মত কথায় মাত হতে,আর একা একা ঘরে বসে কাঁদতে ভাল লাগে না ।

নজমুল আলবাব এর ছবি

পালিয়ে থাকা কোন সমাধান নয় বাবু। ওঠো।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

আল আমিন এর ছবি

লীলেন ভাই ফেসবুকে লেখাটার লিংক দেওয়াতে পড়তে পারলাম, ধন্যবাদ লীলেন ভাই।

প্রান্তিক সরাসরি আমার কেউ না, আমি প্রান্তিকের কেউ এক জনের কেউ। সেই কেউ একজন 'শিপন' আমার বড় ভাই। আমি থাকি গ্রামের বাড়ীতে আর ভাইয়াকে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি করে দিলেন সিলেট শহরের এক কলেজে। ভাইয়া পড়তে পড়তে-পড়তে থাকতে থাকতে হয়ে গেলো কথাকলি আর প্রান্তিকের একজন।

আমরা গোপন সূত্রে খবর পেলাম ভাইয়া সিলেটে একটা পরিবার পাকিয়ে ফেলেছে, আমি তখন ছোট, আমি ভাইয়ার সাত বছরের ছোট, এতো কিছু বুঝিনা, শুধু শুনি ভাইয়া এবার বাড়ীতে এলে ঠেলা বুঝবে। ভাইয়া নাকি যাত্রাপালার মতো কী একটা করে। আমি ভাবলাম বাবাওতো এই বয়সে এই লাইনেরই ছিলেন, ভাইয়াকে ঠেলা দিবেন কেনো? সব খুঁজ খবর নিয়ে বাবা ভাইয়ার পরিবারটাকে মেনে নিলেন। ভাইয়ার প্রান্তিক পরিবার।

আমাকে মাঝে মাঝে শহরে আসতে হতো, প্রথম প্রথম ভাইয়ার বাসায় গিয়ে উঠলেও পরে গিয়ে প্রান্তিকেই উঠতাম প্রথমে, না পেলে যেতাম বাসায়, প্রথম দিন প্রান্তিকে যাবার পর ভাইয়া আমার বন্ধকে সহ একটি ঘরে নিয়ে বসালেন, অনেক লোক, একজন বসে আছে ঢুলের উপর, উনাকে(বাবুভাই)দেখতে একটু ভয়ংকর ঠেকেছিলো! তো আরেকজন এভাবে, আরেকজন সেভাবে, ছোট বড়ো মাঝারি সব সাইজের লোকই আছে।
পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে, তখন পরিচয় হলেও পরে আবার একজন একজন করে সবাইকে ছিনতে হয়েছে, হঠাৎ দেখি ভাইয়া কী যেন একটা বলতে বলতে দাঁড়িয়ে গিয়ে আরো কিছু বলতে লাগলেন,পরে বুঝলাম ওটা ছিল নাটকের সংলাপ। বের হলাম চা খেলাম, অন্যান্ন গ্রুপের ভাইদের সাথেও পরিচয় হলো। আমরা একটু অবাকও হয়েছিলাম অণ্য গ্রুপের ছেলেদের সাথে উনাদের এতো খাতির দেখে। আমরা বাড়ীতে আসার পর এ নিয়ে অনেক দিন গল্পো চলেছিলো। চলছে ভাইয়ার কথাকলি প্রান্তিকে।

আমি শহরে আসলাম লেখাপড়া করতে। ভাইয়ার সাথে থাকি, ভাইয়াকে আর আগের মতো লাগেনা। বেশকিছু দিন থেকে লক্ষ করছি ভাইয়া কেমন যেনো মনমরা হয়ে গেছে, ব্যাপার কী? কোনো পার্সোনাল মেটার? চেহারাটা সেরকমও না। নাকি ঘরের বড়ো ছেলে পরিবারের ভবিষ্যত চিন্তা করছে? একদিন সকালে বেরহয়ে যাবার সময় আমাকে বললো আলামিন একটা বিজনেস করতে যাচ্ছি, আমি ভাবলাম বিজনেস কেনো? বিজনেস করারতো দরকার নাই? ভাই বললো আরে না আমরা কয়েকজন মিলে একটা ডিজাইনিং ফার্ম করেছি, আর বললেন উনারা নাকি সময় কাটানোর জন্য 'সময়' নামের প্রতিষ্টানটি গড়েছেন।
আমি বললাম প্রান্তিকে যাওনা? ভাইয়া বলে প্রান্তিক নেই। নেই মানে? ওরা ভেংগে দিয়েছে। মাটির দিকে তাকিয়ে ভাইয়া যখন কথাটা বলতে বলতে নিজেকে সামলাতে সামলাতে রওয়ানা দিলো, তখন আমি দেখলাম তাঁর মাঝে আরেক পরিবার নেই হবার বেদনার যন্ত্রনা।

ভাইয়া এখন দেশে নেই,......রনিভাই লন্ডনে গেলে উনার সাথে নাটকের মিটিং করে। ইংল্যান্ড বসে বসে ফেস বুকে কথাকলি গ্রুপ বানায়, আমাকে আমন্ত্রন জানায়, আমিও গ্রহন করি।

আমার ছোট ভাই, নয়ন। প্রান্তিকের ইতিহাস জানতে চেয়ে বলতো, ভাইয়ার বন্ধুরা সেখানে কী এমন করতো, যে প্রান্তিকে জন্য এতো হা হুতাস? আমিওতো জানিনা। তার আগ্রহ দেখে ভাইয়া বলল ওকে কথাকলিতে দিয়েদিতে, দিয়ে দিলাম।

ষ্টেডিয়াম মার্কেটে আমাকে যেতে হয় মাসে অন্তত এক সপ্তাহ। ডাক্তার বাজার এই মার্কেটেই। আত্মিয় প্লাস আমার ঘরের রুগী। ওখানেই ছিলো প্রান্তিক।

মার্কেটে ঢুকতেই সুউচ্চ ফ্লাড লাইটের পাশাপাশি যে জিনিসটা বেশি চোখে পড়ে সেটা ভেংগে দেওয়া প্রান্তিক চত্বরের বর্তমান স্থান। আর ডাক্তারের লিষ্টে আমার সিরিয়াল আসার আগ পর্যন্ত ঠাহর করতে থাকি ঠিক কোথায় ছিলো প্রান্তিক, আর কোন পজিশনে ছিলো প্রান্তিকের সেই ঘর। পারিনা।

প্রান্তিকের কাউকে জিগ্গেস করলে হয়তো বলে দিতে পারবে,ওখানে ছিলো স্বপনের চায়ের দোকান... ওখানে ছিলো ঘর..আর ওখানে ছিলো প্রন্তিকের পূর্বের খুঁটি..... আর ওখানে ছিলো পস্চিমের খুঁটি.....

-ধন্যবাদ অপুভাই

আল আমিন

নজমুল আলবাব এর ছবি

এই লেখাটা এতো ভারি ভারি কমেন্ট এ পূর্ণ হলো। আমি সম্ভবত এটা আর পড়তে আসবো না। অথবা বার বার পড়বো।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

তুমি এই লেখাটা বারবারই পড়বে। পড়বেই পড়বে। আমি নিজেই এই লেখাটায় কয়েকদিন পর পরই আসি, দেখি নতুন কেউ কোন মন্তব্য করলো কি না? আল-আমীন ভাইয়ের লেখাটা পড়ে চোখে পানি আটকাতে পারলাম না।

প্রিয়ক এর ছবি

আমার সব গল্পের শুরু প্রান্তিকে
আমার সব সুখ স্মৃতি প্রান্তিক কে নিয়ে
আমার ভালোলাগা, ভালোবাসার পাঠশালা প্রান্তিক
আমার অভিমান আর আশ্রয় প্রান্তিক

প্রান্তিকে আমি পেয়েছি বন্ধু স্বজন
প্রান্তিক আমাকে শিখিয়েছে প্রতিবাদ
আমার এই আমি সবই প্রান্তিকের

নিজের বাবার মৃত্যু শয্যায় পাশে থাকতে পারিনি, যদিও প্রান্তিক খুন হয়েছে আমার সামনে।
মানুষ খুন করলে নাকি সাজা হয়, তবে এতো মানুষের স্বত্তাকে, আনন্দকে, শিক্ষককে, প্রতিষ্ঠানকে যে বা যারা খুন করলো তাদের তো কিছুই হলো না। কিছুই হবেওনা। প্রান্তিক আমাকে অনেক শিখিয়েছে কিন্তু প্রান্তিক এর মৃত্যু আমাকে শিখিয়েছে তার চেয়ে বেশী। সে সত্য হলো_
''আত্মার বন্ধন যতই শক্ত হোক সে শুধ্ই কাদঁতে পারে, পারে না অস্তিত্বের লড়াইয়ে বিজয়ী করতে।''

প্রান্তিকের সকল বন্ধুরা ভালো থেকো।
আপনারে আমি খুজিঁয়া বেড়াই.....

আপনারে আমি খুজিঁয়া বেড়াই.....

নজমুল আলবাব এর ছবি

শুভকামনাটুকু নিলাম

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

শুভপ্রসাদ এর ছবি

আমি কি প্রান্তিকের কেউ? হয়তো না। প্রান্তিক যে শহরের যে দেশের আমি সেই দেশের বাসিন্দা না। প্রান্তিক ভেঙে পড়লে আমার কথা কারো মনে পড়বে না। প্রান্তিক নিয়ে এত কথা এত কাঁদা এত হাসির মধ্যে আমার এইটুকুও ঠাঁই নেই। কারণ, আমি প্রান্তিকের কেউ না। গত দশ বছরে বারো তেরোবার দিন কয়েকের জন্যে সিলেটে যাওয়ার সূত্রে প্রান্তিককে ছুঁয়ে গিয়েছি মাত্র। তার ভেতরমহলের একজন হওয়া কি এত সোজা? আমি তো ছিলাম এক বিদেশি রাষ্ট্রের পর্যটক মাত্র। তবু আজ এই লিখন আমার চোখের পাতা ভিজিয়ে দিল কেন? কেন লীলেনের অমোঘ পংক্তিগুলি আমার ভেতর-প্রদেশে এক অঝোর ঝরণ বইয়ে দিল? বারবারই মনে হয় আমি তো কেউ না? এই মনে হতে হতেই আবার মনে হয় সত্যিই কি কেউ নই? যে সন্ধ্যার স্মৃতি আমার জন্মকে সার্থক করে দিয়েছে সে তো সত্য হয়েছিল প্রান্তিকের ওই অপরিসর ঘরেই।

কী ছিল বাংলাদেশ বা সিলেট আমার কাছে? আমার মা বাবার ফেলে আসা ভিটে বাড়ি। যাকে তাঁরা ফেলে এসেছিল পঞ্চাশ বছর আগেই। তো, যাকে ফেলেই এলে তাকে ঘিরে আবার অতো হাহুতাশ কিসের? হায়, জীবন যদি এত সহজ অঙ্ক কষা হতো! ভিটেহারা জনগোষ্ঠীর সন্তান হিসাবে জন্ম থেকেই জানি, আমাদের কোনো ঘর নেই। জন্মেছিলাম মেঘালয়ের শিলং শহরে। সেখানে ছোটবেলা থেকেই দেখতাম মাঝে মাঝে কোন রাতে বাবা বাড়ি ফিরে বলত, কাল অফিস যাওয়া ঠিক হবে না। কাল হিল স্টেট। অনেক বড় হয়ে জেনেছি, ওটা ছিল স্বতন্ত্র পার্বত্য রাজ্যের দাবিতে হরতাল। আর কেন জানি, যে কোনও দাবিতে হরতাল হলেই শিলং-এ বঙ্গভাষী মানুষ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ওপার বাংলা থেকে ভিটে হারিয়ে আসা মানুষ, তাদেরকে শিকার বানিয়ে হাতের সুখ করত সেখানকার পাহাড়ি মানুষেরা। আমাদের বাড়িওয়ালা অসমীয়া ছেলে ভাইটি, অমলিন শৈশবের সরলতায় উল্লাসের অভিব্যক্তিতে বলত কিভাবে বঙ্গাল খেদার সময় রাস্তায় দেখেছে বাঙালিদের ধরে ধরে মারতে। ওর ভাষায় রিফুউজি, ভগনিয়া। সে কি জানত তার বন্ধুটি যে ভগনিয়ারই গোষ্ঠীভুক্ত। বড় হয়েও ভোটার লিস্টে নাম তুলতে গিয়ে বারবার বিপত্তি। শিলং-এ জন্ম হলেও আমার রাজ্যের এক বড় অংশের কাছে আমাদের পরিচয়, বাংলাদেশি।

এ ভাবেই জেনেছি, আমাদের আসলে কোনও ঘর নেই। ভিটে নেই। প্যালেস্তাইনের ভেসে বেড়ানো মানুষের মতো আমরাও ভাসমান জনসম্প্রদায়। নিরাপত্তার খোঁজে কখনো শিলং, কখনো গুয়াহাটি, কখনো শিলচর, কখনো কলকাতায় তাঁবু খাটাই মাত্র। আমাদের ঘর হতে নেই। তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা, কখন আবার খুঁজতে হয় নিরাপদ আশ্রয়। এভাবেই কখনো দিল্লি, কখনো মুম্বই, কখনো শিলিগুড়ি, আমরা তাঁবু ফেলি মাত্র। আমাদের জন্ম বাবা মায়ের প্রজন্মের লালন করা স্মৃতিতে, আমাদের বেড়ে ওঠা হারিয়ে যেতে বসা সেই স্মৃতিকে প্রজন্মের প্রজন্মের পর ধারন করে রাখার মধ্যেই। জন্ম থেকেই আমি সিলেটকে চিনি। আমার মত আরো কেউ কেউ চেনে ঢাকাকে, কেউ চেনে চট্টগ্রামকে। হয়তো কেউ চেনে বীরভূম-মুর্শিদাবাদকে, কেউ চেনে লখনউ, কেউ চেনে লাহোরকে। কিন্তু কেউই দেখে না। মায়ের কথায় বাবার উদাস খেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিচারণেই আমাদের ভিটে আমাদের মাটি। স্বপ্নে আমি সিলেট দেখতাম, স্বপ্নেই ছিল আমার আসা যাওয়া। আমি যেন ভাবতাম ওই ভূখণ্ডের কোনও বর্তমান নেই, ওই উপভাষার কোনও বর্তমান নেই। শুধু অতীতই। সেজন্যেই ছোটবেলা থেকে কখনো শুনিনি, বাড়ি কই, শুনেছি কোথায় ছিল বাড়ি? আমার বাবার বিশুদ্ধ হবিগঞ্জী উচ্চারণে যে কোনও অতিথি এলেই প্রশ্ন, বাড়ি আছিল কই, সতত বাজে কানে।

এপারে গুজরাল ওপারে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কুশিয়ারার দু’পারে আসা যাওয়া সহজ হল। এর আগে সিলেট ছিল লণ্ডনের চেয়েও দূরে, লাতিন আমেরিকার চেয়েও দূরে। আমাদের জীবন-মৃত্যুর দূরত্ব ছাড়িয়ে অতীতের কোনও স্মৃতিতে। ওই সুদূর থেকে কাছে চলে এল, দু’পারের খেলাধূলার মানুষ, নাটক গানবাজনার মানুষদের সুবাদে। হৃদয়ে হৃদয় যোগ করার সেই সূত্রেই নিরানব্বুইয়ে গেলাম আমার মধ্যরাতের ঘুমের দেশে এতদিন ঘুমিয়ে থাকা সিলেট শহরে। তখনই প্রান্তিক। যেন ওখানে যাওয়াটা পূর্ব-লিখিতই ছিল। আমার পিতৃমাতৃ প্রজন্মের স্মৃতি সিলেটের সাথে প্রাণময় বর্তমান সিলেটের এক ঐতিহাসিক সেতু যেন রচিত হল প্রান্তিকের অপরিসর ঘরের উদার আয়োজনে। গান অনেক গেয়েছি, আগে কিংবা পরে। কিন্তু গান কখনো আমাকে ভাসায় নি, আমি কখনো ভাসাতে পারি নি আমার গানে মানুষকে। কিন্তু সেদিন হয়েছিল। গান গাইতে গাইতে মৃত বাবা দাদু ঠাকুমাকে যেন চোখের সামনে আবিষ্কার করলাম। তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন অতীতের বয়স নিয়ে বর্তমান সিলেটের রাজপথ আর গলি দিয়ে। সন্ধ্যার অন্ধকারে লামা বাজারের বাড়িতে বসে আমার ঠাম্মা কাঁথা সেলাই করছে, দেখলাম। লন্ঠনের আলোয় পড়ছে আমার মা, এম সি কলেজের ছাত্রী মীরা বাজারের বাড়িতে। আমি ওসব কিছুই দেখি নি কখনো। শুধু শুনেছি। শুনে শুনেই স্মৃতিতে বাসা বেঁধেছিল যারা, তারাই যেন চলচ্ছবি হয়ে নেমে এলো চোখের সামনে প্রান্তিকের ওই ছোট্ট ঘরে।

ওই সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট আর আমার কাছে বিদেশ থাকে নি। স্বদেশ-ই বা হয় কি করে। স্বদেশ বিদেশের মধ্যবর্তী এক জাদু যেন, সিলেটের উপভাষায় একেই বোধহয় বলে, মায়া। সিলেটি মা যখন কোনও শিশুকে দেখলে বলেন, পুয়া ইগুরে দেখলে মায়া হয়। এই মায়ার কি কোনও অনুবাদ হয়। সেই মায়াই, আমার কাছে সিলেট, প্রান্তিক, পংকীভাইয়ের চায়ের দোকান, বাবু লীলেন টুকু হান্নানভাই বান্না ভাই রাণাদা হিমাংশুদা ফুয়াদ জুয়েল জাকির অসংখ্য অসংখ্য মানুষ, ওই নদী ওই পথ ওই বাতাস ওই গন্ধ ওই স্পর্শ- আমার কাছে বিদেশ নয়। দেশ বলারও যে স্পর্ধা নেই, আমি যে পালিয়ে যাওয়া বাবা মায়ের উত্তরপুরুষ। দেশ নয়, বিদেশ নয়, আমার কাছে তা মায়া। যে মায়া অশ্বত্থ বটের ছায়ার মত শীতল, বন্ধুর ঘাড়ের গামছায় যার সুবাস, চোখের জলে যার বাস্তুভিটে, সিলেট প্রান্তিক ওখানকার মানুষ জল বাতাস আমার কাছে মায়া, মায়া।!

এ কার কথা বললাম? প্রান্তিকের? নাকি প্রান্তিকের দোহাই দিয়ে দিয়ে নিজের? নাকি অর্থহীন কতগুলি কথা অযথা কতগুলি সময় নষ্ট করে বাতাসে ভেসে গেল অর্থহীন!!

নজমুল আলবাব এর ছবি

দাদা,
ঝিম মেরে আছি। ভালো থাকবেন দাদা।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।