একজন গণিকার সাক্ষাৎকার

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফুল আরেফীন (তারিখ: শুক্র, ০৪/০১/২০০৮ - ৩:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

- কেমন আছেন আপনি?
- যেমন দেখছেন। বেঁচে আছি, কিন্তু নিঃশ্বাস চলে না!
আমি শেফালীর গায়ে জড়ানো শতেক তার আর যন্ত্রপাতির জঞ্জাল এড়িয়ে তার চোখে চোখ রাখলাম। নিঃশ্বাস যে চলে না, সেটার আক্ষরিক অর্থটা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। একো-কার্ডিওগ্রাম মেশিনের মনিটরে বিরামহীন ধূঁকতে থাকা জীবনের গ্রাফ এঁকে চলেছে একটা যন্ত্র। পুলিশী হেফাজতের নিয়মানুসারে একজন নিরাপত্তা প্রহরী পাশে দাঁড়িয়ে। আরেকজন ডাক্তারও আছেন। নিশ্চিত করছেন যে আমি যেন কোনওভাবেই রোগীকে বেশী বিরক্ত না করি। নোটবইটার ওপর কলমটা আলতোভাবে ছুঁইয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
- এখন কি একটু ভালো বোধ করছেন না?
- জানি না।
- কি হয়েছিল এবারে? বলা যাবে একটু সংক্ষেপ করে?
- প্রত্যেকবার যা হয়।
- কাউকে চিনতে পেরেছেন?
- সবাই তো চেনা! তবে এবারে ওরাও ছিল।
- ওরা কারা? পাবনার … ?
- হ্যা। ওরাও ছিল।
শেফালী মূক কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। যন্ত্রপাতির শাসন এড়িয়ে ঠিকমতোন মাথা তুলতে পারে না, কিন্তু শোয়া অবস্থায় তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি তাঁকে একটু সময় দেই ধাতস্ত হতে।
অনেক আগে একবার এভাবেই দূর্বৃত্তদের লোলুপতার স্বীকার হয় মেয়েটি । সেবারে পুলিশের সহায়তায় একদল লোক রক্ষা করে তাকে। সেই বন্দীদশায় বহুবার ধর্ষিতা হয়েছে সে। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবন শুরু করে শেফালী। ভুলতে চেষ্টা করে অতীতকে। কিন্তু দারিদ্র্য চিরসাথী হয় শেফালীর। পুলিশের বরকর্তারা মাঝে মাঝে অযাচিতভাবে তাকে দেখভালের দায় নেয়। শেফালি বোঝে এটা দেখভাল নয়। তাদের মতিগতি আসলে ভালো ঠেকে না তার কাছে। সবাই লোভী। শেফালী আবার নিজে থেকেই মুখ খোলে।
- সেবার ওরা সবাই ধরা পরলো। কিন্তু বিচার হলো না।
- (বুঝলাম, শেফালী ১ম বারের কথা বলছে) কেন?
- বাবা ওদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে গেলেন না। মাফ করে দিলেন। কিন্তু এলাকায় নিষিদ্ধ করা হয় ওদেরকে।
- এতো কিছুর পরেও ক্ষমা!?
- হ্যা। আমি যে বেঁচে ফিরবো এটা অনেকেই আশা করেনি। আমাকে ফিরে পেয়েই উনি খুশী ছিলেন। খুশীর সময় মানুষ কতো কি করে!
- আপনিও ক্ষমা করলেন?!
(শেফালি হাসে, উত্তর দেয় না)
- আমি তখন অনেক বিখ্যাত। গণধর্ষিতা নারীর গল্প সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়।
- আচ্ছা।
- বাবার মৃত্যুর পরে আমার দায়িত্ব নিল পুলিশ।
- কেন? আর কেউ ছিল না আপনার?
- ছিল। কিন্তু পুলিশ আগ বাড়ায়ে আসলো। ঐ যে লোভের কথা বললাম না?
- হুমম।
- কিন্তু পুলিশের বরকর্তা এসেই ওদের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিলেন। ওরা আবার এলাকায় ঘুরাঘুরি করা শুরু করলো।
- বলেন কি?! সেই ধর্ষকরা?
- হ্যা। আমি ভয় পেয়ে এলাকা ছেড়ে যাবার পরিকল্পনা করলাম। পালাতে পারলাম না। একসময় পুলিশের বরকর্তা নিহত হলেন। হত্যাকান্ড। নতুন কর্তা এলেন। আমাকে আবারও নিরাপত্তা হেফাজতে ঢুকানো হলো।
- কেন?
- আমি একা। উপরন্তু চারপাশের মানুষগুলো সব ছোঁক ছোঁক করে। পুলিশ তো বারবার সুযোগ নিয়েছে। আমার রুপ-যৌবনই আমার শত্রু হয়েছে !!
- হুমম।
- আমি আবারও নিরাপত্তা হেফাজত থেকে পালাই। এই হেফাজত আমার পছন্দ ছিল না।
- কিভাবে পালালেন?
- আমাকে সাহায্য করেছিল কিছু নিকটজন আর সেই নিহত বড়কর্তার স্ত্রী।
এতোটুকুন বলে শেফালী হাঁপায়। ডাক্তার এসে আমাকে সতর্ক করে দেয়। কথা শেষ করার ইঙ্গিত করে। আমি আরেকটু সময়ের জন্য অনুণয় করি। শেফালী একটু বিরাম নিয়ে বলতে শুরু করে,
- ৯১ সালের কথা। লোকজন দেখেশুনে আমাকে তুলে দেয় ঐ বিধবা মহিলার কাছে।
- বড়কর্তার স্ত্রী?
- হ্যা।
- তারপর?
- আমাকে দেখিয়ে N.G.O. গুলোর কাছ থেকে টাকা তুলতে লাগলো সেই মহিলা।
- বেশ…তারপর?
- আমি গেরস্থ থেকে বাঁদি হলাম। গণিকালয়ের বাঁদি। আমাকে ঐ মহিলা ব্যবসায় খাটালেন।
- হুমম, কিন্তু টাকাগুলো?
- রংমহলের মৌমাছিদের পেছনে খরচা হলো।
- আপনি কি করলেন? আবার পালালেন?
- হ্যা। তবে টাকার জন্য পালাই নি। পালালাম অন্য কারণে…
- কি কারণ?
- ঐ লোকগুলোকে আশপাশে ঘুড়াঘুড়ি করতে দেখে…
- কোন লোকগুলো? যারা আপনাকে …
- হ্যা। সবাই ক্ষমার যোগ্য নয়। ওরা তার প্রমাণ!
- পালিয়ে কোথায় গেলেন?
- এক আত্মীয়ার কাছে উঠলাম।
- এই আত্মীয়া এতোদিন কোথায় ছিল?
- কাছাকাছিই ছিল। কিন্তু বললাম না, সবাই সুযোগ খুঁজেছে। সুযোগটা পেতে তার সময় লেগেছে।
- তো সেখান থেকে কেন পালালেন?
- সেই তো বাঁদির জীবন। গণিকাবৃত্তি এখানেও আমার পেছন ছাড়লো না।
- সেখানেও?!
- হ্যা। এবারে ভেবেছিলাম, অন্ততঃ ধর্ষকদের বিচারের একটা ব্যবস্থা হবে।
- কাজ হলো?
- না। শুধু চিল্লাচিল্লি হলো। হৈ হল্লা হলো। কাজ হলো না। আমি ভোগের পণ্যই রয়ে গেলাম!!
- ওদেরকে খুঁজে পাওয়া গেল না? নাকি অন্য কিছু?
- খুঁজে পাওয়া গেল না মানে?!!! ওরা তো এলাকাতেই ঘোরে ফিরে। খায়-দায়। ব্যবসাও করে।
আঁকাবাকা অনেকগুলো তার শেফালীর দুর্বল হাত ২টো আস্টেপৃস্টে বেঁধে রেখেছে। নড়বার ক্ষমতা নেই। সেগুলোর প্রতি বিদ্রুপ হেনে আর্তনাদের মতোন করে উঠলো শেফালী। কিছুটা ভড়কে গেলাম! ডাক্তার খানিকটা সময়ের জন্য বিরক্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। বুঝতে পারলাম, এখানে থাকার মেয়াদ আমার দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তড়িঘড়ি জানতে চাইলাম,
- কিন্তু ওদের বিচারটা হলো না কেন?
- জানি না। পুরোনো সব দৃশ্যপটের পূণরাবৃত্তি! এক গণিকালয় থেকে আরেকটায়।
- আচ্ছা!
- বিরক্ত হয়ে আবার পথে নামলাম।
- পালালেন?!!
- কি আর করা? কিন্তু পালিয়ে বাঁচতে পারলাম না।
- লোকজন একা একটা মেয়ে মানুষকে বেশীদিন গার্জেন ছাড়া সহ্য করতে পারে না। আমাকে ঘুরে ফিরে আবার সেই বিধবা মহিলার হাতে সোপর্দ করা হলো।
- আবার?!! বলেন কি?
- হ্যা। এবারে অবস্থা আরোও শোচনীয় হবে আমি বুঝতে পারছিলাম পরিস্কার।
- কেন?
- কারণ, লোকমুখে শুনেছিলাম তাঁর রঙ্গশালায় নাকি এখন ওদেরও যাতায়াত নিয়মিত!
- মানে ঐ পাবনার শয়তানটা?!!!
- হ্যা। আর ওর চ্যালাচামুন্ডরা।
- ওহ্ !!! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? যারা আপনাকে … … তাদের হাতেই আপনাকে সোপর্দ করা হলো?!!
- আমার কিছুই করার ছিল না। আমি শুধু এটাই বুঝলাম যে, এখানে আমি কোনও ফ্যাক্টর নই। আমি শুধু হাতবদলের পুতুল।
- মানতে পারছি না!
- আমিও পারি না। আজ শুধু কাঁদি। কেঁদে লাভ নেই , তাও কাঁদি। প্রথমে লুটেরারা আমার ইজ্জত লুটেছে। এরপর পুলিশের হেফাজত। সেখান থেকে লোকজন আমাকে বারবার বেশ্যালয়ে পাঠিয়েছে। মক্ষীরাণীরা ক’বছরে আমাকে লুটে ছিবড়ে করে দিয়েছে বারবার!!
রোগিনী এবার অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো। ডাক্তার আমার দিকে আসতেই আমি বুঝলাম, আর হবে না। উঠে পড়লাম। নোটবইটা ব্যাগে ভরে নিয়ে দরোজার কাছাকাছি সরে আসলাম। ফটো সাংবাদিক ৩/৪ টা শট নেবার পরেই ডাক্তার ইঙ্গিতে বাইরে যেতে অনুরোধ করলো। ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকানীতে শেফালির শাড়িটা জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছিল বারবার। লাল পেড়ে এই সবুজ শাড়িটা পড়েই সে বহুবছর আগে পথে নেমে এসেছিল। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের নীচে কলমের মুন্ডু চেপে ধরে শেষবারের মতোন ডাক্তারকে ডিঙ্গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম শেফালীকে। ১টা মোটা সিরিঞ্জ নিয়ে ডাক্তার তার হাতের শিরা খুঁজছে। শেফালী ঘুমিয়ে পড়বে শিগ্গিরই।
[অনেক সাহস করে স্যাটায়ার লিখলাম। আদৌ কিছু হলো কি না সেটা জানানোর আবেদন রইলো। তবে আশা করছি সকলের ভালো লাগবে।]


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

লেখাটা ভালো লাগলো।
যদিও এই লেখার প্রেক্ষিত বা শানে নযুল না জানায় লেখকের স্যাটায়ার করার কারণ ধরতে পারছি না। ফলে মূল রসাস্বাদন বাদ দিয়ে লেখকের ইচ্ছাকে জানার আগ্রহ মাথাচাড়া দিতে থাকলো পুরো পাঠের সময় জুড়ে।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

লেখাটি যদি অতি জটিল হয় থাকে তাহলে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।আমি মূলত স্যাটায়ার ধর্মী লেখা কম লিখি। আপনাকে কতোগুলো শব্দার্থ দিয়ে সহায়তা করি,

শেফালী – বাংলাদেশ (১টা ধর্মনিরপেক্ষ নাম দিতে চেয়েছিমাত্র)
পুলিশ – সামরিক সরকার

এবারে আশা করি, পাবনার শয়তানকে আপনি চিনতে পারবেন! চিনতে পারবেন আরোও অনেককেই!

আমার কাঁচা হাতের পাকনামি পাঠক ক্ষমা করবে বলে আশা রাখি।

শেখ জলিল এর ছবি

গদ্যটা বেশ সাবলীল হয়েছে। গল্প হিসেবে পড়তে ভালো লাগছে। স্যাটায়ার হয়েছে কিনা মতামতে শোমচৌ-এর সাথে সুর মিলালাম।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সাবাস! শানে নুযুল'টা জানার পর সব ফকফকা! খুবই ভাল লাগলো।

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ভাইরে! আপনি আমারে উদ্ধার করলেন! আমার স্ত্রী এটা প্রথম পড়ে "কেউ বুঝবে না" বলে আমাকে হতাশার সাগরে ভাসালো। এরপর শোমচৌ সেটা সত্য বলে প্রমান করলেন। অগত্যা কিছু টিপস ছাড়তেই হলো।
আপনি আমাকে ভরাডুবি থেকে বাঁচালেন এ যাত্রা!
আপনারে লাল গোলাপের শুভেচ্ছা!!!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

লেখাটার যেকোন একটা তারিখ/বছর/বয়স দিয়ে দিতে পারেন। তাহলেই রেফারেন্সটা অনেক পরিষ্কার হবে। ব্যক্তিগত অভিমত।

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

শেফালী একটু বিরাম নিয়ে বলতে শুরু করে,
- ৯১ সালের কথা। লোকজন দেখেশুনে আমাকে তুলে দেয় ঐ বিধবা মহিলার কাছে।

আপনার ব্যক্তিগত অভিমত গ্রহন করা হইলো।

আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এইবার এক্কেবারে ফিলিপ্স বাত্তি!!

শ্যাজা এর ছবি

আবার পড়লাম।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ভালো করে বুঝতে, নাকি ভালো লাগাতে?

বেয়াদবি মাফ করবেন, প্রথমবার এটা অনেকেই বু্ঝতে ব্যর্থ হলে স্যাটায়ার লেখক হিসেবে আমার ব্যার্থতাটাই বেশী করে সামনে চলে আসে। হাসি
এরপর টুকটাক কারেকশন করেছি। ইশতিয়াকের মন্তব্য থেকে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছি।

আপনার ভালো লেগেছে কিনা সেটা তাই "আবার পড়লাম" থেকে বোঝা গেল না। মন খারাপ

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

অতিথি লেখক এর ছবি

মারাত্মক......
সচল নই তাই রেটিং দেবার ক্ষমতা নাই।
তাই আপনার জন্য ˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜˜***** (পাঁচটি তারা) দিলাম।
ভাল লাগল।
---------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

এতোদিন পরেও লেখাটা কেউ পড়ছে এবঙ মন্তব্যও করছেন, এটা লেখক হিসেবে আমার বড় পাওয়া।

ধন্যবাদ হাঁস-ভাই হাসি

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

তাহমিনা এর ছবি

প্রথমবারেই বু্ঝতে পারলাম আর ভাল লাগলো। সুন্দর লিখেচেন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
When I'm right nobody remembers; when I'm wrong nobody forgets!

When I'm right nobody remembers; when I'm wrong nobody forgets!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ তাহমিনা হাসি

নগন্য  এর ছবি

অসাধারণ একটা লেখা। আপ্নার সব লেখা পড়লাম। আরো লিখুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।