গন্দম | এগারো

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: সোম, ২৬/১১/২০০৭ - ৯:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০ অক্টোবর, ২০০৬
সময়: দুপুর ১:০০-২:৩০
বনানী বাজার মসজিদ, বনানী, ঢাকা

তমাল, ফয়সাল, রানা, নিপুন, রাজীব অনেক আগে থেকেই জুম্মাবারে বনানী বাজার মসজিদে একসাথে জুম্মার নামায পড়ে। অনেক আগে থেকেই এমনটা চলে আসছে।

রাজীব, তমাল, ফয়সাল ওদের বাবা-ভাইয়ের সাথে জুম্মা পড়তে আসতো এখানে। সময়ের সাথে সাথে ওদের মধ্যে অবশ্য কয়েকটা ভাগ হয়ে গেছে। এখন ওদের বাবারা বসেন এক সাথে। সজীব আর ফয়সালের বড় ভাই বসেন সমবয়সী বন্ধুদের সাথে। রাজীবরা সবাই অন্যদিকে। আরেক দিকে বসে নিপুনের ছোট ভাই, ওর স্কুলের বন্ধুদের সাথে।

জুম্মায় প্রথমদিকে নিয়মিত ছিল না রাজীব। ধর্ম-কর্মে ওর বাবা-মা-ভাইয়ের উদ্যমটা ওর মধ্যে প্রথম থেকেই কোনো এক অজানা কারণে অনুপস্থিত। এছাড়া পরিবারের ছোট বলে ওর প্রতি একটু ছাড় ছিল। পরে অবশ্য রাজীবও নিয়মিতই আসা শুরু করে। তবে সেটা আড্ডা আর চায়ের সাথে সিগারেটের লোভে!

শুক্রবারটা সপ্তাহের একটা মাত্র দিন যেদিন ওর পরিবারের সবাই বাসায় থাকেন। তাই বিকেলের আগে বাসা থেকে বের হওয়াটা ওর জন্য অসম্ভব। বাবা-মা পছন্দ করেন না। ভাইয়াও রাগ করেন।

সারাটা দিন সিগারেট ছাড়া থাকতে হয়, একটা অত্যাচার! সেই অত্যাচারের একটা ফাঁক হচ্ছে এই জুম্মার নামাজ। নামাজ শেষে বন্ধুদের সাথে এক-আধ ঘন্টা অনায়াসে কাটানো যায়। সে সময়ে চায়ের সাথে দমকা টানে দু’তিনটে সিগারেটের শ্রাদ্ধ করা যায়।

রানা, নিপুন আসা শুরু করে আরো পরে। বনানী বাজার মসজিদটা রানার জন্য দূর হয়ে যায়। ও থাকে টিএন্ডটি কলোনীতে। বাসার পাশের মসজিদেই ওর আনাগোনা ছিল। পরে সবার সাথে নামাজ পড়ার অজুহাতে রানাও দলে যোগ দেয়।

আর ওদিকে নিপুনটা গোঁড়া নাস্তিক। ঈদের দুই নামায ছাড়া মসজিদেই ওর পা পড়তো না। পরে রাজীবের মত আড্ডার লোভে সেও আসা শুরু করে।

মসজিদে এলাকার মোটমুটি সবাই আসেন। এছাড়া নিয়মিত যাওয়া-আসার কারনে অন্য নামাজীদের সাথেও একটা মুখচেনা পরিচয় হয়ে গেছে। সে পরিচয়ের সুবাদে নামাযে দেরি হলে অনেকে একটু মৃদু ভর্ৎসনা করেন। একে অন্যকে গুতোগুতি করলে গুরুজনের মত লাল চোখে শাসন করেন। বেশ একটা পারিবারিক পরিবেশ।

মসজিদ থেকে বের হয়ে বাজারের অন্যদিকে চলে আসে পাঁচ জন। মসজিদের সামনে দাঁড়ালেই এঁর-তাঁর সাথে দেখা হয়ে যাবার সম্ভাবনা। সে সম্ভাবনা এড়াতেই চেনা রেস্তোরায় ঢুকে পড়ে সবাই, ফ্যানের নিচে একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়ে। নামাযের পরে এখানে ওদের নিয়মিত আনাগোনা। সবাই চেনা।

ওদের দেখেই হাসে ক্যাশে বসা দোকান মালিক, ফ্যানটা চালিয়ে দেয়। বেয়ারা মন্টু কাছে এসে দাঁড়ায়, “ছার, চা? বেনসন?”

“কে কে রোজা আছিস?” জিজ্ঞেস করে নিপুন।

রানা, ফয়সাল আর তমাল মাথা নাড়ে, রোজা আছে ওরা।

“দু’টো চা দে। আর...” পকেট থেকে টাকা বের করে দেয় নিপুন, “চারটে বেনসন নিয়ে আয়।” রেস্তোরায় সিগারেট বেচে না ওরা, বাইরে থেকে এনে দেবে।

নিপুন গতরাত্রের ঘটনাটা এখনো কাউকে বলেনি। এখন কিভাবে বলবে সেটা ভেবেই ও হয়রান হয়ে যাচ্ছে। তবে বলতে তো হবেই। ও ঠিক করেছে ঘটনাটা বলে রাজীবকে ভাবার সময় দেবে। আজ সব-এ-কদর, রাত্রে সবার আবার মসজিদেই আসার কথা নামায পড়তে। সারা রাত নামায পড়ার কথা থাকলেও ওরা বারটার মধ্যেই বাসায় চলে যায়। এর ফাঁকে ফাঁকে রেস্তোরায় আড্ডাও চলে। তখন না-হয় বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে। এর ফাঁকে রাজীব যদি তৃণার সাথে কথা বলতে চায়, বলবে। আর কি করতে হবে সেটা নিয়ে বাকিদের সাথেও ওরও একটু ফোনে আলোচনা করা দরকার।

“দোস্ত, ডঃ ইউনুস কি রাজনীতিতে আসবে মনে হয়?” জিজ্ঞেস করে রাজীব।

“উনার রাজনীতিতে না আসাই ভালো। এত বড় একজন লোক, এত বড় একটা কাজ করেছেন। নোংরা রাজনীতিতে ঢুকলেই উনাকে নিয়ে নোংরামী শুরু হয়ে যাবে। এটা ঠিক হবে না। যে উচ্চতায় উনি উঠেছেন সেই উচ্চতাতেই উনি থাকুন।” বলে ফয়সাল।

“তোর কথায় লজিক নাই,” বলে রানা, “প্রথমত ভাল লোক রাজনীতিতে না আসলে রাজনীতি তো নোংরাই থেকে যাবে। আগে তো ভাল ভাল লোকই রাজনীতিতে আসতেন। এখন এ দূরাবস্থায় কাউকে তো সেই প্র্যাকটিসটা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে উনার রাজনীতিতে না আসাটা আমি সমর্থন করবো অন্য কারনে।”

“কি কারনে?” জিজ্ঞেস করে তমাল।

“লোকটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না। সে একশো ভাগ ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের আমার এমনিতেই বিশ্বাস হয় না!” এটুকু বলেই খেয়াল হয় রানার ওর বন্ধুদের সবার বাবাই ব্যবসায়ী, তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নেয় ও, “সবার কথা বলছি না। ভাল লোক আছেন ব্যবসায়। কিন্তু স্পেসিফিকালি উনাকে আমার পছন্দ না।”

“কেন? উনি বাংলাদেশের দারিদ্রতা দূরের চেষ্টা করছেন, সেজন্য?” ওর কথাটা কেড়ে নেয় ফয়সাল, “নাকি গ্রামের হতদরিদ্র মেয়েদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করেছেন সেজন্য?”

“পুরোটাই ব্যবসা! ইন্টারেস্ট রেট কতো জানিস? আর ইন্টারেস্ট ওঠানোর জন্য গ্রামীনব্যাঙ্ক যে কি করে তা জানিস? হি ইজ নাথিং বাট এ সুদখোর মহাজন।”

“না, সব তো তুই একাই জানিস! আমি খেয়াল করেছি সব কিছুতে তোর একটা হতাশাবাদী ভাব!” তেড়ে উঠে বলে ফয়সাল, “আরে ব্যাটা এটাই বা আগে ক’জন করেছে শুনি? কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে কি সব কিছুর বিচার চলে? আর ইন্টারেস্ট রেট এর গুজবটা পুরোটাই বাড়াবাড়ি, পুরোটা না জেনেই বলে দিলি সুদখোর মহাজন! আরে ওদের তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে নাকি? এটা কি চ্যারিটি? ”

“তোর ইকোনোমিক্সে কোনো ধারনা নাই, অহেতুক ক্যাচাল করতেছিস! গ্রামীনফোনের কারনে কত টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে তার কোনো ধারনা আছে তোর?”

“গ্রামীনফোনের কারনে কত বেকার চাকরী পেয়েছে? ফোনের ব্যবসা করে কতজন স্বাবলম্বী হয়েছে? সেটার ধারনা আছে তোর?”

“এভাবে দেখলে তো চোরাচালানকারীকেও সাধুবাদ দিতে হয়। ওদের কারনেও তো কত লোক স্বাবলম্বী হয়, হয় না?”

“অর্বাচীনের মত কথা বলিস কেন?” রাগে মুখ লাল হয়ে যায় ফয়সালের, “আমি এনজিও-তে কাজ করি, আমি জানি না? গ্রাসরুট লেভেলে কি বিপ্লবটা ডঃ ইউনুস করেছেন? চোরাচালানীর সাথে তুলনা করলি!”

“বিপ্লব? বিপ্লব কি জিনিস তুই জানিস? আর তুলনা করলাম কই? ওটা ছিল একটা মেটাফোর। মেটাফোর বুঝিস না?” গলা চড়ে যায় রানাও।

ওদের তর্কটা তাঁড়িয়ে তাঁড়িয়ে উপভোগ করে সবাই।

“কিসের মেটাফোর? কত্ত বড় সাহস! একটা লোক, যে কিনা মাইক্রোক্রেডিটের জনক! তুই জানিস যে কোনো... আই মিন, যে কোনো ইকোনোমিক্সের ক্লাসে উনার রেফারেন্স আসবেই? সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিচ্ছে, নোবেল কমিটি স্বীকৃতি দিচ্ছে আর উনি আসছেন সিমেন্সের মহামানব!”

“নোবেলের স্বীকৃতি ধুয়ে পানি খাও তুমি! লবিং করে পাওয়া। পুরোটাই প্রোপাগান্ডা! তুমি কি বুঝবা? এনজিওতে কাজ করো না? এগুলো তো সব নয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী...”

“ফালতু কথা বলবি না রানা। তুই কাজ করিস সিমেন্সে... ক্যাপিটালিস্ট রক্তচোষার দল... তুই কি করেছিস দেশের জন্য? যা করার তো আমরাই করি...” রাগে টেবিল চাপড়ে ওঠে ফয়সাল।

“আচ্ছা কি শুরু করলি তোরা দুইটা?” ওদের থামায় রাজীব, “ডঃ ইউনুসকে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে দোস্ত সত্যি কথা, যখন শুনলাম এবার শান্তির নোবেল আমরা পেয়েছি... কি যে গর্ব লেগেছে! তোর একটুও লাগেনি বল? ...রানা?”

“তা লাগেনি বলতে পারবো না,” থমথমে মুখে বলে রানা, “তবে...”

হাত তুলে থামায় ওকে রাজীব, “হয়েছে, আপাদত ওটুকুই যথেষ্ঠ। এখন অহেতুক ঝগড়া করছিস। বাদ দে! মুড নাই।”

এরই মাঝে চা সিগারেট চলে আসে। একটা সিগারেট ধরিয়ে পর পর কয়েকটা লম্বা টান দেয় নিপুন। যা বলার এখনই বলতে হবে। ভ্রু কুঁচকে রাজীবের দিকে তাকায় ও, “রাজীব তোর সাথে কথা আছে।” অন্যদের দিকে ফেরে নিপুন, “দোস্ত তোদেরও জানা দরকার!”

সময়: বিকাল ৪:০০-৪:৩০
রাজীবদের বাসা, বনানী, ঢাকা

“কি বললে তৃণা? নিপুন বানিয়ে বানিয়ে বলেছে?”

“অবকোর্স! তোমার বন্ধুগুলো সব ব্যাকডেটেড। এখনো স্টোনএজে পড়ে আছে। ক’টা ছেলের সাথে দেখেছে আর যাচ্ছেতাই বলেছে তোমাকে!” ফোনের ও প্রান্তে ঝগড়ার সুরে বলে তৃণা।

“তৃণা তোমাকে আমি আগেও বলেছি, তুমি যেখানে খুশি যাও, যা ইচ্ছে করো, কিন্তু আমাকে বলে করো... বলিনি? তুমি আমাকে বলেছিলে গতকাল তোমাদের দাওয়াত আছে। মিথ্যে তো আমার বন্ধুরা বলেনি, বলেছো তুমি!”

“দাওয়াত ছিল সত্যি। বাবা-মা গেছেন, আমি যাইনি। সেটা তো আর আগে জানতাম যে আমার যাওয়া হবে না!”

“তৃণা, তোমাকে স্ট্রেইট বলি, আমার বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র রেসপেক্ট তুমি করছো না। আমাকে পেয়েছ কি তুমি? আই হ্যাভ হ্যাড এনাফ অব দিস! সব কিছুর একটা লিমিট থাকে!”

“তোমাকে আগেই বলেছি, আমি জাস্ট কয়েকটা ফ্রেন্ডের সাথে গিয়েছি দেখতে। বেশিক্ষণ ছিলামও না!”

“তুমি ড্রিংক করে যাওনি? গিয়ে ড্রাগস নাওনি?”

“না!”

“হাউ ক্যান ইউ লাই লাইক দ্যাট...” রাগে গা জ্বলে যায় রাজীবের, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “ইউ স্টুপিড লিটল কান্ট!”

“হোয়াট ডিড ইউ সে? হোয়াট ডিড ইউ সে রাজীব? এত্তবড় সাহস তোমার? তুমি আমার কথা বিশ্বাস না করে তোমার স্টুপিড ফ্রেন্ডদের কথা বিশ্বাস করছো?”

“এই তোমার সমস্যা তৃণা...” হতাশ গলায় বলে রাজীব, “তুমি সমস্যাটা কোথায় সেটাই বোঝো না। আই লাভড ইউ, আই রিয়েলি লাভড ইউ। সেই ভালবাসা তুমি তামাশা করে রেখে দিয়েছ! কি প্রমান করতে চাও তুমি? তুমি আমার চেয়ে বেটার? নাকি দেখাতে চাও তুমি আমার চেয়ে স্মার্ট? এভাবে তো চলে না তৃণা!”

“চলে না মানে?”

“মানে... আমি এই সম্পর্ক আর রাখতে চাচ্ছি না!”

“আচ্ছা?” খিলখিলিয়ে হাসে তৃণা, “তুমি ব্রেকআপ করবে আমার সাথে? তুমি কি করবে, আমিই করছি! আই অ্যাম ব্রেকিংআপ উইথ ইউ! হ্যাপি?”

ফোনটা নামিয়ে রাখে তৃণা।

সময়: বিকাল ৮:০০-৯:০০
বনানী বাজার মসজিদ, বনানী, ঢাকা

সব-এ-কদর এর পবিত্র রাতের সুযোগে নামাজের ফাঁকে একটা মিলাদ হয়ে যায়। কারো নাতীর মুসলমানী হয়েছে। কয়েকজন তালেবুল এলেম ছড়িয়ে ছড়িয়ে সবার গায়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দেয়। ঘ্রানটা ভাল লাগে রাজীবের।

মিলাদ শেষে দেরি না করে উঠে পড়ে সবাই। বেরুনোর আগে পথ আগলে দাঁড়ান এক বৃদ্ধ, “যাইতেছ কই? আটটা বাজে, এর মধ্যেই নামায শেষ?”

“চাচা, আমরা একটু পরে আবার আসবো!” মাথা নিচু করে বিনয় নিয়ে বলে রানা।

“তা ঠিকাছে, কিন্তু তবারুক নিয়া যাও!”

“চাচা, একটা জরুরী কাজ! এক্ষুনি যেতে হবে!”

“আরে ছেলে বলে কি! এক্ষন কিসের জরুরী কাজ?” ধমকান মুখচেনা চাচা। হাত তুলে হাঁক দেন, “এই জসীম... বাচ্চা গুলানরে আগে তবারুক দে!”

দেরি হচ্ছে দেখে নিজেই গিয়ে পাঁচ প্যাকেট তবারুক নিয়ে ওদের হাতে তুলে দেন তিনি। রানার কাঁধে হাত রেখে একটা অহেতুক মমতা নিয়ে বলেন, “তবারুক না নিয়া কি যাইতে হয়? এইটা হইলো নবীজীর সুন্নাত!”

রাজীব শুনেছে এই মিলাদ জিনিসটাই নাকি ইসলাম সমর্থন করে না। সেখানে তবারুক নেয়াটা আসলেই সুন্নত নাকি তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবু মনটা ভাল হয়ে যায় ওর। কাঙ্খিত মানুষকে এত ভালবাসা দিয়েও সেই ভালবাসার কানাকড়ি ফেরত পাওয়া যায় না। আবার অহেতুক, অনাহূত কত মানুষই না ভালবাসা বিলিয়ে দেন বিন্দুমাত্র ফেরত পাবার আশা না করে। এ বুঝি কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব!

বেরিয়ে সেই রেস্তোরাতেই গিয়ে বসে সবাই। চা-এর অর্ডার আর সিগারেটের টাকা নিয়ে ছুট লাগায় মন্টু।

“দোস্ত, সিগারেটের গন্ধ নিয়ে নাকি নামায হয় না?” জিজ্ঞেস করে তমাল।

“সিওর জানি না! মাকরুহ হয়ে যায় মনে হয়। ভাল মত কুলি করে নিস।” তবারুকের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলে ফয়সাল। প্যাকেটে সিঙ্গারা, আমিত্তি, নিমকী আর আর্ধেকটা কলা। সেগুলো নিমিষে শেষ করে অন্যদের দিকে তাকায় ফয়সাল, “তোরা খাবি? না খেলে আমাকে দে। ভাল মত ইফতারী করি নাই। পেটে মহাযুদ্ধ লেগে গেছে।”

নির্বিকার মুখে নিজেদের প্যাকেট এগিয়ে দেয় নিপুন আর তমাল।

“দোস্ত, এই সিভিয়ার অবস্থাতেও তোর ক্ষুধা লাগছে?” বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে রানা।

“হ লাগছে! কোনো সমস্যা?”

“না! সমস্যা কিসের?”

“সমস্যা থাকলে সরাসরি বল।” ভ্রু কুঁচকে বলে ফয়সাল, “আমি দেখছি তোর এই একটা ব্যাপার আছে। কারো কিছু হলে এমন একটা ভাব ধরিস যেন তুই একাই সেটা ফিল করছিস। আমাদের কোনো ফিলিংস নাই। একেকজনের প্রকাশ একেক রকম। তোর ক্ষুধা লাগে নাই, ভাল কথা। তাই বলে আমাদেরো লাগতে পারবে না?”

“অবশ্যই! তোর বেশী ক্ষুধা লাগলে বল। মন্টুকে বলি বিরিয়ানি আনতে। শুকনা তবারুক খাবি কেন?”

“আহ! কি ছেলেমানুষি শুরু করলি তোরা!” বিরক্তি নিয়ে ধমক দেয় তমাল, “সব কিছুর তো একটা সময় আছে, নাকি?”

“তুই বল? আমি শুরু করছি? আমি করেছি শুরু? চান্স পাইলেই সে আমাকে খোঁচা মারে এটা তোরা খেয়াল করেছিস?” তোতলাতে তোতলাতে অভিযোগ জানায় ফয়সাল।

“থামবি তুই?” কড়া গলায় বলে তমাল, “একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি আর দুইটা মিলে মস্করা শুরু করেছে।”

চা-সিগারেট চলে আসে। সিগারেট ধরিয়ে চায়ে চুমুক দেয় নিপুন, “তমালের কথা ঠিক। বিষয়টা জরুরী। রাজীরের সাথে আমার কথা তোদেরকেও বলেছি কারন এর আগে রাজীবকে আমরাই বলেছিলাম তৃণাকে আস্ক আউট করতে। এখন যা হচ্ছে তার রেসপন্সিবিলিটি আমাদের উপরেও এসে পড়ে।”

“না দোস্ত!” বলে রাজীব, “তোরা আমাকে না-ই বলেছিলি। আমিই জেদ ধরেছিলাম। আমি একাই রেসপন্সিবল।”

“জিদ তোর ধরারই কথা। কিন্তু আমরাও জোর দেইনি, যেটা দেয়া দরকার ছিল। এখন দিচ্ছি!”

“হ্যাঁ দোস্ত...” বলে ফয়সাল, “আমাদের মতে তোর এই মুহূর্তে সম্পর্কটা শেষ করা দরকার। তৃণার কারনে তুই একটা লাফিং-স্টক হচ্ছিস, এটা আমাদের মোটেই ভাল লাগছে না।”

“এবার তুই 'না' বললেও সেটা আমরা মানবো না। ইট হ্যাজ টু বি ডান। আমরা সবাই মিলেই ঠিক করেছি।” দৃঢ় গলায় বলে রানা, “ইট হ্যাজ টু বি হার... অর আস!”

সিগারেটের গোড়াটা অ্যাশট্রেতে পিষে ফেলে রাজীব, “তোরা বলার আগেই আমি এ ডিসিশন নিয়েছি। ইফতারীর আগে তৃণার সাথে কথা হয়েছে, উই ব্রোকআপ!” বিষাদের হাসি হাসে রাজীব, “লাইফের আয়রনিটা দেখ! ওকে আস্ক আউটও করলাম শুক্রবারে, ব্রেকআপও করলাম শুক্রবারে!”

“সরি দোস্ত!” ওর কাঁধে হাত রাখে তমাল, “আমি বুঝতে পারছি তোর খারাপ লাগছে...”

“একদমই না দোস্ত!” তমালের কথাটা শেষ করতে দেয় না রাজীব, “এটাই মজার ব্যাপার। ডিসিশন নেবার আগ পর্যন্ত খুব অস্থির অস্থির লাগছিলো। নেবার পর একটুও না! বরং মনটা কেমন হালকা হয়ে গেল। মনে হলো নিজেকে আবার যেন ফিরে পেলাম।”

তবারুকের প্যাকেট থেকে আমিত্তিটা বের করে কামড় বসায় রাজীব, “তোরাও মিষ্টি মুখ কর! সেলিব্রেশন টাইম এখন। আরো সিগারেট আনতে বল।”

রাজীবের উল্লাস দেখে হাসি ফিরে আসে ওদের মুখে। হাত উঁচিয়ে আরো সিগারেট আনতে বলে রানা, “মন্টু আরো দশটা বেনসন আন!”

“দশটা না আটটা।” শুধরে দেয় নিপুন।

“আটটা কেন?”

“আমি খাব না।”

“কেন খাবি না?”

“ছেড়ে দিয়েছি।”

“ওই আহাম্মক, কখন ছাড়লি? একটু আগেই না সিগারেট নিলি?”

“এক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিলাম। নেশা করে কি অবস্থা হয় সেটা তো নিজ চোখে দেখলাম। ওই অবস্থায় আমি যেতে চাই না। তাই ঠিক করলাম আর কক্ষনো নেশা করবো না দোস্ত, কসম! এই সিগারেটও না।”

[চলবে...] © অমিত আহমেদ


মন্তব্য

অমিত আহমেদ এর ছবি

ঘন্টা খানিক আগে চ্যাপ্টার এগারোর ভুল ড্রাফট প্রকাশ করে ফেলেছিলাম! যাঁরা কষ্ট করে আগেরটা পড়ে ফেলেছেন তাঁদের কাছে আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

বিবাগিনী এর ছবি

খুব ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলাম গন্দমের জন্য।গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম।জীবন বাচালে অমিত।
ভেতরের ঋতুটা ঋতুকে খুঁজে বেড়ায় অহেতুক। মন খারাপ

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ভুল ড্রাফটটা ও পড়ে ফেলেছিলাম হাসি
এবার সঠিকটা পড়া হলো ।
চলুক টু দ্যা এন্ড ।
----------------------------------------
ভালো নেই,ভালো থাকার কিছু নেই

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আমি সঠিকটাই পড়লাম। বেশ ঝরঝরে লেখা। চলুক--


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

দিগন্ত এর ছবি

বাঃ, আপনার লেখা এখন দৌড়চ্ছে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

শুভ জন্মদিন, অমিত !

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হ্যালো অমিত শুভ কামনা
----------------------------------------
সঙ্গ প্রিয় করি,সংঘে অবিশ্বাস

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

রানা মেহের এর ছবি

আপনার গন্দম টা একদম শয়তানি প্ররোচনা।
হেভি কঠিন।
শুভ জন্মদিন অমিত

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

হিমু এর ছবি
ফারলিন এর ছবি

একদিনেই ১১ পর্যন্ত পড়া শেষ, বাকিটুকুর অপেক্ষায় রইলাম। হাসি

কনফুসিয়াস এর ছবি

বাকিটা কই?
সব চলে এসেছে ভেবে একসাথে এগারো পর্যন্ত পড়ে ফেললাম বসে বসে... এখন কি করি?
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অন্য ট্রলার এর ছবি

জনান্তিক স্টল, একুশের বই মেলায়।
দাম সাড়ে এক অস্ট্রেলিয়ান ডলার মাত্র।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।