আজ আদমের জন্মদিন

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: শুক্র, ৩১/১২/২০১০ - ৮:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চৈত্র মাসের রাত ১১টা খুব বেশি রাত না। তার ওপরে আজ বৃহস্পতিবার। কাল পরশু ছুটির দিন। 'নাইট ইজ স্টিল কিড' হওয়ার কথা হলেও পৌষ মাসের ইলেকট্রিসিটিবিহীন অজপাড়াগাঁয়ের মতো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে স্বর্গের সবাই। ফেরেশতাগুলা সারাদিন কাজ করে করে ক্লান্ত আর মানুষগুলা কামে কামে গলদঘর্ম। শুধু একজনের চোখেই ঘুম নাই। তিনি পিতা আদম। আর ১ ঘন্টা পরেই তার জন্মদিন। আদম কোনো বিগত জমিদার চৌধুরী, সৈয়দ কিংবা সিদ্দিকবংশীয় খানদানি লোক নন; কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন তার জন্মদিনে সাত আসমানের রেশমী ফেরেশতারা কেক বানিয়ে আনতো, হুরপরীরা মৌজমাস্তি, নাঁচগানে স্বর্গকে স্বর্গ বানিয়ে রাখতো সপ্তাহাধিককাল। সেসবই এখন শুধু ইতিহাস। আদম শূন্য বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেন আর যথাসম্ভব শব্দ না করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। প্রশস্ত শয়নকক্ষে অপর পাশের বিছানায় শায়িতা হাওয়ার নাকডাকার শব্দে বুঝা যায় আদমের জন্মদিন-মৃত্যুদিন নিয়া ঘুম নষ্ট করার রোমান্টিকতাকে তিনিও ইতিহাসের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ঢুকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

এই নিশ্চিন্ত, নিশ্ছিদ্র, শান্ত শান্তির মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দরজায় দুমদাম শব্দে করাঘাত পড়ে। স্বর্গে ডাকাত নাই; কিন্তু সেই করাঘাতের ডেসিবেল ও ফ্রিকোয়েন্সি যেকোনো অনভিজ্ঞ অতিথিকেই ডাকাতহীনতার তথ্য সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিবে। অভিজ্ঞ আদম অবশ্য জানেন, এই নচ্ছারতা একমাত্র জিবরীলের পক্ষেই সম্ভব। যেখানে মৃত্যু অসম্ভব, সেখানে এই আকস্মিক শব্দে হার্ট-অ্যাটাকের ভয়াবহতা ওই ফাজিলের না জানার কথা নয়। সুতরাং আকামটা সে ইচ্ছা করেই করে। এবং আদমও তাকে ঝাড়ির ওপরে রাখেন। ঝাড়িতে কাজ হয় বলে মনে হয় না; বরং রাগিয়ে আনন্দ পাওয়াটা সে উপভোগ করে। আদম অবশ্য আজ আর ঝাড়িটাড়ি দেন না। মনে বিষণ্ণতা থাকলে মানুষ স্বাভাবিক আচরণ করে না, অত্যধিক উদারতাও সেই অস্বাভাবিকতার অংশ। হাই তোলা আদম জিজ্ঞেস করেন, "কি ব্যাপার জিবরীল? কিছু কইবা নাকি?"

"আরে মিয়া, আপনি বাইরে আসেন। আপনার জন্য দুইজন ডানাকাটা হুর নিয়া আসছি।" জিবরীল ফিচকামি করে।

আদম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। সব বেহেশতির জন্য হুর বরাদ্দ থাকলেও আদমের জন্য তা নিষিদ্ধ। কয়েকটা হুরের সাথে হুটোপুটি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরে হাওয়াই ঈশ্বরের কাছে মামলা করে এই নিষেধাজ্ঞা করিয়েছেন। তার যুক্তি, হুরদের জন্ম পৃথিবীর মানুষের জন্য, আদম মূলত বেহেশতেরই মানুষ, বেহেশতে জন্ম, বেহেশতেই ব্যাক। অকাট্য যুক্তি, বিশেষ করে হাওয়ার জন্য হুরের সমতুল্য কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা না রাখার ভুলপ্ল্যানিংয়ের শিকার ঈশ্বর খুব বেশি উচ্চবাচ্য না করেই হাওয়ার পক্ষে রায় দেন।

আদম ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠেন। হুরের কথা শুনে হাওয়াও যে ঘুম থেকে উঠে গেছেন, তার নাকডাকার শব্দ বন্ধ হওয়া থেকেই তা বুঝা যায়। ঘুমের অভিনয়ে চোখ বন্ধ করা যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের ফ্রিকোয়েন্সি ম্যানিপুলেট করা যায়; নাকডাকার স্বাভাবিক শব্দ যোগ করা অতোটা সহজ নয়।

দরজা খুলেই আদম একটু অবাক হওয়ার ভান করেন। তার সামনে জিবরীলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে তিন মনুষ্যপুত্র। জিবরীল পরিচয় করিয়ে দেন, "ইনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো রিমিক্সার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, ইনি বিখ্যাত ভিসামুক্ত বিশ্ব আন্দোলনের প্রোমোটার শাহরুখ খান আর ইনি পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানীর মা বাপ ডঃ জাকির নায়েক।" আদম হাই-হ্যালো করতে করতে একটু উঁকিঝুঁকি মারেন। তিনি আরো একজনকে আশা করেছিলেন।

এই আশার মূলে ছিলো স্বর্গের কানপাতলা ফেরেশতা ফিসফিসের গোপন বার্তা। ফিসফিসের কারণে স্বর্গে গোপনীয়তা বলে কিছু থাকে না। সে-ই আদমকে জানিয়েছিলো, তার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ঈশ্বর পৃথিবী থেকে ৪ জন বিখ্যাত মানুষ আনবেন। চতুর্থ মানুষটি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো মোটিভেটর এভারেস্টে চড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া বাংলাদেশী পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম।

আদম সবাইকেই আপ্যায়ন করে বসার ঘরে নিয়ে আসেন। হাওয়াও বিছানা থেকে উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে হালকা মেকআপ করে এসে অতিথিদের সাথে যোগ দেন। স্বর্গে রান্নাবান্না কিংবা কফির পানি গরমের ঝামেলা নেই, জিবরীল তার ঝোলা হতে একের পর এক স্বর্গীয় খাদ্য ও পানীয় বের করতে থাকেন। দেখা গেলো, খাদ্যের চেয়ে পানীয়ের দিকেই অতিথিদের আগ্রহ বেশি।

খাদ্য-পানীয় সাজিয়ে জিবরীল বিদায় নেন। আর আদম পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ে অতিথিদের সাথে আলাপ করতে থাকেন। বুলবুল জানান, "এখন পৃথিবীর রাজা বারাক ওবামা।" জাকির নায়েক শুধরে দেন, "নামটা হবে বারেক, বারাক নয়। আর তাকে পৃথিবীর রাজা বলাটাও শোভন নয়, আমেরিকা ধবংসের আর বেশি দেরি নেই, ইরান খুব শীঘ্রই পৃথিবীর হর্তাকর্তা হবে, অন্যদিকে পিতা আদম শুধু শুধু একটা ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকবেন।" শাহরুখ এ টপিকে কিছু বলেন না, শুধু বলদের মতো তার স্পেশ্যল মিনি ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে হাসতে থাকেন।

শাহরুখকে আলোচনায় নিয়ে আসেন আদম নিজেই। সম্প্রতি বাংলাদেশে তার বিখ্যাত শো-এর সুনাম এই স্বর্গাবধি পৌঁছে গেছে। কিছু দুর্ণামও যে নেই, তা নয়। বরং ফিসফিস ফেরেশতা এই দুর্ণামগুলোই বেশি রসিয়ে রসিয়ে আদমকে জানিয়ে গেছে। কোনো দেশে শো করতে গেলে তাদের ভাষা জানার চেষ্টা করেন কিনা, শাহরুখকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আদম।

শাহরুখ একটু গলা খাকারি দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলেন, "ঘোঁৎ ঘোঁৎ ঘোঁৎ, আপনি বাংলাদেশের শো-এ হিন্দি বলা নিয়ে বলছেন নিশ্চয়ই। এখানে আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি বরং রাণীর কাছে বাংলা শেখা শুরু করেছিলাম। স্বপন চৌধুরীই আমাকে বললেন, বাংলা শিখতে হবে না, রেডিও বাংলাদেশ আর হিন্দি সিরিয়ালের কল্যাণে বাংলাদেশে সবাই হিন্দি বলতে পারে; হিন্দির মাঝে আমি যেন বরং ইংরেজিটা একটু কম মেশাই।"

বুলবুল একটু উশখুস করে বলে ফেললেন, "আপনি চাপা মারেন ক্যান ভাই? আপনার মুখের ওপরেই তো গাজি ইলিয়াস সাহেব বলে গেলেন, তিনি হিন্দি ঘৃণা করেন, এক বর্ণও হিন্দি পারেন না। আমরা ভাষার জন্য জীবন দেয়া জাতি, বুঝলেন? বাংলাদেশে এসে হিন্দি বলে যাবেন, এটা সহ্য করা হবে না।"

শাহরুখও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। তিনি পালটা দিলেন, "কেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রীইতো নিজের নাতনিকে হিন্দি শিখিয়ে মঞ্চে পাঠালেন! অবশ্য সে যে পরিমাণে চুইংগাম চিবাচ্ছিলো, তাতে তার হিন্দি চুইংগাম ভেদ করে মুখ দিয়ে খুব বেশি বেরোচ্ছিলো না। তবে ছোহাইল ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার কোনো ছিনেমায় ওকে দিয়ে নায়িকার তোতলা ছোটভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করাবো।"

বুলবুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জাকির নায়েক বাধা দিলেন, "আপনারা এই স্বর্গে এসেও টিভি ছিনেমার আলোচনা ছাড়তে পারলেন না! একটু আল্লা-খোদার নাম নেন। ধরেন, আমার সাথে তাল ধরেন, ইয়া নবী ছালাম আলাইকা, ইয়া রসুল ....."

একপ্রস্থ আল্লা-খোদার অজুহাতে নবীর নামে গীত গাওয়ার পরে আদমের ক্লান্তি লাগে। তিনি প্রসঙ্গ ঘুরাতে চান। "বাবারা, তোমরা তো দুনিয়ায় অনেক ইবাদত-বন্দেগী করো। এই স্বর্গে এসে আর সেটা করে অমূল্য সময় নষ্ট করো না। স্বর্গের ইবাদত কবুল হলে কি আর আমাকে নাঙ্গা করে আমাজন জঙ্গলে নিক্ষেপ করা হতো! তার চেয়ে বাবা জাকির তুমি বলো, শোয়েবের সাথে সানিয়া মির্জার বিয়ে হওয়ায় তুমি খুশী কিনা। তার হাফপ্যান্ট পরা নিয়ে তো একসময় খুব গবেষণা-টবেষণা করেছিলে।"

জাকির নায়েক একটু উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, "আপনি কি বলতে চান, হ্যাঁ? তার বিয়ে নিয়ে আমার সমস্যা কি? আমি কি তার শরীরে নজর দিয়েছি নাকি? আমি তো তার ঈমান নিয়ে চিন্তিত। ঈশ্বর বলেছেন, আমি পৃথিবী খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করি নি, আল-কোরআন সুরা এক্স, আয়াত ওয়াই। অর্থাৎ ইসলামে সকল প্রকার খেলাধুলা হারাম!"

আদমও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন, "কেন, তোমরা যে হাদিস লিখে নিয়েছো, তলোয়ারবাজি, কুস্তি করলে নাকি পূণ্য হয়?"

জাকির তেড়ে ওঠেন, "আরে বাপু, তলোয়ারবাজি, কুস্তি আর ঘোড়ায় চড়া তো জিহাদের অংশ, এগুলো খেলা হয় কি করে!"

অকাট্য যুক্তি। আদম এতক্ষণে বুঝতে শুরু করেছেন, এই মাল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয় কি করে! ঈশ্বর কোরআনে তাবৎ মহাবিশ্বের সমস্ত বিজ্ঞান অন্তর্ভূক্ত করে রেখেছেন, কেউ কিছু আবিষ্কার করলে এই পাবলিক নিশ্চিতভাবেই সেটা কোরআনে আগেই ছিলো বলে যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করে দেয়।

বুলবুল সম্পর্কে আদম খুব বেশি কিছু জানেন না। তবে স্বর্গের টিভিতে তার ঝাঁকড়া চুলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ক্লোজআপওয়ানে জাজগিরি দেখেছেন। ফালু কারাবন্দী হওয়ার পরে ক্লোজআপ ওয়ানের ভবিষ্যত কি, আদম তার কাছে জানতে চান।

বুলবুলের চোখে একটু বিষণ্ণতা ভেসে ওঠে। ক্লোজআপওয়ানের দিনগুলো আসলেই ভালো ছিলো। তিনি বলেন, তিনি শিল্পী মানুষ, টিভি কোন অনুষ্ঠান দেখাবে, না দেখাবে, তাতে তার কি আসে যায়!

বাংলাদেশের সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে সেরা কে - আদমের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য ফাহমিদা নবী আর উঠতিদের মধ্যে পুতুলের নাম জানান। আদম বুঝেন, তিনি সাদাসিধা ঢোঁড়াসাপ টাইপের মানুষ, তেমন বিষ নাই, তাকে ঘাটাইয়াও তেমন লাভ নাই। বরং শাহরুখ আর জাকির নায়েককে নিয়ে একটু খেলা যাক।

"শাহরুখ বাপ, তোমারে যে আমেরিকা তাদের দেশে ঢুকতে দিলো না, তোমার মন খারাপ হয় নাই?"

"মন খারাপ যে হয় নাই, তা বলবো না। কিন্তু আমি তো সমুচিত জবাব দিয়েছি। মাই নেইম ইজ খান অ্যান্ড আয়াম নট আ টেরোরিস্ট হিন্দি ছবি করেও ইংরেজি ডায়লগ দিয়েছি, যাতে আমেরিকানরা বুঝতে পারে।"

"আসলে পৃথিবীতে ভিসা সিস্টেমই থাকা উচিত না", শাহরুখ বলে চলেন, "আমি বাংলাদেশেও শো করতে এসেছিলাম এই মোটিভেশন থেকেই। বড়ো আশা ছিলো, ভিসামুক্ত বিশ্ব আন্দোলনের নেতা ধোলাইখালের ইঞ্জিনিয়ার শাহজাহান সাহেবের সাথে দেখা হবে। কিন্তু আয়োজকদের গাফিলতিতে শাহজাহান সাহেবের বদলে দুইটা মূর্তি তৈরিকারী পিচ্চি পোলার সাথে দেখা করতে বললো! দেখেন কী অবিচার! আমি পোলা দুটোর সাথে দেখা না করলেও সৌজন্য দেখিয়ে মূর্তিদুটো নিয়ে এসেছি, ফেরার পথে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে পাপমুক্ত হয়েছি!"

"বাংলাদেশের মুসলমানদের বুঝা দায়", জাকির নায়েক ফোঁড়ন কাটেন, "তারা নামে মুসলমান হলেও হিন্দু কালচার থেকে এখনও বেরোতে পারে নাই। মূর্তি বানানো! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তবে শাহরুখ ভাই সাহেবের সাথে আমেরিকা যে দুর্ব্যবহার করেছে, তার সাজা অচিরেই পাবে। আল কোরআন সুরা আর, আয়াত এস-এ আল্লাহ বলেছেন, ..."

আদম দেখেন পরিস্থিতি খারাপ। আমেরিকার প্রশ্ন তোলা উচিত হয় নাই। এই দুই জোকারেরই আমেরিকা উপ্রে রাগ। এই প্রসঙ্গে এদেরকে লাগিয়ে দিয়ে মজা পাওয়ার উপায় নাই। তিনি প্রসঙ্গ পালটান।

"আচ্ছা, এই যে শাহরুখ মুসলমান হয়েও হিন্দুর মেয়ে গৌরিকে বিয়ে করলো এ ব্যাপারে বাবা জাকির তোমার মতামত কি?"

আমেরিকা প্রশ্নে একমত হলেও জাকির নায়েক শাহরুখের ওপরে বিভিন্ন কারণে তেতে ছিলেন, বিশেষ করে বেশ কিছু টিভি অনুষ্ঠানে তাদেরকে একসাথে রেখেও শাহরুখের অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেয়া হয় নি। আজ স্বর্গে সুযোগ পেয়ে তিনি হেলায় হারাবেন না, "হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করায় শাহরুখ নিশ্চিতভাবেই মুসলমান নন, তিনি মুনাফিক!"

শাহরুখ অনেক চেষ্টা করেও মুখের হাসি বজায় রাখতে পারেন না। তিনি পণ করেছেন, স্বর্গে বসে জাকিরের সাথে বেশি কথা বাড়াবেন না। তার কূটকৌশলের কাছে শাহরুখের মতো স্মার্ট নায়কও শিশু; বরং দেশে ফিরে মডারেটেড টিভি টক শোতে তাকে সাইজ করা যাবে। তারপরেও উচিত কথা মুখে এলে না বলে উপায় নেই। জাকির নায়েককে কড়া করে জিজ্ঞেস করেন, "আমি মুসলমান না মুনাফিক, তা বলার আপনি কে? আপনি কি ঈশ্বর, নাকি নবী রসুল?"

জাকির নায়েক চটেন না, এ প্রশ্নের উত্তর তাকে অনেকবারই দিতে হয়েছে। তিনি কুরআনের রেফারেন্স ঝাড়েন, "ঈশ্বর বলেছেন, আমি তোমাদেরকে আমার প্রতিনিধিরূপে সৃষ্টি করেছি, সুরা পি, আয়াত কিউ। সুতরাং ..."

শাহরুখ তার এ উত্তরে আরো চটে গিয়ে কি যেন বলতে থাকেন, জাকির নায়েক তার পারসোনাল ব্যাপারে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে, এখন তারা কিছুক্ষণ চটাচটি করবে, আদম আর সেদিকে মনোযোগ দেন না; বরং চুপ চুপে বুলবুলকে জিজ্ঞেস করেন, "তোমাদের মুসা ইব্রাহীম ছেলেটার কথা বলো। সে নাকি বিরাট মোটিভেটর!"

বুলবুল কণ্ঠস্বর নিচু করে বলেন, "আপনাকে একটা গোপন কথা জানাই। এখানে ভিজিটর লিস্টে মুসার নামও ছিলো। কিন্তু সে আপনাকে মোটিভেট করার জন্য প্রতি স্বর্গীয় মিনিটে ৩ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল দাবি করায় ঈশ্বর শেষতক পিছু হটেছেন।" এ তথ্যে আদম ঈশ্বরের ওপর রাগ করতে পারেন না। স্বর্গে এমনিতেই গত দুই বছর ধরে মন্দা চলছে। এই পরিমাণ অর্থ মুসাকে দিতে হলে ঈশ্বরকেই বরং ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পথে বেরোতে হতো।

শাহরুখ-জাকিরের তর্কাতর্কি তখনো সমান বেগে চলছে। আদম বাথরুমে যাওয়ার নাম করে সেই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি খুঁজলেন।

মিনিট দশেক পরে ফিরে দেখেন, বৈঠকে বুলবুল নেই। হাওয়াও উধাও। তর্কাতর্কিতে জাকির নায়েক শাহরুখকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন। ম্রিয়মান শাহরুখ মিনমিন করার চেষ্টা করছেন। জাকির নায়েক তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে চলেছেন, "এটা কি ইন্ডিয়ার টিভির সাজানো টক শো পেয়েছেন নাকি, হ্যাঁ? লোকে কি আমাকে শুধু শুধু পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী বলে? আমি তর্ক দিয়ে যা নেই, তা আছে করে দিতে পারি, যা আছে, তা ও নাই করে দিতে পারি! আরে মিয়া, মিনমিন করেন ক্যাঁ? বিশ্বাস করলেন না? আসেন তর্ক করি, ঈশ্বর আছেন কি নেই। আমি বললাম, ঈশ্বর নেই! নিয়ান্ডারথালদের রচিত 'অনস্তিত্ব' গ্রন্থের তিন নম্বর অধ্যায়ের তেইশ নম্বর শ্লোকে আছে .....। তাছাড়া বিখ্যাত মণীষী আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন ....."

"আরে থামো, থামো। কি শুরু করলা বাবারা!" আদম মাঝপথেই থামিয়ে দেন জাকির নায়েককে। এখন তিনি যদি ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করে ফেলেন, তাহলে এই মন্দার দিনে পুরা ট্রাভেল বিলই আদমের ঘাড়ে এসে পড়বে। ঈশ্বর মুচকি হেসে বলবেন, "আমি তো নেই রে আদম, আমি বিল দিমু ক্যান?" আর জিবরীল বজ্জাতের বজ্জাত। সে নতমস্তকে এসে বলবে, "আমি তো আপনার আজ্ঞাবহ, হে আশরাফুল মাখলুকাতের বাপ। বিলের কথা তুলে আমাকে শুধু লজ্জা দেওয়া কেন!"

"বাবা জাকির, তুমি বরং আরেকটা বিষয়ে জ্ঞান দাও। ধর্ম ব্যবসায় নিয়ে তোমার মতামত কি? এটা কি পেশা হিসেবে ইসলামে জায়েজ?" আদম আলোচনার লাগাম ধরেন।

জাকির নায়েক একটু রুষ্টকণ্ঠে বলেন, "শুধু জায়েজ, না জায়েজের কোশ্চেন ক্যান? ধর্ম ব্যবসায় হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশা। পেশা হিসেবে ব্যবসায় হলো নবীজির সুন্নত। আর ধর্মের মতো পবিত্র বিষয় যদি সেই ব্যবসায় যোগ করা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!"

আবারো অকাট্য যুক্তি, আদম মাথা নাড়িয়ে প্রশংসাসূচক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এর মধ্যেই বুলবুল ও হাওয়া এসে হাজির। হাওয়ার চেহারা দেখে আদম পুরা হা হয়ে গেলেন। সে এমন উৎকট মেকআপ দিয়েছে যে, তাকে হাওয়া বলে আর চেনাই যায় না, প্রায় রাখী সাওয়ান্তের মতোই অশলীল লাগছে।

তারা এসে চেয়ারে বসতে না বসতেই জিবরীল এসে হাজির। সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো, "আপনারা আলোচনা শেষ করেন। ভোর হওয়ার আগেই পৃথিবীতে ফিরতে হবে।"

ফেরার সময় বুলবুল বায়না ধরলেন, তিনি হাওয়াকে সাথে নিয়ে যাবেন। সহবাস হোক, না হোক একসাথে বসবাস করলে সাপের ওপরও মায়া পড়ে যায়, আর হাওয়া তো মানুষ। তাছাড়া পুরুষের ব্যবহারিক কোনো কাজে ইদানিং না এলেও হাওয়াকে হাতছাড়া করার প্রস্তাব আদমের পৌরুষে লাগলো। তিনি বললেন, "হাওয়া আমার পাঁজরের হাঁড় দিয়ে তৈরি। তুমি নিয়া যাবা মানে? কি কও মিয়া, তোমার কি মাথা খারাপ হইছে নাকি!"

"মাথা খারাপ আপনারই হয়েছে! সেই সাথে চোখের মাথাও খেয়ে বসে আছেন। হাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? তার যে চেহারা তার ফুলক্রেডিট আমার!"

"কিন্তু আমার হাড্ডি ... " আদম মিনমিন করেন।

বুলবুল ঝাড়ি লাগান, "রাখেন মিয়া আপনার হাড্ডির আলাপ! এখন রিমিক্সের যুগ! রিমিক্স কইরা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতই পালটাইয়া দিলাম আর তো সামান্য মেয়েমানুষ!"

অসহায় আদম এবার তার শেষ অস্ত্র ছাড়েন, "বাবা বুলবুল, হাওয়া শত হইলেও তোর মায়ের মতো। তারে অন্তত রিমিক্স থেকে রেহাই দে বাবা!"

বুলবুল এখন আর সেই নিরীহ ঢোঁড়া সাপটি নেই, ধমক লাগান, "আরে ধুরু মিয়া, ঈশপের গপ শুনাইয়া কোন বালডা হইবো! ক্লোজআপ ওয়ানেই মা কইয়া কতজনের ...."


মন্তব্য

বোকাবলাকা এর ছবি

যা একখান প্রবন্ধ দিয়েছেন মামা,কি আর কমু,এক্কেবারে জব্বর। তয় মামা,এই লেখার জন্য শতকুঠি প্রশংসা থাকিল জানিবেন।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

থ্যাঙ্কু, মামা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

কৌস্তুভ এর ছবি

বেশ কিছু রেফারেন্স বুঝতে পারি নি বলেই হয়ত, পোস্টটা তেমন ইয়ে হল না।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কৌস্তভদা, এখানে রেফারেন্সের ব্যবহার হয়েছে রেফারেন্সসহ মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করার উদাহরণ হিসেবে। রেফারেন্সের বিশুদ্ধতার দিকেও নজর দেয়া হয় নি। যেমন, নিয়ান্ডারথালদের রচিত গ্রন্থ বা আরজ আলী মাতুব্বরের ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক বক্তব্য আসলেই আছে কিনা, তা যাচাই না করলেও রেফারেন্সের অপব্যবহার দেখাতে কোনো সমস্যা হয় না। একই কারণে, কোরআনের আয়াতগুলোর যথাযথ রেফারেন্সও দেখানো হয় নি, অনেকটা সেগুলোর ছায়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন,

"আর আকাশ ও পৃথিবী এবং এই দুইয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সে সমস্ত আমরা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি” (সুরা আল-আম্বিয়া আয়াত ১৬)"

এই রেফারেন্স দেখাইয়া অনেক ছাগুই বলে ইসলামে খেলাধুলা হারাম। এই লেখায় এই রেফারেন্সের ছায়া ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র।

(খেলাধুলার বিষয়ে জাকির নায়েকের বক্তব্য অবশ্য ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া)

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

কৌস্তুভ এর ছবি

সেই ধরনের রেফারেন্সের কথা বলছিলাম না বলাইদা। শাহরুখের স্টেজ শো সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপার সচলে শুনেছি, তাই সেই রেফারেন্সটা ধরতে পারলাম। এই ধরনের বড় মাপের রেফারেন্স, যেমন মিস করলাম প্রথম চরিত্রটির ক্ষেত্রে। এটা অবশ্যই আপনার লেখার দোষ না, আমার খবরটবর রাখার অল্পতা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

জঠিল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি লেখক এর ছবি

বুলবুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জাকির নায়েক বাধা দিলেন, "আপনারা এই স্বর্গে এসেও টিভি ছিনেমার আলোচনা ছাড়তে পারলেন না! একটু আল্লা-খোদার নাম নেন। ধরেন, আমার সাথে তাল ধরেন, ইয়া নবী ছালাম আলাইকা, ইয়া রসুল ....."

"কিন্তু আমার হাড্ডি ... " আদম মিনমিন করেন।

হাহাহাহাহাহাহাহা.........দুর্দান্ত!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

-অতীত

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

আজকালকার যুগে হাড্ডির আর দাম নাই, দাম হলো অলঙ্কারের। রবী ঠাকুর তার হাড্ডি দইয়ে গান লিখে গেছেন আর আমাদের রিমিক্সাররা সেগুলোকে ইচ্ছেমতো 'কাঁপিয়ে' জাতে তুলছেন!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি লেখক এর ছবি

জাকির নায়েক বাধা দিলেন, "আপনারা এই স্বর্গে এসেও টিভি ছিনেমার আলোচনা ছাড়তে পারলেন না! একটু আল্লা-খোদার নাম নেন। ধরেন, আমার সাথে তাল ধরেন, ইয়া নবী ছালাম আলাইকা, ইয়া রসুল

হাসতে হাসতে শ্যাষ! জয় হো জাকির না(লা)য়েক।

তবে বুলবুল আর মুসাকে টেনে এনে জাকির-শাহরুখের সাথে রিমিক্স করাটা কেন যেন খুব কাঁচা মনে হল। মনে হল লেখক ঘাড় ধরে এদের টেনে এনে মুখে একটা কিছু ডায়ালগ গুজে দিলেন।
বলাইদার গল্পে তো এমনটা হবার কথা না !
শেষটায় এসে ধাক্কা খেলাম। গল্পের এইরকম এন্ডিং কি খুব বেশি দরকার ছিল?

সাত্যকি

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এই পোস্ট মূলত ঘটনাবেইজড, ঘটনার লেজ ধরে আসে ব্যক্তি বা ব্যক্তির টাইপ। আর চার জন ব্যক্তির ঘটনার মধ্যে বুলবুলের সাম্প্রতিক নখরামি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গল্পের এন্ডিংটাও এজন্য হৃদয় বিদারক করতে হয়েছে।

গল্পের বুলবুল চরিত্রটি মোটামুটি স্বল্পবাক, শান্তিপ্রিয়, চুপচাপ; কিন্তু সে-ই মোক্ষম আকামটি করেছে। দেশকে মায়ের সমতুল্য ধরলে জাতীয় সঙ্গীত সেই মায়েরই একটি বৈশিষ্ট্য বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। গল্পের বুলবুল তার রিমিক্সের হাতটি দিয়ে মা হাওয়াকে বিকৃত করতে যেমন ছাড়েন নি, আমাদের আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলও তার 'সৃজনশীলতার' অপপ্রয়োগ করতে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীতকে ধর্ষণ করেছেন। - লেখার সময় আমার ভাবনা এমনই ছিলো। পাঠক না বুঝলে লেখার দুর্বলতা অবশ্যই।

চরিত্রগুলোর মুখে ডায়লগ গুঁজে দেয়ার কথা সত্য। চরিত্রগুলোকে ব্যক্তি হিসেবে না নিয়ে টাইপ হিসেবে নিলে এ বিষয়টা জাস্টিফাই করা যায়। যেমন, খেলাধুলা সম্পর্কে গল্পের জাকির নায়েক যে রেফারেন্স দিচ্ছেন, ওটা বাস্তবের জাকির নায়েকের রেফারেন্স না; বরং ছাগুগোত্রীয়দের রেফারেন্স। গল্পের জাকির নায়েক এই বিশেষ ধরনের ছাগুটাইপকে রেপ্রেজেন্ট করে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

তারাপ কোয়াস এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু


আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা


love the life you live. live the life you love.

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ধন্যবাদ।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

জটিল

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি লেখক এর ছবি

জটিল হো হো হো

---আশফাক আহমেদ

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

একটু সাবধানে থাকবেন ভাই। খপর পাইলাম ইশ্বর খুড়ো আপনার বিরুদ্ধে কপিরাইট ভায়োলেশনের অভিযোগে মামলা করার জন্য জোরেশোরে একজন আইনজীবী খুঁজতেছেন। জানেনই তো, আদম চরিত্রটা সেই সৃষ্টির আদ্যিকাল থেকেই তার মেধাস্বত্ত্বাধিকারভুক্ত : কপিরাইট © 0-২০১১ ইশ্বরখুড়ো.স্বর্গ্‌। সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত। উনি আবার 'সন্দেশের' পোস্টটা পড়ে এসব ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন হয়ে গেছেন ইদানিং । সুতরাং আপনি যে, অনুমতি চেয়েছিলাম..., কিম্বা - ইশ্বর সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি..., বা "যেহেতু চুরি = চুরি, সেহেতু চুরি = চুরি না" -- এই জাতীয় ধানাই-পানাই ইকুয়েশন কষে পার পেয়ে যাবেন, সে আশারও গুড়ে বালি !

সুতরাং, সাধু সাবধান !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।