আমার সন্তান যেন চোখ খুলে দেখে

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: শুক্র, ০৪/০২/২০১১ - ২:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

কাঁপাকাঁপি জিনিসটা সবসময় ভালো না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে হাইতির লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। অনেকে আবার ভ্রুকুঞ্চিত করে আদিম কাঁপাকাঁপির দিকে অদৃশ্য আঙুল বাঁকিয়ে ধরবেন, তারা নিতান্তই কাঁপনমূর্খ। আদিম রসাস্বাদনের সাথে কাঁপাকাঁপির কোনো সরলরৈখিক সম্পর্ক নাই, সেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ছন্দটাই আসল এবং সেই ছন্দে কাঁপাকাঁপি প্রায়শঃই ঋণাত্মক অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু রসায়ন, ভূতত্ত্বে কাঁপাকাঁপিকে সৎছেলের দৃষ্টিতে দেখা হলেও আমাদের বাংলাদেশে তাকে আদর করে পত্রিকার পাতা ভরা হয়, জনমানুষের চেতনাসুদ্ধা সেই কাঁপন পৌঁছে দেয়া হয়। ৩০ মিনিটের কাঁপাকাঁপিতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার যুগান্তকারী বিষয় আমরা সবাই জানি। এবার তার সাথে যোগ হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের মতো দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা। অবশ্য বিশ্বকাপের ৪৯ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৮ ম্যাচের আয়োজক বাংলাদেশের টিকেট না পাওয়া হতাশ দর্শক ঘরে ঘরে টিভিতে, রাস্তার মোড়ে বিগস্ক্রীনে এবং অতি অবশ্যই ছাপড়া চায়ের দোকানের কম্পমান চেয়ার-টেবিলে কি মাত্রার কাঁপাকাঁপি সৃষ্টি করতে পারবেন, যাতে দুনিয়াসুদ্ধা লোক কেঁপে কেঁপে দোয়া ইউনুস পড়বে, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

এই সন্দেহ জিনিসটা খুবই খারাপ। খালি খুঁতখুঁত করে। আরে ব্যাটা, আনিসুল হক কইছে বিদেশিরা এসে আশ্চর্যের সাথে দেখে যাবেন এই ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তুই হুদা সন্দেহ না করে বিশ্বাস করে যা। ৫৬ হাজার বর্গমাইল কি করে ৫৫ হাজারে নেমে এলো এ প্রশ্ন করার দরকার কি? বিগতা প্রাইমিনিস্টারের ভাষণে জনগণের জন্য আবেগমুখী কথা মেশানো শফিক রেহমান উইকিলিক্সের রেফারেন্স দিয়া কইছে বাকশালী নেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বই দিল্লীর কাছে বেঁচে দিছে, আর তো সামান্য হাজার খানেক বর্গমাইল! এছাড়া খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণের বিষয়টাও সঠিক, এমনকি তার জন্য আমাদের খাদ্যাভাস পালটানোরও দরকার নেই, শুধু খাদ্যের সংজ্ঞায় একটু অদল-বদল করে দিতে হবে। ভাতের বদলে আলু খাওয়ার শ্লোগান পালটিয়ে এখন আলুর বদলে রাস্তার ধুলা আর ডালের বদলে চান্দের আলো খেলেই চলে! এই দুইটা জিনিস খাদ্যের স্ট্যাটাস পেলে ফুটপাতের শিশুরা আরো তরতাজা হয়ে উঠবে, কবিরা আরো ফুরফুরে মেজাজে সুজলা-সুফলা-শস্য-রূপালার কবিতা লিখবেন।

আমাদের বড়ো হৃদয় আরো বড়ো হবে। বিদেশিরা এসে দেখবেন আমরা কতো অতিথিপরায়ণ! সরকার থেকে নাকি ইতিমধ্যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে মিরপুর এলাকা ছিমছাম করার জন্য। বিদেশিরা অবশ্য এতো বড়ো কাঁপাকাঁপির সময় বাদেও এদেশে আসেন, এনজিও করেন, ডলার দেন, টাকা নেন, সাজানো গোছানো গুচ্ছগ্রাম দেখেন, ভিডিও করে নিয়ে যান, আমাদের প্রাইমিনিস্টারের জ্বলজ্বলে গর্বিত চোখ ছলছল করে। তবে যাকে বলে পর্যটক, তা আমরা তেমন একটা পাই না। আমাদের ষোড়স শতাব্দীর মন্দিরে সাপের আস্তানা, আমাদের বিশাল সমুদ্র সৈকতে ভাসে ঝালমুড়ির ঠোঙা, আমাদের থানায় এসে কুংফু-কারাত প্র্যাকটিস করে চাইনিজ পান্ডারা এবং অতি অবশ্যই পুলিশের হাতে ধর্ষিত হয় একাকী বিদেশিনী। এসবের পরেও কোনো নিন্দুকের ব্যাটা আমাদের অতিথিপরায়ণতার সমালোচনা করতে পারবে না। আমাদের ইতিহাসই তার প্রমাণ। আমরা দুবাহু মেলে অতিথিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি, তারপর সেই দুবাহুতেই অতিথির পদযুগলের সেবা করেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী। আমাদের ইতিহাস জুড়ে আমলের পর আমল, মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল! এখন আর আমল নাই, আমলনামা কেমন খালি খালি লাগে। বিশ্বকাপ আয়োজনের উপলক্ষে বিনামূল্যে অতিথি সেবা দিয়ে আমল কামাইয়ের এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত হবে না।

আনিসুল হকের মতে আমরাই এবার চ্যাম্পিয়ন হচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের চিররক্ষাকর্তা অলৌকিক ঘটনার ওপর। পীর-সুফি-দরবেশ-বাটপাড়ের বাংলাদেশে অলৌকিক ঘটনা অহরহই ঘটে। পীরের অব্যর্থ সিটিংয়ে সন্তানসম্ভবা হয় লাইগেশন করানো স্বামীর স্ত্রী, বিবর্তনের সব সংজ্ঞাকে উলটে দিয়ে ফুটপাতের মানুষগুলোই হয় মানবজাতির ভবিষ্যত ত্রাণকর্তা, এত কাঁপাকাঁপির পরেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পুরান ঢাকার ইটের পর ইট। ঈশ্বরে সিজদা করতে করতে কপালে দাগ ফেলে দেয়া সরকারী অফিসের ছোট কর্মকর্তাটি ঢাকা শহরে প্লট কিনে, আমাদের স্বাধীনতাকে গলাটিপে হ্ত্যা করতে সর্বস্ব উজাড় করে দেয়া মন্ত্রী মইত্যাকে আমাদের রাজধানীর এক টুকরা সোনার জমি চিরকালের জন্য লিখে দেয়া হয়। এই দেশ অলৌকিকের দেশ। এই দেশ স্বপ্ন দেখার দেশ। মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়ো। আনিসুল হক তাই বড়ো করে স্বপ্ন দেখেন এই বিশ্বকাপে এবার আমরাই অলৌকিকভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছি।

তবে বদলোকেরা সন্দেহ করে পীরের পানিপড়ার ওপর পীরের নিজেরই বিশ্বাস নাই, অলৌকিকের ঘাপলাটা সে ভালোমতোই জানে, হয়তোবা জানে না, হিসাব করতে চায়, সমস্যা হলো হিসাব মেলে না, হিসাব মেলাতে গেলে আর পীর থাকা যায় না। অলৌকিকে বিশ্বাসী আনিসুল হক তাই কিছু হিসাবপত্তরের সূচনা করেন। এই হিসাবে আসে নিউজিল্যান্ডের শিশু সাহিত্যিক ডেভিড হিল। শ্রীলংকা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে নাকি তারা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিলো। বাংলাদেশও এবার নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে, অতএব বাংলাদেশও চ্যাম্পিয়ন! এদিকে রেকর্ডবুক বলে নিউজিল্যান্ডের সাথে ৩ ম্যাচ সিরিজের অর্থহীন শেষ ম্যাচে ইতিমধ্যেই সিরিজহারা শ্রীলংকা জিতেছিলো ৯৬ এর বিশ্বকাপের প্রায় বছরখানেক আগে। আনিসুল হক হয়তো তথ্যটা নিজে যাচাই করে দেখেন নি। দেখলে এই পারফর্ম্যান্সের সাথে তুলনা করে নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ করা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জিততে অলৌকিক ঘটনার ওপরে নির্ভরশীলতার ধার ধারতেন না, কোনো ম্যাচ খেলানো ছাড়াই সরাসরি কাপটা আমাদের হাতে তুলে দিতেন!

২।

কথা হলো, কেউ যদি স্বপ্ন দেখতে চায়, দেখুক, তাতে আমার এত চুলকানির মাজেজা কি? মাজেজা বদঅভিজ্ঞতা! স্বপ্ন এমনিতে খুব ভালো জিনিস। কিন্তু এই পোঁড়ার দ্যাশে যেটা দেখা হয়, সেটা শেষতক স্বপ্ন না হয়ে সিন্দাবাদের ভূত হয়ে দাঁড়ায়। এক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ঠেলায়ই দ্যাশের স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, এমনকি আড়িয়াল খাঁর বিলও ছেড়ে দে বাপ ডাইমেক্রন খাইয়া মরি অবস্থা। তার মধ্যে কয়দিন পরপর এইরকম কাঁপানি দিয়া আমাগো বুদ্ধিজীবীরা যদি স্বপ্নের কাউন্টার-ন্যারেটিভ ডিসকোর্স শুরু করে দেন, তাইলে আল্লার দুনিয়ায় কার্য-কারণের মধ্যে কোনো সম্পর্কের অস্তিত্ব থাকবে না। মেহেরজানের স্বপ্নে পাওয়া গল্পও আমাদেরকে চুম্মা দিয়া মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রাখতে হবে, কবর আযাব নিয়া আরব জাহানের কোনো নেককার বান্দার স্বপ্নেপ্রাপ্ত অভিজ্ঞতার চেইন মেইলও বছরের পর বছর ধরে গণ-ফরোয়ার্ড করে যেতে হবে। শিশু নির্যাতন করা মাদ্রাসার মোদাররেস ছাহেব ফেরশতা মারফত স্বপ্নে পাওয়া ওহীর দোহাই দিবেন এবং অবশ্যই অল্পবয়সী নূরজাহানকে চোখে ধরা প্রৌঢ় মোমিনউদ্দি প্রথম পক্ষকে তালাক দেয়ার গায়েবী নির্দেশ পাবেন।

পৃথিবীটা এমনভাবে স্বপ্নের ওপর চললে আমাদের অনেক কাজই সহজ হয়ে যেত। তেমন কোনো চিন্তাভাবনা করতে হতো না। আল্লার মাল আল্লায় যখন ইচ্ছা নিতো, আবার ইচ্ছামাফিক দিতোও। সমস্যা হলো, পৃথিবীটা এমন স্বপ্নের ওপর চলে না, বদখত পৃথিবী চলে ঘড়ির কাঁটার সাথে দৌঁড়ে দৌঁড়ে। তার এই চিরঅসমাপ্ত রেসে ২ আর ২ যোগ করে ৪ হতেই দেখা যায়, ১০ হয় না। কোনো যাদুটোনা, স্বপ্ন, অলৌকিকের হাত ধরে পৃথিবীর এই হিসেবে একটুও পরিবর্তন আসে না। আমরা একটু একটু করে আয়েশী স্বপ্নের আসক্ত গদিতে ঝিমাই, সময়ের ক্যানভাসে আমরা আরো অস্পষ্ট হই। আমাদের অতিথিপরায়ণতাগুলো কর্পূরের মতো উবে যায় সবুজ পাসপোর্টে বিদেশের বিমানবন্দরে, ইমিগ্রেশন অফিসে। আমাদের তেলের ড্রামে জীবন্ত মানুষগুলো কখনো পৌঁছায় সাইপ্রাসে, কখনো পৌঁছায় না।

৩।

আমরা ভেতো বাঙালি। আমাদের খাদ্যাভ্যাস পালটায় না। আমাদের অলৌকিক স্বপ্নগুলো গোয়াল ভরে গরু, গোলায় ভরে ধান দিয়ে যায় না। আমাদের এখন চোখ খোলার সময়, আমাদের এখন মাথা খোলার সময়, আমাদের এখন কাজের সময়। কাজের সময়ে অলৌকিক স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা মোটেই মানায় না।


মন্তব্য

অমিত এর ছবি

এইভাবেই হবে একসময়, খালি দেইখা যাইতে পারুম না আর কি।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হওয়ার কাজটা আরো সহজ হয়ে যেতো, যদি বুদ্ধিজীবিরা আবেগটা আরেকটু কম বেঁচতেন।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

হিমু এর ছবি

আনিসুল হকের ফুট আর মিটারে একটু সমস্যা আছে। উনি এখন এক হাজার বর্গমাইলও হাপিশ করে দিলেন। কিছুদিন পর বলবেন হাতের ছয় আঙ্গুল সমান না!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এটা মনে হয় ডিকন্স্ট্রাকশন ফর্মূলা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

শ্রদ্ধেয় আনিসুল হকের লেখাটা নিছক দর্শকের সাদামাটা আবেগ থেকে লেখা মনে হয়েছে।...

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

সমস্যা হলো, আনিসুল হকের আবেগ অনেকেই কেনে, অনেকেই তার লেখা পড়ে চোখের জল ফেলেছে। আবেগের বাণিজ্য বিশাল বাণিজ্য।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

আমাদের এখন চোখ খোলার সময়, আমাদের এখন মাথা খোলার সময়, আমাদের এখন কাজের সময়। কাজের সময়ে অলৌকিক স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা মোটেই মানায় না।

চলুক

------------------------------------------
আমার চারপাশ ডট কম

ধুসর গোধূলি এর ছবি

আবেগ থাকা ভালো, কিন্তু সেইটা দিয়ে বাংলাদেশকে একেবারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানানোটা 'ডাবর কি হাজমোলা' দিয়াও হজম করানো কষ্টকর। তবে, ক্ষেত্রটা দুর্নীতি হলে কোনো কথা নাই।

কৌস্তুভ এর ছবি

বড় হাছা কথা কইছেন!

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবি মজা লাগল অছ্যুৎ বলাইএর কথা পড়ে "এটা মনে হয় ডিকন্স্ট্রাকশন ফর্মূলা।" ঠিক কথাই বলছেন।
-------------------------------
[url= http://www.loverofsadness.net/show_quote.php]Sad Quote [/url]

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ওইটা বোধহয় শাহরুখ খান অভিনীত করণ জোহারের সিনেমার চিত্রনাট্যের খসড়া ভুলে ছাপা হয়ে গেছে বলাইদা হো হো হো

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ফাহিম হাসান এর ছবি

কাঁপনমূর্খ - অভিধানে যোগ করে নিলাম। গুরু গুরু

লেখা গুল্লি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

"চৈত্রী"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।