সফটওয়ারের বুদবুদ

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ০৭/০১/২০০৮ - ৩:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুবিনয় মুস্তাফীর লেখা পড়ে আমার মনে হল ভারতের অর্থনীতির বর্তমান বুদবুদ সম্পর্কে কিছুটা লিখেই ফেলি। আমার মনে আছে ছোটবেলায় একধরনের অংক করতাম যাতে হিসাব করতে হত বুদবুদের আকার কি হারে বাড়বে। আমাদের এখানের এই সফটওয়ার বুদবুদ আমার সব হিসাব ছাড়িয়ে বড় হয়েই চলেছে, আর আমি এই বুদবুদ ফাটার অপেক্ষায় কান বন্ধ করে অপেক্ষা করছি।

আগে শুরু করা যাক একটু পুরোনো ফ্ল্যাশব্যাক থেকে। এখানে সফটয়ার শিল্পের শুরু হল একরকম নব্বই দশকে উদার অর্থনীতির হাত ধরে। যদিও, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশীয় স্বয়ং-সম্পূর্ণতা আনার লক্ষ্যে আই-বি-এম কে তাড়িয়ে দিয়ে একরকম দেশীয় কোম্পানীদের ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। উইপ্রো, টিসিএস আর ইনফোসিসের সূত্রপাত এ সময়েই। তবে আসল কাজ করার সুযোগ আসে ওয়াই-টু-কে সমস্যার হাত ধরে। প্রচুর কাজ একসাথে এসে পড়ায় আমেরিকান কোম্পানিরা খরচা বাঁচাতে কিছু ভারতীয় কোম্পানীকে কনট্রাকটে কাজ আউটসোর্স করে দিতে থাকে। ভারতের বাজারে তখন সেই সামান্য টাকার চাকরি দেবার লোকও ছিল না। ফলে দলে দলে লোকে সফটওয়ার শিল্পে চলে আসে। কাজে সাফল্য পেয়ে অনেক কোম্পানী অন্য কাজও দিতে শুরু করে - একে একে আসতে থাকে সার্ভার ম্যানাজমেন্ট, ডেটাবেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা প্রোগ্রামিং-এর কাজও। কিন্তু আবার বাদ সাধে ২০০০ সালের মন্দা আর পরবর্তীকালের ৯/১১ হামলা।

আর এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে চাকরির বাজার। আমাদের এখানে মোটামুটি ভাল সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শেষ বর্ষে ক্যাম্পাসেই চাকরির ইন্টারভিউ হয়। কোম্পানীগুলো "ফ্রেশার" ছাত্রদের চাকরির অফার দিয়ে যায়। পরে পাশ করে বেরোলে ছাত্ররা সেই কোম্পানীতে সুবিধামত যোগ দেয়। ২০০০ সালে চাকরির বাজার এত ভাল গিয়েছিল যে আমাদের কলেজে খুব তাড়াতাড়িই কম্পিউটার সায়েন্সের সবার চাকরি হয়ে গেছিল, তারপরে অন্য বিভাগের ছেলেরাও সফটওয়ারের চাকরি পাচ্ছিল (ক্যাম্পাসে একজন একটার বেশী চাকরি পেতে পারে না, দ্বিতীয় চাকরি বাইরে থেকে পেতে হয়)। আমাদের ২০০১ সালে আমরা আরো তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়ে গেলাম - মাসে ১০-১২ হাজার থেকে শুরু করে ৩০-৩৫ হাজার পর্যন্ত মাইনে। কিন্তু বেরোতে না বেরোতে চাকরি বাজার থেকে উধাও - যারা অফার করে গেছে তাদের আর পাত্তা নেই। কেউ বলে নিতে পারবনা, কেউ বলে পরে নেব - আপাতত জায়গা নেই। খুব হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানীতে জয়েন করতে পারল ছেলেরা। এই মন্দা কাটতে সময় লেগে গেল আরো তিন বছর।

তিন বছর পরে দেখা গেল ভারতীয় কোম্পানীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীরাও বাজারে চলে এসেছে। কারণ মন্দার বাজারে, ভারতীয় কোম্পানীদের সাথে পাল্লা দেবার জন্য সেটাই ভাল কৌশল। আর এ এমন কৌশল, যে একজন তা অবলম্বন করলে বাকিরাও তা করতে বাধ্য। তাই, দলে দলে বহুজাতিক ভারতে অফিস খুলে অফারের ঝুলি নিয়ে কলেজে আসা শুরু করল ২০০৩-০৪ নাগাদ। আই-বি-এম ফিরে এল কোলকাতায়, যেখান থেকে তাদের অনশন ধর্মঘট করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এককালে। আবার ছেলেরা চাকরি পেতে থাকল ভাল বেতনের।

মুশকিলটা হল, এইবারে আর এই চাকরির বুদবুদের কোনো শেষের লক্ষণ দেখছি না। বুদবুদের আকার বেড়েই চলেছে। আমি ১৯৯৭ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছিলাম যখন পশ্চিমবঙ্গে সাকুল্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা ছিল ৬টি, যার মধ্যে একটি বেসরকারি। ছাত্র নেওয়া হত ১৮০০। আর এখন অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর সিট ২৫-৩০ হাজারের মত। কম্পুটারের ছাত্র সফটওয়ারের কাজ করবে - সে দিন আগেই চলে গেছে। নতুন ধারায় সিভিল, মেকানিকালের ছাত্রও সফটওয়ারের কাজে যোগ দেয় মাইনের লোভে। এদের চাকরির বাজার তুঙ্গে। সদ্য খোলা একেকটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের প্রায় অর্ধেকই দেখি ক্যাম্পাসেই চাকরি নিয়ে বসে আছে। টিসিএস মাঝে মাঝে এক-একটা প্রোজেক্ট পাচ্ছে যাতে ৮০০০ থেকে ১০০০০ "মাথা" দরকার। তারা আসে কোথা থেকে? ক্যাম্পাসে গিয়ে ধরে আনা হয়। পিছিয়ে নেই বিজ্ঞান বা কলা-বিভাগের ছাত্ররাও - ডিপ্লোমা করে তারাও নাম লেখাচ্ছে একই দলে। বেড়ে চলেছে চাকরির মাইনে - আর সাথে সাথে মাইনে না বাড়ালে অন্য চাকরিতে চলে যাও। গাদা গাদা রিক্রুটমেন্ট এজেন্সী খালি "মাথা" ধরে এনে দেয় - মাথাপিছু তাদেরও টাকা মেলে ভালই। এই সফটওয়ারের সূত্রে গগনচুম্বী হয়ে গেছে রিয়েল এস্টেটের দাম - শুধুমাত্র যে অঞ্চলে সফটওয়ারের লোকজন থাকে সে অঞ্চলেই। সফটওয়ারের সাথে যোগ দিয়েছে বি-পি-ও, ওপারের লোকজনের সাথে ফোনে ইংরেজীতে কথা বলার চাকরি। সাধারণ ছেলেরা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই কাঁড়ি-কাঁড়ি পকেটমানি তৈরী করে ফেলছে পার্টটাইম কাজ করে।

আর এর ফলে সমস্যাও কম তৈরী হচ্ছে না। একে তো নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের গুণগত মান খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে নেমে চলেছে আরেকদিকে ভাল ছাত্ররা শিক্ষকতার মত মহত পেশায় আর কেউ আসছেনা। বাজার তো ফুলেই চলেছে। সাধারণ সরকারি চাকুরেরা আর প্রতিযোগিতায় না পেরে উঠে মূল্যবৃদ্ধিকে দুষছেন। আর অন্যান্য শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দিচ্ছে - ভাবুন তো আর্কিটেক্টরা যদি দলে দলে সফটওয়ারে যায় তবে আর্কিটেকচারের কাজ কে করবে? কদিন আগে দেখলাম লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর মত নামকরা নির্মান শিল্পের কোম্পানী দাবী জানিয়েছে যে তাদের অধিকাংশ কর্মী প্রথম দু-বছরের মধ্যে ছেড়ে চলে যাচ্ছে - তাও কিনা সফটওয়ারে।

কিন্তু বুদবুদ ফাটলে কি ঘটবে? ভেবেও ভয় হয়। যে হারে টাকার(রুপি) দাম ডলারের বিরুদ্ধে বেড়ে চলেছে তাতে ক'দিনের মধ্যে আমেরিকায় সফটওয়ার রপ্তানী করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বেতনের বিল তো কোম্পানীর পকেট ফাঁকা করেই চলেছে। তাই এই গ্যাপ ভরাতে নতুন কোনো কৌশল অবলম্বন না করলে অবিলম্বে এই বুদবুদ তো সশব্দে ফেটে পড়বে। প্রভাবিত হবে সারা ভারতের সাথে সাথে আরো অনেক দেশও। তাহলে আমি কি নিজের চোখে দ্বিতীয় বুদবুদের পরিসমাপ্তি দেখতে পাব? (Hard Landing)নাকি কালের সাথে সাথে ধীরে ধীরে চুপসে যাবে? (Soft Landing) সেটাই এখন আমার কাছে লাখ টাকার প্রশ্ন।


মন্তব্য

রেজওয়ান এর ছবি

হুম ভারতের এই সাম্প্রতিক ডিফ্লেশন নিয়ে আমার মনেও প্রশ্নের উদয় হয়েছিল।

তবে আমার মনে হয় ভারতকে বাঁচাবে ক্রমবর্ধমান পুঁজি বিনিয়োগ ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোর ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট। ইউরোপে মেইড ইন চায়না মোটামুটি রাজ্য করছে। মেইড ইন ইন্ডিয়া হয়ত করবে কোন সময়।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

কনফুসিয়াস এর ছবি

চায়নার কথা আর বইলেন না, পুরা দুনিয়াটাই এখন মেইড ইন চায়না। অস্ট্রেলিয়ায় এসে দু একটা ড্রিংক্স আর ডেইরি বাদে কোথাও আমি মেইড ইন অস্ট্রেলিয়া দেখি নাই। এমন কি অস্ট্রেলিয়ান স্যুভেনিরগুলাও উল্টাইলে দেখা যায় মেইড ইন চায়না!
--------------
দিগন্তকে ধন্যবাদ। বুদবুদ নিয়ে লেখার জন্যে। অর্থনীতি ভাল বুঝি না, তাই ব্লগে আপনার আর মুস্তফীর এই লেখাগুলো পড়ে মজা পাচ্ছি।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমার পুত্রের তখন বছর চারেক বয়স,মাত্র পড়তে শিখছে। তার যাবতীয় খেলনায়, এমনকি ম্যাকডোনাল্ড থেকে হ্যাপি মীলের সঙ্গে পাওয়া খেলনায়ও লেখা দেখছে - মেড ইন চায়না। ঘরের অনেক ব্যবহার্য জিনিসেও তাই। একদিন জিজ্ঞেস করলো, বাবা আমেরিকাও কি মেড ইন চায়না?!!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ফারুক হাসান এর ছবি

হো হো হো
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

দিগন্ত,

আমার ব্যক্তিগত ধারণা (এবং এই ধারণা পুরোই ভূল হতে পারে) সেটা হচ্ছে এটা আসলে বাড়াবাড়ি-প্রসূত বুদবুদ না। বাব্‌ল বলতে একটা হুজুগে ব্যবসাই বোঝানো হয়। ভারত বাকি পৃথিবীকে যেই সফটওয়্যার সার্ভিস দিচ্ছে, সেটা যে আসলে হুজুগ তার তো কোন আলামত দেখছি না। বরং নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাতায় সোমিনি দিদি লিখছেন যে ২০১০ নাগাদ ভারতে ৫০০,০০০ আইটি-দক্ষ শ্রমিকের অভাব পড়বে। শর্টেজের ফলে ইতিমধ্যে ভারতের আইটি-শ্রমিকদের বেতন এত বেড়ে গেছে, যে ক্লায়েন্টরা আরো সস্তা অপশনের খোঁজে ফিলিপিন চীন ইত্যাদি দেশে চলে যাচ্ছেন। চমৎকার হেডলাইন দেখলাম সেদিন - Indian outsourcer outsources দেঁতো হাসি

আপনি মাঠে আছেন, আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে যে ভারত এই পুরো আইটি ব্যবসাটাই হারাতে যাচ্ছে? অবশ্য বাড়ন্ত রুপি আসলেই বিরাট থ্রেট এই দিক থেকে এবং আইটি রপ্তানী মার্কেট এতে প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

দিগন্ত এর ছবি

"আপনি মাঠে আছেন, আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে যে ভারত এই পুরো আইটি ব্যবসাটাই হারাতে যাচ্ছে?"

- এখানে গল্প হচ্ছে আই-টি ব্যবসা হারানোর সাথে বুদবুদের সম্পর্ক পাচ্ছিনা। আই-টি ব্যবসা হারানো দূরে থাক, আমার মনে হয় না বিশাল অঘটন কিছু না ঘটলে এখন এই সার্ভিস অনেককাল চলবে। কারণ এই শিল্পে দক্ষতা আনে দক্ষতা - মানে এক কোম্পানীতে ১০জন দক্ষ কর্মী থাকলে সেখানে ৫ জন অদক্ষ কর্মী নেওয়া যায় - কিছুদিনের মধ্যেই সেই অদক্ষরা আবার দক্ষে পরিণত হবে। এই পিরামিডের কোনো শেষ নেই। এখন পিরামিডে নিচের দিকে লোক ঢুকছে, তাই ফুলে ফেঁপে ওঠা পিরামিড ব্ল্যাক হোলের মত কর্মী গ্রাস করে ফেলছে। এটাই হল রসায়ন।
কিন্তু সমস্যাটা হল লোকে এটাকে অবিরাম নিরবিচ্ছিন্ন একটা পদ্ধতি ভাবছে - নাহয় ভাবছে এই বেলা দুটো পয়সা লাভ করে নিই। তার ফলেই এই বুদবুদ তৈরী হচ্ছে।
আউটসোর্সাররা আউটসোর্সিং শুরু করেছে এই রিস্ক কমানোর জন্যই। কোম্পানী বিভিন্ন দেশে থাকলে এই মুদ্রার দাম ওঠা নামা থেকে কিছুটা ইমিউনিটি মেলে। কিন্তু যদি খোদ আমেরিকার মার্কেটে মুদ্রার দাম পড়ে যায়, তাহলে কিছু বিশেষ করার নেই। রপ্তানী করবে কোথায়? যারা আজকে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করছেন বা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন তারা কি এটা ভেবে দেখেছেন?


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ঝরাপাতা এর ছবি

মিডল ইস্টে ইন্ডিয়ার বিশাল মার্কেট আছে, চীনের মতো অচিরেই তারা ইউরোপে ঢুকে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। আপনার লেখাটা চমৎকার লাগলো।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।