বেড়ালের চোখে মহাকাল

এনকিদু এর ছবি
লিখেছেন এনকিদু (তারিখ: শনি, ২৮/০৬/২০০৮ - ১০:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেড়াল, চিন্তা নেই, দুশ্চিন্তাও নেইপৃথিবী তৈরী করার পর দেবতারা ভাবলেন জগৎ সংসার চালানো এবং সকল জীবকে দেখাশোনার দায়িত্ব কোন একটি প্রানীর উপর ছেড়ে দিবেন । তাদের পছন্দের প্রানীটি ছিল বেড়াল । চিন্তাশীল ও ধীশক্তির অধিকারী বেড়ালকেই দেয়া হল সেই গুরুদায়িত্ব, দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে তাদেরকে দেয়া হল বাকশক্তি । যেন তারা জগতের আর সব প্রানীকে আদেশ করতে পারে, সেই সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে সৃষ্টিকর্তা দেবতাদের সাথেও । প্রথমে বেশ কিছুদিন সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলল ।

তবে আদতে বেড়ালেরা ছিল বড় আরাম প্রিয় । জগৎ সংসার চালানো আর তার জীবকূলকে দেখেশুনে রাখার একঘেয়ে কাজ করার চাইতে নরম উষ্ণ সূর্যের আলোয় গা এলিয়ে আয়েশ করা আর নয়ত ক্যাটনিপ[১] আর মাতাতাবাইয়ের[২] ঝোপে খেলাধুলা করতেই তারা বেশি ভালবাসত । ব্যপারটা সৃষ্টিকর্তা দেবতাদের চোখে পড়লে তারা বেড়ালদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন সদ্য তৈরী করা এই পৃথিবীতে তাদের কাজ কর্ম কেমন চলছে ।

" জগৎ সংসার চালানোর কাজটা আসলে আমাদের কাছে খুব একটা আগ্রহোদ্দীপক বলে মনে হচ্ছে না ", জানায় বেড়ালের দল । " ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিতে আর প্রজাপতির পিছু ধাওয়া করেই আমরা বেশি আনন্দ পাই । পৃথিবীকে আমরা চলতে দিচ্ছি তার মত । তাকে নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে আমরা উষ্ণ সূর্যালোক আর ফুলের সুবাস উপভোগ করাতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছি । " দেবতারা একটু বিরক্তই হলেন । সেবারের মত বেড়ালের দলকে হাল্কা সতর্ক করে দিলেন যেন ভবিষ্যতে এরকম না হয় । বেড়েলেরাও কথা দিল তারা এখন থেকে নতুন তৈরী করা এই পৃথিবীকে দেখাশোনা করার কাজে আরো মনযোগ দেবে ।

বেশ কিছুদিন পর দেবতারা আবার পৃথিবীতে আসলেন সব কিছু কেমন চলছে দেখতে । এবার তারা বেড়ালদেরকে আবিষ্কার করলেন চেরী গাছের ছায়ায় ঘুমন্ত আর নয়তো ঝরে পড়া চেরীফুল নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত । জগৎ সংসার দেখাশোনার কাজে বেড়ালদের নিষ্ঠা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হল ।

" সত্যি কথা বলতে কী, জগৎ সংসার চালানোর কাজটা আসলে বেশ একঘেয়ে । চেরী গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকা আর ঝরে পড়া চেরী ফুলের মাঝে ছুটে বেড়ান অনেক বেশি আনন্দের কাজ । তবে আমরা এখন থেকে পৃথিবীর দেখাশোনায় আরো বেশি মনযোগ দেব, কথা দিচ্ছি ।" প্রশ্নের জবাবে বলে বেড়ালেরা ।

দ্বীতিয় বারের মত বেড়ালদেরকে সতর্ক করার পর দেবতারা সেবার বিদায় নেন । আরো কিছুদিন পর তারা তৃতীয় বারের মত দেখতে এলেন পৃথিবীর অবস্থা । এবার তারা বেড়ালদেরকে আবিষ্কার করলেন গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে বাতাসে ভেসে বেড়ান শিমূল তুলার বীজ গুলোর পিছে দৌড়ে বেড়াতে ।

" সত্যি কথা বলতে কী, আমরা চিন্তা করে দেখলাম যে, পৃথিবী চালানো আর তার জীবকূলকে দেখেশুনে রাখার দায়িত্বটা আসলে আমাদের পছন্দ না । তবে আপনাদের সৃষ্ট জীবকূলের মধ্যে এমন এক প্রানী আছে, এই কাজে তাদেরকে অনেক বেশি প্রতিশ্রূতিশীল বলেই মনে হয় । কাজটা তাদেরকে দিয়ে দিলেই ভাল হয়, তাহলে আমরাও জগতে আনন্দের উৎস গুলো আরো ভালভাবে উপভোগ করতে পারি ", জানায় বেড়ালেরা ।

শুরুতে দেবতাদের চোখে মানুষেরা ঠিক এই কাজের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি, মানুষের দৌড় কতদূর তা সৃষ্টিকর্তা দেবতাদের ভাল মতই জানা আছে । এবার অনিচ্ছা সত্বেও দেবতারা রাজি হন, তবে এক শর্তে । নতুন করে যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হবে তাদেরকে বাকশক্তি দিতে হবে বেড়ালের বাকশক্তি রদ করে । যেহেতু এর পর থেকে বেড়ালদের করার মত কোন কাজ থাকবেনা, মানুষেরাই পৃথিবীটা নিজেদের মত করে গড়ে নিতে থাকবে, বেড়ালেরা যত খুশি রোদে গা এলিয়ে ঘুমাতে পারবে । বেড়ালেরা তাই রাজী হয়ে গেল ।

সেই থেকে মানুষ বাকশক্তির অধিকারী হল । আর বেড়ালেরা হয়ে উঠল আরাম আয়েশের প্রতীক । প্রকৃতির রঙ রূপ গন্ধ উপভোগ করা আর নরম রোদে গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানই যেন তাদের কাজ । তবে মানুষদের কে দেয়া হয়েছিল শুধুমাত্র পৃথিবী চালানর দায়িত্ব, সময় নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা দেয়া হয়নি । সেই ক্ষমতা এখনো বেড়ালের হাতেই রয়েছে । তাই আজো বেড়ালের চোখের দিকে তাকিয়েই সময় সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় । সকালে বেড়ালের চোখের গভীর কাল মনিটিকে ঘিরে থাকে সোনালী একটা রেখা । সময় যত গড়িয়ে যায় তার চোখের মনিটি ততই বন্ধ হয়ে আসতে থাকে । দুপুরে তা একেবারে বন্ধ হয়ে সোনালী চাকতির মাঝখানে একটুখানি চেরা দাগের মত দাঁড়ায় । বেলা যত বাড়তে থাকে তাদের চোখের মনি আবার প্রশস্ত হতে থাকে । সন্ধ্যায় তা হয়ে দাঁড়ায় আবার কাল রঙের পূর্ণ গোলাকৃতি, চারপাশে তার সোনালী রেখা ।

শুধু তাই নয়, সময় নিয়ন্তা বেড়ালের কন্ঠে মাঝে মাঝে যেই গরর শব্দ শোনা যায় তা হল আসলে বিশ্ব জগতের বিশাল ঘড়িটির যন্ত্রগুলোর চলার শব্দ । বেড়ালেরা আনন্দে গররগরর শব্দে জানিয়ে দেয় যে জগৎ সংসারের প্রধান ঘড়িটি এখনো ঠিকমতই চলছে । যদিবা কোনদিন বেড়াল এই শব্দ করা বন্ধ করে তবে বুঝতে হবে সেই ঘড়িটি থেমে গেছে । থেমে গেছে পৃথিবীর ঋতুচক্র, অন্তরীক্ষে চাঁদ,সূর্য আর তারাদের চলাচল, থেমে গেছে মহাকাল ।

[চীনের লোক-কথা]


[১]ক্যাটনিপ (catnip) : একধরনের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ । এশিয়া মহাদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় । এগাছের পাতা থেকে বিশেষ একধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যা বেড়ালের দেহে কিছু উত্তেজক হরমোন নিঃস্বরনের হারকে প্রভাবিত করতে পারে । ছেঁড়া বা থেতলে যাওয়া পাতা থেকেই এই রাসায়নিক পদার্থ অধিক হারে নির্গত হয় । কাজেই বেড়াল সেরকম কোন থেঁতলান বা ছেঁড়া ক্যাটনিপ পাতার ধারে কাছে আসলেই তার উত্তেজক হরমোন নিঃস্বরন শুরু হয় । ফলাফল হল বিড়ালের তুমুল লম্ফ-ঝম্ফ । হরমোনের প্রভাবে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে, মাটি খামচে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াল সবাইকে জানান দেয় যে তাকে ক্যাটনিপে ধরেছে । একবার ক্যাটনিপ ধরলে প্রায় ঘন্টা দুয়েক নতুন করে ক্যাটনিপ প্রভাব ফেলতে পারে না । এরপর সেই বেড়াল যদি আবার ক্যাটনিপ ঝোপের কাছে আসে তাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ।

[২]মাতাতাবাই : একধরনের লতানো গাছ । ক্যাটনিপের মত এই উদ্ভিদের দেহ নির্গত রাসায়নিক পদার্থেরও বেড়ালকে উত্তেজিত করার ক্ষমতা রয়েছে । চীন-জাপানে অসুস্থ বেড়ালকে চিকিৎসা করতে মাতাতাবাইয়ের ব্যাবহার রয়েছে । মানুষের চিকিৎসাতেও ভেষজ ঔষধ হিসেবে মাতাতাবাই ব্যাবহৃত হয়, তবে বিশেষজ্ঞ কবিরাজের কড়া তত্বাবধানে এই ঔষধ সেবন করা হয় ।


মন্তব্য

রায়হান আবীর এর ছবি

চিন্তিত

---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল

রেনেট এর ছবি

চিন্তিত
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

অতিথি লেখক এর ছবি

বিড়ালের যে এত ক্ষমতা ছিল এটা তো জানতাম না, জানলে সকাল বিকেল সালাম না দিলেও অন্তত মাঝে মাঝে যে ধোলাই দেই, সেটা দিতাম না।
এনকেদু ভাই, বিড়াল মাঝে মাঝে রাতের বেলা কান্না-কাটি করে। ওইটা কিসের আলামত? চীনের লোককথায় এমন কিছু লেখা নাই???

ইবা

এনকিদু এর ছবি

খুঁজে দেখতে হবে । হয়তো মহাকালের ঘড়ির ভেতর ধুলো পড়ে তার যন্ত্রগুলোর চলার পথে বাঁধা দিতে থাকে । তাই বেড়াল কাঁদে । অথবা নিছক পেট কামড়ায় বলেও কাঁদতে পারে ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মুশফিকা মুমু এর ছবি

খাইছে তাইনাকি খাইছে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

এনকিদু এর ছবি

আবার জিগান ! চীন দেশী বন্ধু থাকলে জিজ্ঞেস করেন, আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই । আমি নিছক অনুবাদ করেছি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

পড়ে আনন্দ পেলাম। একটু ব্যথিত এ কারণে যে, খন্ড-ত (ৎ) নিখুঁত।

ধন্যবাদ এনকিদু। তবে দীর্ঘ বিরতি দুঃখজনক!

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

এনকিদু এর ছবি

ধন্যবাদ জুলীয়ান ভাই । আসলেই দীর্ঘ বিরতি দুঃখ জনক । যেই কারনে দীর্ঘ বিরতি সেটা কোন একসময় ব্লগে পোস্টাব, বলার মত কিছু কারন আছে বটে ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ! এখন থেইকা বিলাইরে মাঝে মাঝে ঘড়ি বইলা ডাকুম হাসি

~ ফেরারী ফেরদৌস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।