ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-৪।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: শুক্র, ১৬/১১/২০০৭ - ১:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাস্টার্স এর শেষ দিকে আমি আমার বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। মানে আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। উনাকে চিঠিতে জানালাম যে তাঁর আর আমাকে টাকা পাঠানোর দরকার নেই। এখন থেকে আমি নিজের খরচা নিজেই চালাবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা ছাত্রজীবনটাই এক ধরণের অপরাধবোধ নিয়ে কাটিয়েছি। আমার বাবার ইচ্ছে ছিল আমি যেন ডাক্তার হই। সেই মোতাবেক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরিক্ষাও দিতে গিয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষার অংশটুকু ভালই হয়েছিল, কিন্তু ভাইবা পরীক্ষার সময় এক অঘটন ঘটেছিল, যার ফল হিসেবে আমার আর ডাক্তারী পড়া হয়নি। (সে গল্প পরে একদিন হবে)

আমার বাবা যদিও ভয়াবহ রকমের রাগী লোক ছিলেন, কিন্তু আশ্চর্য্যজনক ভাবে তিনি আমার এই ভরাডুবির জন্য কোনদিন আমাকে কিছু বলেননি। পরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম, তখন বাবা নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন প্রতি মাসে। যেহেতু আমার বাবার স্বভাবই ছিল বকাঝকা করা, তার এই হঠাত্ নীরবতার কারণ হিসেবে আমি ভেবেছি যে তিনি "অধিক শোকে পাথর" হয়ে গিয়েছেন। তাতে আমার অপরাধবোধ বেড়েছে আরো।প্রতি মাসে টাকাটা নিতে বড় খারাপ লাগতো, কিন্তু উপায় কি? এর সাথে ছিল সেশন-জট। চার বছরের কোর্স শেষ করতে প্রায় সাত বছর লাগলো। বাবা সে ব্যাপারেও কোনদিন প্রশ্ন করেননি। আমার তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবার কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা বন্ধ করা।

তখন আমাদের মাস্টার্স-এর পরীক্ষা শেষ, শুধু আমাদের থিসিসের কাজ বাকী। সেটা শেষ করতে আরো ছয়মাস লাগবে। এমনই সময় একদিন মাথায় কি ভূত চাপলো কে জানে। বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলাম যে আমি আর তার উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল নই। ম্যায় আজাদ হুঁ।

লিখে তো দিলাম, এখন মাস কাটবে কিভাবে? ডাল-ভাতের খরচাতো আছেই, ইতিমধ্যে বাবু আবার সিগারেটও ধরেছেন। দুশ্চিন্তায় মাথা দপদপ করতে থাকে।

হীরা ছিল আমাদের ক্লাশের মুস্কিল-আসান ছেলে। যদিও তাকে আবডালে ডাকতাম 'গাঁয়ে মানেনা, আপনি মোড়ল', কিন্তু ঝামেলায় পড়লে সবাই তারই শরণাপন্ন হতাম। আমিও গেলাম তার কাছে।
"দোস্ত, ভেজালে আছি। হেল্প দরকার।"
হীরা সব শুনে জিজ্ঞেস করলো,"চিঠি কি অলরেডী পোস্ট করে দিয়েছিস? তাহলে পিয়নকে ঘুস-টুস দিয়ে চিঠিটা ফেরত নেবার বন্দোবস্ত করি।"
আমি বলি,"টু লেট। চিঠি বোধহয় এতক্ষণে বাবার হাতে পৌছে গেছে।"
হীরা তাতে দমে না। চোখ বন্ধ করে মিনিট খানেক চিন্তা করে। "অসুবিধা নাই। দুটো দিন সময় দে। ইনশাল্লাহ্‌, একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। ভাল কথা-তোর এখন মাস চলতে কত টাকা লাগে?"
"চাপাচাপি করে চললে শ'চারেকের মধ্যে মাস চলে যায়।"
"ঠিক হ্যায়। পরশুদিন সকাল দশটায় আসিস।"

দুদিন পর হীরা শুভ-সংবাদ দিল। টাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সে আমার জন্য একটা টিউশানীর বন্দোবস্ত করেছে। সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে হবে, বেতন ছ'শো টাকা।

হীরারা সিলেটি। অধিকাংশ সিলেটির মতো হীরাদের আত্মীয়-স্বজনেরা একে অন্যের সাথে খুবই ক্লোজ। হীরা তার এক দূর-সম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের জন্য আমাকে ঠিক করেছে।
"আজ বিকেলে আমার সাথে যাবি। তোকে আমার চাচা-চাচীর সাথে আলাপ করিয়ে দেব। তোর ছাত্রটির সাথেও পরিচয় করে নিবি। তোর ছাত্রটির নাম আবদুস শাকুর, ক্লাস সেভেনে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে। ছাত্র হিসেবে সে বেশ খারাপ। তাকে নিয়ে চাচা-চাচীর মনে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে তো উনারা শাকুরের বাবা-মায়ের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না।"
ব্যাপারটা গোলমেলে লাগলো।
"তুইই না বললি শাকুর তোর চাচাতো ভাই, তাহলে তোর চাচা-চাচী আবার কার কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না?"
"ও- হ্যাঁ-শাকুর হচ্ছে আমার রতন চাচার ছেলে, উনি আর সুসান আন্টি লন্ডনে থাকেন। শাকুরের জন্মও লন্ডনেই, সে ওখানেই স্কুলে পড়তো। কিন্তু ওখানে সে আজেবাজে ছেলেপেলেদের সংসর্গে পড়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছিল দেখে রতন চাচা গত বছর শাকুরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন তার ভাই কুটু চাচার কাছে। কুটু চাচাই এখন শাকুরের লিগ্যাল গার্জেন। আর তুই হচ্ছিস কুটু চাচার একমাত্র ভরসা। এখন যে করেই হোক শাকুরকে তোকে পাস করাতেই হবে। তুই ইংরেজি টুকটাক বলতে পারিস এইজন্যে তোর কথা বলেছি চাচাকে। লাগলে কুটু চাচা বেতন বাড়াতেও প্রস্তুত।"
এতো দেখি গরম তাওয়া থেকে জ্বলন্ত উনুনে। কিন্তু করার কিছুই নেই আর, পেটের ভাত জোটাতে হবেতো।

হীরার কুটুচাচারা লালমাটিয়ায় থাকেন। বিকেলে সেখানে গেলাম হীরা সমেত। চা-নাস্তার বিরাট বহর সামনে চলে এলো। এলোমেলো কথার পর হীরা বললো,"চল, পাশের ঘরে যাই। বেচারা এখানে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।"
পাশের ঘরটি শাকুরের। সে মাথা নীচু করে বিছানায় বসা। হীরা আমাকে দেখিয়ে বললো,"উনি তোমাকে পড়াবেন।" তারপর সে আমাদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।
ছোট একটি সালাম দিয়ে শাকুর আবার মাথা নীচু করে থাকে। এতো দেখি লজ্জাবতী লতা। আমি জিজ্ঞেস করলাম,"তোমার নাম কি?"
এ প্রশ্নে শাকুর যেন ভয়ানক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। তারপর ছাদের দিকে তাকায়, দেয়ালের দিকে তাকায়, ঘরের মেঝের দিকে তাকায়। আমি অবাক। কানেও কি কম শোনে নাকি ছোকরা? তখন হঠাত্ত মনে পড়লো যে এরা তো সিলেটি। এরা তো আবার বাংলা জানেনা।
জিজ্ঞেস করলাম,"নাম খিতা?"
এবার মুখ খুললো। ত্বরিতে জবাব এলো,"শুক্কুর।"
বুঝলাম বাবাজী শুধু ইংরেজী আর সিলেটি জানেন। বাংলা জানেন না। কি আর করা। তাইই সই।

পরের সপ্তাহ থেকে আমি পুরোদমে টিউশানী শুরু করে দিলাম।
শাকুরের বয়েস তেরো। তার মুখে সবসময় একটা নির্লিপ্ত ভাব। গালে হালকা দাড়ি উঠছে। তার গুণের মধ্যে হচ্ছে যে সে খুবই শান্ত প্রকৃতির ছেলে। আমি তাকে যখন কোন কিছু বোঝাই তখন সে বড়বড় চোখ মেলে শান্ত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর দোষ হচ্ছে যে তাকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে কোনকিছু বুঝতে পারছে কিনা। সে কখনো প্রশ্ন করেনা, বলেনা তার কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। যদি জিজ্ঞেস করি, সে হেসে মাথা নাড়ে। ভাব দেখে মনে হয় সবকিছু পানির মতো পরিস্কার।
শাকুরকে পড়ানো শুরু করেছিলাম সম্ভবতঃ আগস্ট-সেপ্টেম্বারের দিকে। ডিসেম্বরে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা হবে। সেখানেই হবে আমার দক্ষতার পরিচয়। শাকুরের চেয়ে আমারই টেনশন বেশী। আদা-জল খেয়ে লেগে পড়ি।
মাঝে মাঝে হীরা জিজ্ঞেস করে, "কিরে-তোর ছাত্র কেমন করছে?"
আমিও আমার ছাত্রের মতো একটা মারফতী-মার্কা হাসি দেই। পরিস্কার, সব পানির মতো পরিস্কার।
ডিসেম্বর এগিয়ে এলো। শুরু হোল শাকুরের ফাইনাল পরীক্ষা। তখন তাকে সপ্তাহে তিন দিনের বদলে প্রতিদিনই পড়াতে যাই। কেমন হচ্ছে পরীক্ষা তোমার? এই প্রশ্নে শাকুর গাল ভরে হাসে। ভাল, খুবই ভাল। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি। মাওলা-সম্মানটুকু রেখো।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে হঠাত্ ঢাকা ছাড়তে হোল দশ বারো দিনের জন্য। ফিরে এলাম জানুয়ারীর মাঝামাঝি। বিকেলে লাইব্রেরীতে গেছি থিসিসের উপর কাজ করতে। দেখা হোল হীরার সাথে। "দোস্ত- একটু বাইরে আয়। কথা আছে।"
"কি ঘটনা?"
"তুই কালকে একটু শাকুরদের বাসায় যাস। কুটুচাচার মন খারাপ।"
"কেন?"
"শাকুরের রেজাল্ট ভাল হয়নি তেমন।"

পরদিন গেলাম শাকুরদের বাসায়। অনেকদিন পর আমাকে দেখে শাকুর একগাল হাসলো। তাকে জিজ্ঞেস করি,"শুনলাম তোমার রেজাল্ট বার হয়েছে। হাউ ইজ ইট?"
"ভাল।"
"দেখি নিয়ে এসো তো তোমার প্রগ্রেস রিপোর্ট।"
প্রগ্রেস রিপোর্ট দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। আটটা বিষয়ের মধ্যে শ্রীমান পাঁচটাতেই ফেল করেছেন। ইনক্লুডিং ইংরেজী। লন্ডনে জন্মানো ব্রিটিশ নাগরিক ইংরেজীতে ফেল। আমি হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাইনা। "এই রেজাল্টকে তুমি ভাল বলছো?'" তাকে শুধোই।
"ইয়েস।" ভদ্রলোকের এক জবান।
কেমন যেন একটা সন্দেহ হোল আমার। বললাম,"তোমার আগের পরীক্ষার রিপোর্টটা আনো তো দেখি।"
সেটা দেখে সবকিছু ক্লিয়ার হোল। বাবাজী আগের পরীক্ষায় সবগুলো বিষয়েই ডাব্বা মেরেছিলেন। সেই হিসেবে শাকুরের এবারের রেজাল্টকে ভাল বলতেই হবে।

পরদিন হীরাকে বললাম,"দোস্ত- মাপ করতে কত টাকা নিবি? শাকুরের মতো রতনের যোগ্য সমাদর করতে পারার মতো ক্ষমতা নেই আমার।"
হীরা বললো,"জানতাম, তুই এই কথাই বলবি। তোর দোষ নেই। তবে চাচা-চাচীর কথা চিন্তা করে কি আরো কয়েকটা মাস চেষ্টা করবি নাকি? তোর হাতে পড়ে ওতো তিনটেতে পাশ করেছে।"
"তুই চাচা-চাচীর কাছে আমার হয়ে মাপ চেয়ে নিস। আমি এর মধ্যে আর নেই।"
"সেটা নিয়ে চিন্তা করিস না। চাচা-চাচীকে আমি ম্যানেজ করবো। কিন্তু তোর আয় বন্ধ হলে তুই খাবি কি?"

হীরা চলে যাবার পর প্রশ্নটি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। এখন মাস চলবে কি ভাবে?
এমনি সময়ে এগিয়ে এলো আরেক বন্ধু। চঞ্চল। সে গল্প পরের পর্বে।

_________________
ফুটনোট:
শাকুর পরে লন্ডন ফিরে যায়। এখন সে ব্যবসা করে বিশাল টাকার মালিক।

আইডি: "নির্বাসিত"


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

মজাই লাগলো শাকুর পর্ব পড়ে।
হীরা কোন বিভাগের ছাত্র ছিল? দর্শনের নাকি?
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

হিমু এর ছবি

প্রিয় নির্বাসিত,

আপনার ইমেইল ঠিকানাটি আমাকে মেসেজ করে জানাতে পারেন।

পাশাপাশি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি, কোন লেখা একই সাথে একাধিক জায়গায় প্রকাশ না করার। এ অনুরোধ রক্ষা করলে বাধিত হবো।

ধন্যবাদ।


হাঁটুপানির জলদস্যু

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হুম। চলুক

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বুঝলাম বাবাজী শুধু ইংরেজী আর সিলেটি জানেন। বাংলা জানেন না।

মজা পেলাম । সিলেটি আর বাংলা- দুটো আলাদা ভাষা বানিয়ে দিলেন হাসি
-----------------------------------------
'জলপ্রিয় হে যুবক, তোমার ভিতরে এত
ভাঙনের পতনের শব্দ শুনি কেন!'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে সিলেটি আর বাংলার ভিতরে যে পার্থক্য আছে, সেটা আমাকে সিলেটীরাই প্রথম ধরিয়ে দেয়। অনেক সিলেটীকে বলতে শুনেছি যে অমুক সিলেটী না, বাংগালী।
যেহেতু নিজে সিলেটী নই, যখন যা শুনি তাই বয়ান করি।

-নির্বাসিত

অতিথি লেখক এর ছবি

ঢাবি মাইক্রোবায়োলজির কোন ব্যাচের আপনি?

সাইফ তাহসিন এর ছবি

শাকুর মিয়া দেখি ব্যাপক জ্ঞানি! ৩-৪ মাসের ধাক্কায় ৩-৪ বিষয়ে পাস করেছে! আমি তো মনে করেছিলাম, মহা বান্দর হবে চোখ টিপি
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।