আমি রাজাকার হবো

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফুল আরেফীন (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/১২/২০০৭ - ৪:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[লেখাটি ইতিপূর্বে জার্মানী থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক "অরিত্র"র জানুয়ারী-মার্চ ২০০৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল]

শহীদুল ইসলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য সাহসীকতার জন্য তাঁকে 'বীরবিক্রম' উপাধিতে ভূষিত করেছে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সে একক প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইল শহরের গোটা একটি থানা উড়িয়ে দিয়েছিল ! আজ তাঁর বয়স প্রায় ৪৩। যখন যুদ্ধ করেছেন তখন তাঁর দুচোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক আশা ছিল। সৌভাগ্যবান কারো কারো মতোন উনিও শেষতক বেঁচে ছিলেন। স্বাধীন দেশের মাটিতে পতাকা ওড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। কন্ঠনালী ফাঁপিয়ে তুলে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পেরেছিলেন!

স্বপ্নের তখন কেবল শুরু। স্বপ্নের সেই ঘোড় না কাটতেই দেখলেন যাদের বিরুদ্ধে এতোদিন প্রানপণ করে যুদ্ধ করেছেন, তাদের দোসরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। ওরা আবারও পূণর্বাসিত হলো শহীদুলদের গড়ে দেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে! স্বপ্নের ঘোড়টা তখন বেশ গাঢ় ছিল। ফলে শহীদুলের মনে হলো ঠিকই আছে সবকিছু। হলোই বা ওদের ক্ষমা! দেশতো আমাদেরই। তাছাড়া, সবাই চেনে ওদেরকে। ওদেরকে তো আর ভোলা যাবে না!

শহীদুল জানতো না, ওটা স্রেফ তার স্বপ্নই ছিল। জানতো না, এদেশটা একটা চরম অকৃতজ্ঞ আত্মভোলা জাতি। জানতো না এদেশটা একদিন দূর্নীতির পলিভূমি হবে! জানতো না এদেশে তাঁকে সারাজীবন দিনমজুরের জীবিকা নিয়ে বাঁচতে হবে। ছেঁড়া পোশাকে সন্তানদের ঈদ করাতে হবে। শহীদুল আরো জানতো না যে, একদিন ক্ষমাপ্রাপ্তরাই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে! এসবকিছু জানলে ১৩ বছরের শহীদুল কিংবা ১২ বছরের লালু বুকে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাপিয়ে পড়তো কি না আমরা জানি না।

শহীদুল সবচেয়ে বড় যে ব্যপারটি জানতো না সেটা হচ্ছে, তাঁর ঐ পদকটিও একসময় খোলা বাজারে নামমাত্র মূল্যের পণ্যে পরিণত হবে এই কুলাঙ্গার জাতির কাছে। অথচ একটা ধাতূর পদকের জন্য সে প্রাণপন করে যুদ্ধ করেনি! ৭১ এ কেউ যুদ্ধ করেছে মায়ের আব্রুর দাম শোধ করতে। কেউ বোনের। কেউ স্ত্রীর। কেউবা যুদ্ধ করেছে পিতার হত্যার বিচার নিতে। প্রয়োজনটা ছিল সময়ের। পদকের নয়। দেশকে স্বাধীনতা দেবার বিনিময়ে আমরা শহীদুলকে একটা পদক দিয়েছি। অথচ শহীদুলের সন্তানরা ঈদে একটা ভালো কাপড় পড়তে পারে না। অবশ্য এটা নিয়ে তাদের কোন আক্ষেপ নেই! বাবাকে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, কাপড়-চোপড়ের দরকার নেই। তারা এমন একজন বাবাকে পেয়েই অনেক গর্বিত! অনেক তৃপ্ত!

সেদিন BBC তে স্বাক্ষাত্‍কার দিতে গিয়ে বীরবিক্রম শহীদুল ইসলামের গলা বার বার ধরে আসছিল। কথাগুলো বলতে বলতে সে আক্ষেপ করে উঠলো, “এইটা তো পুরাপুরি স্বাধীণতা হইলো না; তখনো এইহানে সেইহানে মানুষ মরতো, এহনও মরে। সারা রাস্তাঘাটে রক্ত আর রক্ত ছিল, এহনও তাইই"।

শহীদুল আজ বেঁচে আছে শুধু সন্তানদের ঐ গর্বটুকু ধারণ করে। আমরা এখন পাঁয়তারা করছি মুক্তিযোদ্ধাদের এই শেষ গর্বটুকুও কেড়ে নিতে।
বোমাবাজদের চিরকুটে যখন লেখা দেখি, “বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান করা যাবে না”, “জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা যাবে না”,“জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না” --- তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঠিক কারা আমাদের এই মুক্তির বণ্যাকে মেনে নিতে পারছে না। জঙ্গীদের লেলিয়ে দিয়ে কারা যেন ৭১ এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সচেষ্ট!

বড় দুঃখ নিয়ে বলছি, আজ আমার বড়ই আফসোস হয় এটা ভেবে যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার পরিবারের কারো মুত্যু হয়নি! কাউকে পাকসেনাদের পাশবিকতার স্বীকার হতে হয়নি। আমার বোনকে বাবার চোখের সামনে বিবস্ত্র অবস্থায় সিলিঙের সাথে ঝুলে থাকতে হয় নাই! যদি এমনটা হতো, তাহলে জামাতীদের আসল রুপ আরো একটি পরিবার মনের এলবামে গেঁথে রাখতো! বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার থেকে ন্যূনতম একজন করে সদস্যকে যদি জামাতীরা হত্যা করতো তবেই আজ মাত্র ৩৫ বছরের পরিক্রমনে সবকিছু ভুলে আমরা এদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পূনবার্সিত করতাম না!

এ প্রজন্মের চেতনার সঙ্কটে আচ্ছন্ন অনেকেই মনে করে (এমনকি কোন কোন বিকৃত ঔরসের কুলাঙ্গার সন্তান সক্রিয়ভাবে সমর্থনও করে) জামাতীরা ইসলামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি আদর্শবাদী দল। অথচ, এরা আদতে কোনও ধর্মীয় দল নয়। আর দশটা উচ্ছিষ্টভোগী দলের মতোই একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দল। বাকিদের সাথে এদের পার্থক্য হচ্ছে এই যে, এরা রাষ্ট্র হিসেবে কখনোই বাংলাদেশের জন্ম চায়নি বরং প্রাণপনে আমাদের বিজয়কে বাধাগ্রস্ত করেছে। ১৪ই ডিসেম্বর নতুন করে জন্ম লাভ করতে যাওয়া এই জাতিকে আদর্শ-শিক্ষা-মানবতাবোধ-সংস্তৃতি- এবং -নৈকিতভাবে পঙ্গু করে দেবার জন্য এরা শেষ মরণকামড়টুকু হানে। রাতের অন্ধকারে আক্রান্ত হিংস্র পশুর মতোন গুলী করে হত্যা করে এদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে। হয়তো এই দেশকে অন্ধ করে দেবার তাদের সেই চক্রান্ত অনেকটাই সফল হয়েছে; নাহলে আমরা এতো দ্রুত সব ভুললাম কি করে!? আজ আমাদের শরীরে শুধুই একটা পাকস্থলী আছে, হৃদয় নামে আদৌ কোনও যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না! আমরা চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে অথর্ব, জরাজীর্ণ একটা জাতিতে রুপান্তরিত হয়েছি। কারো মৃত্যু আমাদের আর বিচলিত করে না। কারো কান্না আর আমাদেরকে কাঁদায় না।

একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবার কিভাবে বেঁচে আছে, কি খাচ্ছে আমরা সেটা ভেবে দেখার জন্য অবসর পাই না। গোলাম আজম আর নিজামীর সন্তানেরা খোলা ক্যাম্পাসে সদম্ভে দাঁড়িয়ে বাপ-দাদাদের কুকীর্তিকে ইসলামী চেতনার মোড়কে ঢেকে চটি বই আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলার আনাচে কানাচে। সেই বই পড়ে আমাদের আলেম (!) সন্তানেরা দেশজুড়ে বোমাবাজি করে দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের হাত কতো বড়! শক্তি কতো বেশী! আর আমরা বাংলামায়ের কিছু অজ্ঞ, মূক ও বধির সন্তান প্রতিদিন সেই দৃশ্যে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছি। কেন আমাদের কি হাতে অস্ত্র নেই?! রক্তে আগুন ধরাতে পারে এমন কোন চেতনা নেই!? মুক্তিযুদ্ধের মতোন অসামান্য একটা ঘটনার স্বাক্ষীবাহী জ্বলজ্বলে কোন অতীত নেই?! পৃথিবীতে ঠিক আর কয়টা দেশের আছে আমাদের মতোন এমন উজ্জল অতীত? নাকি আমাদের চেতনায় সেই ধার নেই যেটা আছে জঙ্গীবাজদের চটি বইতে?!

ধর্মকে নিয়ে যারা রাজনীতি করে, ধর্মকে নিয়ে যারা সন্ত্রাস করে আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে তাদেরকে রুখে দাঁড়াই। “সংবিধানে মানুষ আইন প্রনয়ন করে এবং সংবিধানে মানুষের তৈরি আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়, এই কথা জানিয়াও যাহারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিল বা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী এমন কাউকে ভোট দিল তাহারা আল্লাহর আইন মানিল না বিধায় ইসলাম হইতে বাহির হইয়া গেল!” --এই হচ্ছে জামাতিদের ইসলামী বিশ্বাস (যদিও নিজেরাই ক্ষমতার স্বার্থে এমন নির্বাচনে বহুবার অংশ নিয়েছে!!)! মওদুদীবাদের ধামাধরা এই মিথ্যাচারী সংঘটির বিপক্ষে এখনই জনমত তৈরি না করা হলে আমাদের আবারও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

কোনও দেশের জন্য তাবেদারী করা যদি রাজাকারী হয় তাহলে আমি আজ সবার সামনে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, প্রয়োজনে আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজাকার হবো! কিন্তু কোনও পাকিস্তানী রাজাকারকে এদেশে আর পূনর্বাসিত হতে দেব না!

শহীদুল ইসলাম আর লালুর বীরগাঁথা শুনে আমারও খুব ইচ্ছে করে এতোবড় একটা ঘটনার স্বাক্ষী হতে! ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিতে! ইচ্ছে করে দেশের মানুষের চোখে স্বপ্ন ফোটাতে। তাদের কাছে মহাবীরের সম্মান পেতে! আমার ইচ্ছে করে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে। পেছনে দাঁড়িয়ে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী একবুক শঙ্কা নিয়ে আমাকে সজল চোখে বিদায় দেবে। আমি তার কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলবো: “ভেব না, আমি ফিরে আসবো .... তোমার জন্য একটা স্বাধীন দেশ নিয়ে!”

লুৎফুল আরেফীন


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ভালো লিখেছেন।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার দেশপ্রেম। বড় অল্পতেই দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেই আমরা, দেশদ্রোহীরা কিনে নেয় কুলাঙ্গারদের, শহীদুল ইসলামরাই বারবার শোষিত হয়। রাজাকার এবং তাদের সকল দোসর নিপাত যাক।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি লেখক এর ছবি

@ সুমন ভাই,
ধন্যবাদ

@ বলাই,
হ্যা, কি করিলে কি হইতে পারে, এটা সবার জানা।
দরকার শুধু দেশপ্রেম।

হিমু এর ছবি
হাসান মোরশেদ এর ছবি

পত্রিকায় দেখলাম মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা খাচ্ছে রাজাকারেরা ।
জয়বাংলা

-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

হিমু ভাইকে ধন্যবাদ।

হাসান ভাই, শুধু কি সম্মানী ভাতা, সবই খেয়ে নিচ্ছে। সহায়, সম্পত্তি, চাকরী-বাকরী,......বাদ নেই কোনোওটাই

বিজয়ের মাসে এদের নিয়ে আরো লিখতে হবে।

-আরেফীন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।