সর্বশেষ সংবাদ (একটি রাজনৈতিক ফিকশন)

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফুল আরেফীন (তারিখ: বুধ, ০৫/১২/২০০৭ - ৬:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
বি.বি.সি.’র বাংলা বিভাগের খবরটা শোনার জন্য আমরা ক’জন বন্ধু কানখাড়া করে বসে আছি। খবরের আকস্মিকতায় ছটফট করছি। সম্ভবতঃ গোটা ঢাকায় লোডশেডিং। টি.ভি. চলছে না। সুতরাং ব্যাটারী চালিত রেডিও ভরসা! ক্যান্টিনের লালমিয়ার রেডিওটার দিকেই এখন সবার মনোযোগ। কানখাড়া। টানটান উত্তেজনা। এক দুই করে লোকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে ক্যান্টিনে। এগিয়ে গেলাম এক চেনামুখ দেখে-

- “কিরে দোস্ত, শুনলাম ২ শালায় নাকি শ্যাষ!?”
- “এখনোও কনফার্ম না। শাহেদের ফোনের অপেক্ষাতে আছি” বন্ধুটি জানালো।
- “বাড়িতে ফোন দে না। ওরা টিভি দেউখ্যা কউক” আমি অধৈর্য হয়ে উঠি।
- “বাসায় লোডশেডিং। অসুবিধা নাই। এখ্খুনি খবর হইবো গুলি খাইছে, তয় মড়ছে কি না এহনও জানি না।”
- “ওহ তাই তো। লোড শেডিং”।

২.
এর ঠিক তিন ঘন্টা ২০ মিনিট আগের ঘটনা।
আমি আর সজীব একটা অন্ধকার ছাদের ওপরে বসে আছি। সজীবের হাতে বৃটিশ মেইড একটা ৮৫ মডেলের ফার্স্ট-রেটেড স্নাইপার রাইফেল। এখন পর্যন্ত এরকম একটা অস্ত্রের অফিসিয়াল কোনও রেকর্ড নাই বালাদেশে। অর্থাৎ রেকর্ড অনুযায়ী রাইফেলটির কোনও কপি বাংলাদেশে নেই! আমার হাতে রয়েছে একই মডেলের আরো একটা। হালকা নীলচে বর্ণের অত্যাধূনিক মেশিনটি রাতের অন্ধকারের সাথে কেমন যেন মিশে গেছে। ভালো করে না তাকালে বোঝা যাচ্ছিল না সজীব সেটা ছাদের অর্ধ-দেয়ালের একটা অংশে সেট করে রেখেছে। নলটা প্রায় ৬০০ মিটার দূরের একটা অনুষ্ঠানের প্যান্ডেলের দিকে অনির্দিষ্টভাবে তাকিয়ে আছে। স্কোপ দিয়ে দেখা যায় এরকম অবজেক্টকে ৬০০ মিটারের দূরত্ব থেকে ৮৫ভাগ নিশ্চয়তার সাথে আঘাত করতে সক্ষম এই যন্ত্রটি। রেঞ্জে প্র্যাকটিসের সময় সজীব সেটাকে ঠেলে ৯৩ ভাগে উন্নীত করেছে। কিন্তু সেটা টেনশন বিহীন অবস্থায়।

আমি শেষবারের মতোন সজীবে কাছ থেকে পালাবার জন্য পরিকল্পনা মাফিক এস্কেইপ-রুটটা বুঝে নিলাম। প্ল্যানের অর্ধেকটা জুড়ে থাকলো প্রায় ৪ ফুট দৈর্ঘ্যের সাড়ে ১২ পাউন্ডের যন্ত্রটা কিভাবে দ্রুত লুকিয়ে ফেলতে হবে তার কলাকৌশল। তারপর বাকিটা হচ্ছে যতোটা সম্ভব শান্ত থেকে পাশের বাড়ির ছাদ হয়ে নিচে নেমে একটা অন্ধ গলি ধরে ধীরেসুস্থে হেটে মাথায় এসে দাঁড়ানো। এরপর অপেক্ষমান একটা ওয়্যাগনে করে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাবো দুজন। পথে বাধা আসলে তাকেও পরপারে পাঠিয়ে দেবার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র আছে আমাদের দুজনার কাছেই।

৩.
যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। অনুষ্ঠান-স্থল লোকে লোকারণ্য। হৈ চৈ এর শব্দ ভেসে আসছে ৬০০ মিটারের বেশী দুরত্বে অন্ধকার ছাদে ঘাপটি মেরে থাকা আমাদের কানেও।
আমাদের টার্গেট এখনোও ঘটনাস্থলে এসে পৌছায়নি। অপেক্ষা চলছে। রাতের ঝি ঝি পোকার নিরবচ্ছিন্ন শব্দে মাথায় ধান্দা লেগে যায়। কনসেনট্রেশন ধরে রাখা দায়। আপাদমস্তক কালো পোষাকে আমাদের একজন আরেকজনকে প্রায় দেখতেই পাচ্ছি না।
হঠাৎ কোলাহলের শব্দ কিছুটা কমে গেল। “অনুষ্ঠানের প্রধান”-গোছের কেউ আসলে শব্দগুলো যেমন বদলে যায় সেরকম।
আমরা নড়েচড়ে বসলাম। একটা অজানা আতঙ্ক গ্রাস করলো দুজনকেই, সেটা পরিস্কার। সজীব আমাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বললো।
আমি ফিসফিসিয়ে নিজেকে বললাম, “কনসেনট্রেইট”

পরপর দুটো জীপ গাড়ি এসে ভিড়লো অনুষ্ঠানের সামনের গেটে। মুরুব্বীগোছের কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে গাড়ি দুটো ঘিরে দাঁড়ালো। সামনের গাড়ি থেকে প্রথমে বের হলো আমার টার্গেট। মাথায় কালো টুপী। বেড়িয়ে এসেই হাত মেলালো অপেক্ষমান মুরুব্বীদের সাথে। হাসিমুখে কুশল বিনিময়ের পর্ব শুরু হলো। এখান থেকে প্যান্ডেল পর্যন্ত যেতে তার ১২ সেকেন্ড সময় লাগবে। পথে কুশলবাবদ যাবে আরোও কিছু সময়। যা করার এইটুকুন সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
কিন্তু সজীব আর আমাকে একসাথে শুট আউট শুরু করতে হবে। ২জনকে আগে পরে শ্যুট করলে ওরা টের পেয়ে যাবে। টার্গেট ঢুকে যাবে অদৃশ্য কোনও কাভারে।

সুতরাং অপেক্ষা চললো দ্বিতীয় টার্গেটের জন্য। ৩ সেকেন্ড পর বেরুলো সেও। ইতিমধ্যে প্রথমজন এগিয়েছে এক গজ মতোন। আমি scope এ চোখ রাখলাম। রেডি সজীবও।
সাদা বৃত্তের মাঝে কালো যোগ চিন্হর ভেতরে নিয়ে আসলাম আমার টার্গেটকে। নলটাকে একটু একটু করে ওপরে ওঠাচ্ছি টার্গেটের মুভমেন্টের সাথে খাপ খাইয়ে। অপেক্ষা করছি টার্গেটের দাঁড়াবার জন্য। প্যান্ডেল আর মাত্র ২ গজ দূরে! আমাদের সোর্সের এখন থাকার কথা সেখানে। কথা বলে আটকাতে হবে টার্গেটকে। কিন্তু তাকে দেখলাম না আশপাশে।

কোনও সমস্যা নয়তো?! ভয় পেয়ে গেলাম! ভ্রুঁ কুঁচকে আশপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। বাকি পথটুকুর জন্য টার্গেটের খরচা হবে মাত্র ৬ থেকে ৭ সেকেন্ড। সোর্স কোথায়?

আর মাত্র ১ গজ। নাহ্ সোর্স লোকটা গেল কোথায়?
কপালে ঘাম জমছে টের পাচ্ছি। আর ৩/৪ সেকেন্ড পরে স্কোপের বাইরে চলে যাবে লোকটা।
হাত ঘেমে গেছে আমার। মুছতে পারছি না। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার শব্দ আসছে। হাপরের মতোন ওঠানামা করছে মধ্যচ্ছেদা। নাহ্ হলো না মনে হয়!

প্রস্তুত হয়ে গেলাম মুভিং অবস্থায় শ্যুট করতে। সময় মাত্র ২ সেকেন্ড! বৃত্তাকার স্কোপের একপ্রান্ত দিয়ে ঠিক সেই মুহুর্তে দেখলাম একটা চেনা মুখ প্রবেশ করলো। আমি জুমআউট করলাম। হাসিমুখে করমর্দন করছে টার্গেট লোকটার সাথে। থেমে গেল দুজনেই।
জোড়ে একটা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। এবারে আমাকে দ্রুত কাজ সারতে হবে। আবার জুম ইন। স্কোপে এবার শুধু টার্গেট -- মাথা থেকে বুক অবধি।

পরের ৩ সেকেন্ডের মধ্যে সজীবের টার্গেটও চলে এসেছে আমাদের সোর্সের কাছাকাছি। থেমে গেল ৩ জনেই। কথাবার্তা চলতে লাগলো। আরেকটা ছোট জটলা তৈরি হলো।
আমরা দুজনেই রেডি। সজীবের ইশারার অপেক্ষাতে আমি।
রীতিমতো সন্ত্রস্ত হয়ে আছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। ১, ২, ৩,.... .... সজীব ছোট্ট করে বললো “নাউ”। আমার মনে আছে নাউ বলার পরে ১ সেকেন্ড অপেক্ষা করে ট্রিগার চাপতে হবে। এই ১ সেকেন্ড ফাইনাল এইমিং এর জন্য। নিঃশ্বাস টেনে নিলাম। আঙ্গুলের মাথা শক্ত হলো।

‘ধুপ’।
‘ধুপ’।
অতি সংক্ষিপ্ত এবং চাপা শব্দটা ২ বার শুনতে পেলাম।
পরপর দু রাউন্ড গুলী ছুটে গেল সাইলেন্সারের ১১ ইঞ্চি নল পেড়িয়ে।
“শিট্” অস্ফুটে বলে উঠলো সজীব। কারণ, ফলাফল জানার আগেই হঠাৎ করে চারিদিক আধারে ঢেকে গেল! লোডশেডিং। “শিট্” আবারও চাপা স্বরে খেদ করে উঠলো সজীব।
আমারও মেজাজটা বিগড়ে গেছে, তবে টেনশনের ভাবটা এখনোও কাটে নি আমার।

৪.
২০ মিনিট পরের ঘটনা।
দরজায় কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে আমি আর সজীব উঠে পরলাম। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

“কি রে কি ব্যাপার” আমার গলার স্বরে পরিস্কার বিরক্তির ছাপ। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
“শালা রা খবর শুনোস নাই?”
“কি খবর রে?”
“আরে ২ শুয়োরের বাচ্চা আজকে একলগে মরছে!”

আমি ঘুরে তাকালাম সজীবের দিকে। সজীব এগিয়ে এসে বললো, “কোন দুই শুয়োর?”
“আরে, আজকে ২ রাজাকার শ্যাষ। দেশের উপর থেইক্ক্যা শনি নামছে। নীচে আয় বি.বি.সি. শুনমু।”

বন্ধুটিকে অনুসরন করে পরিমরি নীচে চলে আসলাম। লালমিয়ার ক্যান্টিনে। অনেক ছেলেপেলে জমেছে। জামাতের নিজামী আর মুজাহিদ নাকি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে শট-ডেড! খবরের আকস্মিকতায় আমরা সবাই থ’। বিশেষ করে আমার আর সজীবের অবস্থা তখন অন্যরকম! একটা চাপা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়লাম।

৫.
এগিয়ে গেলাম এক চেনামুখ দেখে-
- “কিরে দোস্ত, শুনলাম ২ শালায় নাকি শ্যাষ!?”
- “এখনোও কনফার্ম না। শাহেদের ফোনের অপেক্ষাতে আছি” বন্ধুটি জানালো।
- “বাড়িতে ফোন দে না। ওরা টিভি দেউখ্যা কউক” আমি অধৈর্য হয়ে উঠি।
- “বাসায় লোডশেডিং। অসুবিধা নাই। এখ্খুনি খবর হইবো গুলি খাইছে, তয় মড়ছে কি না এহনও জানি না।”
- “ওহ তাই তো। লোড শেডিং”।

আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো যে লোডশেডিং চলছে। কিছুক্ষণ আগেই সজীব আর আমার ফার্স্ট-ম্যান শ্যুটিং গেমটা পন্ড হলো যে কারণে। ল্যানে দুই কম্পিউটারে এর চে’ মজার খেলা আর হয় না।

এক অদ্ভূত শিহরণে আমার গায়ের রোম সব খাড়া হয়ে গেলো! ভার্চুয়্যাল রিয়্যালিটি আর নিরেট বাস্তবতার এই অসামান্য মিল কিভাবে ঘটলো আজকে?! সজীব কোথায়? ও কি ভাবছে এটা নিয়ে?
- “সজীব। সজীব”।
- “হু দোস্ত.... আমি যা ভাবতেছি, তুইও কি তাইই?”

বলেই সজীব ইশারাপূর্ণ একটা হাসি দিল।
[সমাপ্ত]

লুৎফুল আরেফীন


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বেহুদা স্বপ্ন রে ভাই। দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। দুনিয়াটা মরে, এই দুই রাজাকার মরে না। সবাই জেল-হাজতে দিন কাটায়, দেশ-বিদেশ করে বেড়ায় জানোয়ারগুলো।

অয়ন এর ছবি

বাস্তবে এই ধরনের কোন কিছুর যেন না হয় এই আশা করি, বিচারের আগে স্বাভাবিক কিংবা অপঘাত কোনভাবেই যেন কোন রাজাকারের মৃতু্য না হয়। আগে বিচার তারপর জাহান্নামে যাক কোন আপত্তি নাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

@রউফ
হ্যা, কথাটা হয়তো সত্য। আসলে নিজের হাতই চুলকায় থেকে থেকে। লেখাটা ঐ চুলকানি-প্রসূত।

@অয়ন
হা হা ... এটা তো ঠিকই বলেছেন! কিন্তু বিচার করবে কেউ?
ইতিহাসের মতিগতি তো অন্যরকম!

ধন্যবাদ সবাইকে লেখাটা পড়ার জন্য।
-আরেফীন

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

শটডেডে মজা নাই, লাথথায়া মারতে হইবো। নাইলে পাবলিকের হক আদায় হইবো না।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি লেখক এর ছবি

হাহাহা....

একসময় "মৌচাকে ঢিল" নামের একটা ট্যাবলয়েড বেরুত। ওখানে জামাতীদের পূণর্বাসনের বহু ক্রিয়েটিভ আইডিয়া থাকতো -- একেক সংখ্যায় একেক আইডিয়া! যেমন, ওদের চামড়া দিয়ে জুতো বানানো এবং তার মাধ্যমে গরুদের এই ব্যাবসা থেকে কিঞ্চিত রেহাই দেওয়া...ইত্যাদি আরো কতোকি!

পত্রিকাটা মিস করি!
তবে চাইলে এমন কিছু আবারও শুরু করা যায়!
-আরেফীন

জি.এম.তানিম এর ছবি

দারুণ গল্প...

এনালজিটা দারুণ লেগেছে...
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

রানা মেহের এর ছবি

আরে দারুন গল্পতো

তবে আরেকটু কষ্ট দিয়ে মারলে বেশী বেশী ভালো লাগতো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

জোস গল্প! ধন্যবাদ রানাপুকে, খুঁড়ে বের করার জন্য।

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

@ তানিম, রানা মেহের আর সিমন:

অনেকদিনের পুরোনো একটা লেখায় আপনাদের কমেন্ট পেয়ে এতো ভালো লাগছে যে কি বলবো?!! তখন অতিথি ছিলাম হাসি

আমার নিজের ইচ্ছে ছিলো গল্পটা পূণরায় লেখার, একটু বদলে। আলসেমী করে করা হয় নাই। আরেকটু কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে আর কি!

তাপস শর্মা এর ছবি

অসাধারণ একটা গল্প। সত্যি যদি তাই হতে পারত.........

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।