ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-১১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০২/২০০৮ - ১১:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জাহিদ হোসেন (নির্বাসিত)

সেবার কোরবানীর ঈদের আগে জসিম বললো,"ভাই একটা ঈদ ঢাকায় বসে করেন না। প্রত্যেক ঈদেই তো বাড়ী যান। একবার না গেলে এমন কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা। আপনি যদি থাকেন তাহলে আমাদের বাসায় আপনার জন্য খানাপিনার বন্দোবস্ত থাকবে। সেই সাথে আরো থাকবে বিশেষ বিনোদনের ব্যবস্থা।"
কথাটা শেষ করে চোখ টিপলো জসিম।

আমি বিদেশী ভাষা শিখতে যাচ্ছি শুনে রুমমেট মিজান বললো, সেও শিখবে। ততক্ষণে আমার ভাষার ক্লাশটি ভর্তি হয়ে গেছে। সে যেয়ে ভর্তি হোল স্প্যানিশ ভাষার ক্লাশে। আমরা বললাম,"স্প্যানিশ শিখে কি হবে? এটাতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা না, এটা হচ্ছে অশিক্ষিত লোকের ভাষা। এই ভাষা শেখা আর আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষা শেখা একই জিনিস।"
এই কথা শুনে মিজান খুবই চটে গেল।
সে বললো,"জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাষা হচ্ছে মৃত ভাষা। গ্রীক, ল্যাটিন এইসব ভাষা শিখে কি লাভ? কার সাথে কথা বলবো এই সব ভাষায়? সক্রেটিসের শ্বশুরের সাথে? তোমাদের যদি শিখতে ইচ্ছে হয়, শেখোগে। আমি স্প্যানিশই শিখবো।"

আমাদের দুজনের ভাষার ক্লাশ শুরু হোল। প্রতি ক্লাশে দুজনে নতুন নতুন শব্দ শিখি, আর ঘরে এসে সদর্পে সেগুলো আওড়াই এবং প্রমাণ করতে চেষ্টা করি যে আমার ভাষাটাই শ্রেষ্ঠতর। আমাদের দুজনের মাঝখানে পড়ে ঘরের অন্য দুই বাসিন্দার (আসাদ আর রফিক) প্রাণ ওষ্ঠাগত। একদিন তারা দুজন মিলে আইন জারী করলো যে এইসব বন্ধ করতে হবে তা না হলে আমাদের দু'জনকে বস্তাতে পুরে স্পেন আর জার্মান দূতাবাসের সামনে ফেলে আসা হবে, আমাদের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হবে এবং আমাদের দুজনের নামে হুলিয়া জারী করা হবে (কেন কে জানে?)।
এই হুমকিতে কিছুটা কাজ হোল, এবং আমাদের বকবকানি বন্ধ হোল।

ভাষা ক্লাশে যেয়ে নতুন কিছু লোকের সাথে আমাদের দুজনারই পরিচয় হোল। এদের মধ্যে একজন হোল জসিম। যদিও সে মিজানের ভাষাক্লাশের সহপাঠী, ক্রমে ক্রমে সে আমাদের ঘরের সবার সাথেই বন্ধুত্ব করে ফেললো। প্রায় প্রতিদিন ভাষার বৈকালিক ক্লাশ করে আমি, মিজান আর জসিম ফিরে আসতাম আমাদের ঘরে। সেখানে আর এক প্রস্থ আড্ডা মেরে তারপর জসিম বাড়ী যেতো। মাঝে মাঝে রাতের খাবারও সে আমাদের সাথে খেয়ে যেতো।

জসিম থাকতো পুরনো ঢাকার দিকে। খুব সম্ভবতঃ গেন্ডারিয়া এলাকায়। বি কম পাশ করে সে ছোটখাটো একটা ব্যবসা করতো। কেন যে সে স্প্যানিশ ভাষা শিখতে শুরু করেছিল সে কারণটি আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিলনা। তবে মানুষ হিসেবে সে বেশ আড্ডাবাজ ছিল আমাদের মতো। একারণে কিছুদিন পরেই জসিমকে আমাদের সাথে প্রায়ই দেখা যেত।

যেহেতু সে পয়সা আয় করতো, প্রায়ই চা-সিগারেটের পয়সা সে আমাদের দিতে দিতনা।
"আরে আপনারা হচ্ছেন ছাত্র মানুষ, আমি থাকতে আপনারা পয়সা দেবেন কেন? পড়াশুনা শেষ করেন আগে, তারপরে আমার কাছে আসবেন। তখন আমি আপনাদের দেখাবো পয়সা খরচ করার কত রকম তরিকা আছে। তখন বুঝবেন এই ঢাকা শহরে কত রকম ফুর্তি করার জায়গা, দেখবেন কত রকম আনন্দ করে মানুষ। সেদিন আপনারা পয়সা খরচ করবেন, আমি কিছু বলবোনা।"
" কি রকম ফুর্তি জসিম?"
"কোন ফুর্তি চান বলেন? যেটা চান সেইটাই আপনাদের সামনে হাজির করে দেব।"

আনন্দের নিষিদ্ধ ফলটি মানুষের কাছে চিরকালই আকর্ষনীয়। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। ভবিষ্যতের ফুর্তির কথা ভেবে আমাদের চোখ চকচক করে ওঠে। আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপর ছাত্রজীবনের পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে প্রবেশ করবো আসল জীবনে। নিজেকে ভোগবিলাসী রূপে কেমন দেখাবে সেই চিন্তা করে অধৈর্য্য হয়ে পড়ি। কবে শুরু হবে সেই মধুর অধ্যায়টি?

যাই হোক, মূল প্রসংগে ফিরে যাই। কোরবানীর ঈদের আগে জসিমের অনুরোধে সিদ্ধান্ত নিলাম যে সে বারের ঈদটিতে আর বাড়ী যাবোনা। কাগজ কলম নিয়ে বসলাম চিঠি মুসাবিদা করতে।
চিঠিতে ইনিয়ে বিনিয়ে লেখা হোল, যে সামনে ভয়াবহ রকমের কঠিন তিনটি পরীক্ষা আসছে যার প্রস্তুতির জন্য আমাকে ঢাকাতে থাকতেই হবে। ঈদের ছুটির দিনগুলোতে আনন্দ করার পরিবর্তে আমাকে কাটাতে হবে বইয়ের পাতায় মাথা গুঁজে। চিঠির শেষে দীর্ঘশ্বাসসহ লিখলাম যেন পরিবারের অন্য লোকেরা আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে তাদের ঈদের আনন্দকে মাটি না করে। আমার মত ভাগ্যাহতের জীবনে এটাই স্বাভাবিক।
চিঠিটি ঝটপট বাড়িতে পোস্ট করে দিলাম।

জসিমকে বললাম,"আপনার কথাই শুনলাম, বাড়ীতে যাচ্ছিনা এবার ঈদে।"
সে খুশী।"মিজানও থাকছে ঢাকায়। ঈদের দিন বিকালের দিকে আপনার দুজন চলে আসেন আমাদের বাসায়। তত ক্ষণে কোরবানীর মাংস রান্না হয়ে যাবে।"

তারপর বেশ কয়েকদিন জসিমের কোন দেখা পাইনি। মিজান বললো, কি এক কাজে সে নাকি ঢাকার বাইরে গেছে, ঈদের আগের দিন ফিরবে। ঈদের দিন তার বাসায় কি ফুর্তি হবে, তা জানার জন্য মিজানকে জিজ্ঞেস করলাম একদিন। মিজান মাথা নাড়লো। তার কোন ধারণা নেই।

ঈদের দিন সকালে উঠেই মেজাজটা খারাপ হোল অনেকগুলো কারণে। প্রথমতঃ বাড়ীর সবার কথা মনে হোল। এর আগে কোনদিন বাড়ির বাইরে ঈদ করিনি কখনো। দ্বিতীয়তঃ দেরীতে ঘুম থেকে ওঠার কারণে ঈদের নামাজটিও মিস করেছি। তৃতীয়তঃ কোরবানীর মাংস আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে দিয়ে আসার কাজটি আমার প্রিয় ছিল। সেটাও করতে পারবো না মনে করে মন খারাপ।

হলের নীচ থেকে ডাইনিং হলের বেয়ারারা চেঁচাচ্ছে,"সার- ঈদের সেমাই খেয়ে যান।"
যাক-অন্ততঃ সেমাইটা জুটবে কপালে।

নিচে গিয়ে সেমাইয়ের চেহারা দেখে মন খারাপের পরিমাণ বাড়লো। সেমাই এর নামে তারা যে জিনিসট সামনে এনে দিল, সেটি হাল্কা সাদা রঙ্গের একটি পাতলা লিকুয়িড। তার মাঝে কাঠির মতো কি সব জিনিস। ছোট প্লেট নেই বলে জিনিসটি আনা হয়েছে ভাত খাবার বিশাল থালায়। এবং ডাইনিং হলে কোন চামচ না থাকায় তরল পদার্থটি হাত দিয়ে খেতে হবে। এমন সেমাইয়ের ছবি তুলে রাখা উচিত ছিল।

মনে পড়লো ঈদের দিন বাবার আতরের গন্ধ, মায়ের রান্নাঘরের ব্যস্ততা, ছোটভাইয়ের সাথে কোলাকুলি, বোনটির হাতের মেহেদী। বুঝলাম বড় হয়ে গেছি। সাপের মত ফেলে দিচ্ছি পুরনো খোলস।

দুপুরের পর আমি আর মিজান রওনা দিলাম। জসিমের বাসায় যাওয়ার রাস্তা মিজান চেনে।
রিকশায় বসে মিজান বললো,"আমি মনে হয় কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি যে জসীম কি করবে আজকে।"
"মানে ফুর্তি?"
"হ্যাঁ- আমার মনে হয় ও আজকে আমাদের মদ খাওয়াবে।"
"মদ? মানে অ্যালকোহল?"
"হুঁ।"

উত্তেজনায় আমার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে।

সেদিন কিভাবে যে আমরা জসিমের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম, তা বিশদ মনে নেই। এমনিতেই আমি পুরানো ঢাকার পথঘাট ভাল চিনিনে। লোহার পুল আর হাতির পুল কোথায় জিজ্ঞেস করলে ফেঁসে যাবো। ঠাটারীবাজার বাংলাবাজারের কত কাছে বা কত দুরে তার কিছুই চিনিনা আমি।

তার উপর মনের ভিতর দুপদুপানী। ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে? কোনদিন মদ ছুঁয়ে দেখিনি। ছুঁয়ে দেখবো কিভাবে, মদ জিনিসটা কেমন তা কোনদিন চোখেই দেখিনি, অতএব ছোঁয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মদের কিছু বোতল দেখেছি এর ওর বাড়িতে যেগুলোতে তারা পানি ফ্রিজে রাখে ঠান্ডা করার জন্য। এইই হোল আমার দৌড়।

তারপর আজ আবার ঈদের দিন। ঈদের দিন মদ্যপান করতে চলেছি এই চিন্তাটা মনের মধ্যে বদহজমের মতোন বারবার গুঁতো মারতে থাকে। বাবা শুনলে কি ভাববেন? বংশের কুলাংগারের খেতাব উঠবে আমার গায়ে।

তিন নাম্বার কারণটাই আমাকে ভয় পাওয়াচ্ছে সবচেতে বেশী। যেহেতু কোনদিন এইসব খাইনি, আজ যদি হঠাত এই সব খেয়ে আউট হয়ে যাই। মাতাল অবস্থায় আমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে যদি পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন নিশ্চয়ই খবরের কাগজে বড় বড় হেডিং দিয়ে খবর ছাপা হবে। "বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মাতলামী"। মদ খাওয়াটা কি এত বেশী দরকার? ফুর্তি জিনিসটা তো মনে আনন্দ নিয়ে আসবে, কিন্তু এ কেমন ফুর্তি যাতে আমি ভয়ে আধমরা হয়ে যাচ্ছি।

মিজান বরাবরই একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। সে চুপচাপ ঠোঁট চেপে বসে আছে রিকশাতে। বেশী কথা বলছে না। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে তার মনের ভিতর হাওয়া কোনদিকে বইছে।
"মিজান। একটা প্রশ্ন ছিল?"
"বলো।"
"ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে? ঈদের দিন এইসব উল্টো পাল্টা জিনিসের মধ্যে যাওয়াটা?"
"আমিও তাই ভাবছি।"
"এক কাজ করি বরং তার চেয়ে। জসিমের ওখানে না গেলে হয়না? তার চেয়ে চলো একটা সিনেমা-টিনেমা দেখে আসি।"
"কথা দিয়ে ফেলেছি যে। জসিমা আমাদের জন্য বসে থাকবে। না গেলে আগেই বলা উচিত ছিল। এখন বেশী দেরী হয়ে গেছে।"
"তাহলে?"
"চলো যাই তো আগে। তারপর দেখা যাবে। জসিম আমাদের কোন ব্যাপারেই জোর করবে না। যদি দেখি যে কোনকিছু সীমানা ছাড়াচ্ছে, তাহলে সাথে সাথেই কেটে পড়বো।"
"আমি তো ভয় পাচ্ছি যে আউট না হয়ে যাই।"
"আমিও একই ভয় পাচ্ছি।"

বিকেলের দিকে গিয়ে পৌছুলাম জসিমের বাসায়। এটি জসিমের বাবার বাড়ি। ওনার সাথে দেখা হোল, ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হোল। জসিম বাইরে গিয়েছিল তবে মিনিট পাঁচেক পরেই সে ফিরে এলো। তার সাথে তার ঘরে গেলাম আমরা দুজন।

কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা জিনিস পরিষ্কার হোল আমাদের কাছে। কোন এক রহস্যময় কারণে জসিম ঐ বাড়ির মহা দাপুটে ছেলে। যদিও সে ওই বাড়িতে থাকে, সে থাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে। সে তার ইচ্ছেমত যাওয়া আসা করে। তার ঘরে ঢোকার রাস্তাটিও আলাদা।

জসিমের ঘরটি বিশাল। একপাশে একটি পালংক (একটুও বাড়িয়ে বলছিনা), সেখানে মহারাজা নিদ্রা যান। ঘরের অন্যপাশে একটি গোলাকৃতি টেবিল, চারপাশে কয়েক খানা চেয়ার। এগুলোর সব কয়টাকে দেখে বেশ দামী বলে মনে হচ্ছিল। ঘরের দেয়ালে একটি বিশাল হাতে আঁকা ছবি। নদীর বুকে সূর্যাস্ত। কার আঁকা জানিনা, তবে অসম্ভব সুন্দর।

আমাদেরকে চেয়ারে বসিয়ে জসিম বলল,"একদম ঠিক সময়ে আসছেন আপনারা। কোরবানীর মাংসটার রান্না শেষ হোল এই কয়েক মিনিট আগেই। আপনাদের দেরী দেখে আমি কয়েক বোতল কোক আনতে গিয়েছিলাম। আপনারা আরাম করে বসেন। আমি খাবার দিতে বলি।"

জসিমের বাসায় সেদিন খাবারের বিশাল আয়োজন ছিল। ঈদের দিন সবার বাসায়ই ভাল খাবারদাবারের ব্যবস্থা হয় এমনিতেই, কিন্তু সেদিনকার খাবার টেবিলটির চেহারা আজও মনে পড়ে। কি ছিলনা সেদিন? ঢাকায় একা একা ঈদ করার বিষন্নতাকে মুহুর্তেই ঢেকে দিল খাবারের সুঘ্রাণ। আমরা যেখানে একটু পোলাও-কোর্মা পেলেই বর্তে যেতাম, সেখানে এমনই রাজকীয় আয়োজন দেখে থমকে গেলাম।

কেমন লেগেছিল সেদিন, তা দু' লাইন লিখতে পারি। কিন্তু এমনই একটি পরিস্থিতির অতি চমত্কার বর্ণনা দিয়েছেন আমাদের অনেকেরই প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তার বহুল পঠিত "দেশ-বিদেশে" গ্রন্থে। উত্সাহীরা পড়ে দেখতে পারেন। সৈয়দ সাহেবের বর্ণনার কাছে আমরা নিতান্তই "দুধভাত"।

যাই হোক খাবার এর পরিমান এবং রকমফের দেখে দু' দন্ড থমকালেও আমরা খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বেশী দেরী করিনি। পরের পনের-কুড়ি মিনিট কোন কথা বলিনি কেউই। শুধু চলেছে ধবংসযজ্ঞ। মুহুর্তে উড়ে গেল প্লেটের পর প্লেট, গ্লাসের পর গ্লাস বোরহানী, বোতলের পর বোতল কোক।

এমনিই শাহানশাহী ভোজনের পর আমরা ফিরে এলাম জসিমের ঘরে। এবার চেয়ারে কেউই বসতে কেউই আগ্রহী হোলনা। আমরা তিনজনেই পালংকের এধারে ওধারে গড়িয়ে পড়লাম।

জসিম আমাদের অবস্থা দেখে হাসে।"ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেছেন তো? পেটে একটু জায়গা রেখেছেন তো? আইটেম কিন্তু বাকী আছে আরো একটা।"
তার মিটিমিটি হাসিতে মনে হয় মিজানের কথাই হয়তো সত্যি।

মিজান ঝোপ বুঝে কোপ মারে।"কই জসিম, আপনার ফুর্তি কোথায় গেল? কখন হবে সেটা?"
জসিম বলে,"হবে হবে। সন্ধ্যার পর।"
"জিনিসটা কি? লিকুয়িড এন্টারটেইনমেন্ট নাকি?"
জসিম মাথা নাড়ে। "আপনারা ঠিকই আন্দাজ করেছেন।"

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামে। জসিম একটু উসখুস করে। ঘড়ি দেখে বারবার। নিজের মনেই কি যেন বলে।
"আপনি কি কারোর জন্যে ওয়েট করছেন নাকি?"
"হ্যাঁ। এক দোস্তের আসার কথা। সেও শরীক হবে আমাদের সাথে।"

কিছুক্ষণ পর দোস্তের আগমন ঘটে। তার নাম চাঁন মিয়া। লক্ষ্মীবাজারে তার যেন কিসের ব্যবসা। চাঁন মিয়া বেশ উঁচূ গলার লোক। সে ঘরে ঢুকেই হাঁক দিল,"কই জসিম মিয়া, টেবিল ফাঁকা ক্যান? আমি লৌড়াইয়া আইলাম।"
জসিম একটু ব্যস্ত ভাব দেখায়। সেও সমান গলায় জবাব দেয়।"আবে বহেন না মিয়া। আইয়াই চিক্কুর পাড়তাছেন কেলা?"

জসিম আলনা থেকে নকশা করা একটি টুপি বের করে মাথায় দেয়। ঘরের ফ্লুরোসেন্ট বাতি নিভিয়ে দিয়ে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বালায়। কোণার স্টেরিওতে চালিয়ে দেয় বিদেশী সংগীত। "রা রা রাসপুটিন।"
আমরা একটু অবাক। কি কেইস, জসীম?
"আরে ভাই ফুর্তির জন্য পরিবেশ লাগে। সব কিছুর মধ্যে কিন্তু ভাব আনাটাই আসল জিনিস।"
"মাথায় টুপি চাপানোর মাজেজা কি তা তো বুঝলাম না।"
"এইটা শিখছি আপনাদের লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে। শুনেছি উনি নাকি পীর বংশের লোক ছিলেন। আরও শুনেছি উনি নাকি ফুর্তি-টুর্তি করার সময় বিসমিল্লাহ বলে নিতেন। আমিও সেই তরিকায় থাকলাম আরকি।"
কেন যেন এইসময় টুপি দেখে একটু মেজাজ খারাপ হোল। একটা ভাব থাকা ভাল, কিন্তু এটাকে মনে হোল যেন বেশী ভাব। বললাম,"জসিম যদি কিছুমনে না করেন তাহলে টুপিটা খুলেন। আমরা কেউই পীর বংশের লোক না, আর মুজতবা আলির ধারেকাছেও আমরা নাই।"
জসিম একটু ক্ষুন্ন হলেও টুপিটা খুলে ফেললো। "আজ আপনারাই বস।"
চাঁন মিয়া এইসব বাখোয়াসে বিরক্ত হয়। "খামাকা কি ফালতু তামশা লাগায় দিলেন জসিম মিয়া। থাকলে মাল বাইর করেন, না হইলে যাই গিয়া।"
জসিম খাটের তলা থেকে একটি বাক্স বের করে।
আমি আর মিজান চোখ চাওয়া চাওয়ি করি। চাঁন মিয়া উত্সাহে হাত কচলায়।
বাকসটি খোলার আগে জসিম পিছনে ফিরে আমাদের দিকে তাকায়। একটু হেসে বলে," আজ আপনাদের সম্মানে একটু বিদেশীর বন্দোবস্ত করেছি।"
এই কথায় চাঁন মিয়া বড়ই আনন্দ পায়। সে গালভরে হাসে। তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে বলে,"সবই তার ইচ্ছা। ঈদের তোহোফা।"
জসীম জিনিসটি টেবিলের উপর রাখে। জিরো পাওয়ারের বাতির স্বল্প আলোয় দেখি সেটি একটি এলুমিনিয়াম ক্যান। গায়ে ইংরেজীতে লেখা "হাইনেকেন"।
আমি তুতলে বলি,"এই জিনিসটি কি জসীম?"
"এইটা হচ্ছে খাঁটি জার্মান বীয়ার। খোদ জার্মানীতে বানানো। আউল-বাউল দেশী মাল না। সলিড জিনিস, বুঝছেন। ভিতরের জিনিস কেমন সেইটা ক্যান দেখলেই টের পাওয়া যায়। দেখছেন কেমন চকচকে ক্যান।"
(পরে জেনেছি হাইনেকেন আসলে জার্মান নয়, ডাচ বীয়ার)।
চান মিয়া "কথা কম কাজ বেশী" নীতিতে বিশ্বাসী। সে গ্লাস নিয়ে তৈরী।"কই খুলেন। আপনেতো দেখি আবার নতুন দিগদারী শুরু করছেন মিয়া।"
জসিম কি এক কৌশলে খুলে ফেলে ক্যানের উপরের অংশটি। ভুস করে শব্দ হয়। একটু ফেনা ফেনা মতো কি যেন গড়িয়ে পড়ে। জসিম সামনের দুটো গ্লাসে জসিম অল্প একটু পানীয় ঢালে। "আস্তে আস্তে খান। বহুত রংগিলা জিনিস।"
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। মদের সাথে এই প্রথম মোলাকাত।
মিজান একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,"আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কি জসিম, আমাদের তো তেমন কোন অভিজ্ঞতা নাই। প্রথম বারে এতটা খাওয়া বোধহয় ঠিক হবেনা। আবার যদি মাতাল হয়ে যাই।"
জসিম বলে,"এইটা অবশ্য ঠিক কথা। দাঁড়ান- আমি আসছি।"
বাড়ির ভিতর থেকে সে দুটো চা চামচ নিয়ে আসে। "পয়লা বার চামচে করে অল্প একটু টেস্ট করে দেখেন তাহলে।"

আধা চামচ বীয়ার মুখে দেই। তীব্র তেতো স্বাদ। আমি থমকে যাই। এ কেমন ফুর্তির জিনিস? এর চেয়ে তো ফান্টার স্বাদ অনেক ভালো। আমার বিবমিষা জাগে।
মিজানও তার গ্লাসটি সামনে ঠেলে দেয়। সেও মাথা নাড়ে, তারও ভাল লাগছে না।
জসিম আগ্রহী স্বরে জিজ্ঞেস করে,"কেমন লাগছে?"
আমি বলি,"ভাল লাগলো না। আর খাবো না।"
জসিম হা হা করে হাসে। "স্বর্গের জিনিস আপনাদের ভাল লাগলো না। কি যে বলেন?"
জনাব চাঁন মিয়ার তাতে অবশ্য কোনই আপত্তি নাই। "এইটা জোরাজুরির কোন জিনিস না জসিম মিয়া। না খাইতে মনে চাইলে জোর কইরা কি লাভ? আমার গ্লাসে থোড়া ঢালেন না মিয়া।"

আলো আঁধারীর সেই সন্ধ্যেবেলায় আমি আর মিজান বসে বসে দেখলাম জসিম আর চাঁন মিয়াকে। তারা অল্প অল্প ঢোঁকে বীয়ার খায়। জসিম এক সময় আমাকে বললো,"আপনে ভাই, দুই একটা জার্মান কথা বলেন না। জার্মান বীয়ার পেটে গেলে মনে হয় আমিও ভি জার্মান ভাষাটা বুঝবার পারি একটু একটু।"
চাঁন মিয়া সায় দেয়।"ঠিকই কইছেন। ঢাকাইয়া ভাষা আর জার্মানি ভাষা হইলো গিয়া তালতো ভাই। একটা শিখলে পরে আর একটা বুঝা যায়।"
তাদের কথা জড়িয়ে আসে, একটি বাক্য শেষ না হতেই অন্য বাক্যের প্রবেশ ঘটে। জসিম বলে,"বিয়া শালা আমি এক জার্মান মাইয়ারেই করুম। আর যৌতুক চাইমু দুইশো কেস বীয়ার।"
চাঁন মিয়া বরাবরের মতো সায় দেয়। "এইটা একটা দামী কথা কইছেন। বিয়ার যৌতুক হইলো বীয়ার।"
দুজনে হেসে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ে।

মিজান এক সময় আমার কানে ফিস ফিস করে বলে,"আমার কেমন যেন লাগছে। চলো যাই। বেশীক্ষণ থাকলে হয়তো আউট হয়ে যাবো।"

দুজনে জসিমের বাসা থেকে বেরিয়ে মোড়ের দোকান থেকে দুটো বিশাল মশলা দেয়া পান কিনে খাই। কে জানে, পরিচিত কারো সাথে যদি দেখা হয়ে যায়। আমাদের মুখ থেকে নিশ্চয়ই মদের গন্ধ ভুরভুর করছে। জার্মান মদ বলে কথা।

আমি মিজানকে বলি,"আমার কথা কি জড়িয়ে যাচ্ছে নাকি?"
"একটু একটু।"
"তাহলে তাড়াতাড়ি রিকশা ডাকো। এর পরে হয়তো আর রিকশাওয়ালাকে বলতেই পারবো না যে কোথায় যেতে হবে।"

গায়ে তারার আলো মেখে মাতাল আমরা দুই বন্ধু পথ হাঁটি। বহুদিন আগে দেখা এক সিনেমায় অভিনেতা সাইফুদ্দিনের করা এক মাতালের অভিনয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার মতোই ফুঁপিয়ে উঠে বলি,"কে লিলো হামার পঁচাশ রুপেয়া? হামার পঁচাশ রুপেয়া কে লিলো?"

____________________________
ফুটনোটঃ
অনেক দিন পর প্রবল মদ্যপ আমার পাপুয়া নিউগিনির এক বন্ধুকে গল্পটি শুনিয়েছিলাম। ছাব্বিশ ক্যান বীয়ার শেষ করার পর তখন তার নেশা একটু হয়েছে। আমার গল্প শুনে সে প্রথমে হো হো করে হাসলো, তারপর ভয়ানক রেগে গেল আমার উপর কারণ আমার গল্প শুনে নাকি তার নেশা ছুটে গেছে,এবংএখন তাকে দোকানে দৌড়ুতে হবে আরো ছাব্বিশ ক্যান কেনার জন্য।


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

জটিল...
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

দ্রোহী এর ছবি

শেষটা চমৎকার !!!!!!! জটিল অভিজ্ঞতা।


কি মাঝি? ডরাইলা?

আরিফ জেবতিক এর ছবি

সিরিজটায় মজা পাচ্ছি ।

জাহিদ হোসেন (এ কে এ নির্বাসিত) এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
_______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অপালা এর ছবি

মজার

রায়হান আবীর এর ছবি

অতিরিক্ত মজা পাইলাম। ঝটিল!!!
Man can do what he wants, But he can't want what he wants

ইফতেখার নূর এর ছবি

২৬ ক্যান খুব বেশি না।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ক্যান কি ০.৩৩ নাকি ০.৫০? কোন বীয়ার। শতাংশ কত?



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

জাহিদ হোসেন (এ কে এ নির্বাসিত) এর ছবি

এই তো দিলেন আটকে। আমি হচ্ছি আদার আড়তদার, অর্ণবযানের সুলুক আমি জানবো কোথ্থেকে? আমার দৌড় তো ঐ আধাচামচ পর্যন্তই।
_______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়,, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

জাহিদ হোসেন (এ কে এ নির্বাসিত) এর ছবি

তাই নাকি? আমার তো ছাব্বিশটা ক্যান দেখলেই নেশা হয়ে যাবে।
_________________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।