স্বপ্নের স্বদেশে ফেরা হয়নি যার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০২/০৩/২০০৮ - ১০:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একবার বলা কওয়া ছাড়া হঠাৎ করে চাকরী হারাই একদিন। তখন কিছুদিন এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে অস্থায়ী একটি কাজ করতে হয়েছিলো। সেই কাজটি করতে গিয়ে পরিচয় হয় আরেক বাঙালির সাথে। সে কলকাতার, নাম সঞ্জয়, বয়স সাতাশ-আটাশ। খুব হাসি খুশী, আন্তরিক, প্রাণখোলা মানুষ। কাজের ফাঁকে বিরতীতে তার সাথে ধুমপান করি, গল্পগুজব করি, আস্তে আস্তে ঘনিষ্টতা হ'তে থাকে।

একদিন তার আমন্ত্রণে তার বাসায় উপস্থিত হই। দুই রুমের একটি বাসায় থাকে ছোটো ভাই এর সাথে। আমি তার বাসায় পৌঁছে কিছু না ভেবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম করমর্দন করার উদ্দেশ্যে। সে চাঁটি মেরে আমার হাতটি সরিয়ে দিয়ে আমাকে শক্ত ক'রে জড়িয়ে ধরে খাঁটি বাংলাদেশের বাংলায় বলেছিলো, 'আরে রাখেন মিয়া এইসব কায়দা, বুকে বুক লাগাইয়া কুলাকুলি করেন।' আমার সাথে বেশীরভাগ সময় সে এই ভাষাতেই কথা বলতো। সেদিন তার বাসায় পরিচয় হয় তার আরও কিছু উপমহাদেশী বন্ধুদের সাথে। সবাই ভারত, নেপাল বা শ্রিলংকার।

সঞ্জয়ের রান্নার হাত ছিলো অসাধারণ! মুগ্ধ হয়ে পেট পুরে খেয়েছিলাম সেদিন। খেতে খেতে অনেক হাসাহাসি, রসিকতা চলছিলো। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে নেপালি একজন আবার গায়ক। সে গীটার বাজিয়ে নেপালী বা হিন্দিতে গান গায়, অন্যরা হেঁড়ে গলায় তার সাথে যোগ দেয়। আড্ডার এক পর্যায়ে দেশের কথা ওঠে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, প্রবাসীদের আড্ডায় এটি একটি নিয়মিত ঘটনা। সবাই দেশের স্মৃতিচারণ করে, দেশ ছেড়ে এসে ভুল করেছে, দেশে চলে যাবে এইসব বলে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছিলাম সঞ্জয় দেশের কথা বলতে বলতে বারবার আবেগপ্রবন হয়ে পড়ছিলো। অনেক স্মৃতিচারণ করেছিলো সেদিন দেশ নিয়ে, মা-বাবাকে নিয়ে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। বলেছিলো আর কিছুতেই এদেশে থাকতে পারছেন না। কয়েক মাসের মধ্যে দেশে চলে যাবে স্থায়ীভাবে। মা-বাবা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তাঁদের সাথে থাকবে। বাবা হার্টের রুগী, মা'র ডায়বেটিস। যতদিন তাঁরা বেঁচে আছেন ততদিন কাছে থেকে তাঁদের সেবা করবে।

এর পর ঘন ঘন কয়েকবার সঞ্জয়ের বাসার আড্ডায় গিয়েছিলাম তখন। প্রতিবারই দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে কথা উঠতো। দেশের কথা বলতে খুব ভালোবাসতো সে। ধীরে ধীরে আরও জানতে পারলাম সে প্রেম করে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করেছিলো বছর দেড়েক আগে। কিন্তু তার সাথে ছাড়াছাড়ির প্রক্রিয়া চলছে, তাই ভাই এর সাথে থাকছে। সেই ছাড়াছাড়িটিও দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে। সে স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় বাস করতে চায়, কিন্তু আমেরিকান স্ত্রী কিছুতেই সম্মত হয় না। স্ত্রীর কথা বলতে গিয়েও তার চোখে পানি আসতে দেখেছি। দুঃখ ক'রে বলেছিলো, 'দাদা, মাইয়াটারে অনেক বুঝাইতে চেষ্টা করছি, কিছুতেই রাজী করাইতে পারি নাই। শেষে ছাইড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম বউ গ্যালে বউ পামু, মা-বাপ গ্যালে মা-বাপ পামু না। ডিভোর্সটা কমপ্লিট হইলেই আমি সোজা দেশে।' সে হিসেব করেছিলো সব ঝামেলা চুকিয়ে এদেশের পাট গুটিয়ে স্বদেশে ফিরবে তিন মাসের মধ্যে। তখনও মনে মনে আশা ছিলো বউ শেষ মুহূর্তে মত পাল্টে তার সঙ্গ নেবে। আমরা কেউই তখন জানতাম না কোথাও একটি ভয়ংকর গোলমাল ছিল সেই হিসেবে।

এইসব ঘটনার মাসখানেক পর একদিন সকালে কাজে যাবার আগে তার ভাই সুভাষের ফোন পেলাম। সে যা বললো তা আমার বোধগম্য হতে অনেকখানি সময় লেগে গেলো। যা বুঝলাম তা হলো, তার আগের রাতে ঘুমোতে যাবার আগে সঞ্জয় গিয়েছিলো বাথরুমে। সুভাষ বাথরুমের পাশ দিয়ে নিজের ঘরে যাবার সময় বাথরুমের ভেতরে একটি পতনের শব্দ শুনতে পায়। সে আতংকিত হয়ে 'দাদা' 'দাদা' ব'লে ডাকাডাকি করে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া আসে না, শুধু নিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করার আওয়াজ শোনা যায়। সে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে দেখে সঞ্জয় মেঝেতে পড়ে গলা আঁকড়ে ধরে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে করতে নিথর হয়ে যাচ্ছে। সুভাষ নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন ক'রে সাহায্য চায় তৎক্ষণাত। কিছুক্ষনের মধ্যে প্যারামেডিক্স এর এ্যামবুলেন্স এসে সঞ্জয়কে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে সুভাষ জানায়, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আমি যেনো সরাসরি হাসপাতালে চলে যাই।

আমি সাথে সাথে চলে যাই হাসপাতালে। ফ্রন্ট ডেস্কে যখন সঞ্জয়ের রুম নাম্বারের খোঁজ করছি তখন এক শেতাঙ্গ বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে সঞ্জয়ের শ্বশুর বলে নিজের পরিচয় দেন। তাঁর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। সারারাত হাসপাতালে ছিলেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করে সঞ্জয়ের রুমের দিকে যেতে যেতে জানতে চাই ওর কী অবস্থা। ভদ্রলোক জানালেন সঞ্জয় সত্যিকার অর্থে মৃত। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে তার শরীরটিকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আমি তার কথা বুঝতে পারলাম না, মনে আছে কিছুটা বিরক্তই হয়েছিলাম এমন উদ্ভট কথা শুনে। সঞ্জয়ের রুমের কাছে পৌঁছে দেখলাম তার সব বন্ধুরা উপস্থিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এদের কয়েকজন সারারাত হসাপাতালে ছিলো। আমি এক নজর রুমের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম সঞ্জয় বিছানায় শুয়ে আছে, সাদা চাদরে শরীর ঢাকা, অচেতন। নাকে মুখে এবং সারা শরীরে নানা রকম টিউব যেগুলো আবার নানা রকম যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো। নিঃশ্বাসের সাথে তার বুক ওঠা নামা করছে। নিজ চোখে দেখলাম সঞ্জয় বেঁচে আছে। নিশ্চিত হলাম যে ঘটনার আকস্মিকতায় ওর শ্বশুর উল্টোপাল্টা বকছেন।

কিছুক্ষণের ভেতর একজন নার্স আর সঞ্জয়ের বন্ধুদের সাথে কথা বলে আমার ভুল ভাঙলো। জানলাম, সঞ্জয়ের যা হয়েছে তাকে বলে ব্রেইন এন্যুয়ারিজম। কখনো কখনো মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরার দুর্বল কোনো অংশে শিরার দেয়াল পাতলা হয়ে বুদবুদের মত ফুলে উঠতে থাকে। সাধারণত এর কোনো লক্ষন বাইরে থেকে বোঝা না যাওয়ায় বেশীর ভাগ সময় তা অজানা থেকে যায়। অধিকাংশ মানুষ এই অবস্থাটি নিয়ে সারা জীবন বেঁচে থাকে। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে এই বুদবুদটি একদিন হঠাৎ করে বিস্ফোড়িত হয়। সঞ্জয় সেইসব দুর্ভাগাদের একজন। তার এই সমস্যাটি ছিলো তার মস্তিষ্কে। তাই বিস্ফোড়নের পর পর তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় প্রায় সাথে সাথে এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মস্তিষ্কের বেশীরভাগ অংশ স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে চেতনায় ফিরে আসার সাম্ভাবনা প্রায় নেই বলতে গেলে। লক্ষ-কোটিজনে হয়তো একজন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠতে পারে। তাও কতদিন সময় লাগতে পারে তা কারো জানা নেই। আর জেগে উঠবে যে মানুষটি সে হবে বস্তুতঃ জড় পদার্থের মতো। সঞ্জয়ের শরীরটি লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে সক্রিয় করে রাখা হয়েছে শুধু মাত্র আইনগত কারণে। তার আত্মীয়-স্বজনরা কাগজে সই করে সম্মতি দিলেই লাইফ সাপোর্ট বিচ্ছিন্ন করা হবে। আমার কাছে খুব অবাস্তব লাগছিলো সবকিছু। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না।

এর পরের ঘটনাগুলো ঘটে গেলো খুব দ্রুত। সঞ্জয়ের মা এসে পৌঁছলেন দিন তিনেকের মাথায়। বাবা রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লী এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসে তাঁর হার্টের অসুস্থতা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে কোলকাতা ফিরে যেতে হয়েছে। সঞ্জয়ের মা'র সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ হয়নি আমার। আমিই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। সন্তান হারানো মা'কে কী বলে সান্তনা দিতে হয় তা আমার জানা ছিলো না। তিনি কাগজে সই করে সঞ্জয়ের লাইফ সাপোর্ট বিচ্ছিন্ন করার অনুমতি দিতে যাবার আগে দুর থেকে এক নজর দেখেছিলাম তাঁকে। সে দৃশ্য বুক ভেঙ্গে দেবার মত যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। সঞ্জয়ের পরিচয় পত্রে তাকে অর্গান ডোনার হিসেবে উল্যেখ করা ছিলো। তাই তার মৃত্যুর পর দান করা অঙ্গগুলি সংগ্রহ করে নিয়েছিলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া তার পরিবারের অনুমতি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মস্তিষ্ক রেখে দিয়েছিলো গবেষনামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে। স্থানীয় একটি ক্রিমেটোরিয়ামে দাহ করা হয়েছিলো তার শবদেহ। সবশেষে সন্তানের দেহভস্ম নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন তার মা।

এই ঘটনাটি আমার উপর ভীষণ মানসিক চাপের সৃষ্টি করেছিলো সেই সময়। বেশ কয়েক মাস আমি সঞ্জয়ের মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারছিলাম না। হঠাৎ যেনো কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো জীবন কত ঠুনকো হতে পারে। তারপরও জীবন এগিয়ে চলে নিজের নিয়মে। আমি কাজ বদলাই, বাসা বদলাই, ব্যস্ত হয়ে পড়ি নিজের জীবন এবং নিজেকে নিয়ে। দেখতে দেখতে কেটে যায় প্রায় দু'বছরের বেশী।

মাস দুয়েক আগে একদিন সন্ধ্যায় একটি শপিং মলে ঘোরাঘুরি করছি, এমন সময় সঞ্জয়ের সেই নেপালী গায়ক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো। দু'জনই উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম, কুশল বিনিময় করলাম। তারপর তার পিড়াপিড়ীতে তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সঞ্জয়ের সেইসব বন্ধুরাও একে একে এসে হাজির হলো। সেই আগের মতো জমে উঠলো আড্ডা, খাওয়া দাওয়া আর গান বাজনা। এক পর্যায়ে কথা শুরু হলো দেশ নিয়ে। সবাই দেশের কথা বললো, দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললো। জানলাম সুভাষ দেশে ফিরে গিয়েছে বছর খানেক আগে। অন্যরাও দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। আমি নিশ্চিত এই আড্ডার অনেকেই দুই, পাঁচ, দশ বা বিশ বছর পর দেশে ফিরে যাবে। বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম সেখানে সে রাতে। লক্ষ্য করলাম কেউ সঞ্জয়ের প্রসঙ্গ তোলেনি। আমিও তুলিনি। স্বপ্নের স্বদেশে ফেরা নিয়ে যখন কথা হয়, তখন যার ফেরা হয়নি তার কথা বোধহয় কেউ ইচ্ছে করেই মনে করতে চায় না।

--------------------------------------
শামীম হক


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আহ, আমাদের সেই দেশে ফিরে যাওয়ার বাসনাগুলি! হয়ে উঠবে না অধিকাংশেরই, জেনেও তবু আকাঙ্খাটি ঠিক জেগে থাকে। দেশে ফেরার বাসনা নিয়ে সঞ্জয়রা পৌঁছে যায় আরো অনেক দূরে কোথাও।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অতিথি লেখক এর ছবি

দেশে ফিরে যাব ভাবলেই কেন যেন আমার পদ্মা নদীর মাঝির একটা ডায়লগের কথা মনে পড়ে , কুবের এর, "মিয়াবাই আমি কিন্তু ময়নাদ্বীপে যামুনা"। আমিও সেইরকম সবসময় নিজেকে শুনাই ,"আমি কিন্তু প্রবাসে সবসময় থাকুমনা।"
*********উলুম্বুশ*******

রায়হান আবীর এর ছবি

---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

কষ্ট লাগল ,,,,
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।