একটি সদ্য মুক্ত কাপুরুষের কথা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৫/০৫/২০০৮ - ৪:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০১।

নিজেকে কেমন জানি হাল্কা হাল্কা লাগছে। মুক্ত হয়েছি বলেই কি? পুরোপুরি হয়তো না। কিন্তু বহুদিন ধরে বুকের ভেতর চেপে বসা ভারি পাথরটা যে পালিয়েছে সেটা স্পষ্ট টের পাচ্ছি।

একটা প্রাণবন্ত উচ্ছল এবং সময় সময় কিছুটা উদ্দাম সত্ত্বাকে বীভৎসভাবে খুন করে আমি আমার মুক্তি আদায় করে নিয়েছি। অন্য কোন পথ ছিল না আমার। অথচ…

এই সেদিনও আমার একাকিত্বের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলে তুমি! করার মত তেমন কিছু যখন থাকতো না, একাকিত্বে অস্থির লাগতো, কবিতার নামে কিছু ছাইপাশ লিখতাম। পড়ে তুমি বলতে, “বাহ! সুন্দর প্রেমের কবিতা তো! আমার বেশ ভাল লেগেছে।” কবিতার জন্ম দিতাম এই একাকিত্বের যন্ত্রণায় পুড়ে। আর এই অদ্ভূত যুক্তিতে তুমি আমার সাথে হঠাৎ হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে! আমার যে কেমন লাগতো! এইমাত্র ডাঙায় তোলা মাছের মত ছটফট করতাম। ক্লাস করতাম না। দিনে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম। ক্লান্ত হয়ে রাতে ভার্সিটির হলে ফিরতাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতাম তুমি যোগাযোগ করার পর কিভাবে তোমাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। মধ্যরাতে অস্থিরতা কিছুতা কমে এলে টেবিলে বসতাম। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কবিতার খাতায় খসখস শব্দ তুলে মাথার ভেতর সাপের ফণার মত ছোবল মারতে থাকা শব্দগুলো সাজিয়ে নিতাম।

আমি তোমাকে ডাকতাম ‘তুমি’ বলে, যদিও তোমার নাম ছিল মিতু। ‘ছিল’ বললাম কেন? তুমি অতীত হয়ে গেছো বলেই? আজ সকালেও তুমি আমার কাছে বর্তমান ছিলে। সুবিশাল বর্তমান। আমার জীবন ক্যান্‌ভাসের পুরোটাই তো তুমি ইচ্ছেমত রংতুলি দিয়ে এঁকেছো। তুলির আঁচড় কখনো কখনো ব্যথা দিলেও শিল্পীর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত মনে করে চুপ থেকেছি।

আমি সেই শিল্পীকে আমার জীবনে বর্তমান থেকে অতীত করে দিয়েছি, খুন করে মুক্তি পেয়েছি!

০২।

তোমার সাথে আমার পরিচয়পর্বটা মোটেই সিনেম্যাটিক নয়। বড়জোর নাটুকে বলা যায়। এখনকার মত মোবাইলের রমরমা অবস্থা তখন ছিল না। “সবার জন্য মোবাইল” প্রকল্প তখনও “জোরেশোরে মহব্বতের সাথে” চালু হয়নি। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরপরই আমি টিউশনিতে লেগে গেলাম। কোচিং সেন্টারগুলোতেও ক্লাস নিতে থাকলাম। আসতে থাকল কাঁচা টাকা। কিনে ফেললাম মুঠোফোন। ভার্সিটির হলে আমার আশেপাশের কয়েকটা রুমে তখন সবেধন নীলমণি এই একখানা মুঠোফোন। সেই মুঠোফোনেই একদিন তুমি কল্‌ করলে। না, আমাকে চাইলে না, চাইলে আমার রুমমেট ও ক্লাসমেট তিতাসকে। পরে তিতাসের কাছেই জানলাম, তোমাদের দুজনের বাড়ি কাছাকাছি। সেই সূত্রেই তোমাদের পূর্বপরিচয়।

আমি নিয়মিত দুপুরে ভাতঘুম দিতাম, উঠতাম সন্ধ্যায়। আর বিকেল বেলাতেই তুমি তিতাসকে দু’তিন দিন পরপর দোকান থেকে কল্‌ করতে। ঘুমের মাঝে মুঠোফোনের আপাত মিষ্টি সুর বিরক্তিকর লাগতো! নাম্বারটা চেনা হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই দোকানের নাম্বার থেকে কল্‌ আসলেই আমি সরাসরি তিতাসকে মুঠোফোনটা দিয়ে দিতাম। আর তিতাস ব্যাটা ওটা নিয়ে সোজা চলে যেত বারান্দায়। আমি রুম থেকেই শুনতে পেতাম তার বিগলিত হাসি। ঝাড়া কমপক্ষে ১০ মিনিট স্থায়ী কপোত-কপোতীর কথোপকথন শেষে মুঠোফোনখানা ফেরত পেতাম। বত্রিশ দাঁত বের করে চেহারায় গদগদ ভাব নিয়ে আমার হাতে মুঠোফোনটি গুঁজে দিয়ে তিতাস বলতো, “জয়তু মোবাইল মামু।”

জয় আমার হয়েছে ঠিকই। এক ভিন্ন ধরনের জয়। তো কি হয়েছে? যেভাবেই পাই, জয় জয়ই।

এক বিকেলে যথারীতি তোমার কল্‌ এলো। ঘুম ভেঙ্গে গেল স্বভাবসুলভ বিরক্তি নিয়ে। আশেপাশে তাকাই। রুমে তিতাস নেই। গেল কোথায়? ক্যান্টিনে দুপুরের খাওয়া শেষে টিভি রুমে খেলা দেখতে গিয়ে খেলায় মজে গেল নাকি? কি আর করা! অগত্যা আমিই কল্‌ রিসিভ্‌ করলাম।

- হ্যালো
- তিতু আছে? মানে তিতাস আছে?
বাহ! বাপ-মার দেয়া নামটা প্রেমিকার কাছে এসে লেজ হারিয়েছে! তিতাস থেকে তিতু বানিয়েছে।
আমি উত্তর দিলাম, “তিতাসতো নাই। টিভি রুমে খেলা দেখছে মনে হয়। আপনি দশ মিনিট পর কল্‌ করেন, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।”
- থাক্‌। ডেকে দিতে হবে না। খেলা দেখছে, দেখুক।

ভদ্রতার মুখোশ পরে বলতে ইচ্ছে করল না, “না না, সমস্যা নেই। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।” বরং কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি ফুটিয়ে বললাম, “ঠিক আছে। আমি তিতাস এলে আপনার কথা বলব।”

আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছি। আবার তোমার কল্‌। আমি রিসিভ্‌ করে তোমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, “আপনি এক ঘন্টা পর কল্‌ করেন। তিতাস এর মধ্যেই চলে আসবে।”
- আমি ভাবছিলাম আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলব।

পৃথিবীর কোন পুরুষ, হোক সে কাপুরুষ কি প্রকৃত পুরুষ, ঘটনার এমন আকস্মিকতায় অবাক না হয়ে পারে না। আমি তোত্‌লাতে তোত্‌লাতে বললাম, “আ…মা…র সা…থে কথা মানে?”
- আচ্ছা, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি। আপনি কিন্তু আপনার বন্ধুকে বলবেন না আমি এসব জিজ্ঞেস করেছি।
রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! আমি আর কিছু না ভেবেই বললাম, “আচ্ছা।”
- সত্যি করে বলুন তো, আপনার বন্ধু তিতাস মানুষ হিসেবে কেমন?
- ভাল
- কতটুকু ভাল?
- যতটুকু ভাল হলে পাশের বাড়ির একটি মেয়ের মনের মানুষ হওয়া যায়।
- সে কি অন্য মেয়েদের সাথেও আপনার মত মেয়ে পটানো টাইপ কথা বলে?
ওরে বাবা! দুই কথাতেই বুঝে গেলে আমি কোন টাইপ্‌ কথা বলি! সাংঘাতিকভাবে আমাকে চমকে দিলে। আমি দমে না গিয়ে তোমাকে বললাম, “কেন? সে বুঝি আপনাকে পটানো টাইপ কথা বলে না?”

তোমার খিল্‌খিল্‌ হাসি। তোমার হাসি শুনে মুগ্ধ হবার মত মনের অবস্থা তখন নেই। আমার কাছে তখন “মেয়ে পটানো টাইপ কথা বলা”র অপবাদটাই মুখ্য। আমি নিরাবেগ গলায় বললাম, “আমি কোন হাসির কথা বলিনি। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছি।”
- সে আমাকে কি বলে সেটা আপনাকে বলব কেন?
- তাহলে আমিও আপনাকে কিছু বলব না।
- ভালই তো!
- আর কিছু বলবেন?
কয়েক সেকেন্ড কোন কথা নেই। তারপর কিছু না বলেই লাইন কেটে দিলে তুমি। আহ! বাকযুদ্ধে জিতে গেছি!

আমার জয়যাত্রার সেই শুরু।

০৩।

রেডি হতে হতে দেরি হয়ে গেল। ডেটিং এ ফিটফাট হয়ে না গেলে কেমন দেখায়! অমন সুন্দর একটা মুখ তোমার, আমি মুখভর্তি জঞ্জাল নিয়ে হাজির হই কিভাবে?

- সরি, দেরি হয়ে গেল।
- লেইট লতিফ তো দেরি করবেই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। বেইলি রোডের এই ফাস্টফুডের দোকানটায় আজ ভীড় কম দেখে স্বস্তি লাগছে।
- খুব বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখলাম নাকি?
- বাদ দাও, এসব সহ্য হয়ে গেছে। চিঠি এনেছো?
- হুম। আমারটা কই?

কয়টা চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে? খুব বেশি না, আবার কমও বলা যায় না। সেসব চিঠি তুমি কোথায় রেখেছো? এসবের জন্য আবার বিপদে পড়ব নাতো! ধুর! পদে পদে বিপদ দেখছি!

‘হয়েছে’ থেকে কখন যে ‘হইছে’ বলতে শুরু করলাম টের পাইনি। অপরিচিতের দেয়াল ভেঙে স্বাভাবিক হতে আমার একটু বেশিই সময় লাগে। তবে তুমি বরাবরই সপ্রতিভ ছিলে।

আমার মনে আছে - একদিন ধানমন্ডি লেকের ৮ নং গেটের ওদিকে বসে আমরা গল্প করছিলাম। হঠাৎ তোমার কি মনে হল জানি না। তুমি তোমার দু’হাত দিয়ে আমার সুন্দর করে যত্ন নিয়ে আঁচড়ানো চুল একেবারে এলোমেলো করে দিলে আর হিহি করে হাসতে থাকলে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এর মানেটা কি?”
- কোন মানে নাই।
- মানে না থাকলে এলোমেলো করে দিছো কেন?
- এলোমেলো করে দিতে ভাল্লাগছে, তাই।
তারপর কাছে এসে হাত দিয়ে আমার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তুমি বললে, “আমি তোমাকে এলোমেলো করে দিবো, আবার নতুন করে সাজাব। সমস্যা কি?” এই বলে আবার তোমার হিহি করে হাসি।
- এত্তো হাইসো নাতো!
- তোমার চুল এত্তো কোঁকড়া কেন্‌!
- সমস্যা কি?
- যাদের চুল কোঁকড়া তাদের একটা ব্যাপার আছে, জানো না?
- না। কি ব্যাপার আছে?
- বলা যাবে না।
আবার হিহি হাসি। এবার কিছুটা রহস্যময়, অশ্লীল ইঙ্গিতবাহী!

হাসলে তোমার দাঁতের মাড়ি দেখা যেত। খাপ-খোলা তলোয়ারের মত ধারাল বা চাঁদের আলোর মত স্নিগ্ধ সৌন্দর্য না থাকলেও তুমি সব মিলিয়ে অপছন্দ করার মত মেয়ে ছিলে না। তবে অপরিচিত কেউ নিশ্চিত ধাক্কা খাবে বেঢপ হাসি দেখে। তুমি হাসার সময় শুধু মুখের নিচের অংশের দিকে তাকালে তোমাকে আমার ডাইনী মনে হতো।

তুমি আসলেই ডাইনী ছিলে!

০৪।

তিতাস খুব মনমরা হয়ে থাকে। ঘটনা কি সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। আমি তো বুঝি। তারপরও না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করি, “কিরে? ঝিম মেরে আছিস কেন্‌?” খানিকক্ষণ চুপ থাকে।
- মিতু মনে হয় আমাকে এড়িয়ে চলছে।
- তো কি হইছে?
তিতাস আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আমি তাকে সান্ত্বনা দেই, “শোন্‌। যে গেছে সে গেছে। সে তোর ছিল না বলেই চলে গেছে। এখন এতো ভাবাভাবির কি আছে? ভাদাইম্যার মত ঝিম মেরে থাকিস না।”

তিতাস ঝড়ের বেগে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

সান্ত্বনার কথাটা আমি বলে ফেললাম ঠিকই, কিন্তু ভেবে বললাম কি? যে গেছে সে তিতাসের ছিলো না বলেই গেছে। ভালো কথা। তাহলে যে মেয়ে একজনকে এভাবে ছেড়ে আমার কাছে এসেছে, সে যে একইভাবে আমকে ছেড়ে দিয়ে আরেকজনকে ধরবে না তার নিশ্চয়তা কি?

তিতাস রুমে ঢুকে। চোখ ফোলা, লাল হয়ে আছে। মনে মনে ভাবি, “শালা! বিশ্ববিখ্যাত ভোদাই!”। মুখে জিজ্ঞেস করি, “কিরে? কই গেছিলি?”
- টয়লেটে।
- চোখ লাল কেন্‌? আজকাল চোখ দিয়েও টয়লেট করিস নাকি?
তিতাস উত্তর দেয় না।

রাতে ঘুমানোর জন্য শুয়েছি। কিন্তু ঘুম আর আসে না। ভাবনাটা ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে। পোকার মত কুটকুট করে কামড়াচ্ছে।

যতই দিন যায়, আমার অস্থিরতা ততই বাড়ে। একমুহূর্ত শান্তি পাই না। তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে ভয়ংকরভাবে পেয়ে বসে। সারাক্ষণ কেমন যেন একদলা কান্না গলায় এসে আটকে থাকে।

সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। ভয় হতো – কার সাথে এরপর থেকে আমি আমার সুখ-দুঃখের কথাগুলো ভাগাভাগি করব? নাহলে যে শান্তি পাব না! কিন্তু রুমে ফিরেও তো শান্তি পেতাম না। একটাই দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরত – তুমি চলে গেলে কি হবে আমার? সারাক্ষণ বাজে চিন্তা – অন্য কোন ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে নাতো তোমার? নাহ! এভাবে আমার পক্ষে চলা সম্ভব নয়। হারানোর অনিশ্চিত ভয় নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটানোর চেয়ে একাকিত্বের নিশ্চিত যন্ত্রণা হাজারগুণ ভালো।

বহুদিন পর শেষ পর্যন্ত একদিন সফল হয়ে গেলাম! দুলতে থাকা পেন্ডুলামটাকে থামিয়ে দিলাম। খুব একটা কষ্ট তুমি পেয়েছো বলে মনে হয়নি।

০৫।

আমাদের দুজনের সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো। প্রাণবন্ত, নদীর পানি যেমন শব্দ তুলে বয়ে যায় তেমনটি। ছোটবেলায় গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটার সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকি পোকাদের আলো দিতে দেখতাম। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা অসহ্য অন্ধকারে মিটিমিটি আলোর মত ছিলো। যে আলো পথ দেখাতো না, ক্ষণিকের আনন্দ দিতো, আর বাকি পুরোটা সময় মরীচিকার মত বিভ্রান্ত করে যেতো!

ফেরারী ফেরদৌস


মন্তব্য

রায়হান আবীর এর ছবি

চলুক
---------------------------------
জ্ঞানীরা ভাবলেন খুব নাস্তানাবুদ করে ছাড়া গেছে...আআআহ...কি আরাম। বিশাল মাঠের একটি তৃণের সাথে লড়াই করে জিতে গেলেন।

ছোট্ট তৃণের জন্য অপরিসীম ঘৃণা।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার জীবনে লেখা প্রথম গল্পের প্রথম মন্তব্যকারীকে কী বলে ধন্যবাদ দিবো? ভেবে পাচ্ছি না। দেঁতো হাসি

ফেরারী ফেরদৌস

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ভালো ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ শিমুল ভাই।

ফেরারী ফেরদৌস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।