কৈশোরের আবেগ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৮/১১/২০০৯ - ২:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কিশোরবেলা। জৈষ্ঠ্যৈর রোদেলা দুপুর। সবুজ ধানের তপ্ত মেঠো আল দিয়ে চপল পায়ে খামোখাই হেটে বেড়াঁই। ভাবনায় কৈশোরের বাধভাঙ্গা কৌতুহল, অবাধ উচ্ছলতা, সবকিছুতেই ভাল লাগা।

দিগন্তজোড়া ধুঁ ধুঁ কচি মাঠের আলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা, ছোট্ট অন্নপূর্না পাহাড়ের শুভ্র ঝর্নার পাদদেশ থেকে তৈরি হওয়া আকাঁবাকাঁ ছোট্ট খালের পাড়ে বসে পড়ন্ত বিকেলে বড়শী দিয়ে মাছ ধরা, রতনীকান্তবাবুর কাঠাঁল বাগান থেকে সন্ধ্যায় সবার অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঠাঁল খাওয়া, মধুদার বাড়ির উঠোনে রোদে দেওয়া তেঁতুলের হাড়িতে কাঠি ঢুকিয়ে আচার তুলে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, পাতার আগুনে পুড়ে গ্রীষ্মের কাচাঁ আম পাকানো, স্কুলের পাঠ শেষে শিমুলবাগান দিয়ে আসার সময় উত্তরপাড়ার অমিতের বাসার চালে ঢিল ছুড়ে মারা, গ্রীষ্মের তপ্ততায় একটুকানি প্রশান্তির জন্য একটি নেংটি পড়ে নদীতে ঝাপিয়ে পড়া, চয়ন-দার নৌকায় করে অনেক দুরের মানশ্রী বিলে গিয়ে শাপলা আর সজনে ডাটার ফুল তোলা, গভীর জঙ্গলের মাধবীলতা গাছের চূড়াঁয় বসে থাকা কাকতাড়ুঁয়া পাখিকে ফাদঁ পেতে ধরে ফেলার আকুল প্রচেষ্টা, শ্যাঁওলা-ধরা শান বাধানো পুকুরের ঘাটে বসে মাছরাঙ্গা পাখির ছোঁ মেরে মাছ খাওয়ার দৃশ্যের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা, অলস দুপুরে প্রায় প্রানহীন আমি সূর্যের আলোয় কিছুক্ষন অবগাহন করা, ম্লান উচ্ছলতায় শীরশীরে উদাস চোখ দুটির তপ্ত ধূসর উঠোনপানে কিছুক্ষন নিরিবিলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, অস্ফুট, শুনশান পড়ন্ত গোঁধুলীবেলায় ছোট্ট টিলার পাশে সন্ধ্যামালতী গাছের গায়ে দেলান দিয়ে বসে বর্নীল সূর্যাস্ত দেখা, ভালবাসার পঙ্খিরাজে উড়ে বেড়ানো, মায়াবী কিশোরীর মায়াভরা মুখ কল্পনায় সুতায় বুনা -- এরকমই ভরা আনন্দে কেটেছিল আমার কিশোরবেলা। সবকিছুতেই ছিল বাধঁভাঙ্গা তীব্র আনন্দ, অনাবিল উচ্ছ্বাস।

অনিন্দ্যসুন্দর ছোট্ট গ্রামটির দু’পাশের বাশঁবাগানের সারি, শান্ত পাকানো ছোট্ট নদীর পানির কলকলানি গান, সবই অদম্য কৌতুহলের উদ্দাম ভালোলাগার উপজীব্য ছিল, তখন।

ছোটবেলার সব স্বপ্ন জুড়ে থাকত শুধুই এই গ্রামটির ছবি। কল্পনার সবকিছুতেই গ্রাম্য ঘটনা আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। সারাজীবন এখানেই কাটিয়ে দেওয়ার আকুল তৃষ্ণা। কিন্তু বাস্তবতার নিষ্ঠুর হাতছানিতে সেই তৃষ্ণা অতৃপ্ততায় অকালেই প্রাণ হারায়। জীবিকার তাগিদে শহরে চলে আসা, অনেক আগেই। এখনও অনেক সুখস্মৃতি আবছা আবছা ভাসে, জানালার করিডোরে দাড়িয়ে থাকা নিরিবিলি ভাবনায়। কি সুখের ছিল সেই কৈশোরের দিনগুলি। অবাধ আনন্দে কি স্বপ্নময়ই না ছিল চারপাশের সবকিছু। মনে পড়ে, খুব।

দেশ ছেড়ে আসার আগে, অনেকদিন পর গিয়েছিলাম আবার সেই আমার ছোট্টবেলার ছোট্ট গ্রামটিতে। এখনও সেই সুরমা নদীর রিনিঝিনি শব্দে স্রোতময় বয়ে চলা, এখনও সেই শিমুলচাঁপা গাছের ঠায়ঁ দাড়িয়ে থাকা, সেই উঠোন, সেই গোলা ভরা ধানের আড়ত -- আগের মতই, সব। কিন্তু নেই শুধু আমার সেই কিশোরবেলার আবেগ, আমার একাকী ছুটে চলার দুরন্তপনা, তীব্র কৌতুহলভরা চোখে শালিক পাখিটির দিখে তাকিয়ে থাকার অবিচল অভিলাশ। শত শত শৃঙ্খলে হাত-পা বাধা এখন বাস্তবতায় খাচাঁয়। যৌবনের উন্মুত্ত্বতায় নিভৃতে কাদেঁ কৈশোরের তীব্র অস্ফুট আবেগ। এখনও ভালো লাগে খুব সেই গ্রাম, এই মাটি।

যৌবনের প্রান্তে এখন। বাস্তবতার ব্যস্ততায় তাড়া করে ফিরে সবসময়। গ্রাম থেকে ফিরে আসার সময় প্রান্তসীমানায়। কিছুক্ষন পরেই গাড়ি ছাড়বে।

আমার হাতে দেওয়া ঠাকুরমার আনারস আর শীতলী পিঠার থলেটি। পরম মমতায় আকঁড়ে ধরে ক্ষেতের আল ধরে আবার হেঠে চলেছি আমি। ফিরে আসার সময় আবার পিছনফিরে তাকাই, আবছা আসছে স্মৃতিগুলো, সেই ছুটে চলা, সেই কৈশোর, সেই ভাললাগা।

--আরেকটু কি দীর্ঘায়ীত হতে পারত না আমার কৈশোরবেলা?

--শুভাশীষ
রিপন (ripon4t@yahoo.com)
৭ নভেম্বর, ২০০৯
ওন্টারিও, কানাডা,


মন্তব্য

Hrishi এর ছবি

আপনার লেখাটি আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে। কৈশোরের আবেগপ্রবনতা কখনই ভুলার নয়। ভালো থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুভাশিষ রইল।

ওডিন এর ছবি

আরেকটু কি দীর্ঘায়ীত হতে পারত না আমার কৈশোরবেলা?

শুধু একটা দীর্ঘঃশ্বাস।

খুব সুন্দর লিখেছেন। তবে কয়েকটা বানান একটু চোখে লাগলো। খেয়াল রাখবেন আশাকরি। হাসি

---------------------------------------------
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা। চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, ওডিন ভাই। আপনার সমালোচনার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ থাকবে এখন থেকে। শুভাশিষ।

রিপন।

কথা [অতিথি] এর ছবি

আপনার লেখার হাত অনন্য লেগেছে আমার কাছে। আপনার কাছ থেকে আরও লেখা আশা করছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

কথা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনাদের উৎসাহ আমার পাথেয়।

রিপন।
ওন্টারিও, কানাডা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।