দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে | ৪র্থ পর্ব |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৫/০৬/২০১০ - ৮:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

|| কুটুমবাড়ি ||

প্রেমে ঝাঁপ...

এক মাস পর। মে ফেয়ার। লন্ডনের অন্যতম অভিজাত পাড়া।

লর্ড হেনরির বাড়ির লাইব্রেরি। ডোরিয়ান গ্রে অনেকক্ষণ হয় একটা অ্যান্টিক চেয়ারে বসে আছে। একজন ভদ্র, শিক্ষানুরাগীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে কক্ষটি সত্যি মন্ত্রমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে।

বড় নীল রঙের চীনা জার আর ম্যান্টলপিসের ওপর হলুদ টিউলিপ শোভা পাচ্ছে। ভারী ওক কাঠের বুককেস দেয়ালজুড়ে। জানালায় সিসের প্রলেপ দেয়া ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের পাত, গ্রীষ্মের তপ্ত কমলা-লাল রঙের রোদ তার ভেতর দিয়ে অবাধে প্রবাহিত হচ্ছে।

ডোরিয়ান বন্ধুর জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। সবাইকে অপেক্ষায় রাখাটা লর্ড হেনরির একটা অভ্যাস। তিনি অবশ্য নীতিগতভাবেই দেরি করার পক্ষে। তিনি বলতে ভালোবাসেন যে সময়ানুবর্তিতার কারণে আমাদের প্রচুর সময় নষ্ট হয়। তাঁর এ ধরনের আরও কিছু কথায় প্রমাণ হয় নিজেকে তিনি কতটা আলাদা দেখাতে চান।

‘দেরি হওয়ায় দুঃখিত, ডোরিয়ান। এক টুকরো কাপড় কিনতে গিয়ে ওয়ার্দুর স্ট্রীটে আটকা পড়েছিলাম। দরদাম করতে গিয়ে কতগুলো ঘণ্টা নষ্ট হলো। কী দিনকাল যে পড়েছে, সবাই শুধু দরটাই বোঝে কিন্তু মূল্য জানে না কিছুরই।’ লর্ড হেনরি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

‘ভাবী এসে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে গিয়েছিলেন,’ ডোরিয়ান জানাল তাঁকে। লর্ড হেনরির স্ত্রী খানিকটা চটুল স্বভাবের আর পরিপাটি পোশাকের মহিলা। দু জনের জীবনযাপনের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিয়ের প্রতি লর্ড হেনরির অবজ্ঞা অবশ্য সব মহলে পরিচিত।

‘সাদা চুলের মেয়েকে কখনও বিয়ে করো না,’ লর্ড হেনরি দৃঢ়তার সাথে বললেন।

‘কেন, হ্যারি?’ জানতে চাইল ডোরিয়ান।

‘কারণ তারা খুবই আবেগপ্রবণ।’ টাই বিন্যস্ত করার ফাঁকে উত্তর দিলেন তিনি। ‘তোমার প্রতি আমার উপদেশ- কখনও বিয়েই করো না।’

‘চিন্তা করো না,’ ডোরিয়ান হাসল। ‘বিয়ে করব না। আমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছি। এটা তোমার অন্যতম অভিমত ছিল, হ্যারি,’ তার মুখে রক্ত জমছে, ‘এবং নিজেকে এটা রপ্ত করায় নিয়োজিত করেছি। তার নাম সিবিল ভেন। সে একজন অভিনেত্রী। একটি সত্যিকারের প্রতিভা।’

‘তোমার প্রতিভাটি সম্পর্কে বলো আমাকে,’ লর্ড হেনরি উসকে দিলেন। ‘তাকে কত দিন ধরে জানো?’

ডোরিয়ান খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে। সে জানাল যে লর্ড হেনরি-ই তার এই আনন্দের জন্য দায়ী। তার খামখেয়ালি বন্ধুটিই তাকে জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। আর তাই ডোরিয়ান পুরো লন্ডন চষে বেড়িয়েছে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।

সে সব জায়গায় গিয়েছে- সুরম্য মিউজিয়াম থেকে শুরু করে নোংরা কানাগলি- তার লক্ষ্য ছিল অ্যাডভেঞ্চার। সেন্ট জেমস পার্ক থেকে পিকাডিলি সার্কাস, ডোরিয়ান চাঞ্চল্যকর কিছু খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছে। ‘আমি অনুভব করছিলাম এই লন্ডন শহরের ভাণ্ডারে অবশ্যই কিছু একটা আছে আমার জন্যে,’ সে বলল।

‘হ্যারি, তোমার মনে পড়ে প্রথম যেদিন তোমার সাথে ডিনার করি? তুমি বলেছিলে জীবনের গোপন রহস্যটি হলো সৌন্দর্যের সন্ধান করা। তোমার সেই উপদেশটি আমার অন্তর ছুঁয়ে যায়। তার পর থেকেই আমি সৌন্দর্যের সন্ধানে ছিলাম।’

‘কী ঘটেছে বলি তাহলে,’ আনন্দের সাথে ব্যাখ্যা করল ডোরিয়ান। ‘ছোট্ট একটা থিয়েটারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গ্যাসবাতির উজ্জ্বল আলো আর কুৎসিত বিজ্ঞাপনে ছেয়ে আছে জায়গাটা। অদ্ভুত একটি লোক থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। গায়ে তার আজব এক ফতুয়া, হাতে সিগার জ্বলছিল।'

'সে আমাকে ছোট একটি নির্জন ঘরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমি স্বচ্ছন্দে মঞ্চ দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা ছিল একটা বেশি ভাড়ার পর্দাঘেরা আসন, রং দিয়ে কিউপিড আর ফুলের ছবি আঁকা। কিছু মহিলা কমলা, আদার তৈরি বিস্কুট এবং বিয়ার বিক্রি করছিল,’ সে যোগ করল।

ডোরিয়ান একটানা বলে গেল। সে বর্ণনা করল শেক্সপিয়ারের যে নাটকটি সে দেখেছে সেই ‘রোমিও এবং জুলিয়েট’-এর কথা। খুবই নিম্ন মানের বাজনা বাজছিল। তারপর একটি তন্বী, রূপসী অভিনেত্রীকে সে মঞ্চে আসতে দেখে। অবিলম্বে সে নিজের ভেতর আবেগ ও ভালোবাসার অনুভূতি লক্ষ করে। কী অসাধারণ সেই মেয়েটির কণ্ঠ! কী অপূর্ব তার রূপ! তক্ষুনি সে অভিনেত্রী সিবিল ভেনের প্রেমে পড়ে যায়।

‘আমি মোটেও অবাক হইনি, ডোরিয়ান। কিন্তু এটাই কি তোমার আসল প্রেম?’ লর্ড হেনরি আশ্চর্য হলেন। ‘তুমি সব সময়ই ভালোবাসা পাবে, ভালোবাসবেও। যাদের কোনো কাজ নেই, প্রেম নিয়ে তারাই বেশি মাতামাতি করে,’ তিনি বললেন, তাঁর চোখ মিটমিট করে। ‘তবুও আমার কৌতূহল হচ্ছে। তুমি কীভাবে তার সাথে দেখা করলে?’

‘আমি রোজ থিয়েটারে যাওয়া শুরু করি। তৃতীয় রাতে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে,’ ডোরিয়ান জবাব দিল। ‘আমি ওই অদ্ভুত লোকটির কাছে দৌড়ে যাই। থিয়েটারের সাথে তার কিছু একটা যোগসূত্র থেকে থাকবে। সে-ই আমাকে সিবিলের ম্যানেজার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এক রাতে সিবিলকে ফুল ছুড়ে মেরেছিলাম। সে তখন ওপরে তাকিয়ে আমাকে দেখছিল। এটা বৃদ্ধ ম্যানেজারের চোখে পড়েছিল। সে তখন সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার। আমি খুবই আনন্দিত যে সে এটা করেছে!’

‘তোমার অভিনেত্রীটি দেখতে কেমন?’ লর্ড হেনরি জানতে চাইলেন।

‘তার চুল গাঢ় বাদামি, চোখ নীল আর ঠোঁট কমনীয়। তার বয়েস মাত্র সতেরো। তার চেয়ে বেশি মনোরম কিছু আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি!’ দাবি করল ডোরিয়ান। ‘সে আমার কাছে সবকিছু। আমি প্রতি রাতে তার অভিনয় দেখতে যাই। আমার কাছে মনে হয় সে প্রতি রাতেই আগের রাতের চেয়ে ভাল করছে।’

‘সে খুবই লাজুক এবং কোমল। সিবিল বলে আমি নাকি দেখতে প্রিন্সের মতো। সে অবশ্য আমার আসল নাম জানে না,’ ডোরিয়ান যোগ করল, ‘আমাকে ডাকে প্রিন্স চার্মিং নামে।’

লর্ড হেনরি অবাক দৃষ্টিতে বন্ধুকে দেখছিলেন। প্রথম যেদিন তাকে বাসিলের স্টুডিওতে দেখেছিলেন, সে ছিল শান্ত। আর এখন কত বদলে গেছে! ডোরিয়ান বড় হয়ে উঠছে। সে পরিণত হয়ে উঠেছে আর উপভোগ করছে তার প্রথম প্রেম।

‘আমি চাই বাসিলকে নিয়ে তুমি সিবিলের অভিনয় দেখতে যাবে,’ ডোরিয়ান জোর দিয়ে বলল। তার চোখ জ্বলছে, ‘আমি নিশ্চিত যে তোমরা তার প্রতিভার উচ্চ প্রশংসা করবে। আমি ঠিক করেছি ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটার ভাড়া করব। শহরের গণ্যমান্য সমালোচকদের সেখানে রেখে তাকে পরিচয় করিয়ে দেব। আমি আমার প্রিয়তম সিবিলকে স্টার হিসেবে দেখতে চাই।’

‘ভাবতে দাও,’ ডোরিয়ানকে কথা দেয়ার আগে লর্ড হেনরি একটু বিরতি নিলেন। ‘আজ মঙ্গলবার। এসো আমরা কাল দেখা করি। সন্ধ্যে আটটায়, ব্রিস্টল-এ। আমি বাসিলকে নিয়ে আসব।’

‘আটটায় না, হ্যারি। এসো ছ-টায় দেখা করি। মঞ্চের পর্দা ওঠার আগেই আমাদের থিয়েটারে পৌঁছে যেতে হবে। যাই তাহলে। শুভ বিদায়।’

ডোরিয়ানের কথা শোনার সময় লর্ড হেনরি একটা বিষয়ে সচেতন ছিলেন- এবং চিন্তাটা তাঁর বাদামি চোখে ঝিলিক নিয়ে এল- এটা নিশ্চিত যে তাঁরই কথার সূত্র ধরে ডোরিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। বড় পরিসরে বললে, তিনি ডোরিয়ানের রোমান্টিক স্বভাবকে উসকে দিয়েছেন। কখনও বই ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কখনও ভূমিকা রাখে ব্যক্তি। লর্ড হেনরি বুঝতে পারছেন ডোরিয়ান গ্রের চালচলনে তাঁর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

কিন্তু কে এই রহস্যময়ী যে কিনা ডোরিয়ানের হৃদয় দখল করে নিয়েছে? সিবিল ভেন তাঁকে কৌতূহলী করে তুলছে। সত্যি বলতে কি লর্ড হেনরি উন্মুখ হয়ে আছেন তাকে দেখার জন্য। পরের রাতেই সিবিলের অভিনয় দেখতে যাবেন এই মর্মে চুক্তি করে দুই বন্ধু আলাদা হলেন।

পরে, একাকী বসে, লর্ড হেনরি ভাবছিলেন ডোরিয়ানের নতুন প্রেমের কথা। জানালা দিয়ে বাইরের খোলা দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি প্রেমের রহস্যময়তায় বিস্মিত হচ্ছিলেন। সূর্য ডুবছে। বাড়িঘরের ছাদগুলো জ্বলছে তপ্ত লোহার মতো। মাথার ওপরে আকাশটা ম্লান গোলাপি রং ধারণ করেছে।

ডোরিয়ানের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে ভেবে হেনরি অবাক হচ্ছিলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোনো অনুমান করার আগে, একটা চমক পেলেন তিনি। ডোরিয়ান একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। সেটায় ঘোষণা করা হয়েছে সে এবং সিবিল ভেন বিয়ের বাগদান সম্পন্ন করে ফেলেছে!

১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব

কুটুমবাড়ি


মন্তব্য

নৃ [অতিথি] এর ছবি

আপনি আবার কাজ শুরু করেছেন দেখে ভাল্লাগলো.. চালিয়ে যান হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

---------------
কুটুমবাড়ি

স্পর্শ এর ছবি

চলুক
সকল বানান প্রমিত হয়েছে। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

স্পর্শদা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তবে লেখার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিলে আরও বেশি খুশি হব। হাসি

------------------------------
কুটুমবাড়ি

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

আমার খুব প্রিয় উপন্যাস। আপনি অনুবাদ করছেন দেখে ভালো লাগলো। নিয়মিত পড়ে শুরু করলাম।

গত বছর উপন্যাসটা মুভিও হয়েছে, যদিও শেষের দিকে একটু পরিবর্তন করা হয়েছে চিত্রনাট্যে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, নিয়াজ ভাই। কালজয়ী এই উপন্যাসটির ওপর আগেও মুভি হয়েছে, তবে ট্রেলার দেখে এই ছবিটি দেখতে ইচ্ছে করছে।

আমি কিন্তু উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করছি (একটি কিশোর সংস্করণ থেকে)। সত্যি, অস্কার ওয়াইল্ডের ভাষা অননুকরণীয়। আর দুর্দান্ত সব সংলাপ, পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রাখে। মূল উপন্যাসটি এত উঁচু মানের, এত বেশি ঋদ্ধ যে ভয়ই করছে আপনাকে না আবার হতাশ হতে হয়। তবে আমি চেষ্টা করছি যথাসম্ভব উতরে যাবার। বাকিটা পাঠকের ক্ষমাসুন্দর মন, আর ভালো কিছু যদি পাওয়া যায় তা-ই কুড়োনোর চেষ্টা। খারাপটুকু না হয় ফেলে দিলেন আস্তাকুঁড়ে। শুভেচ্ছা রইল।

----------------------------------
কুটুমবাড়ি

বইখাতা এর ছবি

ভালোই হচ্ছে। চালিয়ে যান।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। সাথে থাকার জন্য।

------------------------
কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।