৩৫ বছর আগের একদিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৫/০৮/২০১০ - ৪:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

এই শুক্রবারটা গড়পড়তা অন্য দিনের মত ছিলনা, সেদিন ঢাকার এক নিভৃত কানাগলিতে কোন অনাহুত আগন্তুককে দেখে নেড়িকুত্তারা সশব্দে ঘেউ ঘেউ করে ওঠেনি, হকারের উচ্চকিত কোরাসে ঐ গলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠেনি, সামনের রাজপথের রিকশাগুলো বেপথু হয়ে একটা দুটো কানাগলির সামনে এসে গোত্তা খায়নি, তবে মির্জা আসলাম ঠিকই গোসল সেরে ফুরফুরে মেজাজে বেরিয়েছিলেন। সুপুরুষ এই তরুণের প্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি,বনেদি কাঠের আলমারি খুলে তার সদ্য খলিফাপাড়া থেকে সেলাই করা সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে দেন। স্বভাববিপরীত ব্রীড়া ঝেড়ে ফেলে আয়নায় নিজেকে দেখার লোভটাও সামলাতে পারলেননা, গর্বোদ্ধত ভঙ্গিমায় নিজেকে দেখলেন,নাহ! পাঞ্জাবিতে আসলেই তাকে দারুণ মানায়। মাথাটা আঁচড়িয়ে যেই টুপিটা হাতে নিলেন, আচমকা একটি অযাচিত খবর তাকে বাকরুদ্ধ করে দিল। শোকস্তব্ধ আসলাম ধীরে ধীরে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলেন, তারপর যন্ত্রচালিতের মত আলগোছে রেখে দেন বিছানার পাশে। সেই নতুন বানানো পাঞ্জাবির ভাঁজ নিপাটই থেকে গেল, তিনি আর ভুলেও তা ধরে দেখেননি।

২.

গড়পড়তা মানুষের তুলনায় আসলাম সাহেবের উচ্চতা কিছুটা বেশিই । এই প্রৌঢ বয়সেও এই গৌরবর্ণের মানুষটিকে ব্যক্তিত্ত্বের ছটার জন্যে আলাদাভাবে ঠিকই নজর কেড়ে নেন তিনি। সরকারি চাকুরির প্রলম্বিত জীবন শেষে এই কিছুদিন হল তিনি অবসরে গিয়েছেন। চাকুরির পাট চুকানো হয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়েরাও এখন বেশ লায়েক, পড়াশোনা শেষে তারা টাকাও কামাচ্ছে মন্দ না। ছোট ছেলেটাতো মাত্র কিছুদিন আগেই নতুন চাকুরীতে যোগ দিল। এর মধ্যে পয়লা মাইনের অর্থে সে সবার জন্য উপহারও কিনে ফেলেছে এন্তার। এমনিতে আসলাম সাহেব মানুষটা একটু সৌখিন গোছের। কর্মজীবনেও তিনি ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। চেহারার জৌলুসের কারণে তাকে সব পোশাকেই কমবেশি মানিয়ে যেত। এখন তার বয়স গড়িয়েছে, তবে এটুকু শখ আহ্লাদ এখনো পুরোপুরি বিসর্জন দেননি তিনি। ছেলেদের কাছ থেকে মর্জিমত উপহার পেলে এখনো তিনি বেজায় খুশি হন। এদিকে তার গিন্নি আবার বুড়ো বয়সে সাজপোশাকের এই খোকাটে বাইয়ের জন্য ঠাট্টা করতে ছাড়েননা। তিনি অবশ্য এসবের থোড়াই কেয়ার করেন,কাপর চোপড়ে হরবখত টিপটপ থাকার চেষ্টা করেন, মায় তাঁর আটপৌরে লুঙ্গি দেখলেও সদ্য পাটভাঙ্গা বলে ভ্রম হতে পারে। আশেপাশের মানুষজনও তাঁর এই বাতিকগ্রস্ততা সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানে।

শুক্রবার। আসলাম সাহেব সময় থাকতে গোসলটা সেরে নিলেন, খানিক বাদেই জুমার নামাজের জন্য মসজিদে যেতে হবে। এসব কাজে তিনি তাড়াহুড়ো একদমই পছন্দ করেননা। তাছাড়া এই বয়সে আগের মত চটপটে হয়ে থাকতে পারাটাও হ্যাপার ব্যাপার। তাই সবকিছুর জন্য একটু আলাদা সময় এখন বরাদ্দ রাখতেই হয়। ড্র্রয়ার থেকে সদ্য ধোয়া লুঙ্গি আর ইস্ত্রি করা সাদা হাফশার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন।

এমন সময় তাঁর ছোট মেয়ে অনুযোগের সুরে জানতে চাইল,"বাবা, আবার এই সাদা শার্ট কেন? ভাইয়া কালকে যে পাঞ্জাবিটা এনেছে সেটা একদিন পড়লে কীইবা এমন হয় ? "

আসলাম সাহেব মৃদু হাসলেন,"মা,তুই কী জানিস না, আমি শুক্রবার দিন কখনো পাঞ্জাবি পড়িনা।"

সত্যিই তো, একে একে পয়ত্রিশটি বছর কেটে গেল,এর মধ্যে তিনি একবারের জন্যও কোন শুক্রবারেই পাঞ্জাবি গায়ে চড়াননি। ৩৫ বছর আগের মধ্যআগস্টের সেই শুক্রবারের ফেরারী স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়া করে ফেরে, চোখ মুদলেই সেদিনকার সেই সফেদ পাঞ্জাবিতে তিনি লাল লাল ছোপ দেখতে পান...তার আর পাঞ্জাবি পড়া হয়না....।

অদ্রোহ।


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

বেপথু মানে তো কাঁপছে এমন, আপনি কি বিপথগামী বলতে চেয়েছিলেন?

গল্প খারাপ না।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক ধরেছেন, আমি তাই বলতে চেয়েছিলাম, শব্দটা বোধহয় লাগসই হয়নি।

অদ্রোহ।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অদ্রোহ, ২ নম্বর পার্টটা কি ইচ্ছা করেই একটু লম্বা করা নাকি? আমি হলে ডাইরেক্ট লাস্ট প্যারাটায় চলে আসতাম ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

কৌস্তুভ এর ছবি

মনে হয় তাই। শেষ প্যারার আগে এই বর্ণনা দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করাটা কিন্তু খারাপ লাগছে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

অদ্রোহ।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনিন্দ্য ভাইয়া, গল্পটা কলেবরে বেশি স্বল্প হওয়ায় একটু ডাইভার্শনের চেষ্টা চরিত্তির করেছিলাম। মনে হয় কেঁচে ফেলেছি।

অদ্রোহ।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চলুক

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

থেঙ্কু দোস্ত।

অদ্রোহ।

নিবিড় এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

শুকরিয়া নিবিড় ভাই।

অদ্রোহ।

রানা মেহের এর ছবি

ভালো লেগেছে গল্প
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

কৃতজ্ঞতা পড়ার জন্য।

অদ্রোহ।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
ইসরাত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।