বানানায়তন- ১০ | কখন কি লিখব, কখন কী লিখব |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৩/১২/২০১০ - ১০:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

... বানান ব্যক্তির সম্পত্তি নয়, তাই তা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন ভৃত্যও নয়; বানান ভাষার সম্পত্তি, ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই অধিকারের সীমানা সম্পর্কে ঔচিত্যজ্ঞান থাকলে বানানের ক্ষেত্রে নিয়মনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করা যাবে, নইলে নয়। –হায়াৎ মামুদ

অর্থভেদে অভিন্ন বানানকে কার-এর সাহায্যে ভিন্ন বানান করার প্রবণতা প্রথম শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। তিনিই প্রথম কি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং কি ও কী-এর প্রস্তাব করেন। তারপর থেকেই এ-বিষয়ে নানা মুনির নানা মত চলে আসছে। যেমন :

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ক’য়ে দীর্ঘ ঈকার দিয়া ‘কী’-এর প্রচলন করিয়াছেন- বর্ত্তমানে ইহা ভাষায় রীতিমত চলিয়া গিয়াছে। ‘কী’ স্থলে ‘কি’ লিখিলে কি অসুবিধা হইত জানিনা। আমরা বক্তৃতা, গান বা আবৃত্তি করিবার সময় অনেক সময় দীর্ঘ এবং অত্যন্ত দীর্ঘ উচ্চারণ করিয়া থাকি-তাহাতে যদি কোন অসুবিধা বোধ না হইয়া থাকে তাহা হইলে "ক"-কে দীর্ঘভাবে উচ্চারণ করিতে বাধা হইবে কেন? –সুধীর মিত্র (বাংলাভাষার বানান ও মুদ্রণ, ফাল্গুন ১৩৪০ সংখ্যা, বিচিত্রা)

দু একটি নিয়ম আপাততঃ বাঞ্ছনীয় মনে হইলেও প্রকৃতপক্ষে অনাবশ্যক। যেমন ‘কী (কোন জিনিস) খাবে?’ এখানে কী’র দীর্ঘ উচ্চারণের দৈর্ঘ্য নির্দ্দেশ করিতেছে। এতদনুসারে ‘কী আশ্চর্য।’ ‘কী, এত বড় কথা।’ এরূপ লেখা উচিত। এরূপ স্থলে গাণিতিক সঙ্কেত অবলম্বন করিয়া কী ১, কী ২, কী ৩, ইত্যাদি লেখা যাইতে পারে। বক্তা তোৎলা হইলে কী ২০ পর্য্যন্ত আবশ্যক হওয়া অসম্ভব নহে। ‘হাঁ’ শব্দটি উচ্চারণের সময়ে সকলের মুখ সকল সময়ে সমপরিমাণে ব্যাপ্ত হয় না। সুতরাং মুখব্যাদানের পরিমাণ নির্দ্দেশের জন্য হাঁ ১, হাঁ ২ প্রভৃতি লেখা যাইতে পারে। এইরূপ লিখনরীতি আপাততঃ মনোহর মনে হইলেও নিতান্তই অনাবশ্যক। কারণ সাধারণ লেখা গানের স্বরলিপির ন্যায় না হইলেও ক্ষতি নাই। –অধ্যাপক জ্যোতির্ম্ময় ঘোষ (বাংলা বানান সমস্যা, ২৪শে ফাল্গুন ১৩৪২ সংখ্যা, আনন্দবাজার পত্রিকা)

শুরুর দিকটাতে এমনই কত না ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে হয়েছে "কী"-কে! একই শব্দের একাধিক অর্থ সব ভাষাতেই আছে এমন যুক্তিও দেখিয়েছেন অনেকে। এটা সত্যিই যে, বাংলা ভাষাতেও এমন আরও অনেক শব্দের উদাহরণ পাওয়া যায়, এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থভেদ থাকলেও বানানভেদ করা সম্ভব নয়। কিন্তু কি-এর ক্ষেত্রে অর্থপার্থক্যে বানানভেদ করা সম্ভব -কার চিহ্ন পরিবর্তন করে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আজও অনেকেই এ সুবিধা গ্রহণে দ্বিধান্বিত। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? বিষয়টি কি এতই জটিল যে, আজও অব্দি আমরা কি/কী ব্যবহারে পারঙ্গমতা অর্জন করতে পারিনি? নাকি আমাদের অন্তস্থিত প্রতিক্রিয়াশীলতাই এর পেছনে দায়ী? ভেবে দেখলে, অনেকে এ-বিষয়ে বিতর্কে যতটা সময় ব্যয় করেছেন, তার চেয়েও কম সময় বিনিয়োগ করে নিয়মটি আত্মস্থ করে নিতে পারেন। কিন্তু তা না-করার পেছনে শুধুমাত্র ব্যাকরণভীতিই নয়, বরং কিছুটা পশ্চাদমুখীনতাও কি দায়ী নয়? বস্তুত কি/কী-র ব্যবহার ভাষার যেসব নিয়মের সাথে জড়িত সেগুলো এতটাই প্রাথমিক স্তরের (এবং সহজ) নিয়ম যে সকলেরই তা জানা থাকা উচিত।

আপনি কি পড়ছেন? সাদাসিধে প্রশ্ন : এ মুহূর্তে পড়ার কাজটা চলছে কি না? উত্তর হবে হ্যাঁ/না। এখানে কি-এর কাজ প্রশ্ন করা, প্রশ্নবাচক অব্যয়। আবার আপনি কী পড়ছেন (কোন বইটি বা কোন লেখাটি পড়ছেন)? উত্তর হ্যাঁ/না দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে কী-এর কাজ সর্বনামের। অব্যয়-এর ক্ষেত্রে স্বরাঘাত পড়ে ক্রিয়ার ওপর, আর সর্বনামের (এবং বিশেষণেরও) ক্ষেত্রে কী-এর ওপর। লেখায় প্রশ্নসূচক চিহ্ন বলে দেবে এটি প্রশ্ন, কথায় (ধ্বনিতত্ত্বের ভাষায়) সাধারণ আরোহী স্বরাঘাতের দরকার পড়বে, অর্থাৎ শেষের অক্ষর প্রথমটির চেয়ে জোরালো উচ্চারিত হবে। ‘কি’ হলো প্রশ্ন, বিস্ময় বা সংশয়বোধক; আর ‘কী’ হলো সর্বনামবাচক, বিশেষণ বা বিশেষণের বিশেষণ যেমন, ক্রিয়া বিশেষণ।

সংক্ষেপে :
কি - প্রশ্নবোধক, সমতাবিধায়ক, সংশয়সূচক এবং বিস্ময়বোধক অব্যয়
কী - প্রশ্নবোধক সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ

ব্যুৎপত্তি : সংস্কৃত কিম্‌ (किम्) থেকে প্রাকৃত কিং হয়ে বাংলায় কি। সংস্কৃত কীদৃক্‌ (कीदृक्) এর সাথে বাংলার কী তুলনীয়, যার অর্থ কী প্রকার, কেমন বা কী রকম। তবে প্রাকৃতে ‘কি’ এবং ‘কী’ নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়, আর এ কারণেই বোধ করি বাংলায় কী-এর প্রচলন হতে এতটা দেরি হয়েছে।

অব্যয় শব্দ ‘কি’ এবং সর্বনাম শব্দ ‘কী’ এই দুইটি শব্দের সার্থকতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি, প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না। ‘তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়’ আর ‘তুমি কী জানো সে আমার কত প্রিয়’, এই দুই বাক্যের একটাতে জানা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর একটাতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে জানার প্রকৃতি বা পরিমাণ সম্বন্ধে, এখানে বানানের তফাত না থাকলে ভাবের তফাত নিশ্চিতরূপে আন্দাজ করা যায় না। –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। [১]

জানি অনেকেই রবি ঠাকুরের এ-কথায় আপত্তি তুলবেন। প্রশ্ন উঠবে বিরাম চিহ্ন পালটে দিলেই তো হয়! যেমন :

তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়! (সংশয়সূচক বক্তব্য)
তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়? (প্রশ্নসূচক বক্তব্য)

হ্যাঁ, এ উদাহরণটিতে বিরাম চিহ্ন পালটে দিলেই বাক্যের অন্তস্থিত ভাব বুঝে নেওয়া যায়। তবে ভুলে গেলে চলবে না, এ নিয়মে বাক্যের অর্থ অনুধাবনে পাঠকের ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটার অবকাশও থেকে যায়। কথ্য ভাষায় শ্রোতা তাৎক্ষণিকভাবে কী বলা হচ্ছে তা ধরে ফেলতে পারলেও লেখ্য ভাষায় তা নাও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে পাঠকের বিরক্তি বোধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া বিরাম চিহ্ন পরিবর্তনের সুযোগ সব সময় নেইও। যেমন,

এটা কি ছবি?–জানতে চাওয়া হচ্ছে এটা কোনো ছবি কি না।
এটা কি ছবি?–জানতে চাওয়া হচ্ছে এটা কোন ছবি।

দুটো বক্তব্যই প্রশ্নবাচক হওয়ায় এখানে বিরাম চিহ্ন পরিবর্তনের কোনো সুযোগই নেই। আর তাই সময়ের প্রয়োজনে কী-এর শরণাগত হওয়া। এখন "কী" বাংলা ভাষায় এতটাই জায়গা জুড়ে বসেছে যে তাকে আর সহজে অস্বীকার করার উপায় নেই! নইলে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ব যে! অন্যদিকে যত্রতত্র "কী" ব্যবহারও সঙ্গত নয়, তাতে পাণ্ডিত্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার (সাথে পাঠকের বিরক্তি উৎপাদনেরও) ভয়। তাই আর গড়িমসি না-করে আসুন দেখে নেই কি/কী শুদ্ধভাবে ব্যবহার করার কী কী উপায় বা নিয়ম রয়েছে।

দুটি সহজ সূত্র

প্রথমেই কি/কী নিয়ে দুটি সহজ নিয়ম বা সূত্রের সন্ধান দেই। এ দুটি সূত্র মনে রাখলে শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই (আমার ধারণা) শুদ্ধভাবে কি/কী ব্যবহার করা সম্ভব :

১. যদি প্রশ্নের উত্তর হয় 'হ্যা/না' দিয়ে অর্থাৎ উত্তর যদি হ্রস্ব হয়, তাহলে ক-এ হ্রস্ব ই-কার='কি'। যেমন,
-তুমি কি খাচ্ছ?
-হ্যাঁ।

আর যদি উত্তর হয় অন্য কোনো শব্দ দিয়ে অর্থাৎ উত্তর যদি দীর্ঘ হয়, তাহলে ক-এ দীর্ঘ ঈ-কার='কী'। যেমন,

-তুমি কী খাচ্ছ?
-ভাত।

২. "কি" বাক্যের মধ্যে বা শুরুতে বসলে এবং বাক্যের শেষে বিস্ময়সূচক চিহ্ন থাকলে "কী" হবে (অন্যদিকে বাক্যের শেষে বসলে সাধারণত "কি" হয়)।

কিন্তু এ হচ্ছে প্রাথমিক পাঠ, ঠেকা কাজ চালানোর জন্য। যাঁরা লেখালেখির সাথে জড়িত আছেন বা হতে চান তাঁদের আরেকটু উচ্চতর পাঠের দরকার হবে। সে উদ্দেশ্যেই আজকের বানানাসর উৎসর্গ করা হলো।

কি লেখা হবে

অব্যয় পদরূপে ব্যবহৃত হলে।

অব্যয় কী? আক্ষরিক অর্থে অব্যয় বলতে যার ব্যয় নেই অর্থাৎ ক্ষয় বা পরিবর্তন নেই এমন কিছু বা নিত্যকে বোঝায় (আমি অজর অমর অক্ষয়; আমি অব্যয়–নই)। ব্যাকরণে অব্যয়ের অধিষ্ঠান বিশেষ্য পদ হিসেবে। লিঙ্গ বচন কারক বা বিভক্তিভেদে যে শব্দের কোনো পরিবর্তন ঘটে না তা-ই ব্যাকরণের পরিভাষায় অব্যয়।

‘কি’ যেখানে অব্যয় সেখানে প্রশ্নের সংকেত। ঊহ্য বিশেষ্যের সহযোগে বিশেষণে ওর প্রয়োগ আছে। –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [২]

কিছু উদাহরণ :

১. তুমিও কি যাবে? (প্রশ্নবোধক, উত্তর হবে হ্যাঁ/না বোধক)
২. সে কি আসলেই আসবে? (সংশয়সূচক, উত্তর হবে হ্যাঁ/না বোধক)
৩. কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী। (সমতাবিধায়ক, বাংলা অথবা ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী)
৪. কি শীত কি গ্রীষ্ম তার সর্দি লেগেই থাকে (সমতাবিধায়ক, শীত কিংবা গ্রীষ্ম তার সর্দি লেগেই থাকে)
৫. কি রাম কি শ্যাম কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না (বিকল্প বোঝাতে, রাম কিংবা শ্যাম কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না)।

লক্ষণীয় : ১-২ নং বাক্যে কি-এর উত্তর হবে হ্যাঁ/না বোধক। হ্যাঁ এবং না অব্যয় পদ। ৩-৫ নং বাক্যে কি অথবা/কিংবা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অথবা/কিংবা অব্যয় পদ।

বলতে কি (অব্যয়) বলতে কি, ভুত আমিও ভয় পাই। (সত্য বলতে হলে)

কত কি (অব্যয়) কত কি দেখব কালে কালে! (বহু কিছু বা নানা কিছু অর্থে)

বল কি (অব্যয়) বল কি! তার এ কাজ? (বিস্ময় প্রকাশক উক্তি)

আর কি (অব্যয়) বেটা নবাব আর কি! (প্রায় তদ্রূপ অর্থে)

কিরে (অব্যয়) প্রশ্ন বা সম্বোধনসূচক শব্দ (কিরে, আছিস কেমন?)

কিসে (অব্যয়) কী থেকে; কী জন্য; কোন (কিসে কী হলো)। কোন উপায়ে; কেমন করে (কিসে দুটো ভাত জুটে)। কোনো বিষয়ে বা বস্তুতে (কিসে পণ্ডিত)। কার মধ্যে; কোন বস্তুর মধ্যে (সুখ কিসে)।

কিবা (অব্যয়) অথবা; কিংবা। কেমন; কী মনোহর (কিবা সুরে পাখি গাইছে)। অধিক কী; কী আর (কিবা বলার আছে)। না জানি কী (কিবা তোমার লীলা; কিবা রাত কিবা দিন)।

কিরূপ (বিশেষণ) কী প্রকার; কী রকম; কেমন।

এমনকি (অব্যয়) অধিকন্তু বা আরও অর্থে। যেমন : এমনকি তুমিও এসেছিলে।

কি ভাবে ("কি" অব্যয় এবং "ভাবে" ক্রিয়াপদ) তারা কি ভাবে? (তারা ভাবে কি?)

লক্ষণীয় : একটি বহুল প্রচলিত ভুল বানান "কিভাবে" [এর জন্য একদিকে দায়ী এনসিটিবির ভুলে ভরা বানানরীতি, যার ফলে পাঠ্যবইয়ে "কিভাবে" বানান ছাপা হয়ে আসছিল এত দিন (সম্প্রতি সরকার বানানরীতিটি বাতিল ঘোষণা করেছে) এবং বাংলা একাডেমীর ভুলে ভরা "বানান অভিধান" (অভিধানটির বিরুদ্ধে প্রমিত বানানরীতি নানাভাবে লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে]।

কি না/ কিনা/ কি-না

কি এবং না দুটি আলাদা শব্দ হলেও একত্রিত হয়ে একটি স্বতন্ত্র পদ হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে। লক্ষ করুন, কি এবং না দুটিই অব্যয় পদ। তাই তারা একত্রিত হয়ে একটি অব্যয় পদ হিসেবে আত্মপ্রকাশে অসুবিধা নেই।

কি-না

অশুদ্ধ। ব্যবহার করা যাবে না।

কি না

ক. সন্দেহসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : টাকা দেবে কি না জানি না।

খ. বিতর্কসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন- আমার লেখায় কোনো ভুল আছে কি না বলো?

গ. প্রশ্নবোধক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : তুমি যাবে কি না?

কিনা ক. এই কারণে বা যেহেতু অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : জ্বর হয়েছে কিনা তাই আসেনি।

খ. অর্থাৎ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন : হ্রী কিনা লজ্জা।

গ. বাক্যালঙ্কার (বাক্যে যা না থাকলেও অর্থ পরিবর্তন হয় না) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আর মা কিনা ঘরের ভেতর গিয়ে বসে আছে (এখানে কিনা শব্দটি ছাড়াও বাক্যের অর্থ একই থাকে)।

কী লেখা হবে

সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ রূপে স্বতন্ত্র পদ হিসেবে ব্যবহৃত হলে।

প্রশ্নসূচক কি শব্দের অনুরূপ আর-একটি ‘কি’ আছে, তাকে দীর্ঘস্বর দিয়ে লেখাই কর্তব্য। এ অব্যয় নয়, এ সর্বনাম। এ তার প্রকৃত অর্থের প্রয়োজন সেরে মাঝে মাঝে খোঁচা দেবার কাজে লাগে, যেমন : কী তোমার ছিরি, কী যে তোমার বুদ্ধি। বক্রোক্তির কাজেও ‘ই’কে লাগানো হয়েছে : কী কাণ্ডই করলে, কী বাঁদরামিই শিখেছে। ‘কী শোভাই হয়েছে’ ভালোভাবে বলা চলে, কিন্তু মন্দাভাবে বলা আরও চলে। এর সঙ্গে ‘টা’ জুড়ে দিলে তীক্ষ্মতা আরও বাড়ে, যেমন : কী ঠকানটাই ঠকিয়েছে। আমরা সোজা ভাষায় প্রশংসা করে থাকি : কী চমৎকার, কী সুন্দর। ওর সঙ্গে একটু-আধটু ভঙ্গিমা জুড়ে দিলেই হয়ে দাঁড়ায় বিদ্রূপ।

‘কেন’ শব্দটা সর্বনাম। এর অর্থ প্রশ্নবাচক, এর রূপটা করণকারকের। ঘটনা ঘটল কেন : অর্থাৎ ঘটল কী কারণের দ্বারা। ‘কেন’র সঙ্গে ‘যে’ যোগ করলে পরিতাপ বা তিরস্কারের ভঙ্গি আসে। ‘কী করতে’ শব্দটারও ওই-রকম ঝোঁক, অর্থাৎ তাতে আছে ব্যর্থতার ক্ষোভ।

শুধু ‘কী’ শব্দের মধ্যেও এই রকমের ভঙ্গী। এই কাজে ওর সঙ্গে যোগ দেয় ই অব্যয় : কী চেহারাই করেছ, কী কবিতাই লিখেছেন, কী সাধুগিরিই শিখেছ। ই-র সহযোগিতা বাদ দিলে ‘কী’ বিশুদ্ধ বিস্ময় প্রকাশের কাজে লাগে : কী সুন্দর তার মুখ।

ঊহ্য বিশেষ্যের সহযোগে বিশেষণে এর প্রয়োগ আছে। তুমি কী করছ : অর্থাৎ ‘কী কাজ’ করছ। আর-একটা প্রয়োগ বিস্ময় বোঝাতে, যেমন : কী সুন্দর। পূর্বেই বলেছি তীক্ষ্মধার স্বরবর্ণ ই সঙ্গে না থাকলে এর সৌজন্য বজায় থাকে। বিশেষণ-প্রয়োগে ‘কী’, যথা : কী কাজে লাগবে জানি না। ‘কী’ বিশেষণ শব্দে অচেতন বা নির্বস্তুক বা অনির্দিষ্ট বোঝায় : ওর কী দশা হবে, কী হতে কী হল। ‘কোন’ বিশেষণ জড় চেতন দুইয়েই লাগে।

‘কী’ শব্দের করণকারকের রূপ : কিসে, কিসে করে, কী দিয়ে, কিসের দ্বারা। অধিকরণণেরও রূপ ‘কিসে’, যথা : এ লেখাটা কিসে আছে। এ-সমস্তই একবচনের ও অজীববাচকের দৃষ্টান্ত, এরা বহুবচনে হবে : এগুলোকে দিয়ে, সেগুলোকে দিয়ে, কোন্‌গুলোকে দিয়ে। অসম্মানে মানুষের বেলা হয়, নচেৎ হয় : এদের দিয়ে, তাদের দিয়ে, ওদের দিয়ে।

‘তুমি কি যাবে’ এই বাক্যে ‘কি’ অব্যয়ে সুস্পষ্ট প্রশ্ন। কিন্তু ‘তুমি বুঝি যাবে’ এই প্রশ্নে যাবে কি না সন্দেহ করা হচ্ছে।

‘গো’ শব্দের প্রয়োগ সম্বোধনে ‘তুমি’ বর্গের মানুষ সম্বন্ধে, ‘তুই’, বা ‘আপনি’ বর্গের নয় : কেন গো, মশায় গো, কী গো, ওগো শুনে যাও, হাঁ গো তোমার হল কী। ‘কী গো’ কেন গো’ শব্দে বিদ্রূপ চলে : কেন গো, এত রাগ কেন; কেন গো, তোমার যে দেখি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল; কী গো, এত রাগ কেন গো মশায়; কী গো, হল কী তোমার। ভয় বা দুঃখ-প্রকাশে মেয়েদের মুখে ‘কী হবে গো’, কিংবা অনুনয়ে ‘একা ফেলে যেয়ো না গো’।

শুধু ‘হে’ শব্দ আহ্বান অর্থে সাহিত্যেই আছে। মুখের কথায় চলে ‘ওহে’। কিংবা প্রশ্নের ভাবে : কে হে, কেন হে, কী হে। মাননীয়দের সম্বন্ধে এই ‘ওহে’র ব্যবহার নেই। ‘তুমি’ ‘তোমার’ সঙ্গেই এর চল, ‘আপনি’ বা ‘তুই’ শব্দের সঙ্গে নয়। –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। [৩]

সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ রূপে স্বতন্ত্র পদ হিসেবে কী ব্যবহারের কিছু উদাহরণ :

কী পড়? (কোন বইটি পড়)—সর্বনাম

কী খাবে? (কোন খাবারটি খাবে)—সর্বনাম

কী আর বলব? (আর কোন কথাটি বলব)—সর্বনাম

কী জানি? (কোন বিষয়টি জানি)—সর্বনাম

এটা কী বই? (এটা কোন রকমের বা কোন বিষয়ের বই)—সর্বনাম

পরীক্ষায় সাফল্যের উপায় কী? (পরীক্ষায় সাফল্যের কোন কোন উপায় আছে)—সর্বনাম

কী আনন্দ! (কত আনন্দ)—বিশেষণ

কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে? (কেমন বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে)—বিশেষণ

ছবিটা কী রকম লাগল? (ছবিটা কেমন লাগল)—ক্রিয়া-বিশেষণ

কী করে এ কথা বললে! (কেমন করে এ কথা বললে)—ক্রিয়া-বিশেষণ

আর কী আর কী চাইবার আছে তোমার? (আর কোন জিনিসটা চাইবার আছে তোমার)—সর্বনাম

কীনা অব্যয় পদে কোনোভাবেই কী-র ব্যবহার সঙ্গত নয়, এবং একক পদ হিসেবে কখনোই কীনা-র ব্যবহার শুদ্ধ হবে না। তাই এটি একটি অশুদ্ধ প্রয়োগ এবং বর্জনীয়।

কী না অনেক সময় কী এবং না এই শব্দ দুটি পাশাপাশি বসে বাক্য তৈরি করতে পারে, তবে তা কোনো একক পদ নয় বরং আলাদা দুটি পদ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। যেমন,

আমি তোমার জন্য কী না করেছি (আমি তোমার জন্য কত কিছুই না করেছি)!
বলো তো, বাতাসে কী না থাকলে মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হতো?

লক্ষণীয় : প্রথম বাক্যটিতে কী ক্রিয়া-বিশেষণ পদ হিসেবে এবং দ্বিতীয় বাক্যটিতে কী বিশেষণ পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর দু জায়গাতেই কী-এর পরে না বসে গেছে অব্যয় পদ হিসেবে।

কী না কী বলল কিছুই মনে নেই (কোনটি না কোনটি বলল কিছুই মনে নেই)।

লক্ষণীয় : এখানে কী দু বার উল্লেখ করা হয়েছে দুটি আলাদা বিশেষণ পদ হিসেবে। এই আলাদা পদ দুটিকে জোড়া লাগিয়েছে মাঝখানের না শব্দটি, যা নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র অব্যয় পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এমন কী সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ রূপে স্বতন্ত্র পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন : এমন কী ক্ষতি হয়েছে তোমার! (কতখানিই বা ক্ষতি হয়েছে তোমার)

লক্ষণীয় : এমন কী মাঝখানে ফাঁক রেখে বসলেও দুয়ে মিলে একটিই পদ, ব্যবহৃত হয় বিশেষণ হিসেবে।

কীভাবে

অনেকেই জানতে চান যেভাবে কিরে, কিসে, কিরূপ লিখি ঠিক সেভাবেই "কিভাবে" না লিখে "কীভাবে" লিখতে হবে কেন? লক্ষ করুন, যেভাবে (সর্বনাম+ভাবে) ভালোভাবে (বিশেষণ+ভাবে), নানাভাবে (বিশেষণ+ভাবে) লিখি ঠিক সেভাবে (সর্বনাম+ভাবে)-ই "কী" (সর্বনাম ও বিশেষণ)-এর পরে "ভাবে" সংযুক্ত হয়ে "কীভাবে"। যেমন, কীভাবে এলে? (কোন ভাবে অর্থাৎ কোন উপায়ে)–সর্বনাম

------------------------------------------------------------------------------------

কী আশ্চর্য, তাই না? কিন্তু, সত্যিই আশ্চর্য কি? এত কিছু বলার পরেও কি বলবেন, "কেম্নে কী?" দেঁতো হাসি নিশ্চয়ই না? নিন, তাহলে লিখতে থাকুন হাত-পা খুলে। আপনার পাশেই থাকবে বানানায়তন।

তথ্যসূত্র : [১] রবীন্দ্র-রচনাবলী

[২-৩] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলাভাষা-পরিচয়)

বিশেষ কৃতজ্ঞতা : বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান

------------------------------------------------------------------------------------
বানানায়তন- ৯ | ব-য় শূন্য 'র' বনাম ড-য় শূন্য 'ড়'|
বানানায়তন- ৮ | পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর বানানরীতি মেনে চলতে হবে |
বানানায়তন- ৭ | বাংলা হরফ বনাম রোমান হরফ—জ বনাম J, Z, G |
বানানায়তন- ৬ | বাংলার তিন 'শ'—দন্ত্য-স, মূর্ধন্য-ষ আর তালব্য-শ|
বানানায়তন- ৫ | দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ |

বানানায়তন- ৪ | 'অনুস্বার' বনাম 'ঙ', সাথে 'এ' বনাম 'অ্যা' |
বানানায়তন-৩ | হ্রস্ব স্বর না দীর্ঘ স্বর |
বানানায়তন- ২ | ও কি এল, ও কি এল না |

বানানায়তন ১ | ই-কার বনাম ঈ-কার |
------------------------------------------------------------------------------------

---------------------------
কুটুমবাড়ি

---------------------------


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

কী এর জন্মকাহিনী বাৎলানোর জন্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ, আমার অনুরোধ মেনে কীকাহিনীর উপর একটা পোস্ট দেবার জন্যও। কিন্তু খবর্দার, আমরা কখন কী লিখব তাই নিয়ে কিছু বলতে আসলে... খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

হে হে হে কী যে বলেন। তাই কি হয় নাকি? চোখ টিপি

মন্তব্যের জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, কৌস্তুভ ভাই। আপনার মন্তব্য পড়ে গড়াগড়ি দিয়া হাসি

এখন আবার পোস্ট পড়তে গিয়ে লেখা ফর্মেটিংয়ে ম্যালা ঘাপলা চোখে পড়ল। ইয়ে... লেখা কীভাবে জাস্টিফাই করব বা table insert করাতে পারব কেউ বলে দিলে ভালো হতো। অগ্রিম ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি।

কুটুমবাড়ি

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

বানান ভাষার সম্পত্তি, ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণাধীন।

কীন্তু...থুক্কু...কিন্তু ভাষা কার সম্পত্তি ও নিয়ন্ত্রনাধীন ?

কৌস্তুভ এর ছবি

ডিজিটাল জগতে এই ভাষা কাগুর নিয়ন্ত্রণাধীন... খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

মশাই, আপনার সেন্স অব হিউমার রীতিমতো ঈর্ষণীয় মন খারাপ

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

লইজ্জা লাগে

তবে এই ইমোটা রেসিস্ট। হলুদ আর লাল রঙ যথাক্রমে কালো আর বেগুনি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে এই ক্ষেত্রে।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি

এই ইমোটাও রেসিস্ট। লাল আর সাদাটে নীল রঙ যথাক্রমে বাদামি আর আঁশটে হলুদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে এই ক্ষেত্রে।

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

হ। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

আর হ্যাঁ, চাকর ক্লাসের এই ভাষাও তাদের ঘটিবাটি জানমালের মতই জমিনদার সাহেবের নিয়ন্ত্রণাধীন।

অতিথি লেখক এর ছবি

পান-বিড়ি-ওয়ালা জসিমুদ্দীনকে তুশ্চু করায় তীব্র প্রেতিবাদ জানাই...

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

মনমাঝি ভাই, রবি ঠাকুর অনেক আগেই লিখে গিয়েছিলেন-

ভাষা বানিয়েছে মানুষ, এ কথা কিছু সত্য আবার অনেকখানি সত্য নয়। ভাষা যদি ব্যক্তিগত কোনো মানুষের বা দলের কৃতকার্য হত তা হলে তাকে বানানো বলতুম; কিন্তু ভাষা একটা সমগ্র জাতের লোকের মন থেকে, মুখ থেকে, ক্রমশই গড়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর জমিতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের গাছপালা যেমন অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে, ভাষার মূলপ্রকৃতিও তেমনি। মানুষের বাগ্‌যন্ত্র যদিও সব জাতের মধ্যেই একই ছাঁদের তবু তাদের চেহারায় তফাত আছে, এও তেমনি। বাগ্‌যন্ত্রের একটা-কিছু সূক্ষ্ম ভেদ আছে, তাতেই উচ্চারণের গড়ন যায় বদলে। ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুখে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের মিশ্রণ ঘটবার রাস্তায় তফাত দেখতে পাওয়া যায়। তার পরে তাদের চিন্তার আছে ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচ, তাতে শব্দ জোড়বার ধরন ও ভাষার প্রকৃতি আলাদা করে দেয়। ভাষা প্রথমে আরম্ভ হয় নানারকম দৈবাৎ শব্দসংঘাতে, তার পরে মানুষের দেহমনের স্বভাব অনুসরণ করে সেই-সব সংকেতের ধারায় সে ভরে উঠতে থাকে। পথহীন মাঠের মধ্যে দিয়ে যখন একজন বা দু-চারজন মানুষ কোনো-এক সময়ে চলে গেছে, তখন তাদের পায়ের চাপে মাটি ও ঘাস চাপা পড়ে একটা আকস্মিক সংকেত তৈরি হয়েছে। পরবর্তী পথিকেরা পায়ের তলায় তারই আহ্বান পায়। এমনি করে পদক্ষেপের প্রবাহে এ পথ চিহ্নিত হতে থাকে। যদি পরিশ্রম বাঁচাবার জন্যে মানুষ এ পথ বানাতে বিশেষ চেষ্টা করত তা হলে রাস্তা হত সিধে; কিন্তু দেখতে পাই, মেঠো পথ চলেছে বেঁকেচুরে। তাতে রাস্তা দীর্ঘ হয়েছে কি না সে কথা কেউ বিচার করে নি।

ভাষার আকস্মিক সংকেত এমনি করে অলক্ষ্যে টেনে নিয়ে চলেছে যে পথে সেটা আঁকাবাঁকা পথ। হিসেব করে তৈরি হয় নি, হয়েছে ইশারা থেকে ইশারায়। পুরোনো রাস্তা কিছু কিছু জীর্ণ হয়েছে, আবার তার উপরে নতুন সংস্কারেরও হাত পড়েছে। অনেক খুঁত আছে তার মধ্যে, নানা স্থানেই সে যুক্তিসংগত নয়। না হোক, তবু সে প্রাণের জিনিস, সমস্ত জাতের প্রাণমনের সঙ্গে সে গেছে এক হয়ে।

এই রবিবাবু লুক্টা খুব খ্রাপ। আমাদের জন্য বলার মতো তেমন কিছু বাকি রাখেনি মন খারাপ

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

সচলেই তো কওয়া আছে, "রবীন্দ্রনাথ একজন খুবই দুষ্ট লোক।" যদি দাড়িদাদু এই কি/কী না বানাতেন, তাহলে কি/কী এই ফ্যাসাদ আমাদের বইতে হত?

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি

কুটুমবাড়ি

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

দায়বর্জনবিবৃতিঃ আমার নিম্নে প্রদত্ত বক্তব্য এবং জিজ্ঞাস্য সম্পূর্ণরূপে নৈর্ব্যক্তিক এবং তাত্ত্বিক। যদিও বক্তব্যকে একটু মশলাদার ও সুস্বাদু করিবার প্রয়োজনে কিছু বিশেষণ ব্যবহার করা হইয়াছে, কিন্তু সেগুলিও আসলে নৈর্ব্যক্তিক। কোন বাস্তব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিন্দা, সমালোচনা, হেয় প্রতিপন্ন বা আঘাত করা ইহার উদ্দেশ্য নয় কোনক্রমেই। পাঠকালে এই সতর্কবাণী সবিশেষভাবে সর্বদা স্মরণযোগ্য ! দেঁতো হাসি

ভাসা বানিয়েছে মানুষ, এ কথা কিছু সত্য আবার অনেকখানি সত্য নয়। ভাষা যদি ব্যক্তিগত কোনো মানুষের বা দলের কৃতকার্য হত তা হলে তাকে বানানো বলতুম; কিন্তু ভাষা একটা সমগ্র জাতের লোকের মন থেকে, মুখ থেকে, ক্রমশই গড়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর জমিতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের গাছপালা যেমন অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে, ভাষার মূলপ্রকৃতিও তেমনি।

ভাষা যদি সমগ্র জাতির যৌথ সৃষ্টি ও তাদের যৌথ সম্পত্তিই হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে ঐ ভাষার বানান ও ব্যাকরন কেন 'বানানবিদ' বা 'ব্যাকরনবিদ' নামক কোন স্বঘোষিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'দলের' নিয়ন্ত্রনাধীন হয়ে পড়বে ? কেন তাঁদের হুকুম বা অনুমোদন ছাড়া অন্যরকম লেখা যাবে না ? এটা কি ভাষা সৃষ্টির মূল, স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ারই বিরোধী নয় ? এটা কি এক ধরণের অনধিকার স্বৈরাতান্ত্রিক চর্চা নয় ? আমাদের কি এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা উচিত নয় ?

তাছাড়া একটু চিন্তা করলেই, বিশেষজ্ঞ না হয়েও বোধহয় বোঝা যায় যে পুরো ভাষা না হলেও এর মৌলিক ইউনিট বা উপাদান অর্থাৎ একেকটা শব্দ কোন না কোন সময় কোন ব্যক্তি-বিশেষই উদ্ভাবন করেছিল এবং পরে তা সামাজিক কনসেনসাসের মাধ্যমে সামাজিকভাবে গৃহীত হয়ে সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং বিবর্তনের মাধ্যমে তা বর্তমান রূপলাভ করে (বিভিন্ন বানান-টানান সমেত)। এবং এই পুরো প্রক্রিয়াটাই মূলত এবং প্রধানত সাধারন মানুষের হাতেই হয়েছে, এবং তা ব্যক্তি-ইনিশিয়েটিভ-ভিত্তিক (তা না হলে ভাষা সৃষ্টিই হতো না!)। যেকোন জীবন্ত ভাষার ক্ষেত্রেই এই বিবর্তন একটা নিরন্তর চলমান প্রক্রিয়া। আপনার উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে উল্লেখিত "পায়ে হাটা মেঠো পথের" উদাহরণই এর একটা প্রকৃষ্ট ব্যাখ্যা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আমজনতা যারা এই ভাষা তৈরি করেছি, তারা কেন হঠাৎ করে এই উড়ে এসে জুড়ে বসা মুষ্টিমেয় স্বঘোষিত মাতব্বর বা কর্তৃপক্ষ শ্রেণীর ( ব্যাকরনবিদ) হুকুমদারি মেনে নিব, বা তাদেরকে আমাদের হাতে-পায়ে শিকল-ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে দিয়ে চিরতরে ফসিলীভুত করে ফেলার সুযোগ দিব ?

আপনার উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের দেয়া উদাহরনটাই একটু দেখিঃ

যদি পরিশ্রম বাঁচাবার জন্যে মানুষ এ পথ বানাতে বিশেষ চেষ্টা করত তা হলে রাস্তা হত সিধে; কিন্তু দেখতে পাই, মেঠো পথ চলেছে বেঁকেচুরে। তাতে রাস্তা দীর্ঘ হয়েছে কি না সে কথা কেউ বিচার করে নি।

অর্থাৎ, ভাষার ক্ষেত্রে যুক্তিটুক্তি আসলে তেমন বা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যেটুকু গুরুত্ব আছে, সেটুকু প্রায় অবচেতনেই বা জীবন্ত ভাষার সাধারন ব্যবহারকারীদের হাতেই অর্জিত হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয় ভাবেই। তা না হলে, আমরা হয়তো এখন C# প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা অঙ্কের ভাষায় কথা বলতাম। যেমন কিনা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ঐ 'মেঠো পথটা' রোডস এ্যন্ড হাইওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যাকরনবিদদের পাল্লায় পড়লে হয়তো শান বাঁধানো, সিধে এবং যুক্তিসংগতরূপে সংক্ষিপ্ত হতো। কিন্তু তা হয়নি। হলে, ওটার উপর দিয়ে ঐ ব্যাকরনবিদ আর ইঞ্জিনিয়াররাই কেবল হাঁটাতেন বা বৈকালিক পরিভ্রমণে যেতেন বা বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থায়নকারীদের দেখাতে নিয়ে যেতেন (বা আরেকটা মৃত এসপারান্টো প্রসব হতো), কিন্তু আমজনতা আরেকটা 'মেঠো পথ' তৈরি করে নিত নিজেদের জন্য। ভাগ্যিস হয়নি! সুতরাং, রবীন্দ্রনাথের ঐ উদাহরণের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন হল - ব্যাকরন ও ব্যাকরনবিদরা আসলে কতটুকু প্রাসঙ্গিক বা তাঁদের স্বৈরতন্ত্রকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন কতটুকু ?

রবীন্দ্রনাথ আপনার উদ্ধৃত উক্তিতে জীবন্ত মানুষের জীবন্ত ভাষা সম্পর্কে বলছেনঃ

...সেটা আঁকাবাঁকা পথ। হিসেব করে তৈরি হয় নি, হয়েছে ইশারা থেকে ইশারায়। ...অনেক খুঁত আছে তার মধ্যে, নানা স্থানেই সে যুক্তিসংগত নয়। না হোক, তবু সে প্রাণের জিনিস, সমস্ত জাতের প্রাণমনের সঙ্গে সে গেছে এক হয়ে।

এটাই তো আসল কথা তাই না ? সমস্ত জাতের প্রাণমনের সাথে একাত্ন প্রাণের ধনটা আঁকাবাঁকা, নানা স্থানেই যুক্তিহীণ ও খুঁতবহুল হতেই পারে - তবুও সেটাই কাঙ্খিত, সেটাই আদর্শ, সেটাই জীবন্ত, সেটাই প্রিয়, সেটাই প্রাণের বস্তু, সেখানেই প্রাণের ও প্রাণের ভাষার প্রকৃত মুক্তি। বন্ধ্যা বা মৃতপ্রসবা ব্যাকরনবিদের যুক্তিপূর্ণ কুতর্ক, রক্তচক্ষু আর নিষেধের ডান্ডাবেড়িতে নয় !!!

আপনি কি বলেন ?

ও হ্যাঁ, উত্তর দেয়ার আগে একদম শুরুতে দেয়া ডিস্ক্লেমারটি আরেকবার মন দিয়ে পড়ে নিন, প্লিজ ! দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাষার প্রমিতকরণ বিতর্কিত ব্যাপার, বানান সে হিসেবে অতটা নয়। উচ্চারণ একটা স্বাভাবিক ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যাকে শাসন করা যায় না। তবে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে বানান "পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে শাসন" বা "শাসনের ভিতর দিয়ে পরিবর্তন" যা-ই করতে চান না কেন তা সম্ভব, প্রয়োজনীয়ও।

কখনো ভেবে দেখেছেন আমরা এত বেশি ব্যাকরণ ও বানান ভীতিতে ভুগি কেন? কারণ গোড়ার দিকে ব্যাকরণবিদরা বাংলাকে 'সংস্কৃতানুযায়িনী' করার চেষ্টা করেছেন, 'বাংলা' করার চেষ্টা করেননি। যদি করতেন তাহলে হয়তো আর আজ বাংলায় লেখা এতটা কষ্টকর ঠেকত না। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি। সংস্কৃত ক্রিয়ার্থভিত্তিক ভাষা। এ ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো–কোনো শব্দ তার কোনো প্রতীককে নির্দেশ করে না। তার ক্রিয়া বা কাজকে নির্দেশ করে। ফলে অদৃশ্য কর্মকে চেনা যায়। সেজন্য একটি নয় ওই কর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরও শব্দের উন্মেষ ঘটে। ভাষার ক্ষমতা বেড়ে যায়। কিন্তু বাংলা ভাষাও আর দশটা প্রতীকভিত্তিক ভাষার মতোই। অর্থাৎ বাংলাকে সংস্কৃতানুযায়িনী করার চেষ্টা বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে প্রতীকভিত্তিক ভাষা হওয়ায় নতুন শব্দ তৈরি করা দুষ্কর, অন্যদিকে সংস্কৃত কারও মুখের ভাষা নয় তাই তার ব্যাকরণ আমাদের কাছে অত্যন্ত কঠিন ঠেকে। অর্থাৎ বাংলাকে ব্যাকরণের নিয়মকানুন ধার করতে হয় সংস্কৃত ভাষা থেকে, অথচ নতুন শব্দ পেতে বা তৈরি করতে নির্ভর করে থাকতে হয় "শব্দ আমদানি"র ওপর। বানের স্রোতের মতো বিদেশি শব্দ এসে আমাদের ভাষায় ঢুকছেও। ভেবে দেখলে, বাংলা যে একটি বহমান ও জীবন্ত ভাষা এটাই তার প্রমাণ। কিন্তু নতুন আসা এই শব্দগুলোর বানান নির্ধারিত হবে কেমন করে? নাকি যে যেমন খুশি লিখবে সেটাই চান? ইতিমধ্যেই আমাদের ভাষায় প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ আছে, প্রতিনিয়ত যা বাড়ছেই এবং বাড়তেই থাকবে। বিকল্প বানান আমাদের মতো আম পাব্লিকের জন্যই তাই বেশি ক্ষতিকর হবে। ভেবে দেখুন যেখানে আপনাকে দেড় লক্ষ বানান জানলেই হতো সেখানে আপনাকে তার চেয়ে কয়েক গুন বানান বেশি মুখস্ত করতে হবে বা জানতে হবে। সম্ভব এটা?

আয়রনিটা কোথায় দেখুন, আমরা বাংলার জন্য সংস্কৃতের বর্ণ পরিকল্পনা নিয়েছি, কিন্তু সংস্কৃতের উচ্চারণ নেইনি। বর্ণমালায় সংস্কৃত প্রভাব, অথচ উচ্চারণে প্রাকৃতের প্রভাব–বাংলা বানান ও উচ্চারণে গরমিল হওয়ার জন্য এই অসঙ্গতিই সবচেয়ে বেশি দায়ী। এই অসঙ্গতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতেই প্রমিত বানানরীতির প্রয়োজন আছে। বাংলা একাডেমী এ কাজে অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছে। সম্প্রতি সরকারও পাঠ্যবইয়ে এনসিটিবিকে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করতে বলেছে। একটি সুশৃঙ্খল, নিয়মানুগ ও পরিশীলিত (এবং সময়ের সাথে পরিবর্তনীয়ও, সিচুয়েশন ডিমান্ড বলে একটা কথা আছে না?) বানানরীতি ভাষাকে শৃঙ্খলিত করে ফেলবে এ আশঙ্কাটা একেবারেই অমূলক। বরং তার যথাযথ প্রয়োগ হলে ভাষাচর্চা আরও সহজ হবে, ফলে ভাষা আরও বেশি গতিশীল হবে এটা ধারণা করা যায়। ভাষার স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন হয় না, কিন্তু বানানের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব এবং সুখের কথা এ কাজটাই বর্তমানে করা হচ্ছে।

সবশেষে বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্রী, যোগেশচন্দ্র রায় এঁরা বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য, কারণ বাংলা ব্যাকরণকে 'বাংলা' করার প্রাথমিক প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা ওনারাই নিয়েছিলেন। আমাদের দায়িত্ব তাঁদের সে অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করার কাজে বাংলা একাডেমীর প্রচেষ্টায় সাড়া দেওয়া।

অনেক দিন আগে এই সচলেই একটা পোস্ট দিছিলাম এ বিষয়ে। পড়ে দেখতে পারেন।

-কুটুমবাড়ি

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

কুটুমবাড়ি ভাই,

আপনার বক্তব্য-বিষয় জানি ও মানি।
আপনাকে খুঁচিয়ে একটু উত্তেজিত কট্টর বা রক্ষণশীল ব্যাকরনবাদী কাউন্টার-আর্গুমেন্ট শুনতে খুব ইচ্ছা করছিল! তাই ঐ কথাগুলি বলা। দেঁতো হাসি
উদ্দেশ্যটা মহৎ নয় নিঃসন্দেহে, আশা করি কিছু মনে করবেন না ! চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

হো হো হো আমি তো ভাই সৈয়দ শেখ জনিন্দারন্দন ঠাকুর ডাকিয়াতি এসবের কোনোটাই না। চোখ টিপি আম্মো পান-বিড়ি-ওয়ালা জসিমুদ্দীন। আমার কী হপে? হাসি

কুটুমবাড়ি

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

আপনার এই সিরিজ থেকে কিন্ত অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন হবেন।
কি ঠিক বললাম তো, না কি আবার বলে বসবেন, ধুর মশায় কী যে বলেন!

আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

অতিথি লেখক এর ছবি

শত ভাগ ঠিক! দেঁতো হাসি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানবেন।

কুটুমবাড়ি

কৌস্তুভ এর ছবি

আরেকটা কথা। দুজনের ক্ষেত্রে কিন্তু বানান অনেকটাই তাঁদের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ে। এক, মহান ব্যক্তিগণ। তাঁরা কিছু উল্টাপাল্টা করলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় আর্ষ প্রয়োগ। দুই। কবি। কাব্য নামক ফ্রি ফর্মটির অধিকারে ইচ্ছামত শব্দ এবং বানান আমদানি করা হালাল হয়ে দাঁড়ায়। কি, ঠিক বললাম?

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক। তবে সেই ইচ্ছাগুলোকে হতে হবে যুক্তিসঙ্গত, এবং আম পাব্লিককে না চটিয়ে... খাইছে

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

পোস্ট ভালা পাইলাম।
মেঘ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, মেঘ। পোস্ট ভালো লেগেছে জেনে আমারো খুব ভালো লাগল। হাসি

কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।