[b]অপ্রাসঙ্গিক [/b]

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৪/০৪/২০১১ - ৫:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অপ্রাসঙ্গিক

আলোটা ঝাক্ করে চোখে লাগার সাথে সাথেই ঝাঁঝালো পেচ্ছাপের গন্ধটাও নাকে ঢুকে পড়লো।

শালা! রোজ বলা যে বাইরে গিয়ে করবি। এইটুকু হেঁটে যাবেনা! জানালা দিয়ে বাইরে ছাড়তে ছাড়তে মেঝেসহ ভিজেছে।

একপাশে ক্যারামবোর্ডটা কেঁতরে পড়ে আছে। বোতলগুলোর সঙ্গেই জঘন্য একটা ভঙ্গিতে পড়ে বিশ্রি চিকন সুরে ফর্ ফর্ করে নাক ডাকছে রুস্তম। জিপারটা তখনো খোলা, ভেতরের ক্যাটক্যাটে লাল জাঙ্গিয়াটা দেখা যাচ্ছে। জাঙ্গিয়ার রং শালার কেউ লাল কেনে!

ভাঙা ঘুলঘুলি আর জানালার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সকালের তেড়িয়া রোদটা ছেনে দিচ্ছে পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনির টিনের ছাপড়া দেয়া আট ফুট বাই দশফুট ক্লাবঘরটার একটা পাশ, যেপাশে মানিক এতক্ষণ ঘুমুচ্ছিল। শিবু আগেই উঠে ভেগেছে। বাপে তোয়াক্কা না করলেও নিজের গরজে আক্ষরিক অর্থে বাপের হোটেলে বসা লাগে ওর। নইলে ফূর্তি করার, মালপানি খাওয়ার টাকাটা জুটতোনা।

আর ছিল মোতা, মোতালেব। লাইনের বাস চালায়। সে রাতেই ফুটেছে। বৌ-বাচ্চা সহ ফুল ফ্যামিলি-পাবলিক।

মানিকের ঐসমস্ত ব্যাপার নাই। মা মরার পর আরেকটা বিয়ে করার জন্য বাপটা যে পাঁচটা মাস সময় নিয়েছিল তাতেই সে বাপের উপর খুশি। তার থেকে লাখ তিনেক টাকা বের করতে পেরে ভক্তি বেড়ে গেছিল আরো। মানিক সেবারই ঐ টাকায় বাসস্ট্যান্ডে টায়ার টিউবের দোকান দিয়ে আলাদা হয়ে গেল । তারপর গতবছর ইলেকশনের পর দোকানটা তুলে দিয়ে মজাপুকুরটার পাড়ের খাসজমিতে কাঠের কারখানাটা দিয়েছে। পার্টির জন্য মারামারি, খুনোখুনি আগের পাঁচ বছরে তো আর কম করেনি। ইলেকশনেও জান দিয়ে খেটেছে। এখনো দরকারে অদরকারে ওদেরই ডাক পড়ে। এইটুকু তার প্রাপ্য । আর তাছাড়া এই পাড়ায় ওদের বরাবরই চলে। আর কারো মাস্তানির খাওয়া নাই। উঠতি ছেলে ছোকরাগুলো যে ওদের বেশ মান্য করে এইটাও মানিকের একটা জোরের জায়গা।

কারখানাটা চালায়, ভেতরেই একটা ঘর তুলে নিয়ে থাকে আবার পেছনের খাস জমিতেই পাড়ার ছেলেদের নামে তোলা ক্লাবঘরটাতেও রাত কাটায়।

নামকাওয়াস্তে ক্লাবঘর। সারাদিন কারখানার কাটাই-চেরাইযের ফাঁক ফোকরে ওরাই চার-পাঁচ জনে তাস পেটায়, ক্যারাম টোকে, মাল-টাল খায় অথবা শুকনা টানে। রাতে মেয়েছেলেও চলে। এইবার একটা টিভির বায়না করেছে ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে। ব্যাটা আজ দেব, কাল দেব করছে।

টিভিটা ছাড়া ঠিক জমছেনা আসলে। খেলা-টেলাগুলো জুত করে দেখা যেত।

উঠে এক কাত হয়ে থাকা রুস্তমের পাছায় একটা লাথ কষায় মানিক- উঠ্ শালা!

বিপজ্জনক একটা শব্দ করে নাকডাকাটা থামায় রুস্তম। তারপর চোখ খুলে নড়ে চড়ে উঠে বসে আর সবকিছুর আগে ভূতে পাওয়ার মতো দরজা দিয়ে বেরিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে হাঁ হয়ে থাকা জিপারটাই আবার টেনে নামাতে চায়। মানিক ঝর-র-র শব্দ শোনে ঘর থেকে ।

ব্যাটার ডায়েবেটিক না হয়েই যায়না। অনেকবার বলা হয়েছে। পরীক্ষা করাতে রাজি নয় কিছুতেই। ধরা পড়লেই তো শেষ! -‘সারাজীবন ওগলা ঝামেলা এক্কেরে পোষাবেনা দোস্। তাচেচ এই ভালো। খালি এট্টু ঘন ঘন ছাত্তে হয় আরকি’।

এর নাম একটু! এরপর মাল পেটে গেলে তো আর কথাই নাই।

ও ব্যাটারও এখন ঝাড়া হাত পা। মা’টা দুবছর হ’ল মরেছে। বউ ভেগেছে আজ তিনমাস। না ভেগে করতোই বা কি! রুস্তমকে দিয়ে আর কিছু হলে তো! রুস্তম এনিয়ে কোনো ঝামেলাও করেনি সেজন্য। পালাবার পর একদিন বলেছিল মানিককে-‘বাচ্চুর সাথে যে মাগির চিটির পিটির, সেইটা কি আর জানতাম না মনে কচ্ছিস? ভালোই হইছে গেছে। চাইছিলামই তো ভাগুক’। বলে খি খি করে কি হাসি! হলুদ গেঞ্জিটা থেকে তেড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া পেটটা কাঁপিয়ে অনেক্ষণ হেসেছিল যেমন, কয়েক টান শুকনার পর কেঁদেছিলও তেমনি।
আজিব মাল!

ঘরটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে মানিক বাইরে চলে আসে । কারখানার ছোকরা নুরু’র এতক্ষণে চলে আসার কথা। ওর কাছে চাবি দেয়া আছে আর বলা আছে এদিকটায় সেইরকম কোনো দরকার না পড়লে যেন না আসে। নুরু’র ওপর অনেকটাই নির্ভর করে ও। বয়েস কম কিন্তু চালাক চতুর আছে। দৌড়-ঝাঁপ করার ব্যাপারেও কুঁড়েমী নাই। এখন পর্যন্ত উল্টাপাল্টা কিছু দেখেনি সে ছোকরার স্বভাবে। সেইরকম কিছু ধরা পড়লে বরং মানিকেরই মুশকিলে পড়তে হতো। নুরুকে ওর আসলেই দরকার। নইলে সারাদিন বসে বসে দোকানদারি করা ছাড়া উপায় থাকবেনা। এইটা মানিকেরও এক্কেরে পোষাবেনা ।

চোখ রগড়াতে রগড়াতে রুস্তম পেছনে এসে দাঁড়ায়। ঠিক কানের কাছে এসে একটা হাই তোলে। বাসি দুর্গন্ধ ভক করে নাকে এসে লাগে। সামান্য সরে দাঁড়িয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে মানিক তাকায় ওর দিকে। রুস্তম মুখ ঘষতে ঘসতে বলে,

-চ’! শিবুর হোটেলের দিক যাই। চা খাওয়া লাগবে।

কাঠের চেলা দিয়ে ঘেরা কারখানার গেটটা ঠেলে সরিয়ে ভেতরে নুরুর লক্কর ঝক্কর সাইকেলটা দেখে নিয়ে মানিক বলে,

-আসতেছি। তুই আগা।

নুরু ক্যাশের হিসাবপত্র নিয়ে বসেছিল। খড়ি নিতে এসেছে একটা লোক।

মানিক নুরুর সাথে দু’একটা কথা বলে নিয়ে টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে পায়খানায় ঢোকে।

মুখটুখ ধুয়ে তারপর কারখানা থেকে বেরোয়।

রাস্তায় নেমেই শিবু আর রুস্তমকে দেখতে পায় সে। এইদিকেই আসছে।

-কি ব্যাপার! বাপ ভাগাই দিল্?

ঘাড় ঘুরিয়ে গজ পঞ্চাশেক দুরে মসজিদের মোড়টা একবার দেখে নেয় শিবু,

-ঝাঁপ ফ্যালাই দিবা হইল্। গন্ডগোল লাগিছেলো।

মানিক তেমন একটা অবাক হয়না। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এইগুলা হরহামেশা হয়। তবে সেজন্য হোটেল বন্ধ করার বিষয়টা মাথায় ঢোকেনা।

-ঘটনা কী? কী হইছে?

-একটা চ্যাংড়ি নাকি মইরছে ভোরের দিক্। দশমাইলের গড়ত্। ঢাকার বাস থাকি নামিছেলো। ঐঠেনায় পুলিশের কয়েকজন মিলি আগে জবরদস্তি কাম সাইরছে, তারপর ফ্যালাই থুইছে। এখন লোকজন খেপি গেইছে আর কি। এইঠোতে দুইবার পুলিশের সাথে ঢেলাঢেলি হইল্ বিহান থাকি।

রুস্তম বিরক্তি নিয়ে বলে,

-লাইনের কুনো মেয়েছেলে হবে, বুচ্চিস। পুলিশের তো আর কাম নাই!

মানিক শিবুর দিকে তাকায়,

- পুলিশও তো ঐটায় কহেছে। কিন্তু চ্যাংড়িটার মা ভাই নাকি লাশ সনাক্ত কইরছে। ওয় নাকি ঐর্কম নাহে। ঢাকাত কাম কচ্ছেলো। ছুটিত্ বাড়ি আইসেছেলো।

মানিক মসজিদের মোড়ের ছাড়া ছাড়া মানুষের জটলাটা দেখছিল। চা টা খাওয়া দরকার। ওদিকেই পা বাড়ায় সে ,

-চ’ ধিনি! দেথোঁ ।

আবার মোড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে ওরা।

পান আর চায়ের দোকান ছাড়া মোটামুটি বাকি সব বন্ধ। কি কারণে জানি খালি নারায়নের সেলুনটার হাফ ঝাঁপ তোলা। তিনরাস্তার মোড়টায় পুলিশের ভ্যানটা রাখা। তিনকোনা আইল্যান্ডের ওপর বটপাকুড় গাছটার গোড়ায় গোটাদশেক পুলিশ বসে আছে। রাস্তায় ইটের টুকরার ছড়াছড়ি। ইট মারা লোকগুলো সব এরমধ্যে ভেগেছে অথবা সাবধানে মিশে গেছে এখানে সেখানে। কয়েকজন সাইফুলের স্টিল ফার্নিচারের দোকানের সামনের নর্দমার স্লাবের ওপর দাঁড়িয়ে, কিছু লোক পান সিগারেটের দোকানের সামনে আর বাকি জটলা মন্টু মেকারের রিপেয়ারিং শপটার পাশের চায়ের দোকানটায়।

মানিকরা কালুর টঙের সামনে দাঁড়িয়ে ৩টা চা বলে সিগারেট ধরালো। একই কথা আরো কয়েকজনের মুখে শুনল ঘুরে ফিরে।

শিবু যা বলেছিল তার চেয়ে বেশি কিছুই নয়। সুতরাং চা’র সাথে গোল পাউরুটি চুবিয়ে চুবিয়ে খেয়ে কালুর কাছে থেকেই সামান্য আড়ালে তিনটা ছয় ইঞ্চি পকেটে ভরে ফিরতি পথ ধরল ওরা।

বেশ একটা হরতাল হরতাল মুড এসে গেছে দিনটায়। তাস পিটিয়ে, ক্যারাম ঠুকে সন্ধ্যাটা পার করে একটা মাগি না আনলেই নয় আজ। রেলবস্তি তুলে দেয়ার পর এখন রাস্তাঘাটে ঘুরছে মেয়েছেলেগুলো। তবে মানিকরা পারতপক্ষে ঐসবে যায়না। মজু মিস্ত্রির ছেড়ে দেয়া বউটা এতদিন করতো, কিছুদিন হলো তার মেয়েটাও লাইনে নেমেছে। বুকপাছা ঠিকমতো ভরার আগেই নেমে পড়েছে। কিন্তু ফেস কাটিং ভালো। প্রথম প্রথম ঘরেই বসাতো, ইদানিং ক্ষ্যাপও মারে। মানিকদের ক্লাবঘরেও গেছে কয়েকবার। যাবার পথে ঐবাসায় একবার দেখা দিয়ে এলো ওরা। সেই ফাঁকে রুস্তম মুতেও নিলো।

সারাদিনে মানিকদের এলাকায় আর কিছু ঘটলো না। তবে শহরের কয়েকজায়গায় ভাংচুর, পুলিশের সাথে পাবলিকের ধাওয়া টাওয়ার খবর শুনলো ওরা।

বিষযটা অত সহজে শেষ হলোনা তাহলে। শহরের মানুষ এতো ক্ষেপলো কেমন করে সেইটা আশ্চর্য লাগছিল মানিকের। এমনিতে পাড়ায় পাড়ায় হকিস্টিক, চাপাতি, কিরিচ নিয়ে বিভিন্ন ঝামেলায় শো ডাউন, মারামারি তো হয়ই। ওরাও আলুর দলের চ্যাংড়া প্যাংড়াকে কতবার কলোনি পর্যন্ত ঠেঙিয়ে এসেছে। কিন্তু পুলিশ পর্যন্ত ঐসমস্ত গড়ায়না সাধারণত। এইবারের প্যাঁচটা ঠিক ঐরকম না। আলাদা কিছু। এইরকম তো আগে হয় নাই!

পরদিন দুপুরের মধ্যে শহরের পরিস্হিতি পুরোই বদলে গেল। মোতা বিকালের আগে আগে এসে খবর দিলো লাইনের বাস বন্ধ, আজকে আর চলবেনা। প্রচুর ভাঙচুর হয়েছে। পাবলিক খেপেছে খুব। ঘটনার বাদবাকিটাও জানা গেল ওর কাছে। মেয়েটার বাড়ি সর্দারপাড়ার দিকে । সত্যি সত্যিই নাকি ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতো। দশ মাইলের কাছে শেষরাতে নেমে বাড়ি ফেরার জন্য ভ্যান ট্যান খুঁজছিল যখন, তখনই কয়েকজন কনস্টেবল আর এস আই মিলে সাহায়্য করার নামে ওকে পুলিশ ভ্যানে তুলেছে, ইজ্জত নিয়েছে। তারপর হয়তো বেকায়দায় পড়ে মেরে ফেলে রেখে গেছে। পরে আবার ওরাই কথাটা ছড়িয়ে দিয়েছে যে, ও লাইনের মেয়েছেলে ছিল। এই নিয়ে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড়। তারপর তো কেমন করে জানি পুরা শহরের লোকজনই ক্ষেপে উঠেছে। পুলিশ দেখলেই মারতে যাচ্ছে লোকে। এরমধ্যে পুলিশের হাতে পাবলিক যেমন লাঠিপেটা হয়েছে তেমনি পুলিশের লোকেরাও খেয়েছে ভালোই। বিডিআর-ও নেমেছে রাস্তায়।

পুরো ঘটনার সাথে কোথাও নিজেদের ঠিকঠাক যোগ খুঁজে না পেলেও ভেতরে কেমন একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল মানিক। মারামারির খবরেই বোধায়। রক্তে একটা অস্হিরতা ছড়াচ্ছিল একেকটা নতুন খবর।

শিবুর ডিউটি সকালের সময়টায় থাকে। দুপুরের পর ওর স্কুল ফেরতা ছ্টেভাই ভাতের হোটেলে বাপকে সঙ্গ দেয়। শিবু তাই দুপুরেই এসে পড়েছিল।

রুস্তম কোথায় জানি বেরিয়েছে বারোটার দিকে। মিস্ত্রিপাড়ায় ওর বাসাটা এখন খালি থাকে বলে বেশিরভাগ দিন রুস্তম মানিকের কারখানাতে ওর সাথেই থাকে। আগে বর্ডারে হুন্ডির ব্যাবসা করেছে কিছুদিন। মরতে মরতে বেঁচেছিল একবার। ছ’মাস হ’ল ওসবে আর যায়না। এখন বসে বসে টাকা উড়াচ্ছে। ইদানিং ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করেছে মানিকের সাথে পার্টনারশিপে কিছু করতে চায়। মানিক পাত্তা দিচ্ছেনা। ও জানে রুস্তমের সাথে পার্টনারশিপে যাওয়াটা গাধামী ছাড়া কিছু হবেনা। কোনো দায়িত্ব নেবেনা, পরে ঝামেলাটা ঠিকই করবে। তাই স্রেফ এড়িয়ে যাচ্ছে সে।

রুস্তম ফিরল বিকেলে। গরম খবরটাও নিয়ে এলো সঙ্গে। লাশ পড়েছে। একটা না, সাত সাতটা পাবলিকের লাশ! টগবগ করে ফুটছিল সে। লাশ না পড়লে কি আর জমে!

ঘটনাটা হ’ল, দুপুরের দিকেই একটা মিছিল বের করেছিল লোকজন। বিরাট মিছিল নাকি। শহরের মেইন রোডগুলো দিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিল ওরা। ‘ইয়াসমিনের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই’-ইত্যাদি’র সাথে হয়তো পুলিশের চামড়া তুলে নিতে চাওয়ার মতো আরো কিছু গরম গরম শ্লোগান চলছিল। তারই মাঝে পুলিশ প্রথমে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে, পরে হঠাৎ গোলাগুলি। আর তাতেই মরেছে লোকগুলো। জখমও ম্যালা। শহরের অবস্থা এখন ভয়াবহ। কার্ফ্যু দিতে পারে।

লঝ্ঝরে সিডি এইট্টিটা নিয়ে একটা চক্কর দিয়ে আসবে কিনা ভাবছিল মানিক।

বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বাকিদের কোনো উৎসাহ দেখা গেলনা। ওদের রেখে মানিক শেষমেষ নিজেই বেরুলো।

শহরতলির এদিকগুলোয় তেমন একটা কিছু বোঝা না গেলেও রেল স্টেশন থেকে চৌরঙ্গি সিনেমা হলের মোড় পর্যন্ত থমথম করছে শহর। স্পষ্টই বোঝা যায় এই শহরে আজ কিছু একটা হয়েছে। টায়ার জ্বলছে রাস্তার কোথাও কোথাও। গলগলে ধোঁয়া বেরুচ্ছে সেগুলো থেকে। যানবাহন খুব কম। পুরোপুরি হরতালের অবস্থা। কোন পলিটিকাল পার্টির ডাকা হরতালেও এতোটা হয়না এখানে। পুলিশ দেখা গেলনা। দুটো ভ্যানের চলে যাওয়া ছাড়া টহল পুলিশের কোনো পাত্তা নাই।

সদর হাসপাতালটা একবার দেখে যাবে কিনা ভেবেও মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে ফিরে এলো মানিক।

একটা বেখাপ্পা উত্তেজনা, দুইটা কেরুর বোতল আর অসংখ্য সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে একটা উদ্ভট প্রতিক্রিয়ার রাত কাটালো মানিক, শিবু আর রুস্তম। কাউকে পিটানোর একটা তীব্র ইচ্ছা ভর করছিল মাথায়। একটা পুলিশ পিটানোর ইচ্ছা। দোহাত্তা মাইর। শহরে এত্ত মারামারি হয়ে গেল আর ওরা কিছুই করলো না! একটা পুলিশকেও পিটাইতে পারলো না!

‘বালের পাবলিক হইছো তুমি! এইঠেনায় বসি বসি হাত মারেক্’।-বোতলের সাথে গড়াগড়ি যাওয়া মানিকের কথায় বাকি দুজনেরও মনে হতে লাগল, আহা, সত্যি কতদিন কাউকে পিটানো হয় না!-কত্তদিন জুত করে হাতের সুখ মিটানো হয় না। ওদের হাত পা মগজ নিশপিশ করতে লাগলো।

পরদিন বিকেলেই পুলিশ পিটানোর ব্যাপারটা একরকম ফরজ হয়ে দাঁড়ালো।

থানা ঘেরাও করে নাকি বিরাট ভাঙচুর হয়ে গেছে। শহরে কার্ফ্যু । দেখামাত্র গুলির নির্দেশ। দেশের সব পেপারে বড় বড় করে খবর ছাপা হয়েছে। অনেক পুলিশের লোক বাসাবাড়ি ছেড়ে ভেগেছে। লুট হয়েছে কোথাও কোথাও। গোটা দেশে ইয়াসমিন নামের মেয়েটাকে নিয়ে এখন বিরাট তোলপাড়।

মানিক, শিবু, রুস্তমেরও এইবার মনে হতে লাগলো শালার ঠোলার বাচ্চারা একটা গরীব মেয়েকে এইরকম করে মেরে ফেললো! হারামীদের ছাল ছাড়ায় নেওয়া দরকার না!

সুতরাং মসজিদের উত্তর দিকের নারকেল গাছওয়ালা দারোগার বাসাটা সহসাই শত্রুদুর্গ মনে হতে লাগলো ওদের। ঠিক তো! কয় মাস হইলো ঐ ব্যাটা আসছে, আসেই বহুত হুজ্জত! ঘুষ খায় খায় হারামী তো বিরাট ভুড়ি বানাইছে। বৌ-বেটিরাও মাটিতে হাঁটেনা। গাড়িতে কাচ তুলে দিয়ে যায় আসে। বাইর করতেছি ব্যাটা তোর হারামের পয়সায় মৌজ করা।

ওদের তিনজনের মাথাতেই বিভিন্নভাবে একটা কথা ঘুরে ফিরে আসে, হারামীর একটা বেটি আছে না! দেখার ইচ্ছা বাড়িয়ে গাড়ির কাচের আড়ালে যাওয়া আসা করে। কয়েক ঝলক মাত্র দেখা।

সেদিন সন্ধ্যায় আঁধার নামার পরপরই মসজিদের উত্তর দিকের নারকেল গাছওয়ালা বাসাটায় ডাকাত পড়লো। লোডশেডিঙের অন্ধকারে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা তিনজন যুবক অস্ত্রের মুখে দারোয়ানকে বেঁধে রেখে ঢুকে পড়লো ভেতরে। দারোগা সেইসময়টায় বাসায় ছিলনা। বেশ একচোট ভাঙচুর করলো তারা। তারপর ভেতর ঘরের দরজা ভেঙে খুঁজে পেল হুইল চেয়ারে বসা আধা প্যারালাইসড দারোগা গিন্নি আর তার সাথে মেয়েটাকে। মহিলার চিৎকারের মুখে তার মুখ বেঁধে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো একজন। বাকি দুজন ততক্ষণে মেয়েটার মুখ বেঁধে নিয়ে গেছে বেডরুমে। তারপর তিনজন অস্ত্রধারী যুবকের কয়েকমাসের গোপন ফ্যান্টাসি, ফেন্সিডিলের টাটকা নেশা আর গত দুদিনের ক্রোধের সম্মিলিত উদগিরন হল মেয়েটির ওপর। প্রায় বেহুঁশ মেয়েটিকে ফেলে আসার সময় আরো কিছু জিনিসের সাথে ড্রইংরুমের কালার টিভিটাও তুলে আনলো ওরা।

... ... ...

শিবুর মনে হয় কাজটা খুবই ন্যায্য হয়েছে। শালার বাঞ্চোতেরা বুঝুক মানুষের বৌ-বেটিদের ঐ হাল করলে কেমন লাগে! খালি আপসোস পুলিশ পিটানোর শখটা মিটলোনা।

রুস্তম ভাবছিলো টিভিটা সেট করার জন্য এন্টেনা আর তার কেনা লাগবে কালকে। এইবার বিশ্বকাপটা জমায় দেখা যাবে। ঐ শালার কমিশনারকে আর বাল দিয়েও পুছতে হবেনা।

মানিকের মনে পড়ে মেয়েটা একবার যেন তার পিঠ খামচে ধরেছিল। চরম সময়ে মেয়েগুলো যেমন ধরে। বিষয়টা ভাবতেই প্যান্টের ভেতর আবার নড়াচড়া টের পেতে থাকে মানিক।

গাঁজায় দুইটা লম্বা টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সে।

আরো ঘন্টাখানেক বাদে, আসল সময়ে প্যান্টের জিপারে চামড়া আটকে যাওয়া নিয়ে রুস্তম যখন খেপাচ্ছে শিবুকে -‘শালা আকাটা! কতবার বলছি কাটি নে কাটি নে ...’, মোতা এসে খবরটা দিলো,

-শুইনছি রে! দারগার বাসাত্ নাকি ডাকাইত পইড়ছে? দারোয়ানোক্ বান্ধি রাখি লুটপাট কইরছে। বৌটাকো পিটাইছে, ফের কাজের বেটিটার অবস্থা দিছে খারাপ করি । দুইজনায় হোসপিটালোত্।

হাওয়ায় ভাসমান মানিক ধপ্ করে মাটিতে পড়ে।

মুর্খের মতো জিজ্ঞেস করে,

-কুন্ দারগা?

-আরে হামার পাড়ারটায়! ঐ ব্যাটা তো বাচি গেইছে। গাড়িত করি বেটিটাক্ বগুড়াত্ নাকি বোহিনের বাড়িত্ রাখি আসিবা গেইছেলো। তারে ভিতর এই ঘোটনা।

ক্লাব ঘরটায় হঠাৎ মহাশুন্যের স্তব্ধতা নেমে আসে। ঘরের টিকটিকিটাও আজ কোথাও টিক টিক করে

ওঠেনা। বাতাসে ক্যাঁচ করে ওঠেনা জানালার কব্জা ভাঙা পাল্লাটা।

অথবা এসব পৌঁছোয় না ওদের কান পর্যন্ত।

সেইসময় মোতা টিভিটা দেখতে পায়,

- টিভি! দিলি? এই সোমায়!!

জবাব আসেনা কারো থেকে।

শিবুর হাতের ফেনসিডিলের ছয় ইঞ্চি শিশিটা ভারি হতে হতে প্রবল ভরবেগে হাত থেকে খসে পড়তে চায়।

মানিকের পেটে দুপুরের ভাতগুলোয় অকারণ আলোড়ন ওঠে।

রুস্তমের হঠাৎ বেগ পায় ভীষন, মনে হয় ওখানেই হয়ে যাবে, বাইরে যাওয়া হবেনা কোনোদিন।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দুইবার করে শিরোনাম লিখলেন, অথচ নিজের নামটাই লিখলেন না! তাহলে আমরা কীকরে বুঝবো এটা কার লেখা!

আপনার গল্পের ভাষা চমৎকার! যে ধরনের ঘটনাকে হারবার্ট মার্কাস "অ্যান্টিথিসিস" বলে চিহ্নিত করেছেন, সে ধরনের ঘটনার কালে "অ্যান্টিসোশাল" শ্রেণীর মনোজগতে যে আলোড়ন হয় সেটা ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। তখন যে সুযোগ নেবার ঘটনা ঘটে সেটিরও উল্লেখ করেছেন। তবে সেটাতেই শেষ করাটা ভালো লাগেনি। এটি গল্পের কী-পয়েন্ট হতে পারে না। যাকগে, সেটা আমার মতামত। তাতে আপনার একমত হওয়া জরুরী নয়।

লিখতে থাকুন - হাত খুলে, মন খুলে, নিয়মিত।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তিথীডোর এর ছবি

আপনার লেখার ধরন দারুণ! চলুক চলুক
লিখুন নিয়মিত...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সারওয়ার রেজা এর ছবি

ষষ্ঠ পান্ডব@ পড়ার এবং চমৎকার মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা।

সচল হবার চেষ্টায় পুরনো একটা লেখা দেয়া। ব্লগের মাপে যেটা রীতিমতো বড় মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, কেউ এতটা ধৈর্য্য নিয়ে অচেনা কারো লেখা পড়বে কিনা। আপনার মন্তব্যে ভরসা পেলাম।

ইয়াসমিনের ঘটনাটার প্রতিবাদে ঐ এলাকার লোকদের মাঝে যেটা হয়েছিল সেটাকে একধরণের গণজাগরণ বলা যায়। বিক্ষোভ-সহিংসতায় যারা প্রাণ দিয়েছিল তারা কেউই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সেটা যে ঠিক সমসত্ত্বভাবে হয়েছিল, তাও নিশ্চয়ই নয়। কেউ কেউ বিভ্রান্ত ছিল, সুযোগ সন্ধানী ছিল, থাকে। আমি এই শ্রেণীটাকে ধরতে চেয়েছিলাম। যেটাকে 'অ্যান্টিথিসিস' বলেছেন, সেটার মধ্য দিয়ে আসলে এই শ্রেণীটাকেও আমি এই জাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছি। ঐ পয়েন্টে এসে ওদের উপলব্ধির একটা সম্ভাবনা তৈরি করে ছেড়ে দিতে চেয়েছি। কালু, রুস্তম, শিবুরা 'অপ্রাসঙ্গিক' থেকে ঐ পয়েন্টে এসেই 'প্রাসঙ্গিক' হয়ে ওঠার একটা সুযোগ হয়তো পেতে পারে। হয়তো না।

অধমের নাম সারওয়ার রেজা।

সারওয়ার রেজা এর ছবি

তিথীডোর@
অনেক কৃতজ্ঞতা...

তিথীডোর এর ছবি

অফ টপিক: সারওয়ার ভাই--
যার মন্তব্যের উত্তর দিতে যাচ্ছেন, জবাবে ক্লিক করলে ঠিক তার নিচেই সেটা দেয়া যাবে। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

এ ধরণের বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে, পড়ার সময় গল্পের ভাষা কে অনেক সময় আড়ষ্ট বা জোর করে চাপানো মনে হয়। এই গল্পে তা একবারো মনে হয়নি।

গল্পের বিষয় আর ভাষা নির্বাচন চমৎকার লাগল। সচলায়তন আরো একজন দারুণ গল্পকার পেল মনে হচ্ছে। আরো অনেক অনেক লিখুন হাসি

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

গল্পের গাঁথুনি ভালো। পরিণতি ঠিক পছন্দ হয়নি, আরো জোরালো কিছু হতে পারতো। তবে লেখক নিশ্চয়ই পাঠকের পছন্দ না ভেবে নিজের তাগিদেই লিখবেন।

আরো লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

বইখাতা এর ছবি

আমার কাছে একেবারে যথার্থ মনে হয়েছে শেষটা। লেখার ভাষা, কথোপকথন বা বর্ণনা, কোনোটাই আরোপিত মনে হয়নি। দারুণ! আরও লিখুন।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো। চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সারওয়ার রেজা এর ছবি

আনন্দী কল্যান@ আপনার প্রশংসা পাওয়া সত্যি বিশেষ কিছু। কারণ, আপনার কবিতা আমার ভারি পছন্দ। কৃতজ্ঞতা জানবেন হাসি

সারওয়ার রেজা এর ছবি

সুহান রিজওয়ান@ ধন্যবাদ পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য হাসি

সারওয়ার রেজা এর ছবি

বইখাতা@ এরপর তো তবে লিখতেই হবে.. হাসি কৃতজ্ঞতা জানবেন

সারওয়ার রেজা এর ছবি

সুলতানা পারভীন শিমুল@ অনুপ্রাণিত হলাম হাসি কৃতজ্ঞতা...

সাফি এর ছবি

অসাধারন লাগলো। সত্যি অসাধারন। পড়ার সময় মনে হচ্ছিল পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সব দৃশ্য

সারওয়ার রেজা এর ছবি

সাফি@ আপনার মন্তব্য অনেক অনুপ্রাণিত করলো। হাসি অসংখ্য ধন্যবাদ...

সারওয়ার রেজা এর ছবি

তিথীডোর@ কিন্তু 'জবাব' চাপার পর একটা শূণ্য পাতা অনেকক্ষণ ঝুলে থাকে (ঝুলিয়ে রাখে), মন খারাপ অপেক্ষার শেষটা দেখা হয়না- এতোটাই দীর্ঘ সময়। হতে পারে 'অতিথি লেখক'দের জন্য এটা সচলায়তনের বরাদ্দ ধৈর্য্য পরীক্ষা। নাকি শুধু আমার ক্ষেত্রেই হচ্ছে! আবারো ধন্যবাদ হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বর্ণনাভঙ্গি চমৎকার।
লেখা চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সারওয়ার রেজা এর ছবি

নজরুল ইসলাম@ ধন্যবাদ আপনাকে... হাসি

ফাহিম হাসান এর ছবি

চোস্ত্ সংলাপে মুগ্ধ হলাম।

সারওয়ার রেজা এর ছবি

ফাহিম হাসান@ কৃতজ্ঞ হলাম হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।