স্বপ্ন ও অন্যান্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৪/০৪/২০১১ - ৫:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়। সে হিসেবে এখন আমার শিশুসম অবস্থা, যদিও কালে কালে বয়স আটাশ পেরিয়ে গেছে। বেঁচে থাকলে মানুষ বারে বারে বদলায়, আর সেইসাথে স্বপ্নের পরিধি ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকীয় তত্তের মতন পাক খেয়ে একটা ক্ষুদ্র বিন্দুতে চলে আসে।
যুক্তিহীন, আবেগতাড়িত স্বপ্নগুলো নাকি জন্ম নেয় শৈশবে। খুব ছোটবেলায় যখন লিলিপুট গাড়ি আর হেলিকপ্টার নিয়ে খেলা করতাম একাকী, স্বপ্নগুলো খুব সহজ ছিল- বড় হয়ে পাইলট হব আর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াব মুক্ত পাখির মতন উড়োজাহাজের পাখায় ভর করে। জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে শৈশবের স্বপ্নগুলো মিলিয়ে যেতে খুব একটা সময় নেয় না। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে (তখনো ঢাকা শহর ফ্ল্যাটবাড়ি আর দোকানের সমারোহে পুরোপুরি জরাজীর্ণ হয়নি), বাড়ির পাশের খোলা মাঠটাতে ক্রিকেট খেলতে যেতাম প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে। টিভির রুপালি পর্দায় কপিল দেভ, ইমরান খান আর অ্যালান বোর্ডারদের খেলা দেখে মনে সাধ জাগত, একদিন আমিও ঝকঝকে সবুজ মাঠে চার ছয়ের পসরা সাজাব। কিছুদিন যেতেই নিজের সীমাবদ্ধতা টের পাই, তখন ব্যাট হাতে ইট দিয়ে গড়া ডামি উইকেটের (কাঠের স্ট্যাম্প দিয়ে খেলাটা সেইসময় বিলাসিতার পর্যায়ে ছিল) সামনে দাঁড়ানোটা শুধুই নির্মল আনন্দের জন্য (আর মনে মনে গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার জন্যে)।
ছেলেবেলার একটা পর্যায়ে গল্পের বইয়ের পোকা হয়ে যাই। একটা কারন ছিল আশপাশের খালি জায়গাগুলো ধীরে ধীরে ভুমি মালিকদের আগ্রাসনে সুরম্য অট্যালিকায় পরিনত হওয়া, পরিনাম খেলাধুলা শুধু স্কুলেই সীমাবদ্ধ। আরেকটা কারন বোধহয় স্বভাবগত অন্তর্মুখিতা। বইয়ের চরিত্রগুলোকে নিজের খুব কাছের মনে হত, তাদের সাথে সাথে আমিও যেন চলে যেতাম মিথ্যে কল্পলোকে, অসম্ভবকে সম্ভব করতাম। শুরুর দিকে রহস্য-রোমাঞ্চের কাহিনীগুলোই বেশি টানত। তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা, কাকাবাবু, অর্জুনদের খুব কাছের মানুষ মনে হত। বই কেনার জন্য কত কষ্টই না করতাম। মা প্রতিদিন স্কুলে যাবার জন্য দশ টাকা দিতেন। শ্যামলী বাস স্ট্যান্ড থেকে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল লোকাল বাসে করে যেতে দেড় টাকা লাগত। যাওয়া আসা নিয়ে তিন টাকা। দুই টাকা করে চার টাকা লাগত বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ড যাওয়া আসায়। বাকি টাকা টিফিনের জন্য। এই ছিল মা'র হিসাব। টাকা বাঁচানোর জন্য টিফিনের সময় প্রায়ই কিছু খেতাম না, হেঁটে যেতাম বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসা পর্যন্ত। এইভাবে জমিয়ে জমিয়ে বই কেনা। সদ্য কেনা বইয়ের গন্ধ ঈদের নতুন পোষাকের মতনই মোহময়ী মনে হত। স্কুলে আমার মতনই বইয়ের পোকা খুঁজে নিলাম আর কিছু- নবীন, ইমন, সাফওয়ান, তোরন আর
অনেকের সাথে বন্ধুত্বের শুরু এভাবেই। বন্ধুদের সাথে বই বিনিময় নতুন নতুন বই পড়া অনেক সহজ করে দিল। আর বই পড়তে পড়তেই স্বপ্ন দেখি লেখক হবার।
বড় লেখকদের মতন, আমার লেখালেখির প্রচেষ্টা শুরু হল বেশ অল্প বয়সেই। যতটুকু মনে আছে, ক্লাস থ্রিতে থাকতে বন্ধু তোরনের সাথে ঠিক করলাম, একটা গোয়েন্দা উপন্যাস লিখব দুজনে মিলে। শুরু হল টিফিনের ফাঁকে আর স্কুল শেষে আমাদের উপন্যাস পরিকল্পনা। মোটামুটি একটা কাহিনী দাঁড়িয়ে গেল। লেখাও শেষ করে ফেললাম একদিন। বন্ধুবান্ধব আর পরিচিতজনদের সান্ত্বনাসূচক প্রশংসা লেখালেখির উৎসাহে আপাত ইতি টানল। লেখক হবার ভূত পুরোপুরি ছাড়েনি যদিও। দেয়াল পত্রিকা আর স্কুল ম্যাগাজিনগুলোতে মাঝে মাঝে গল্প-কবিতা জমা দেয়া চলল বিচ্ছিন্নভাবে। পঞ্চম শ্রেনীতে থাকাকালীন অবস্থায় আরেকবার উপন্যাস লেখার মহাপরিকল্পনায় নিয়োজিত হলাম এবং তিন-চার মাসের কলম চালাচালিতে একটা পান্ডুলিপি মোটামূটি দাঁড়িয়ে গেল। এবার অবশ্য বর্ননাশৈলী আর কাহিনী চিত্রায়নে কিছুটা পরিপক্কতা ছিল। পরিচিতজনদের কেউ কেউ সত্যিকারের উৎসাহ দিল-লেগে থাকলে হয়ত স্বপ্ন পুরন হতেও পারে! লেগে থাকার ধৈর্য্যটুকু ছিল না, -এটাই বোধহয় একজন সফল মানুষের সাথে আমার মতন সাধারন মানুষদের পার্থক্য গড়ে দেয়। তবে এটাও সত্যি যে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হিসেবে একটা তাড়না কাজ করত ভাল ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার জন্য, আর্থিক স্বাধীনতা খুব গুরুত্বপূর্ন
মনে হত।

ক্লাস সেভেনে ক্যাডেট কলেজ পাড়ি দিলাম। অনেক কিছুই বদলে গেল একটু একটু করে। সামরিক শৃঙ্খলায় জীবন যাপন করতে করতে একসময় মনে হল সেনা কর্মকর্তা হতে পারলে বোধহয় মন্দ হয় না। যদিও প্রতিবন্ধক দৌড়ে বন্ধু মোবাশ্বিরের দুই মিনিটের দুর্দান্ত ঝলকের সাথে নিজের চার মিনিটের কোনরকম সমাপ্তি বুঝিয়ে দিল, এইদিকে সুবিধে হবে না। এস.এস.সি, এইচ.এস.সি'র তুলনামুলক ভাল রেজাল্টেরও কিছুটা ভুমিকা ছিল সেনা কর্মকর্তা হবার স্বপ্ন পরিত্যাগ করে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক(?) পেশাজীবী হবার সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার। ক্যাডেট কলেজে থাকতেই সংগীতের প্রতি আগ্রহটা তীব্র হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাগুলোতে বড় ভাইদের গিটার, কীবোর্ড বাজানো মুগ্ধ করত। হারমোনিয়াম বাজাতে পারতাম বলে বোধহয়, নবম শ্রেণীর আগত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে গড়ে ওঠা নব্য ব্যাচ-ব্যান্ডে কীবোর্ডিস্ট হিসেবে সু্যোগ পেলাম। কিন্ত কীবোর্ডিস্ট হলে কি হবে, কীবোর্ড তো বাজাতে জানি না। কি আর করা, বড় ভাইদের পেছন পেছন ঘোর। তাদের করুনাতে একটা দুটো করে কর্ড প্যাটার্ন শিখতে শিখতে কাজ চালানোর মতন কীবোর্ড শিখে গেলাম। তবে এও বুঝে গেলাম, বিধাতা এতটা সংগীত প্রতিভা দেন নি যে, সংগীতকে পুঁজি করে নিজের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারব। সেজন্য যে পরিমান
সাধনা আর ত্যাগের প্রয়োজন ছিল, সেটার জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না।
ইন্টারমিডিয়েটের কাছাকাছি সময়ে, কীবোর্ডের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে গিটার শেখা শুরু করলাম। এবার অবশ্য কোন প্রত্যাশা ছিল না, কেবল নিছক আনন্দের জন্য। স্বপ্নের পরিধি তখন অনেকটাই বাস্তবকেন্দ্রিক। কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন, আর সেই জ্ঞানকে দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজে লাগানো। খুবই সহজ সরল হিসাব। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে স্বপ্নের দ্বিতীয় অংশটুকু যে সময়ের প্রতিঘাতে আর আত্বকেন্দ্রিকতায় অচিরেই মুছে যাবে, বুঝতে পারিনি বোধহয়।
উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে আসাটাও তাই অগ্রজ-সহপাঠীদের পদাংক অনুসরণ করে গড্ডালিকা প্রবাহে গা-ভাসানো্র জন্যে কি না- মাঝে মাঝে সংশয় বোধ করি। জীবনের এই পর্যায়ে সব স্বপ্নই খুব দুরের মনে হয়। স্বপ্নহীনের মতন শুধুই বাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। অনৈচ্ছিক গবেষণা, অর্থহীন আলাপ, প্রিয়জনদের ভালবাসা আর অলসতায় কেটে যায় সময়। হঠাৎ হঠাৎ মেঘহীন আকাশের জ্বলজ্বলে তারাদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, জীবনটা নেহায়েত মন্দ নয় তো।

-নাসাদ আহমেদ সাফা


মন্তব্য

আব্দুর রহমান এর ছবি

ভালো লাগলো।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

স্বপ্নডানা এর ছবি

এই অপূর্ণ স্বপ্ন গুলো নিয়ে বেঁচে থাকার নাম ই কি জীবন?

তিথীডোর এর ছবি

জীবনটা নেহায়েত মন্দ নয় তো।

আপসুস, এরকম কদাচিৎ মনে হয়...
লেখা ভাল্লাগলো। চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

লেখা ভাল্লাগলো। আমিও নাইন্টিসে বড় হইছি। একই শহরে। অনেক কিছু কমন পড়ল। স্বপ্ন দেখা থামায়েন না। যদিও জীবন যেকোনো স্বপ্নের চে বড় হাসি


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নৈষাদ এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

স্বপ্ন পূর্ন আর অপূর্ন থাকুক, জীবন তো এগিয়ে যাবেই। ধন্যবাদ সুন্দর সব মন্তব্যের জন্য।

-নাসাদ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জীবন একটা প্রক্রিয়া, কোনো এন্ডরেজাল্ট নাই। আগ্রহের সব বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময়ও পাওয়া যায় না। সুতরাং বর্তমানে যে কাজটা হাতে আছে, সেটা যতোটা সম্ভব সফলভাবে করার চেষ্টাই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো অপশন।

লেখা ভাল্লাগলো। নিয়মিত লিখুন।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অপছন্দনীয় এর ছবি

কি সর্বনাশ, অনেক কিছুই তো করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে...

আরে ভেবে দেখুন না, আমার মত প্রাণীও পৃথিবীতে আছে আপনার কাছাকাছি বয়স, কিন্তু আপনি যা যা করার চেষ্টায় কিছুদূর গিয়েছেন সেগুলোর চিন্তাও করে উঠতে পারেনি...দেখবেন ভালো লাগতে শুরু করেছে দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

কমন পড়লো অনেক কিছু ! ভালই তো লেখেছেন লেখক হবার সম্ভাবনা শেষ হয়নি মনে হয় !
গুল্লা

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সবকিছুর পরেও কাউকে পজিটিভ ভাবতে দেখলেই ভাল্লাগে। চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সৈয়দ আফসার এর ছবি

চলুক

__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

স্বপ্ন এরকমই, চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সাফি এর ছবি

চমৎকার লিখেছিস নাসাদ। নিয়মিত হ। সচলে স্বাগতম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।