অল্প-স্বল্প ছেলেবেলার গল্পঃ প্রসংগ ভর্তিযুদ্ধ, ১৯৯৪

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০৪/২০১১ - ৮:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার স্ম্‌তিশক্তি ভয়াবহ রকমের খারাপ। গতকালকের ম্যাচে সাকিব কাকে কাকে বোল্ড করেছে কিংবা গত পরশুর খেলায় বার্সা শিবির ক'বার রিয়েলের জাল ছিন্নভিন্ন করেছে---এইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও আমি মনে রাখতে পারি না। সেজন্যেই বোধোয় বন্ধুদের স্ম্‌তিশক্তি দেখে আমার বরাবরই দারুণ হিংসে হয়। এমনো বন্ধু আছে, যাদের কিনা ক্লাস ওয়ানের ভর্তি পরীক্ষার খুঁটিনাটি পর্যন্ত মনে আছে। আমি দেখি আর অবাক হই। এতোটুকুন মগজের মধ্যে এতো এতো স্ম্‌তি মানুষ ধরে রাখে কী করে? সেই হিসেবে আমার মগজ তো টেন্ডস টু জিরো সাইজের হওয়ার কথা। কেননা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি পরীক্ষা দূরে থাক, এই তো সেদিন এসএসসি আর এইচএসসি দিলাম। যে দুটো পরীক্ষার জন্য এতো প্রস্তুতি, এতো দোয়া-দুরুদ আর এতো এতো মানুষের পথ চাওয়া, তারই বলার মত কোন স্ম্‌তি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

তো আমাদের ডিপার্টমেন্টের ম্যাগাজিন 'খড়কুটো'তে বন্ধু লুনারের একটা লেখা পড়ে ব্যাপক হিংসিত হলাম। ক্লাস ওয়ানের ভর্তি পরীক্ষার উপর স্ম্‌তিচারণমূলক লেখা। চমৎকার লিখেছে সে। বাসার সবাই তো তার লেখা পড়ে মুগ্ধ। আমার ছোট ভাইগুলোকে আমি জোর করেও আমার লেখা পড়াতে পারি না। এদিকে বন্ধুবরের লেখা দেখি ওরা এক গোগ্রাসে পড়ে শেষ করেছে। তারপর থেকেই সুযোগ খুঁজছি, সময় পেলেই আমিও '৯৪ এর টানটান উত্তেজনাময় ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে একখানা কাব্য কি গদ্য লিখেই ফেলবো। এখানে বলে রাখি, উত্তেজনাটা আমার নয়, স্পেসিফিক্যালী বলতে গেলে আম্মুর। আব্বুর কথা হল, আপাতত কোন একটা স্কুলে পড়লেই চলবে। বয়স হোক, সামান্য জ্ঞানবুদ্ধি হোক, তখন না হয় কোন ভাল স্কুলে ভর্তি করা যাবে। আম্মুর আবার পাশের বাসার ভিকারুন্নিসার আপুদের দেখে দেখে নজর খানিকটা উঁচু হয়ে গেছে। তার ছেলেদের তো আর ভিকিতে পড়ানো সম্ভব না, দেখা গেলো ছেলেদের জন্য আমাদের এলাকায় ভালো স্কুল বলতে সরকারির মধ্যে মতিঝিল গভঃ বয়েজ স্কুল আর বেসরকারির মধ্যে আইডিয়াল স্কুল। দুটোর জন্যই ফর্ম কিনে আনা হল। তখন অবশ্য এতো কিছু বুঝি না। আম্মু 'সমাধান' নামে একটা গাইড কিনে এনেছিলেন (এটা সম্ভবত আইডিয়ালের সামনে বিক্রি হত)। তো আমি খানিকটা বাংলা সিনেমার কায়দায় ট্রাইসাইকেল চালাতে চালাতে সেই বই খতম করে ফেলি। এবং যে কোন কারণেই হোক, আমার ধারণা হয়, এটাই আমার পাঠ্যবই এবং এ বই থেকেই সব কোশ্চেন আসবে।

মতিঝিল গভঃ এ পরীক্ষাটা মোটামুটি আনন্দদায়কই হয়। এ পরীক্ষাটি নিয়ে বেশি কিছু মনে পড়ে না। জসীমউদ্দীন-এর 'মামা বাড়ি' কবিতাটা লিখতে দিয়েছিলো-এইটুকু খালি মনে পড়ে। কবিতাটা আমার পড়া ছিলো। কাজেই আমি গটগট করে সেটা খাতায় তুলে দিই। কিছুক্ষন পর দেখি এক বুড়োমত স্যার এসে কবিতাটা জোরে জোরে আব্‌ত্তি করছেন। আমরাও এ সুযোগে স্যারের সাথে সাথে এক দফা রেওয়াজ সেরে নিলাম। মতিঝিল গভঃ এ সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিলো, আশেপাশের ছেলেদের দেখে মনে হয় নি, এরা কেউ পরীক্ষা দিতে এসেছে। ভাবখানা এমন, সবাই আঙ্কেল-আন্টির সাথে পিকনিক করতে এসেছে। এর মধ্যে কেউ একজন এসে বললো, "আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা, (মেয়েরা ছিলো না যদিও) পরীক্ষা দিয়ে যাও", অমনি সবাই দল বেঁধে পরীক্ষা দিতে ছুটে এলো। এবং পরীক্ষা শেষেও "আমরা করেছি জয়" এমন একটা হাবভাব নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এই স্কুলটা আমার অনেক ফেভারিট। শিক্ষাজীবনের প্রথম ছয়টা বছর আমি এখানেই কাটিয়েছি।

নেক্সট টার্গেট আইডিয়াল। এখানে পরীক্ষা দিতে এসে মনে হল, "মাম্মি, এখানে পরীক্ষা হবে না অন্য কিছু?" স্কুলের সামনের রাস্তাটা স্কাউটরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে (তখন যে এদের স্কাউট বলে তা অবশ্য জানতাম না), গার্জিয়ানরা হৈ হৈ রৈ রৈ করছে। স্যারদের ব্যস্ততাও সীমাহীন। মতিঝিল গভঃ এর স্যারদের সেই তুলনায় অনেক কুল মনে হয়েছিলো। যা হোক, পরীক্ষা শুরু হল। এবং 'সমাধান' থেকে তেমন কিছুই এলো না। বুঝে গেলাম, বৎস, এ মুলুকে তোমার কিছু হবে না। যেটুকু পারি, লিখে দিয়ে আশেপাশে তাকানো শুরু করলাম। আমার দুই পাশেই দুটো মেয়ে। ভাবলাম, ওদের কিছু জিজ্ঞেস করবো কিনা। কোন এক বিচিত্র কারণে আমার ধারণা ছিল, মেয়েরা পড়াশোনায় বরাবরই ভালো হয়। এদের জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করলে একটা কিছু হিল্লে হলেও হতে পারে। আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে কিছুক্ষণ পর উলটো উনারাই আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। আমি সেদিকে ধ্যান না দিয়ে পানি চিবিয়ে খায় না গিলে খায় এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করলাম এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসলাম, নাহ, পানি চিবিয়েই খায়! ডাবের ভেতরটা ফাঁপা না নিরেট এ নিয়েও কয়েকশ সেকেন্ডের গবেষনার ফল লিখে দিয়ে আসলাম, নিরেটই হওয়া দস্তুর। পাঠক বুঝতেই পারছেন, রিসার্চার হিসেবে আমার ভবিষ্যৎ কতোখানি অন্ধকার। আরো কীসব হাবিজাবি কোশ্চেন এসেছিলো সেদিন। মুখের উপর তো হাবিজাবি বলে ফেললাম। স্যাররা এইসব শুনলে আমাকে আস্ত খেয়ে ফেলবেন। কেননা এই স্কুল থেকে আমি আবার এসএসসি পাশ করেছি। এবং প্‌থিবীর সবচেয়ে অদ্ভূত ও সেরা শিক্ষকেরা সম্ভবত এই স্কুলেই পড়ান। যদি কখনো স্ম্‌তিশক্তির সামান্যতম উন্নতি সাধিত হয়, এই অদ্ভুতূড়ে স্যারদের নিয়ে দু-এক প্রস্থ লেখাজোকার ইচ্ছে আছে। টিল দেন, স্টে টিউনড চোখ টিপি

---আশফাক আহমেদ


মন্তব্য

অতিথি লেখকঃ অতীত এর ছবি

তুমি তো তাও পরীক্ষা দিছো কিংবা তাতে আসা দুই একটা প্রশ্ন মনে রেখেছো, আমি আদৌ পরীক্ষা দিছি কিনা তাই ঠিকমতো মনে পড়েনা মন খারাপ এই বিরেন লইয়া ভার্সিটি পর্যন্ত পার হইলাম ক্যাম্নে, নিজেই টাস্কি খাইয়া যাই মাঝে মাঝে। যাইহোক স্কুলে শুধু এটুকু মনে পড়ে, প্রথমদিন আব্বুর হাত ধরে যেয়ে এত সব বান্দর পোলাপাইন একলগে দেখে নিতান্ত ভড়কাইছিলাম। আমি আবার নিতান্ত শান্ত-শিষ্ট ভীতু টাইপের ছিলামতো তাই। এত পোলা-মাইয়া একলগে একই কালারের পোশাকে (মানে ছেলেদের সবার একরকম আর মেয়েদের সবার একরকম) কীভাবে এলো আমার মাথায় আসেনাই। শুধু আমার ড্রেস আলাদা। ভয়ে আব্বুকে বললাম, " আব্বু, আমি এখানে থাকবোনা, আপনার সাথে অফিসে যাবো" ওঁয়া ওঁয়া

(অতীত)

ধুসর গোধূলি এর ছবি

ভয়ে আব্বুকে বললাম, " আব্বু, আমি এখানে থাকবোনা, আপনার সাথে অফিসে যাবো"

অই বয়সে স্কুলের চেয়ে মনেহয় আব্বুর অফিসকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনেহয়! আমার বড় ভাইও নাকি এই কাহিনি ঘটিয়েছিলো। তবে কান্নাকাটি করে পুরো স্কুল রাস্ট্র করার পর। আমার ব্যাপারে অবশ্য এমন কোনো কথা বাজারে প্রচলিত নেই। দেঁতো হাসি

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে লিখেছিলাম খানিক।

পাগল মন এর ছবি

স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা একবারই দিয়েছিলাম, ক্লাস টু এর জন্য। প্রশ্ন কী ছিল তা মনে হয় পরীক্ষা হল থেকে বের হয়েই ভুলে গেছিলাম কেননা এরপরে আর কখনোই আমার সে প্রশ্ন মনে আসেনি।
শুধু মনে আছে আব্বুর হাত ধরে গিয়েছিলাম স্কুলের গেট পর্যন্ত, তারপরে ভিতরে ঢোকার পরে দেখলাম অনেক মানুষ, এরপরে সব ব্ল্যাংক, পুরাই ফকফকা মেমোরি, কিচ্ছু মনে নাই। মন খারাপ

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

অপছন্দনীয় এর ছবি

প্রথম সত্যিকারের ভর্তি পরীক্ষা ছিলো ক্লাস ওয়ানে। বাংলা বর্ণমালা লিখতে দিয়েছিলেন তেরেসাদি। সেটা লেখা শেষ হলে নিজেই হাত ধরে খুকুদির ক্লাসে নিয়ে গিয়েছিলেন - ক্লাস ওয়ান এ সেকশন, উদয়ন হাই স্কুল, বরিশাল। এই পর্যন্তই মনে আছে হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

জুজুগণ কবে যে মানুষের বাচ্চাগুলোকে রেহাই দেবেন!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

পোয়েট অব এ ডিমাইজ এর ছবি

অভিনন্দন আশফাক।

আমার স্মৃতিশক্তি বিচিত্র, কখনও প্রতারণা করে কখনও অনুগতই থাকে। গল্যাহাস'৯৪ ভর্তিযুদ্ধের তেমন কিছুই মনে নাই, তবে একটা বিষয় স্পষ্ট মনে আছে, এলোমেলো শব্দে 'বাগেরহাট'কে 'বাহারগেট' লিখেছিলাম (লুনারের বিপরীত কাজটা করেছিলাম)। সবার ক্ষেত্রেই শৈশবস্মৃতি হিরণ্ময়।

শৈশব হোক সকল ধরণের চাপ-নির্যাতন মুক্ত।

কবি মৃত্যুময়,

সাত্যকি. এর ছবি

এতো তাড়াতাড়ি শ্যাষ?
আশফাক আহমেদ ইদানিং আলসে হয়ে গেছেন।
আমি তো প্রথমে মহামতি লুনারের লিখা মনে করে ঢু মেরেছিলাম।

আশফাক এর ছবি

@আদিলদাঃ ইশকুলের প্রথম দিনের উপর পূর্ণদৈর্ঘ লেখা চাই হাসি
@ধুগোদাঃ আপনার লেখা পড়ে ঈর্ষান্বিত। হায়, আমারও যদি অমন নারীভাগ্য হত মন খারাপ
@পাগল মন ও অপছন্দনীয় ভাইয়াঃ পড়ার জন্য ধন্যবাদ লইজ্জা লাগে
@কবিঃ "বাহারগেট" গড়াগড়ি দিয়া হাসি তোমার creativity দেখে মুগ্ধ
@সাত্যকিঃ আসলেই একটু অলস হয়ে গেছি হাসি

সচল কর্ত্‌পক্ষের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, অতিথি লেখকের মন্তব্যের নিয়মকানুন কী একটু শিলথিল করা যায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।