এম জির সাথে জীবন যুদ্ধ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৯/০৪/২০১১ - ৮:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মায়েস্থেনিয়া গ্রাভিচ (এম জি) অতি বিরল আমরন এক অসুখ, যার পরীক্ষিত কোন চিকিৎসা বা ঔষধ নেই; আছে কিছু পরীক্ষনীয় ঔষধ। ভয়াবহ সেই অসুখের সাথে যুদ্ধ এবং তা জয় করার সত্য গল্প।

চার

নিরাভরন, হাস্পাতালের হাল্কা নীল রঙের সুতির গাউন পরে ওয়েটিং রুমে এসে দেখি আমার মত অনেকেই অপেক্ষা করে আছে। চুপচাপ, কিছুক্ষন পরে আমার ডাক এলো। হেটেই গেলাম, হটাৎ শীতল একটা স্রোত আমাকে কাপিয়ে দিলে, নার্স আমাকে গরম কম্বলে ঢেকে দিল। আমার দুই হাতেই ইনট্রাভেনাসের খুব মোটা সুই ঢুকিয়ে টেপ দিয়ে নিরাপদে আটকে দিল। হুইল লাগানো আমার বিছানা যাত্রার শুরু, আমার স্বামি আমার হাতটি ধরে আমার সাথে সাথে চলতে লাগলেন, একটি বন্ধ দরোজার কাছে এসে নার্স আমার হাতটি ছেড়ে দিয়ে তাকে বিদায় নিতে বললো, দরোজা খুলে গেল। সেই চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে আমার জীবনের একটা অচেনা যাত্রার হোল শুরু।

সার্জন, দুইজন জুনিওর সার্জন, দুইজন নার্স, একজন এনেস্থেটিক মাস্ক, সার্জিকাল গাউনে ঢেকে আমার বিছানার পাশে এসে দাড়ালেন। আমার কাঁধের কাছে দাঁড়ানো এনেস্থেটিক খুব কোমল মায়াময় চোখের সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘আই হ্যাভ ফোর ব্রিলিয়্যান্ট চিল্ড্রেন, এন্ড এ ওয়ান্ডারফুল হাসবেন্ড, হু ক্যান নট রান দি ফ্যামিলি উইদাউট মি ইন হিজ সাইড, প্লিজ হেল্প মি’। আয়তুল কুরছি, কলেমা পরে আমি তৈরি হলাম। একটি মাস্ক মুখে দেবার পরেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম। কতক্ষন পরে জানি না, কোন গহীন তলদেশ থেকে ভেসে উঠলাম, ইনটেন্সিভ কেয়ারে চারিদিকে সাজানো অনেক গুলি মেশিনের সাথে আমি। বিভিন্ন তার, নলের সাথে সংযুক্ত আমার দেহ। আটচল্লিশ ঘন্টা পরে ঐ সমস্ত মেশিন থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে পোস্ট অপারেশান রুমে নিয়ে এলো। আরো চব্বিশ ঘন্টা পরে আমাকে রুমে নিয়ে আসলো, আরো একজন খুবই অসুস্থ মহিলা সেখানে। ঘোরের মধ্য আরো কয়েক ঘন্টা কাটানোর পরে হটাৎ অন্য রকমের এক অসহনীয় কস্টের সাথে পরিচয় হোল, যেটার কোন কারন ডাক্তার, নার্স খুজে পেলো না।

আমি যখন ছট ফট করছি, তখন আমার মেজো মেয়ে চেয়ারটা টেনে আমার মাথার কাছে এসে বসলো, চুলের মধ্যে আংগুল দিয়ে চিরুনির মত চালাতে চালাতে বলতে লাগলো, ‘আম্মা মনে নেই সেই যে আমরা ডিজনি ওয়ার্ল্ডে গেছিলাম, মনে আছে আম্মা? সেই যে মিকি আর মিনির সাথে আমরা তিন বোন স্টেজে উঠে ছিলাম, আব্বা আর আপনি এপকট সেন্টারের ‘ল্যান্ড’ এ গিয়ে কত খুশি হয়েছিলেন। আমরা সবাই ফায়ার ওয়ার্ক দেখতে চাওয়ায় আপনি আব্বাকে অনেক কস্টে রাজি করাইছিলেন রাত বারোটা পর্যন্ত এপকট সেন্টারে থাকার জন্য, ফায়ার ওয়ার্ক দেখে মোটেলে ফেরার পথে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। মিডল ইস্টের থেকে আমেরিকায় জীবনের প্রথমবার এসে এয়ারপোর্ট থেকেই গাড়ী ভাড়া করে চালিয়ে মোটেলে গেছিলেন, আপনারা কত এডভেঞ্চার করেছেন আম্মা! মনে আছে? ধীরে, অতি ধীরে মেয়ে আমাকে কস্টের চেতনাকে ঘুম পারিয়ে, স্মৃতির দরজা খুলে দিল, মনের চোখে ভিসুয়ালাইজ করে সেই সব পথে আমাকে নিয়ে চললো, আমি তার সাথে অশেষ নির্ভরতার সাথে স্মৃতির পথে পথে হাটতে লাগলাম, মেয়ে যখন ছোট ছিল, তখন তারা আমার সাথে হাটতো, আর এখন আমি হয়ে গেছি অক্ষম, অসুস্থ, অসহায় তাই মেয়ে আমার হাত ধরে ধরে স্মৃতির পথে হাটতে হাটতে নিয়ে এলো এক রুদ্ধ দ্বারের কাছে, স্বপ্নের দরোজা কি সেটা? অত্যান্ত কোমল মিনতির সুরে সে আমাকে বললো, ‘আম্মা আপনি আমদের ওই স্বপ্নের দরোজাটা চিনিয়েছেন, আমাদের চলার পথে সব সময়ই আমাদের সাথে ছিলেন, আপনাকে ছাড়া ঐ দরজাটা যে আমরা খুলতে পারবো না, আপনাকে যে আমাদের অনেক অনেক দরকার, ঐ স্বপ্ন পুরনের দেশে! আপনার তাড়াতারি ভালো হতে হবে, বাসায় আসতে হবে’। অত কস্টের মাঝেও আমার উপলব্ধিতে আসলো, তাইতো, সন্তানের স্বপ্নছোয়াঁর সেই মহেন্দ্র ক্ষনে তাদের পাশে তো আমার থাকতে হবে! আমার ভালো হতে হবে’। এটাই আসলে যুদ্ধ জয়ের আসল মুলমন্ত্র।

পর্বত শিখর থেকে যে ভয়াবহ অসুখ আমাকে গভীর খাদে নিক্ষেপ করেছিল, তার সাথে অসম এই যুদ্ধে কানাডিয়ান হেলথ কেয়ার সিস্টেম, সৎ, সাহসী নিউরোলজিস্ট, সার্জন, ডাক্তার, নার্স, তাদের সময়োপযোগী কারিগরি দক্ষতা, তাদের আন্তরিক প্রচেস্টাই ছিল আমার যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার, আমার সকল সময়ের, সুখের, দুঃখের সংগী আমার স্বামি, প্রানপ্রিয় সন্তানেরা আমার প্রতি দিনের কত কাজের অক্ষমতা ভাগ করে নিজেদের মাঝে নিয়ে নেয়া বীর সহ যোদ্ধা। স্রস্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস গভীর হতাসার অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। নিয়ম মেনে চলা, দিনে প্রায় পচিশটা ঔষধ সময় মত খাওয়া, তিন মাস অন্তর অন্তর নিউরোলোজিস্টকে, বিশেষজ্ঞকে নিয়মিত দেখা করে যুদ্ধের দশম বছরে, যখন ডাক্তার বলেন ‘আসমা ইউ কংকোওর দি ডিজিজ, ইট উইল নট কিউর, বাট ইট ইজ কন্ট্রোল্ড, আই য়্যাম প্রাউড অফ ইউ’! তখন মনে হয়, যুদ্ধ শেষের জীবনটা কত সুন্দর!!!

পুনশচঃ বিরল এই অসুখের সম্নন্ধে কেউ যদি কোন জানা তথ্য শেয়ার করেন, তাহলে খুশি হবো।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

সমাপ্ত

আসমা খান। অটোয়া


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

পুরো সিরিজটা পড়েছি। আপনার কষ্টকর এই জার্নি ভালোভাবে সমাপ্ত হয়েছে জেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন।

এই লিংকে কিছু তথ্য আছে।
http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmedhealth/PMH0001731/

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

লেখাটি সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার লিংকটি এখনই দেখবো। অশেষ ধন্যবাদ মাহবুব মোরর্শেদ।

বইখাতা এর ছবি

চার পর্ব একটানা পড়লাম। কী অসম্ভব কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আপনাকে! আমার আম্মু একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, ডাক্তাররাও আমাদেরকে পরিষ্কার করে কিছু বলছিলেন না, পড়তে পড়তে সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। আব্বুসহ আমরা ভাই বোনেরা ভয়াবহ মানসিক কষ্টের এক দীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছি। আপনার ও আপনার পরিবারের সবার জন্য শুভকামনা।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

লেখাটি সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। প্রত্যকেরি জীবনে এমন কিছু সময় আসে যেখান থেকে মনোবলের সাথে লড়াই করাটা কর্তব্য, জয় পরাজয়টা শেষ কথা নয়, ভাগ্য বা নিয়তি অথবা নিজের মনকে যা খুশি বলে নিজেকে নিয়ে সামনে চলাই হচ্ছে জীবন!!! আপনারা এখন কেমন আছেন? অনেক শুভ কামনা রইলো।

আয়নামতি1 এর ছবি

আপনার যুদ্ধ শেষের জীবনটা দীর্ঘায়ু হোক, আনন্দের হোক সে কামনা। বইখাতার মত আমারও ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে পড়েছে প্রতিটা পর্বেই। কিন্তু সেটা হেরে যাবার গল্প, হারিয়ে ফেলবার গল্প.........! নতুন লেখা আশা করছি আপা আপনার কাছ থেকে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে অনেক ভালো থাকুন।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

লেখাটি আপ্নদের স্মৃতিকে নাড়া দিয়েছে জেনে ভালো লাগছে।অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়া এবং মন্তব্যর জন্য। আপনার পরিবারের জন্য অনেক সমবেদনা, শুভেচ্ছা।

কৌস্তুভ এর ছবি

যুদ্ধজয়ের অভিনন্দন রইল।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

যুদ্ধজয়ে অভিনন্দন।

বিরল এই অসুখের সম্নন্ধে কেউ যদি কোন জানা তথ্য শেয়ার করেন, তাহলে খুশি হবো।

অনেক আগে একটা লেখায় একটুখানি লিখেছিলাম এই রোগটা সম্পর্কে, একজন পাঠক প্রশ্ন করেছিলেন বলেই। ইচ্ছে হলে পড়ে দেখতে পারেন এখানে: ব্যাড়ে খোন্দ খায়: প্রতিরক্ষা জটিলতা এবং প্রতিরক্ষা থেকে আত্মরক্ষা

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

শশাঙ্ক বরণ রায় এর ছবি

এই সুযোগে আপনাকে আর একবার ধন্যবাদ। আমার অনুরোধে অটো-ইমিউন ডিজিজ, বিশেষত মায়েস্থেনিয়া নিয়ে লেখার জন্য (যদিও খুব সংক্ষেপে লিখেছিলেন)। অনুরোধটা এখনও বহাল আছে, আরও বিস্তারিত জানার জন্য।

শশাঙ্ক বরণ রায় এর ছবি

চারটা পর্বই পড়লাম। অভিনন্দন আপনাকে।
সুস্থ হওয়ার সংগ্রামের আরও বিস্তারিত জানতে পারলে ভাল হত, বিশেষত, চিকিৎসা বিষয়ে।
অনেক সুন্দর থাকবেন।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

আপনার লেখা লিংকটা পেয়ে খুবই ভালো হোল। চমৎকার, সহজ, সুন্দর ভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ, অনার্য সঙ্গীত।

রানা মেহের এর ছবি

সংগ্রাম জয়ে অভিনন্দন

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

ফারুক হাসান এর ছবি

সবগুলো পর্বই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি কিন্তু মন্তব্য করা হয় নাই। অভিনন্দন আপনাকে এমন কঠিন যুদ্ধ জয়ের জন্য। মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনে যদি এরকম কষ্টের সময় কারো না আসতো তাহলে কত ভালো হতো! আবার যখন আপনার যুদ্ধ জয়ের কথা ভাবি, তখন মনে হয় বাস্তব যত নিষ্ঠুরই হোক, তার সাথে লড়াই করার শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। ভালো থাকবেন।

ড. কালাম এ. মীর এর ছবি

প্রিয় আসমা ভাবী, সালাম!

জানতাম আপনি কোন এক কঠিন অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন। সাহস করে প্রশ্ন করি নি কি অসুখে ভুগছেন আপনি। সচলাতয়নে আপনার লেখা পড়ে তা জানলাম। সচলাতয়নের লেখকরা নিজ দায়িত্বে 'ছাপান' বলে কিছু লক্ষণীয় ত্রুটি সত্ত্বেও আপনার লেখা বরাবরের মতই উপভোগ্য!

সচলায়তন ভাল লেগেছে! - মনে হলো, যেন শীতল শুকনো সরোবর! একটা কৃত্রিম গম্ভীর আবহ সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে হাস্যকর ঠেকলো। তবু, ভিন্নতারও একটা স্বাদ আছে বৈ কি!

লিংকটা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ! ভাল থাকুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।