ঘন অন্ধ গগন- বন্ধ খেয়া, নামিলো দেয়া

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২২/০৫/২০১১ - ৯:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আম্মা প্রায় সময়ই বকে, সারাদিন ভ্যান ভ্যান করে গান বাজাতে থাকিস, মনে হয় যেন পাড়ার মোড়ের চা দোকান। ভাঙা রেডিওর মত বাজছে তো বাজছেই, কোন বিরাম নাই।আমার ভাগ্নের প্রশ্ন, তোমার ঘরে সারাদিন গান বাজে কেন! আমার উঠতে-বসতে-শুতে-খেতে-পড়তে-স্নানে-ভ্রমনে গান শোনার অভ্যাস। বাসা থেকে বেরুবার সময় লিফট এর বোতাম চেপে ব্যাগ থেকে এয়ারফোনের জড়ানো তার ছুটাতে থাকি হেয়ারব্রাশ থেকে-রিকশার পথটুকু গান-ই হয় সাথী, অফিসে মাঝে মাঝে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করি কখন ছটা বাজবে। একটু গান শোনার বন্দবোস্ত করতে পারবো!
এই মুহূর্তে শুনছি স্করপিয়ন্স এর হলিডে।কাল সারাদিন শুনেছি অলওয়েজ সামহয়্যার।অল্প আগে আকাশ কালো ক’রে ঝড় নেমেছে। বাইরে এখন ঝমঝমে বৃষ্টি আর ঠান্ডা একটা বাতাস। আমার দশতালার বারান্দা দিয়ে হাওয়া খেলছে আর বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে পড়ছে। পিচ্চি ভাস্তে হাত ধরে টানাটানি করছে, “ফুপি বিস্তি, বিস্তি।“
এবারে ঢাকার গ্রীষ্মকালটাকে আগে দেখা কোন সময়ের সাথে মেলাতে পারছি না। গরমের তেজ অন্য যেকোন বারের তুলনায় বেশ সহনীয় আর প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। কালবৈশাখি কমই। বরং বর্ষাকালের বৃষ্টির ধাঁচ। এক একটা দিন বৃষ্টি, মেঘ আর হাওয়ার খেলা দেখলে মনে হতে থাকে ঘন শ্রাবণ মাস চলছে!
আমি বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলেই কোন একটা কুফা লাগে। হয় অফিস যাচ্ছি, কিংবা ঠান্ডা জ্বর, কিংবা যদি সন্ধ্যার বৃষ্টি হয়, এমন কোন পার্টি থাকবে যেটাতে না গেলেই নয়। একবার তো ঝুম বৃষ্টিতে সাথে থাকা বন্ধুদের ক’জন বেশ ভিজছে। যেই না আমি নামলাম খোলা ছাদে, অমনি বৃষ্টি ধ’রে গেলো!
অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলো সেদিন। বন্ধুদের সাথে পানাম নগরীতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। একটা পথ আর পথের দু’ধারে প্রাচীন দালান,প্রাচীর। কিছু কিছু দালান প্রায় ধ্বসে পড়ার পর্যায়ে।ভেতরে ইট দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা। বাইরে বেশ করে লেখা কেউ যেন ওপরে না ওঠে।কিন্তু দেখলাম স্থানীয় হত-দরিদ্রমানুষ দালানগুলিতে বসত পেতেছে। তারা কেউ কেউ আবার আমাদেরকে দেখে খুব বিরক্ত, এবং সেটা রাখঢাক করবারও খুব একটা গরজ দেখাচ্ছে না।
খুব অন্যরকম লাগছিলো। নকশিকাটা এক একটা দেয়াল, খিলান, আর দালানের ভেতরে ছোট ছোট ঘর। বসার ঘরের ছাদটা নকশাকাটা। একটা দালানের তালা লাগানো ভাঙা দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম ভেতরে অন্দরখানা আর বাহির ঘরের মাঝটা গোলমত ছাদখোলা, উঠোন। রোদের তেজ তখন অনেক বেশি। মধ্যদুপুর। তৃষ্ণার্ত আমরা বহুদিন পরে চাপকলে হাতচেপে মুখ রেখে পানি খেলাম। এত ঠান্ডা যে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
পানাম নগরী থেকে ঈশা খাঁর প্রাসাদ আর জয়নুলের জাদুঘর। আকাশে তখন একটু একটু করে কালো মেঘ জমা হচ্ছে। ঘটনাক্রমে সেদিন ওখানে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। আমরা যাদুঘরে ঘুরে পুকুরঘাটে বসে রইলাম। ঘাটের দুপাশে নারকেল গাছ, ইষৎ সবুজাভ জল। দুদিকে আরো দুটো ঘাট। আকাশ তখন পুরো মেঘে ঢাকা। হাল্কা ঠান্ডা একটা বাতাস বইছে। আর অল্প দূরের মিলনায়তন থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসংগীত। আমি পা ছড়িয়ে ঘাটের শেষ সিঁড়িটায় বসে ছিলাম। পাশের বন্ধুটি হঠাৎ আঙুল তুলে আমাদের দৃষ্টি সরালো দু’টা ফড়িং এর দিকে। এত সুন্দর! আমার ঠিক মাথার কাছটায় উড়ছে। একটা ফড়িং যেন আরেকটাকে ছুঁয়ে দিতে চাইছে। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম-ফড়িং দুটোই উড়ে চ’লে গেল মাঝ-পুকুরে। আমি হেসে দিলাম- হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই...... হাহা...।
জয়নুলের জাদুঘরের পাশে একটা বড় জলাশয় মত আছে যেখানে প্যাডেল বোট চালানো যায়। এক একটায় চার জন বসার মত। আমরা দুটা বোট নিয়ে যেই না মাঝামাঝি গিয়েছি, ঝুম ঝুম বৃষ্টি নামলো। সবাই ভিজে একসার। একজন গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলো। এত অদ্ভূত আর ভালোলাগা বৃষ্টিভেজা আমার কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ছিলো না। বৃষ্টি হলেই মন দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে যে অবস্থায়ই থাকি না কেন। কেন হয়? আমার জীবনের সবচে বড় বড় ঘটনাগুলির সাথে বৃষ্টি জড়িয়ে আছে। একটা সরলরেখা যেই বাঁকটায় অন্য সরলরেখা তৈরি করতে গেছে- তখনই তুমুল বৃষ্টি নেমেছে আকাশ বাতাস অন্ধকার করে। এক একসময় মনে হয় আমিই যেন জোর করে যোগসূত্র মেলাই। আসলেই কি তাই?
আকাশের সবটুকু কালো মেঘ যেন নেমে এসেছে- আমার হাতে, মুখে,চোখে। চোখ খুলে তাকাতে পারছিলাম না! চোখের পাতায় মনের আবেগ আর বৃষ্টির ফোঁটা মিশে যাচ্ছিলো। হঠাৎ যেন মনে হচ্ছিলো এই বৃষ্টির বাস্তবতায় আমি বসবাস করি না। অনেক দূর থেকে দেখছি এই উন্মাদের মত বৃষ্টি ভালোবাসা এই দলটাকে।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আহা নিজের নামটাই দিলেন না দেখছি। লেখা ভালো লেগেছে।

আপনি ফড়িঙ-এর কথা বলায় মোবাইলে তোলা এই নিম্নমানের ছবিটার কথা মনে পড়লো।
ফড়িঙ


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাঝি এর ছবি

দুর্দান্ত! আরো লেখা চাই! হাসি

লেখিকা এর ছবি

পড়েছ আর পছন্দ করেছ বলে ধন্যবাদ মাঝি। লজ্জাও লাগছে। কাউকেই দেখাতে চাইনি। আর বেশি লিখতেও চাই না। মন না বললে লিখবো কোথা থেকে? আর এমন হাতিঘোড়া কিছুতো পারিও না। ভালো ভালো লেখার মাঝে নিজের লেখার অসংখ্য খুঁত খুঁজে পাই।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

আপনার বৃস্টি বর্ননা খুব ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

লেখাটা পড়তে চমৎকার লাগলো। আরো অনেক লিখুন হাসি

তিথীডোর এর ছবি

ভাল্লাগলো পড়তে.. হাসি
চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।