গল্প : প্রতিধ্বনি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১০/০৭/২০১১ - ৮:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডাইনিং টেবিলটার কোনা ধরে বিশাল ফ্রিজটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বকুল। বেড রুম থেকে চিৎকার দিল এশা, “আম্মু, পরাগ চিলি সস চায় ... ঐ যে টক-মিষ্টি সসটা। নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি ...।”

বকুল কোন উত্তর দিল না। পরাগ চার মাস আগে মারা গিয়েছে।

“আম্মু?” আবার এশার চিৎকার।

বকুল ডাইনিং রুমটার চারিদিকে তাকালো। মনে করার চেষ্টা করলো কেন এ রুমে ও এসেছিল। বিষয়টা এখন আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নাই। মৃত্যু কী এটা বুঝার জন্য এশা যথেষ্ট বড়। তার বুঝা উচিৎ পরাগ মারা গেছে, এবং সে সস চাচ্ছে না। বেড রুমে তো দূরের কথা এই দুনিয়াতেই সে নাই। এশাার বয়স সাত, পরাগ বেঁচে থাকলে এ মাসে পাঁচে পড়তো।

একাধারে উদ্বিগ্ন ও নার্ভাস বোধ করছে বকুল। ঘুরে বেডরুমের দিকে যেতেই পিঠের তীব্র ব্যথায় জমে গেল। এ্যাকসিডেন্টের পর ডাক্তার বলেছিলেন এটা সারবে না, সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তার এখন একত্রিশ চলছে। যদি আর কোন এ্যাকসিডেন্ট না হয় এবং পরিণত বয়স পর্যন্ত বাঁচে তাহলেও দীর্ঘসময় এ ব্যথা সহ্য করে থাকতে হবে।

বেডরুম টা অন্ধকার। সকালে বার কয়েক চেষ্টা করেছে ভারী পর্দা সরিয়ে জানালাগুলো খুলে দিতে। এশার জন্য পারেনি। মেয়েটা দিনে দিনে অদ্ভুত হয়ে উঠছে। বাইরের উজ্জলতা এবং অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে অন্ধকার রুম আর মৃত ভাইয়ের সঙ্গ তার বেশি পছন্দ।

পিছনে বড় বালিশটা দিয়ে আরাম করে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখছে এশা। বকুল উজ্জল চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মুখে কাটাকুটির দাগগুলো নেই, ভাঙ্গা হাড়গুলোও জোড়া লেগে গেছে। কে বলবে সেও ঐ ভয়াবহ এ্যাকসিডেন্টে ছিল! বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় প্লেটের উপর একটা স্যান্ডউইচ রাখা।

“তুমি এটা খাওনি মা?” স্যান্ডউইচটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওকে।

জবাবে ভারী আদুরে একটা ভঙ্গি করলো এশা, “না আম্মু আমি ওটা পরাগের জন্য রেখে দিয়েছি। কিন্তু ওতো সস ছাড়া খেতে চাচ্ছে না!”

না শোনার ভান করে বকুল জিজ্ঞেস করলো এশাকে, “কী দেখছ?”

“টম এন্ড জেরী ... পরাগ দেখতে ...।”

“আর কিছু দেখাচ্ছে না?”

“কি জানি দেখাচ্ছে কিনা। তুমিই তো এটা ছেড়ে দিয়ে গেলে! তাছাড়া পরাগ বললো ...।”

“ঠিক আছে, এবার বন্ধ করো। আমার মাথা ব্যাথা করছে।”

“আম্মু তুমি এরকম করছো কেন?”

“কী রকম?”

“যখনি পরাগের কথা বলি তুমি অন্য কথা শুরু করে দাও!”

“দুপুরে কী খেতে চাও মা?”

“আম্মু ...?” ফিসফিসে কান্না ভেজা স্বরে ডাক দিল এশা।

প্রায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে বকুল। এশার পাশে আরেকটা বালিশ রাখা। নিজের অজান্তেই ওখানে তাকালো, পরাগকে যদি দেখা যায়! পরমুহূর্তে মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা দূর করে দিল।

“আম্মু?”

মনের উপর জোর খাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ও। এখন যদি এশার সাথে কথা বলে তাহলে তার বানানো দৃশ্যে ঢুকতে হবে। সেটা ঠিক হবে না। এমনিতেই গত রাতে শফিকের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করে বেডরুমে ঢুকে দেখে তারা দুজন পরাগের সাথে কথা বলছে। খুব রাগ করেছে ... বলেছে এভাবে ভান করা কারো জন্যই ভাল নয়।

বকুল আবার বিছানার দিকে তাকালো। তাকালো তার একমাত্র মেয়ের দিকে, “এর পর যখন দোকানে যাব তখন তুমিও সাথে যাবে। সস শেষ হয়ে গেছে, ফ্রিজও প্রায় খালি, ঠিক আছে?” এশা বিছানার পাশে স্যান্ডউইচটার দিকে তাকালো।

আহা সত্যি যদি হতো, একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবলো বকুল।

অনেক পরে যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা। শফিক এক কাপ কফি বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসলো। জিজ্ঞেস করলো বকুলকে, “কী করলে সারাদিন?”

“এইতো ... ।”

হাসপাতালের ডাক্তার শফিকের ঘাড়ে যে ধাতব বন্ধনীটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন ওটা সে খুলে রেখেছে। কিন্তু তার শরীরের অবস্থা ভাল না। ডাক্তার তাকে পূর্ণ সময় কাজ না করে রেস্টে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

বেডরুমে জোরে টিভি চলছে। বকুল জানে এশা প্রায় সারাদিন ওটার সামনে নিথর হয়ে পড়ে আছে। শফিকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বকুল থেকে বেডরুমের দিকে ঘুরে গেল।

“বকুল, টিভি চলছে কেন?” উচ্চস্বরের হাসি ভেসে এল টিভি থেকে। শব্দ শুনে মনে হল এখন মিঃ বিন দেখাচ্ছে কার্টুন চ্যানেলটায়।

“প্লিজ কিছু বল না ওকে ... একটু টিভিই তো দেখছে।” অন্যদিকে তাকিয়ে বললো সে।

শফিক উঠে দাঁড়ালো। তারপর ডান পা টা একটু টেনে টেনে হেঁটে বেডরুমের দিকে গেল। একটু পর টিভির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।

“তোমাকে তো বলেছি আমি এসব পছন্দ করি না”, ডাইনিং রুমে ফিরে এসে চিৎকার করলো, “আমি চাই না তুমি খালি রুমে এসব উল্টাপাল্টা খেলা খেল ... রুমে কেউ নাই অথচ ... যত্তোসব।”

তীব্র কান্নার দমকে ডাইনিং টেবিলের উপর মাথা নামালো বকুল। কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে বলতে চাইলো আজ সকালে কী কথা হয়েছে এশার সাথে। কিন্তু প্রতিদিন, হ্যাঁ প্রতিদিন ... যতবারই ও শুরু করে শফিক কথা ঘুরিয়ে দেয় ... জিজ্ঞেস করে রাতের খাবারের মেনু কী কিংবা পাশের বাসার মিসেস হোসেন এসেছিলেন কিনা।

বার কয়েক চেষ্টার পর হতাশ হয়ে ওড়নাটা টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল বকুল বড় রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে সস আনতে। বেশ দূর, হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু তারপরও গাড়ি নেয় না ও। এখনও গাড়িতে চড়তে তীব্র ভয় ওর।

শফিক রয়ে গেল একা বাসায়। দ্বিতীয় কাপ কফি বানাতে বানাতে ভাবলো, আহা সত্যি যদি হতো।

-----------------------------------
লরেন্স সি কনোলির ছোট গল্প ‘ইকোস’ (১৯৮৩) অবলম্বনে।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

পড়লাম।
ইয়ে, লেখকের নাম কই? ইয়ে, মানে...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

ইয়ে ... অধমের নাম তাওহীদ আহমদ

তিথীডোর এর ছবি

ঠিকাসে।
নামহীন লেখায় প্রশংসা করে আরাম পাই না। এই বেলা চলুক দেখিয়ে গেলাম। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

দুই লেভেল এর নেস্টিং মনে হচ্ছে...

কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে বলতে চাইলো আজ সকালে কী কথা হয়েছে এশার সাথে। কিন্তু প্রতিদিন, হ্যাঁ প্রতিদিন ... যতবারই ও শুরু করে শফিক কথা ঘুরিয়ে দেয় ..

আসলে কি দুর্ঘটনায় এশাও মারা গিয়েছিল নাকি?

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

গল্পটা প্যারাসাইকোলজিক্যাল হরর গ্রুপের। গল্পটার চরিত্র ৪টা - বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে। তারা সবাই একটা ভয়াবহ গাড়ি এ্যাকসিডেন্টে পড়ছিল। গল্পটাকে যদি ভাবেন ২ লেয়ার বিশিষ্ট ... ১ম লেয়ার - বকুল (মা) ও এশার পর্ব, এবং ২য় লেয়ার শফিক (বাবা) ও বকুল পর্ব। একটা লেয়ার আরেকটার প্রতিধ্বনি। এ্যাকসিডেন্টের দুইটা রেজাল্ট চিন্তা করেন, (১) শুধু শফিক ও বকুল বেঁচে আছে অথবা (২) শুধু শফিক বেঁচে আছে। ১মটা সত্যি হলে বকুল হ্যালুসিনেশনে ভুগছে। সে মনে করছে তার মেয়ে এশা বেঁচে আছে এবং তার মৃত ভাইয়ের সাথে কাল্পনিক গালগল্প করে। ২য়টা সত্যি হলে শফিক হ্যালুসিনেশনে পড়ছে। সে মনে করতেছে তার স্ত্রী-ই কল্পনায় মেয়েকে জীবিত ভাবে এবং এইটা নিয়া শফিক তার সাথে রাগারাগি করে।

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

বলতে ভুলে গেছি আপনার ধারণা সঠিক। হাসি

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

আমিও একটা কথা বলতে ভূলে গেছি-- উত্তম জাঝা!

অপভ্রংশ এর ছবি

উত্তম জাঝা!

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

ধন্যবাদ।

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

চলুক লেখকের নামতো জানা হলো না।

Sagar এর ছবি

উত্তম জাঝা!

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

উপরে লিখেছি। হাসি

আয়নামতি1 এর ছবি

চমৎকার লাগলো আমার চলুক অনুবাদটা আমিই করেছি' বলে চালিয়ে দেবো কিনা ভাবছি চিন্তিত জলদি এসে পোষ্টদাতা নিজের নামটি বলে যান। নইলে কিন্তু ঘোষণা দেয়া হবে এটি আয়নামতির অনুবাদ খাইছে

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

উপরে নাম লিখেছি। লইজ্জা লাগে

আয়নামতি1 এর ছবি

যাক এবেলা বেঁচে গেলেন! পরেরবার নামহীন যেকোন(ভালো লেখা) পোষ্ট আয়নামতির বলে বিবেচিত হবেক শয়তানী হাসি এরকম ঘটনার একটা মুভি দেখেছিলাম, কিন্তু সেখানে সবাই মৃত থাকে। তারা একে অন্যের প্রতি খুব এ্যাটাচড বলে কেউ কাউকে ছেড়ে যায়না....মুভির নাম যথারীতি মনে নাই মন খারাপ সচলে আপনাকে স্বাগতম হাসি

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

দেঁতো হাসি ধন্যবাদ স্বাগতম জানানোর জন্য। সচলায়তনে এটাই আমার প্রথম পোষ্ট, তাই ঠিক বুঝতে পারিনি।

Sagar এর ছবি

চিন্তিত উত্তম জাঝা!

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

চিন্তিত কেন? হাসি

বইখাতা এর ছবি

চমৎকার!

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

কবি-মৃত্যুময় এর ছবি

চলুক

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

গল্পটা খুব ভালো লাগলো, ভয়ের না, ভালোবাসার। একেবারে শেষে এসে একা শফিককে দেখি আর তার চেতনায় তার একান্ত ভালোবাসার মানুষগুলোকে দেখি। বস্তুজগতই কি শেষ কথা? বিরাট বিপুল চেতনা ও স্বপ্নের জগতে তারা থাকে, নাহয় নাই বা রইলো আমাদের পাথুরে দুনিয়ায়।
অনুবাদককে শুভেচ্ছা।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

আপনার দীর্ঘ মন্তব্যে অনুপ্রাণিত বোধ করছি। হাসি

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

আপনার দীর্ঘ মন্তব্যে অনুপ্রাণিত বোধ করছি। হাসি

তারাপ কোয়াস এর ছবি

ভাল লাগলো। চলুক


love the life you live. live the life you love.

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

প্রথম লেখা গল্প হলেও বেশ ভালো হয়েছে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

বন্দনা- এর ছবি

প্রথমে একটু ধাঁধার মত লাগছিলো, মন্তব্য পড়ে পুরাটা বুঝতে পারলাম, অনেক ভালো লাগলো।

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

তানিম এহসান এর ছবি

খুব, খুব ভালো লাগলো!

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

চলুক

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

হাসি ধন্যবাদ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো... বেশ ভালো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নিটোল(অতিথী)  এর ছবি

দারুণ লিখেছেন। গল্পের শেষ লাইন পড়ে সত্যি কনফিউজ হয়ে গিয়েছিলাম।

নিটোল

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

হাসি

মৌনকুহর. এর ছবি

অসাধারণ!! এমন লেখা আরও চাই...... চলুক

তাওহীদ আহমদ এর ছবি

হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লিখেছেন ভাই, আরো লিখা চাই আপনার কাছ থেকে

ম্যালাকাইটের ঝাঁপি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।