ছেলেটা!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/০৭/২০১১ - ১০:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সামাদ সাহেব দুপুর বেলা থলে হাতে বাজারে যাবার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছেন। সরকারী কলোনিতে থাকেন। একটু যেতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে দাড়িয়ে পরলেন। দুই-তিনটি কুকুর দোতলার একটা বারান্দার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। কিছু দূরে দুইটি বিড়াল বসে আছে। খুব সাবধানী চোখে একবার দোতলার বারান্দার দিকে আর একবার কুকুরের দলের দিকে নজর দিচ্ছে। এদিকে সান-সেডের (sun-shed) উপর কিছু শালিখ পাখী ক্যাচ-ক্যাচ করছে। সামনের বড় শিউলী গাছটাতে এক ঝাক চড়ুই পাখী কিচির মিচির করছে। সবাই যেন কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে। সবার অপেক্ষার পালা শেষ করেই যেন বারান্দায় একটা ছোট ছেলের মাথা দেখা গেল। ছেলেটার হাতে কয়েকটা রুটি। নিশ্চয়ই মা বানিয়ে রেখে অফিসে গিয়েছে। ছেলেটা রুটি ছিড়ে ছিড়ে প্রথমে কুকুর গুলি কে দিল। তারপর একে একে বিড়াল, শালিখ, চড়ুই সবাই ভাগ পেল। হাতের রুটি শেষ হয়ে গেলে আবার দৌড়ে ভিতর থেকে নিয়ে এল। বিড়াল, কুকুর, পাখীতে সে এক মহা সরোগোল। ছেলেটা আবার এদের সাথে কথাও বলে। কখনও কুকুরগুলোকে শাষন করে, কখনও পাখীগুলিকে আদর করে ডাকে। মনে হচ্ছে এরাও ছেলেটার কথা বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ দেখার পর সামাদ সাহেব বাজারের পথে আবার হাটা শুরু করলেন।

পরদিন দুপুরে একই দৃশ্য দেখা গেল। এবার সামাদ সাহেব ভাবলেন ছেলেটার মা-বাবকে জানাতে হবে। নিশ্চয়ই নিজে না খেয়ে পাড়ার পশুপাখীকে খাওয়াচ্ছে। ছেলেটার মা সব শুনে মনে মনে হাসলেন। সামাদ সাহেবকে বললেন, ‘আমার ছেলেটার মন অনেক নরম’। ছেলের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন যেন ও ভাল ‘মানুষ’ হয় বড় হয়ে।

ছেলেটা আর একটু বড় হয়েছে। সারাদিন বাইরে খেলে বেড়ায়। একদিন বিকালে হঠাত দৌড়ে ঘরে এল। মা অবাক, যে ছেলেকে ব্যথা পেলেও ঘরে আনা যায় না, সে নিজেই কেন এত তাড়তাড়ি বাসায় আসল! গিয়ে দেখলেন ছেলের হাতে একটা শালীখ পাখী। আহত হয়ে পড়ে ছিল। দুষ্টু ছেলেরা পাখীটাকে মেরে ফেলবে দেখে নিয়ে এসেছে। কিছুদিন খেলা ভুলে ছেলেটা বাসাতেই কাটাল পাখীর সেবা করে।
আরও দিন যায়। শুধু বাইরে না, ঘরেও এখন পাড়ার পা ভাঙ্গা বিড়ালটা থাকে, বাজার থেকে নিয়ে আসা মুরগিটা ছেলেটার কোলে বসে চাল খায়। এই সেদিন নিচের বাসার চাচার সাথে ‘বেয়াদবি’ করল, কারণ তিনি একটা অসহায় গরুকে বেঁধে মারছিলেন তার বাগানের সব্জী খাওয়ার অপরাধে। এ নিয়ে দুই পরিবারে একটু মনোমালিন্যও হল। মা ছেলেকে কিছু বললেন না, ছেলেটা অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারে না যে! তার ছেলেটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখুক!

বড় হতে হতে ছেলেটা বাইরের পৃথিবী দেখতে শিখে। কোথায় কোন্‌ বস্তির ছেলের বই কিনতে হবে, কোথায় কোন্‌ কাজের বুয়ার ওষুধের টাকা লাগবে, পড়াশুনা বাদ দিয়ে এগুলোর খবরে বেশী ব্যস্ত থাকে। বন্যায় ব্যস্ত থাকে ত্রাণ নিয়ে। শীতে ব্যস্ত থাকে গরম কাপড় সংগ্রহ নিয়ে। সমাজতান্ত্রিক ধারণায় দুনিয়া বদলাতে চায়। পাড়ার পশুপাখীগুলো এখন আর তাকে পায় না আগের মত। মা-বাবাও এখন আর ছেলের কাজকর্মের খবর রাখতে পারেন না। ছেলের দুনিয়া এখন অনেক বড়! দেশ থেকে অন্যায় তাড়াতে হবে, একনায়কতন্ত্রের থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে, নতুন প্রজন্মকে মানুষের মত মানুষ বানাতে হবে। কত কাজ! বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল ভরে যায় ছেলেটার দাবীতে – ‘জাগাও বিবেক, রুখো সন্ত্রাস’। নোটবুক ভরে যায় কবিতার পংক্তিতে –‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়!’

প্রতি বছর ২৯শে জুলাই সারা দেশে ছেলেটার বন্ধুরা তার জন্মদিন পালন করে। ছেলেটার বয়স কিন্তু বাড়ে না। আজ ১৯ বছর ধরে ছেলেটার বয়স ২৩ শে আট্‌কে আছে! কতকিছু বদলে গিয়েছে! ঢাকা এখন অনেক চাকচিক্যময় হয়েছে। কিন্তু মলিন হয়ে গিয়েছে নোটবুকের সেই পাতাটা, যেখানে ছেলেটা লিখেছিল – ‘শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কী আকাশ’!

-লাবণ্য-


মন্তব্য

সাইফ জুয়েল এর ছবি

রাজু তোমায় দেখিনি কিন্তু ছুটে গেছি প্রতিবার তোমার সাথে একত্ব হতে সব সন্ত্রাসের প্রতিবাদে । আজও যাব রাজু ভাস্কর্য।

তন্ময় আহসান ০৭ এর ছবি

খুব ভাল লাগছিল পড়তে কিন্তু শেষে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে যারা খোঁজ রাখেন তারা জানেন "বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন" আজ পর্যন্ত অস্ত্রের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়নি, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কেউ তাদের হাতে নিহত হয়নি। এমন একটি সংগঠনের কর্মী মঈন হোসেন রাজুকে যখন ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় তখনো তাই তার কোন সহিংস প্রতিবাদ হয়নি। যা কিছু হয়েছে সব প্রবল অথচ অহিংস প্রতিবাদ। আজ পর্যন্ত এই কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডটির কোন বিচার হয়নি, আসামীদেরকেও সনাক্ত করা বা গ্রেফতার করা হয়নি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে হত্যাকারীদের জন্য এক অলিখিত ইনডেমনিটি আছে। তাই সেখানে হত্যা করা হলেও খুনীর কোনো শাস্তি হয় না। শুধু নিহতদের কারো কারো স্মরণে স্মৃতিফলক বা স্মৃতিভাষ্কর্য ওঠে। ক্যাম্পাস ভরা এতো স্মৃতিফলক বা স্মৃতিভাষ্কর্য প্রতিদিন দেখতে দেখতে আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এগুলো তখন আর আমাদের চোখে লাগেনা। আমাদের মনেও হয় না কি ভীষন অন্যায় এখানে হয়ে গিয়েছিলো। জাতীয় নানা ইস্যুতে প্রবল প্রতিবাদমুখর শিক্ষার্থীরা আজ পর্যন্ত এমন একটা দাবী নিয়ে আন্দোলন করলোনা যে - এই পর্যন্ত নিহত সকল শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের অনতিবিলম্বে বিচার চাই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

লাবণ্য (অতিথি) এর ছবি

যে দেশে স্বাধীনতার সৈনিকদের হত্যাকারীদের বিচার হয় না, সে দেশে ছাত্রহত্যার বিচার কিভাবে হবে?

-লাবণ্য-

shoptorshi এর ছবি

শ্রদ্ধা

প্রখর রোদ্দুর এর ছবি

চলুক

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

হাততালি

আশালতা এর ছবি

চলুক

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

শুভ জন্মদিন রাজু...
ভাস্কর্যটার নাম "রাজু ভাস্কর্য" অনেকেই জানে, কিন্তু রাজু কে? কী তার পরিচয় তা খুব কম লোকেই জানে। এই ভাস্কর্য কেন এখানে তাই বা কজন জানে? চলুন ভাস্কর্যটির বর্তমান ব্যবহার দেখি...



গত পহেলা বৈশাখে ছবিটি তুলেছেন বন্ধু আসাদ আব্দুল্লাহ...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

নজরুল ভাই, যাদের বিবেক জাগ্রত হয় না সেরা বিদ্যাপীঠে বসে তারা রাজুর মান রাখবে কি করে!!
রাজুর কথা না হয় বাদই দিলাম, অবাক লাগে যখন অপরাজেয় বাংলা-র অবমাননা করা হয়। ওটাকে ব্যবহার করা হয় ব্যবসায়িক প্রয়োজনে!!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক ছেলেমেয়েই অপরাজেয় বাংলার সঠিক ইতিহাস জানে না। রাজুর ইতিহাস তো অনেক পরের কথা! ডাঃ মিলনের যে বেদিটা আছে ওটার অবস্থা আরও খারাপ!!

ধুসর গোধূলি এর ছবি
আসাদ আব্দুল্লাহ এর ছবি

ঐ কাল কাবুলি হারামজাদাকে যদি একটু ধোলাই দিতে পারতাম তাহলে বড়ই শান্তি পেতাম।

জহির  আহমাদ এর ছবি

ভাল করে চেয়ে দেখলে সবই এক দাদা/
কালোর পেছনে পাছা পেতে আছে সাদা/
আর লাল যে পতাকা মাথা ভেতরে বিষ্ঠা/
মন চায় উহাদের জোরেশোরে মারি উষ্ঠা ।।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

শকড! অ্যাঁ

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

লাবণ্য (অতিথি) এর ছবি

সবাই যে সবকিছু জানবে বা সবকিছু সম্মান করতে শিখবে, এটা হয়তবা ভাবা উচিত না। কিন্তু তারপরও প্রথম ছবিটা দেখে একটা ধাক্কা খেলাম।

রাজু ভাস্কর্য নিজেই একটা সন্ত্রাসবিরোধী আইকনে পরিনত হয়েছে। যে কোন আন্দোনলে, দাবীতে দেখি সবাই এখানে জমায়েত হয়, ভাস্কর্যের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেধে ছাত্ররা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। সেগুলি যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি এই ছবিগুলি।

-লাবণ্য-

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

শ্রদ্ধা

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

নিটোল ( অতিথি) এর ছবি

শ্রদ্ধা

saima এর ছবি

শ্রদ্ধা

অরুপ এর ছবি

শ্রদ্ধা .......শ্রদ্ধা আর শোক রাজুদার জন্য......প্রতিদিন টি.এস.সি তে বসি আর ভাবি ভাষ্কর্যগুলোর প্রাণ থাকলে যে কি হতো...... টি.এস.সি টাতো এখন কেবল ভার্সিটির অংশ না....সারা দেশের।সব জায়গার মানুষ আসে এখানে সে বৈশাখেই হোক অথবা বঙ্গীয় বাঘেদের খেলা দেখতে হোক....আর বাইরের মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই এইসব ভাষ্কর্যের অবমাননা করবে।তাদের কাছে তো এই সব কেবলই প্রাণহীন কাঠামো।তাদেরকে সঠিক ইতিহাস জানানোর কোন উদ্যোগ তো নাই......রাজু ভাষ্কর্যের নিচে এখন ফলকটা দেখা যায় কিনা সন্দেহ ....ভার্সিটির ছাত্ররা এমন করবে আমি বিশ্বাস করিনা.....হলপ করে বলতে পারি ওই কালো কাবুলিওয়ালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়..........পুরান ঢাকায় হয়তো খোজ করলেই পাওয়া যাবে...হয়তোবা এই ছেলেটাই প্রতিদিন একটা চমকদার বাইক হাকিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই ভাষ্কর্যের চারপাশে......হয়তোবা এই ছেলেটাই টি.এস.সি মোড়ে রিক্সাচালককে অন্যায্য ভাড়া ধরিয়ে দুটো চড় দেয়।যারা টি.এস.সি মোড়ে নিয়মিত তারা অবশ্যই পরিচিত হবেন হয়তো এসব কুলাংগারগুলার সাথে।মজার ব্যাপার এরা কাজগুলো করেই ভার্সিটির ছাত্র পরিচয়ে.......যাইহোক রাজুদার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা রইল.....

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
লাবণ্য (অতিথি) এর ছবি

আজ রাজুর ৪২ তম জন্মদিন। বেঁচে থাকলে হয়তবা সে আজকে তার স্ত্রী-বাচ্চা নিয়ে কেক কাটত। সবাইকে ধন্যবাদ রাজুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।

-লাবন্য-

তানিম এহসান এর ছবি

রাজু ভাইয়ের কথা শুনেছি তৈমুর ভাই এর মুখে, বলতে গিয়ে তৈমুর ভাইয়ের মুখটা সবসময় অন্যরকম দেখাতো। আপনার জন্য স্যালুউট থাকলো ক্রমাগত ভুলে যাওয়া মানুষকে আবারো মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। নিরন্তর শুভেচ্ছা,

গেরিলা এর ছবি

আপু, আপনার পরিচয়টা জানতে ইচ্ছে করছে, আমি এখন ছাত্র ইউনিয়ন করি। রাজুর মা'র সাথে ৪ বছর আগে একবার কথা বলতে গিয়েছিলাম, আপনি

এ প্লিজ যোগাযোগ করেন...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।