পুঁজির নিগড়ে বন্দী যেখানে শিক্ষা: স্বাস্হ্যনীতির আলোকে ইংরেজি মাধ্যম সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৮/১১/২০১১ - ৮:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় spina bifida (দ্বিভঙ্গ মেরুদন্ড) নামক একটি জন্মগত ত্রুটির কথা জেনেছিলাম। এর লক্ষণ হল: ‘মনযোগের অভাব জনিত অতি কর্মব্যস্ত ভাবাপন্নতা’ (Attention Deficit Hyper Activity Disorder), দৃষ্টি-কর্ম অসংলগ্নতা (Hand-eye in-coordination), অপরিপক্ব বুদ্ধিবৃত্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশের শিক্ষার 'ত্রিভঙ্গ' দশা, মেডিকেলে পড়া সেই রোগটির কথা লক্ষণ সমেত স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই সাথে মনে পড়ে বহুল পঠিত সেই প্রবচন: 'শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড'। শরীরে মেরুদন্ড থাকে একটি; এর বেশি থাকলেই সেটা অভিব্যক্ত করে গুরুতর অসুস্থতা। শরীরে যেমন; বোধকরি মেরুদন্ডের সাথে তুলনীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও।

জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০০৯ এ যদিও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘সাধারণ শিক্ষা’ এবং ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’র মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ভাবে কিছু বলা নেই। আমাদের দেশের নব্য ধনিক শ্রেণী তাদের আদরের দুলালটিকে কোন মতে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই বিশেষ শ্লাঘা অনুভব করেন। কিন্তু এই শ্লাঘা উদ্রেককারী নাদুস নুদুস দুলালটি যখন বিচ্যুত হয়ে পড়ে দেশজ সংস্কৃতির শিকড় হতে, যখন শুদ্ধ করে নিজের মাতৃভাষাটিকে উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয়, যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ম্রিয়মাণ একটি অথর্ব শব্দমালা হিসেবে পরিগণিত হয়, যখন এই দেশ তাদের কাছে কেবল বাইরে পাড়ি জমানর মোক্ষম উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়- তখন প্রশ্ন জাগে তারা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তা আমাদের দেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ ‘শিক্ষা’ হিসেবে গণ্য হবে কিনা।

জাতীয় শিক্ষানীতির প্রথম অধ্যায়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা; তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ ইত্যাদির বিকাশ ঘটানো; জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি আরো নানা সুসমাচার। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে এসব সুসমাচারের প্রতিফলন ঘটছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। যদি ঘটে তো ভাল; আর যদি না ঘটে থাকে তাহলে এদেরকে কি 'শিক্ষিত', অন্তত 'যথার্থ শিক্ষিতি' বলা সমীচীন হবে?

যদি তাদেরকে 'যথার্থ শিক্ষিত' হিসেবে গণ্য করা না যায় সেক্ষেত্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ১৯(ক) তে যেখানে ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ কথা বলা হয়েছে যার মাধ্যমে ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের’ নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তা-ই যদি হয় তাহলে এই আপাত 'শিক্ষিত' কিন্তু বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত বা কুশিক্ষিত কোমলমতিদের উপযুক্ত শিক্ষা বিধানের দায় থেকে সরকার সদাশয় মুক্ত থাকতে পারেননা।

শিক্ষানীতির ২য় অধ্যায় তথা ‘প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা’ অধ্যায়ের ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ অংশে বিভিন্ন ‘ধারার সমন্বয়’ শিরোনামে বাংলাদেশের সংবিধানের বরাত দিয়ে ‘বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সমগ্র দেশে প্রাথমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয় সমূহে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের’ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধারার উদাহরণ দিতে গিয়ে ‘সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন (যা আদৌ প্রাথমিক বিদ্যালয় নয় বরং প্রাক-প্রাথমিক), ইবতেদায়ি মাদরাসা ও বিভিন্ন এন জি ও পরিচালিত বিদ্যালয়/শিক্ষাকেন্দ্রে’র উল্লেখ করা হলেও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গুলো সম্পর্কে রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে।

নীরবতা নাকি হিরণ্ময়; হিরণ+ময়। বাংলা অভিধানে ‘হিরণ’ শব্দের অর্থ দেয়া আছে ‘স্বর্ণ’। আমরা যে টাকা বা অর্থ ব্যবহার করি তার বিপরীতে কেন্দ্রীয় কোষাগারে ‘হিরণ’ জমা থাকে; যার দরুন ‘হিরণ’ তথা স্বর্ণ, টাকা তথা অর্থের সমার্থক।

বাংলা ভাষায় আরো একটি প্রবাদ আছে, ‘অর্থই অনর্থের মূল’।

-তৌফিক জোয়ার্দার


মন্তব্য

মুনীর এর ছবি

আমার ইংরেজি মাধ্যম এর শিক্ষার্থী দের ব্যাপারে কোন ক্ষোভ নাই...আমি অনেক মেধাবী দেখেছি ইংরেজি মাধ্যম এর...কিন্তু ওরা সম্পূর্ন একটি দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিহীন স্বার্থপর জেনারেশন হিসেবে বড় হচ্ছে....আমি নিশ্চিত ওদের ৯০% রবীন্দ্রনাথ এর নাম জানেনা...এমনকি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এর নাম ও বলতে পারবে না......

মুনীর

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

সেটাই। তাছাড়া ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার মধ্যে যে গূঢ় অসাম্য/বৈষম্য নিহিত আছে সেটাও কম পীড়াদায়ক নয়। প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য- অন্তত এ দু'টো বিষয় মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্গতির ওপর নির্ভরশীল হওয়াটা উচিৎ নয়।

দ্রোহী এর ছবি

অতীতে বাঙালি মুসলমানেরা ইংরেজি বর্জন করতে গিয়ে সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল। কালের আবর্তে ইংরেজি যেহেতু লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় পরিণত হয়েছে তাই ইংরেজি বিমূখ হলে লোকসান আদতে আমাদেরই হবে।

আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা কারিকুলাম দেশের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। ফলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে যারা বেড়ে উঠছে তারা দেশের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীন হয়েই বেড়ে উঠছে।

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

অতীতে বাঙালী মুসলমানেরা যখন ইংরেজী বর্জন করে পিছিয়ে পড়েছিল, তখন ছিল British Colonial আমল। এখন বরং সেই colonial tendency পুষে রাখলেই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা। সবার তো লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় শিক্ষিত হবার দরকার নেই। বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষের জীবনে ইংরেজীর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। সামান্য যে ভগ্নাংশের তা দরকার হয় বা হতে পারে তারা অন্যান্য সভ্য দেশের মত একটু কষ্ট করে শিখে নিলেই পারে। বরং ইংরেজি ছাড়াও যে আরো ভাষা আছে সেটা শিখলে কিছু unexplored market এর দরজা আমাদের জন্য খুলে যেতে পারে। আফ্রিকায় রয়েছে বিরাট Francophone জনগোষ্ঠী; লাতিন আমেরিকায় Spanish, ব্রাজিলে পর্তুগিজ, মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ান, মধ্যপ্রাচ্যে আরবি।

ইংরেজি শেখার বিরুদ্ধেও আমি নই; তবে শিক্ষার মাধ্যমটাই ইরেজি করে ফেলার বিরুদ্ধে। আমরা কি মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কখনো স্বপ্ন দেখতে পারি? Creative কিছু করে জগতে স্থান পেতে হলে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হওয়াটা অপরিহার্য। তাই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার মূলোৎপাটন করে রেগুলার কারিকুলামে যেন উপযুক্ত মেথডোলজিতে ইংরেজি (এবং প্রয়োজনে অন্যান্য ভাষা) শেখানো হয় সেদিকে নজর দেয়া উচিত। আমি নিজে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফ্রেঞ্চ শিখতে গিয়ে লক্ষ করেছি; তাদের উন্নত শিক্ষণপদ্ধতির বদৌলতে দুই বছরে একজন যে পরিমাণ ফরাসি ভাষা শেখে আমাদের স্কুল কলেজ মিলিয়ে বার বছরেও কেউ তার ধারে কাছে শেখেনা।

আপনার মূ্ল্যবান মতামত শেয়ার করার জন্য কৃতজ্ঞ।

কল্যাণF এর ছবি

এইটা পাবল্কিকের অর্থনৈতিক আর সামাজিক অবস্থানের বিশাল ব্যবধানের ফলাফল। সমাজের একটা অংশ (সেই ১% বলা যেতে পারে) এত বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে যে বাকি সবাই এখন ওই অবস্থানটাকেই জীবনের আল্টিমেট লক্ষ্য মনে করতেছে। ফলে সুবিধাজনক অবস্থানে যারা আছে তাদের ফলো করলেই মোক্ষ লাভ হবে এরকম একটা সাধারন ধারনা সর্বস্তরে জনপ্রিয়। সাথে আছে ছোট্ট একটা দেশে সীমিত রিসোর্স নিয়ে বিপুল সংখ্যক আদমের কামড়া কামড়ি। এত সহজে কিছু হইত না।

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

আপনি ঠিক আমার বক্তব্যের মূল সুরটিই ধরেছেন। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার বিকাশের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক- অনেকগুলো প্রেক্ষাপটের ঘনিষ্ট সহযোগ আছে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

বাহ। সহজ, এবং ছোট্ট কিন্তু শক্ত লেখা। ভালো লাগল।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

অনুপ্রাণিত হলাম। এটাই সচলায়তনে আমার প্রথম পোস্ট।

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

হে হে হে, আমার কাছে তো পুরাই বিতর্কের স্ক্রিপ্ট মনে হলো রে নটরডেম বিতার্কিক দলের প্রাক্তন দলনেতা দেঁতো হাসি
কিছু বানান একটু দেখে নিস --

মেরুদন্ড -> মেরুদণ্ড
মনযোগ -> মনোযোগ বা মন:যোগ
জমানর -> জমানোর
উপলক্ষ -> উপলক্ষ্য
দেশাত্মবোধ -> দেশাত্ববোধ(?)

ডাবল থাম্বস আপ দোস্ত চলুক চলুক

চলুক

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

হো হো হো
থ্যাঙ্কস দোস্ত। প্রথম লেখা সচলায়তনে। আরেকটা লেখার জন্য হাত নিশপিশ করছে; কিন্তু টাইম বের করতে পারছিনা। বানান ঠিক করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। বাংলা লেখা হয়না বলে একেকটা শব্দ হাতড়ে হাতড়ে বের করতে হচ্ছে। বানান ভুল তো রয়েছেই। লেখাতে আরেকটা মারাত্মক ভুল আছে; কিন্তু এডিট করার তো কোন রাস্তা দেখতে পারছিনা।

ডিবেটের স্ক্রিপ্ট মনে হওয়ার কথায় খুব হাসি পেল। কথায় আছে না, 'ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে'। আরটিভিতে প্রোগ্রাম করার সময় পোডিউসার রেগুলার ঝাড়ি দিত- ডিবেটের মত করে কথা বলছি বলে। লিখতে গিয়েও একই দশা। গাইড করিস, ভুল ধরিয়ে দিস, ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

গৃহবাসী বাঊল এর ছবি

শিরোনাম দেইখাই বুঝছি এইটা যে তোমার লেখা। তোমার লেখা নিয়া মন্তব্য করুম না। লেখতে থাক হাসি

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

হাসি মন্তব্য না করলে বুঝব কিভাবে কোথায় দুর্বলতা, কিভাবে সংশোধন করব? যাইহোক, পরিচিত সুবাসে অস্তিত্বের নিবাস ম ম করছে; কিন্তু.... চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।