মধ্যবিত্ত পরিবর্তন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৬/১১/২০১১ - ১০:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"তুই কি ছাত্র??"
এই বলে হাতে পত্রিকাটা নিয়ে ছিঁড়ে ফালি ফালি করে ফেলেছিলেন পিতৃদেবতা, বেশ সিনেমাটিক ভঙ্গিতেই। অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ থেকে যেভাবে গুমরে গুমরে উঠছিলেন তাতে বেশ একটা বিপদ যে আসন্ন তা বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা যে এতোটা সিনেমাটিক হবে তা ধারনাও করতে পারি নাই। কোথায় চোখেমুখে ফিটিয়ে তুলার দরকার ফাঁসির আসামীর মত অনুতাপ, সেই জায়গায় ভুরভুরিয়ে কোত্থেকে যেন রাজ্যের হাসি পেয়ে গেলো। হাসি চাপতে চাপতে মনে করছিলাম কবে কোন সিনেমাতে এমন চমৎকার নাটকীয় দৃশ্যটা দেখেছিলাম। ভাগ্যিস সে মুহূর্তেই পিতৃদেবতা অনুধাবন করতে পারলেন পরীক্ষার আগের দিন নির্বিকার চিত্তে বইপত্র ছেড়ে পত্রিকায় মনোনিবেশকারী ধর্মবিমুখ ছেলের মস্তিষ্কের অসারতা, আর তাই সে যাত্রা অল্পের উপর দিয়েই বেশ বেঁচে গিয়েছিলাম।

বাংলাদেশের আর দশটা চরম মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই আমার পিতামাতাও সন্তান জন্মের সাথেই সাথেই 'আমার ছেলে হবে ডাক্তার' জাতীয় সিদ্ধান্তে পৌছে গিয়েছিলেন। যদিও সেই ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ নিষ্ঠার সাথেই তাদের হৃদয়ে দাগা দিয়ে আসার দায়িত্বটা পালন করে আসছি। আজকে এই সচলায়তনে প্রথমবারের মত লেখার বিষয়বস্তু অবশ্য আমার ছেলেবেলা নয়, আমার লেখার বিষয় ঘোর পুঁজিবাদী এই সমাজে তীব্র অস্তিত্তের লড়াইয়ে ব্যস্ত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মানসিকতা।

মধ্যবিত্ত জীবন অনেকটা শাঁখের করাতের মত, আপনি চাইলেও উঁচুতলার জীবনটার মত বিলাস করতে পারবেন না। এমনকি সামান্যতম শখের যে বিলাসটা করে মুহূর্তখানিক আনন্দ পেতে চাইবেন, নিশ্চিত জেনে রাখুন ঐ বিলাসের পেছনে সামান্যতম অতিরিক্ত ব্যায়টাও আপনার গলায় কাটার মত বিধে থাকবে।আবার সব ছেড়েছুড়ে নিম্নবিত্তের জীবনের স্বাধীনতায় গা ভাসাতে গেছেন কি মরেছেন, সমাজ আর সামাজিকতার অক্টোপাস আপনাকে ঠিক পিষে মারার আয়োজনে এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে কথাগুলো আরো নির্মম থেকে নির্মমতর হয়ে উঠছে। কালো অর্থ, সাদা অর্থ, লাল নীল বেগুনী অর্থের ঝনঝনানিতে হঠাত করেই বিত্তশালী হয়ে উঠছে একধরনের লোকেরা। বাকিরা হাতড়েপাচড়ে ভীষন চেষ্টায় রঙ্গিন অর্থের হাতছানি পাবার আশায় ব্যস্ত। মধ্যবিত্ত জীবন যেকোন সময়ের চাইতে বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে।

এমনটা হবার কথা ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যদিও সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহন ছিল, তারপরও যুদ্ধপূর্ব আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে, বিদ্রোহকালের সামনের কাতারেতে, যুদ্ধের সাহসী সংগঠনে আমার ধারনা মধ্যবিত্তরাই ছিল সবচেয়ে অগ্রনী ভূমিকায়। একটা ধর্মনিরপেক্ষ জাতি তৈরিতে যে অঙ্গীকার তা এমনি এমনি কিন্তু উড়ে আসেনি সেই সময়টায়, এই চেতনা তখন সত্যিকার অর্থেই ছিল বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত চেতনার প্রতিফলন। অথচ সময়টা এখন কত বদলে গেছে। নিজেদের অধিকার আদায়ের যে নেশা থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলো যেই সমাজ, তারা আজ পদে পদে নাগরিক অধিকারের অবমাননাতেও বিকারহীন। ছড়িয়ে দেয়া রাশি রাশি অর্থ, সর্বত্র টিকে থাকার প্রতিযোগীতায় দাঁতে দাঁত চাপা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সুখি জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন তাদের এতটাই অভিভূত করে রেখেছে তারা আজ দেশপ্রেম, মানবতা এসব মুল্যহীন চেতনায় বোধহীন। যতক্ষন পর্যন্ত নিজেদের ঘাড়ে বিপদটা এসে পড়ছে ততক্ষণ তাদের সেসব ব্যাপার যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এজন্যই তারেক মাসুদের মত মানুষ মারা যাবার পরও কোন নির্লজ্জ মন্ত্রী দাঁত কেলিয়ে বলতে পারে তাঁর মৃত্যু ছিল নির্ধারিত, নিরাপদ সড়ক চাওয়ার মত মানবিক আবেদনের জন্য মন্ত্রীর সঙ্গিসাথীরা ইলিয়াস কাঞ্চনকে জুতা মারতে চায়। যে যেখানে যা পাবো কুড়িয়ে নেওয়ার মানসিকতা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে কে সৎ আর কে অসৎ এসব মৌলিক প্রশ্ন করে নিজের বিবেককেই আর কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় না। যার ফলাফল আমাদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনায়, সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞানভাবনায় সব জায়গাতেই দেখতে পাই। যেখানে হতে পারতো মধ্যবিত্তেরই সবচেয়ে সফল অংশগ্রহন সেখানে এইসব অলাভজনক কর্মকাণ্ডের প্রতি এই সমাজ রীতিমত চোখ তুলে নিয়েছে।

তবে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে সেটা বাঙ্গালীর ধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। মধ্যবাম যে চিন্তাচেতনা থেকে দেশটা স্বাধীন হয়েছিলো সেই জায়গা থেকে সরে এসে মধ্যবিত্ত সমাজকে এখন বেশ মধ্যডান শ্রেণীতে ফেলা যায়। আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও ধর্ম যেখানে ছিল একান্তই আমাদের ভিতরকার ব্যাপার, আজ তা বেশ আমাদের বাহিরের অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে। ধর্মের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে আর্থসামাজিক যে পরিবরতন তার অবশ্যই ভুমিকা আছে। কিন্তু তারপরও এতোটা ধার্মিক জাতি হিসেবে আমাদের এই আত্মপ্রকাশ শুধুমাত্র অর্থের হিসেবের কারনে বলে আমি মেলাতে পারি না। মধ্যডান এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ধর্মের নামে বীভৎসতা এখন ছড়িয়ে পড়ছে একদম সাধারন মধ্যবিত্ত সমাজেও। যে কারনে জাফর ইকবালে মেয়ের প্রাইভেট ছবি শেয়ার হয়ে যাচ্ছে ধর্ম রক্ষার নামে, যে কারনে বোরখার বিরুদ্ধে কথা বলাও কাফির মুরতাদ বলতেও দ্বিধা করছে না একটি তরুনসমাজের বেশ বড় একটি অংশ। চল্লিশবছ আগে মাখালারা যে পোশাক পরেছে তাদের তরুন কালে, আজকে সেই পোশাককেই অশ্লীল বলার লোকের অভাব নাই। হয়তো সেই একই মাখালাদের চোখেই সেই পোশাক লাগছে দৃষ্টিকটু। এভাবে বাংলাদেশের সমাজের একটা বড় অংশ কিভাবে ধর্মের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করে ফেললেন সেটা আমাকে প্রায়ই ভাবিত করে। যে ধমনিরপেক্ষ চেতনা থেকে এই দেশের জন্ম সেই ধরমনিরপেক্ষতাই এখন সংবিধানে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী বিচারকেও এখন একশ্রেনীর মধ্যবিত্ত কিন্তু জাতিকে বিভক্ত করার পায়তারাই ভেবে থাকেন।
আমার একজন অসম্ভব প্রিয় মানুষ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি সবসময়ই আশার আলো এখতে পান।তার লেখাতেই একবার পড়েছিলাম সমাজের এই যে অস্থির সময়, যেমন খুশী তেমন করে ভোগের সময় সেটা সাময়িক। সম্পদ অর্জনের পরই মানুষ আবার ফিরে আসবে সম্পদ রক্ষা করার তাগিদেই চিরন্তন মানবতার কাছেই। নিজের আপন সত্ত্বাকে বাঁচাতেই সে আবার তার প্রানের কথা শুনবার তাগিদ অনুভব করবে। তার মত চিন্তা ভাবনা করতে, ভাবতে ভালই লাগে। কিন্তু প্রতিনিয়তই যখন দেখি সব নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে তখন এই হতাশা এই ভাললাগাকে ম্লান করে দিতে সময় নেয় না।

সজলায়তন


মন্তব্য

ঝুমন এর ছবি

স্যারের কথা যেন সত্য হয় এই আশাতেই আছি।

সাই দ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ভাই ...আমার মনের কথাগুলো গুছিয়ে বলে দিলেন... আপনি তো দেখি সজল ২...লেখা জারি থাকুক

সজলায়তন এর ছবি

ধন্যবাদ
আপনার মনের কথাগুলোও লিখে ফেলুন, নিজের ভেতর জমিয়ে লাভ নেই।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

টেস্ট

কল্যাণF এর ছবি

বড়ই রহস্যজনক, মুর্শেদ ভাই খালি টেস্ট কইরা বেড়াইতাছে চিন্তিত

তারেক অণু এর ছবি
ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সজলায়তন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নিটোল এর ছবি

চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

অর্ণব এর ছবি

আরো লিখতে থাকুন। লেখা অসাধারণ ।

তাপস শর্মা এর ছবি

ভালো লাগলো ... চলুক

কল্যাণF এর ছবি

ভাল্লাগছে চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।