এলিয়টের প্রুফ্রক আর আমাদের নগরজীবন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০১/২০১২ - ৯:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিষে বিষক্ষয় বলে যে ব্যাপারটা আছে আমার বেলায় সেটা একবোরেই অকাট্য। দুঃখ, বিষন্নতা, হতাশা এই জাতীয় প্রতিটি ব্যাপার থেকে বের হতে আমার বিষে বিষক্ষয় পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। যেরকম একবার এক কষ্ট পেয়ে মূক ও বধির হবার উপক্রম হয়েছিলো, তখন আমাকে বাচাঁয় The Bicycle Thief. কারো সান্তনাবাক্য, বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করা কোনটাই কাজ করে না আমার ক্ষেত্রে। তাই যখনই আমার দুঃখ-টুঃখ হয় মোটামুটি পাগলের মতো খুজতে থাকি তার চেয়েও বড় একটা দুঃখ। তো একটা সময়ে কিভাবে যেন আমার প্রতিটা অনুভূতিই প্রখরভাবে হতাশাবাদী হয়ে গেল, প্রায় সব জিনিসের প্রতি একটা নিস্পৃহ ভাব । চোখের মধ্যে মরা মাছের মতো শূণ্য-দৃষ্টি চলে আসলো। এবং আমার ধারনা এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে যাবতীয় বাজে অনুভূতির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে হতাশা। যাই হোক আমার অবস্থা খুবই করুণ, অকাল সন্নাসব্রতের ফলে নজেকে নিজের কাছেই জম্বি মনে হয়। সেই প্রবল দূর্বিপাকের দিনে খুব এলেবেলে ভাবেই একদিন হাতে নেই টি. এস. এলিয়টের কবিতা "The Love Song of J. Alfred Prufrock". এবং বলাই বাহুল্য আমার হতাশাবাদী জম্বি জীবনের সেখানেই সমাপ্তি।

কবিতাটির শিরোনামে যথেষ্টই কনফিউজড হবার আশঙ্কা আছে, আর যাই হোক এটা কোনমতেই লাভ সং না। একটা রোমান্টিক কবিতা ভেবে যেটাকে হাতে নিয়েছিলাম সেটা দাড়িয়ে গেল আধুনিক নগরজীবন, হতাশা আর সিদ্ধান্তহীণতার পাচাঁলীতে। কবিতার শুরুতে ভিনদেশী ভাষা দেখে আৎকে উঠেছিলাম, স্টার চিহ্ন অনুসরন করে পেছনে গিয়ে দেখি সেটা আসলে দান্তের Inferno থেকে নিয়েছেন এলিয়ট। কবিতাটির এপিগ্রাফ হিসেবে। সেখানের ব্যাপারটা এরকম যে দান্তের সাথে Guido নামের একজন নরকবাসীর দেখা হয়েছে, সে ইতালির খবরাখবর জানতে চায় দান্তের কাছে। দান্তে তাকে ইতালি সম্পর্কে বলার পর বিনিময় হিসেবে নরক নিয়ে জানতে চায়। এইটুকু হচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ডের ঘটনা। এলিয়ট এর পরের অংশটুকু ব্যাবহার করেছেন, যেখানে দান্তেকে Guido বলছে- আমি যদি জানতাম যার কথার উত্তর আমি দিচ্ছি সে মর্ত্যে ফিরবে তবে আমি কিছুই বলতাম না। কিন্তু যা শুনেছি তা যদি সত্যি হয়, এখান থেকে কেউই বেচেঁ ফিরতে পারে না। সুতরাং আমার কোন ভয় নেই কলঙ্কের কথাগুলো বলতে। এইটুকু পরার পর মুগ্ধতা, কৌতুহল দুটোই হয়। কবিতাটা পরার পর বুঝতে পারি কতটুকু স্বার্থক ছিলো এই এপিগ্রাফের ব্যাবহার। এখানের Guido কবিতায় দাড়িয়ে গিয়েছে প্রুফ্রক হিসেবে। যে তার নিজস্ব নরকের গল্প শোনায়, আর দান্তের ভূমিকায় থাকে প্রুফ্রকের রহস্যময় সঙ্গী। যেটা হয়ত আসলে আমরা, পাঠক।

Let us go then, you and I, - কবিতাটির প্রথম লাইন। পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো আমার সামনে দাড়িয়ে কেউ বলছে এক্ষুনি তার সাথে যেতে। হলাম প্রুফ্রকের সঙ্গী। সময়টা ছিলো সন্ধ্যা, যে সন্ধ্যাটাকে প্রুফ্রকের মনে হচ্ছে টেবিলে শোয়ানো নিস্তেজ রোগীর মতো। গল্প-গুজবরত মানুষরা নীড়মুখি। রাস্তাগুলো কূটতর্কের দ্বন্দের মতো এদিক ওদিক বাক নিচ্ছে। In the room woman come and go/ Talking of Michelangelo. কোন পূর্বভূমিকা ছাড়াই এ দুটি চরণের অবতারনা, কিন্তু যেন মনে হচ্ছিলো এ নিতান্ত স্বাভাবিক। মানুষ তো এভাবেই কথা বলে। চোখের সামনে সেই অতি আধুনকি ঘড়ের ছবি ভেসে উঠলো, যেখানে এন্জেলোর ছবি টানানো আর অতি উচু শ্রেণীর রমণীরা তাকে নিয়ে কথা বলছে। হয়তো তেমন কিছু না
জেনেই,সফিস্টিকেশনের খাতিরে। এই দুটি লাইন আরো একবার বলে প্রুফ্রক, অনেকটা গানের ঢঙে। কুয়াশা, জানালার কাঁচ, ছুচোঁর মুখ, নর্দমা, ঝুল-কালি, ঘড়ের কোন, শান্ত রাত প্রত্যেকটি দৃশ্যপট প্রুফ্রকের মানসিক অবস্থার মতো হয়ে যাচ্ছিলো। যেন সে আয়নায় তার ভেতরের প্রতিবিম্ব দেখছে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। প্রুফ্রক তার সিদ্ধান্তহীনতার কথা বলে, তার সব চিন্তা শুধু চিন্তাজগতেই ঘুরপাক খায়। সেগুলোর রিহার্সাল হয়, রিভিসন হয়, কিন্তু সেগুলো সিদ্ধান্ত হয় না। শুধু কারো সামনে দাড়ানোর দৃঢ়তাটুকু আসে না, একা সময়ে বারবার নিজেকে তৈরি করেও এগোনোর সিড়িটা নামিয়ে ফেলতে হয়। চুলে কি টাক দেখা দিচ্ছে? কোট, কলার, নেকটাই সব হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু টাইয়ের পিন টা বড় সাদামাটা। এখানে আসে সেই অসাধারণ চারটি চরণ-

Do I dare
Disturb the universe?
In a minute there is time
For decisions and revisions which a minute will reverse.

প্রুফ্রক তার চিন্তার আরো গহীণে যেতে থাকে, আমি অখন্ড মনোযোগী শ্রোতা। নগরে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি মুখ যেন চেনা। তারা কি বলবে, কি আচরন করবে সব জানা। তবু নতুন করে চেনা হয় না। সন্ধ্যা, সকাল, মধ্যাহ্ণ গুলোও চেনা। এ সময় গুলোতে দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু সঙ্গীতের সামনে কিভাবে কথা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। এত সময় বয়ে যায় যে টেবিলের কফি স্পুন দিয়ে জীবন মেপে নেয়া যায়। ওদের চোখের দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করে। পিন দিয়ে আটকানো পোকার মত ছটফট করতে থাকে প্রুফ্রক। কিভাবে যায় এসব উপেক্ষা করা? সেই চোখ চেনা, সেই তরুণিকে চেনা। কিচ্ছু হয় না তবু। ভালোবাসা আছে হয়তো, কিন্তু দ্বিধা তার চেয়ে অনেক বেশি। প্রুফ্রক বলে তার মানুষ হওয়া উচিৎ ছিলো না, সাগরতলের কাকড়া হওয়া উচিৎ ছিলো। ক্লান্ত, ঘুমন্ত, নিস্পৃহ কাকড়া। কিংবা ভালোবাসার কথা কাওকে বলেই বা কি লাভ, এত চিন্তা, সিদ্ধান্ত নেয়ার কষ্ট এসব কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না ঐটুকুর জন্য। যাকে বলা হবে সে হয়তো ফিরিয়েই দেবে। আর সেটার সম্ভাবনাই কি বেশি না?এভাবে সময় যায়, বয়স বাড়ে, কিছুই হয় না।

জেগে থেকেই ঘুমিয়ে থাকে প্রুফ্রক, কিংবা সত্যিই হয়তো ঘুমোয়। মারমেইডদের গান শুনতে পাওয়া কোন সমুদ্রপুরীতে। Till human voices wake us, and we drown. -এটাই প্রুফ্রকের কাছ থেকে আমার শোনা শেষ কথা। এই 'us' বলতে কি আমরা সবাই? আমরা কিছু মুখরোচক-সুখকর ইমাজিনারি আইডিয়া ধারণ করে বেঁচে, মাঝে মাঝে সেটা বুঝতে পারি এবং কঠিনভাবে বাস্তবতায় ডুবে যাই। We drown.
এলিয়ট এখানে অনেকগুলো বিখ্যাত সাহত্যিরচনা ও রচনার চরিত্র নিয়ে এসেছে রূপকের মতো করে। শেক্সপিয়ারের Twelfth Night ও Hamlet, অস্কার ওয়াইল্ডের Salome, এন্ড্রু মারভেলের To His Coy Mistress ইত্যাদি। অসাধারণ এই জিনিস গুলোর ব্যাবহার। প্রচন্ড হতাশাবাদী এই কবিতা এবং সত্য। আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদের একটি এই কবিতা পড়ার অনুভূতিটুকু। আমার মনে হয় প্রতিটা মানুষের একবার হলেও এই কবিতাটি পড়া উচিৎ।

পদব্রজী


মন্তব্য

রুমঝুম ১ এর ছবি

'Till human voices wake us, and we drown"
কথা সত্য চলুক

লেখায় চলুক তবে আরেকটু কম্পারিটিভ আলোচনা করতে পারতেন

লাবণ্যপ্রভা এর ছবি

কবিতাটি এখনও পড়া হয়নি। তবে আপনার লিখা যথেষ্ট উৎসাহজাগানিয়া । ভাল লাগল চলুক

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

পড়ব, কথা দিচ্ছি।

শিক্ষানবিস এর ছবি

ইংরেজি কবিতা পড়ার অভ্যাস নেই। কিন্তু এটা আসলেই ভাল লাগল, বিশেষ করে লেখাটার জন্য।
বিষে বিষক্ষয়ের ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য। কষ্টে থাকলে সেই কষ্টের চেয়েও কষ্টকর কিছু খুঁজে বের করে তার মধ্যে যুবে যাওয়ার আইডিয়া তো সাংঘাতিক।
নিয়মিত লেখা পাব আশাকরি...

সুবর্না এর ছবি

কবিতাটা কেমন জানা নেই, কিন্তু পোষ্টমর্টেমটা অসাধারন। কবিতার সাথে জড়িয়ে যাওয়া, তৈরি হওয়া আপনার অনুভূতিগুলো অনবদ্য। বিশ্লেষনভঙ্গিটাও সংক্রামক, আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে অপরকে ।
আরও লিখুন ।

পদব্রজী এর ছবি

ধন্যবাদ...

পদব্রজী এর ছবি

সচলায়তনে লেখা প্রথম লেখাটাই চলে আসবে ভাবিনি, ভালো লাগছে...।
@শিক্ষানবিস
আসলেই ভালো লাগার মত একটা কবিতা। আরো লেখা দিতে চেষ্টা করব।

পথিক পরাণ এর ছবি

আমার খুব আপন একটা কবিতা... চলুক

এই অদ্ভুত কবিতার দৃশকল্প গুলো খাপছাড়া আর পারম্পর্যহীন মনে হতে পারে কখনো কখনো। দৃশ্যগুলো খুব অনায়াসে দৃশ্যান্তরে চলে গেছে। যেন এরকমই ঘটে যাবার কথা ছিল। একেবারে গোরায় বেরিয়ে পড়বার এক উদাত্ত আহবান। কিন্তু কোথা থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষ? এই বেরিয়ে আসা নিজের চেতনা আর বোধ থেকে। কবি কাউকে ডাকছেন... let us go then you and I.. কখনো মনে হয় এই you বলতে আমাকেই ডাকছেন তিনি। আবার পরক্ষনেই মনে হয় কবি যেন তাঁর সত্তাকে ডাকছেন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। I টাই বা কে? এই কবি, এই প্রুফক নিজেই আসলে অপারেশন টেবিলে ইথার-অবশ এক রুগী। এর মধ্য দিয়ে আসলে প্রুফ্রকের অর্ধচেতন মানসিক অবস্থাটিই প্রতিফলিত। প্রুফ্রকের সিদ্ধান্তহীন মনও অলস-বিবশ সন্ধ্যার মতোই অসাড়তালিপ্ত। নিজেকে তার এক হাস্যাস্পদ নিকৃষ্ট ভাঁড় বলে মনে হয়- সকলের চোখে প্রুফ্রক এক কাপুরুষ। তার স্বগতোক্তির মধ্যে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ আসলে তার নিজেরই দুই বিভক্ত সত্তা। তার প্রেমগান তার আপন মনের ইনফার্নোর বাইরে কখনোই উচ্চারিত হবে না, এটা প্রুফ্রক আলবৎ জানে। কেবলি একঘেয়ে পথ, কুয়াশা-বেড়ালের ছবি, বাইবেলের জন দ্য বাপতিস্ত, লাজারাস, মিকেলেঞ্জেলো, আর শেক্সপিয়রের নাটকের কুশীলবরা- সবাই যুগপৎ এসে ভিড় করে তার মনে। তার অপৌরুষ-লাঞ্ছিত জীবন এতটাই অর্থহীন যে, পিচফল খেতেও তার সাহসের দরকার পড়ে। চুলটা কি করে কোন দিকে, ডানে না বামে আঁচড়াবে, এই নিয়েও সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। একটিবারও সে সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না।

আমরাও সবাই কি কমবেশি এমন সিদ্ধান্তহীনতার মুখোমুখি হয়ে পরিনা কখনো? তাইতো প্রুফ্রকের এই গান যেন আধুনিক মানুষের যাপিত জীবনের চিত্রকল্প...

-----------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

পদব্রজী এর ছবি

খুব ভালো বলেছেন। হ্যা, আমারো মনে হয় কমপ্লেক্স জীবনের দোটানায় ভোগার এমন অকপট চিত্র আর হতে পারে না। এটা পড়ে আমার মনে হয়েছিলো প্রত্যেকটা জীবন আসলে একেকটা বৃত্ত এবং কিছু বৃত্ত কখনো আরেকটার অন্তর্বর্তী হতে পারে না, আক্ষরিক অর্থেই একা থেকে যায়। প্রুফ্রক তার বৃত্তের বাইরে যেয়ে নাগরিক দৃশ্যপটের অংশ হতে পারে নি, জানালার কাঁচের ওপাশে দাড়ানো দর্শকই থেকে গিয়েছে।

ইফতি এর ছবি

কবিতাটা সিলেবাসে থাকায় পড়েছি মাস্টার্সে। যাপিত জীবনের চরিত্ত্র গুল ঘিরে চিত্রায়ন। তবু ও আপনার আলোচনা ভালই লাগ্ল।

আরেকটা কবিতা আছে the waste land, এতা পড়লে তৎকালীন লন্ডন নগরী এবং তার আবহ, এবং মানুশের মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে এক্তা ধারনা পাবেন। ধন্যবাদ।

পদব্রজী এর ছবি

Waste Land এখনো পড়া হয় নি, পড়ার আশা রাখি।

ফাহিম হাসান এর ছবি

বেশ ভাল লাগলো লেখাটা

পদব্রজী এর ছবি

হাসি

তানিম এহসান এর ছবি

আশা করি এমন আলোচনা আরো পাবো হাসি

পদব্রজী এর ছবি

চেষ্টা করব... হাসি

তারেক অণু এর ছবি

আজকেই কবিতাটা আবার পড়লাম, সারা সন্ধ্যা জুড়ে, লেখার জন্য ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।