হেমন্তের উত্তরবঙ্গ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৬/০২/২০১২ - ১২:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তৃতীয় পর্বঃ কৌশলতত্ত্ব

২১ কার্তিক ১৪১৭, শুক্রবার। হেমন্তের সুন্দর সকাল। ঠিক সাতটায় আমার যাত্রা শুরু হল। মহাসড়কে নেমেই বেশ সতর্কতার সাথে হাঁটতে লাগলাম। সতর্কতার কারণ আমার চট্টগ্রাম ট্যুরের তিক্ত অভিজ্ঞতা। সেবার দ্বিতীয় দিনে আমার বাম পা মচকে যায়। ব্যাপারটাকে প্রথমদিকে অগ্রাহ্য করায় পরবর্তীতে এক কঠিন মাশুল গুনতে হয়। মচকানো পা নিয়েই আমাকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সে এক অবর্ণনীয় অসহ্য যন্ত্রণা। এবার আর এটা হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না। তাই খুব ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। আমার লক্ষ্য ছিল অন্তত বগুড়া পৌঁছানো পর্যন্ত যেন পা দুটো ভাল থাকে।

দিনের প্রথম কিমি পোস্ট জানান দিল- বগুড়া এখনো আমার থেকে ১৪২ কিলোমিটার দূরে, রংপুর ২৪৮; আর ঢাকাকে ফেলে এসেছি ৫৪ কিলোমিটার পিছনে। গোয়ালবাথান ছেড়ে আসতে আমার একটু খারাপই লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আরেকদিন থেকে গেলেই তো কালকের সেই গোধূলিবেলা আবার দেখতে পেতাম। উপরন্তু আহমাদ ভাইয়ের (মসজিদের ইমাম) কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে আসতে খুব খারাপ লাগছিলো। উনি আমার ফোন নাম্বার রেখে দিলেন। স্মৃতিসরূপ আমার একটা ছবি তুলে রাখলেন। শেষতক আবার এই গোয়ালবাথানে আসবার আমন্ত্রণ জানালেন। ঘটনাটা চিন্তা করলে আজও আমার চোখে পানি এসে যায়। আহমাদ ভাই পরবর্তীতে আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন। আমি কোথায় আছি, কি করছি, শরীর কেমন আছে বিশেষ করে আমার পা জোড়া ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। আমার প্রতি তার এই আন্তরিকতা ছিল অকৃত্রিম আর স্বার্থহীন। যাই হোক এসব আবেগমাখা স্মৃতি পেছনে ফেলেই আমাকে সামনে এগোতে হবে, লক্ষ্য ছুঁতে হবে।

০৭:০৮ মিনিটে গাজীপুরের শ্রীফলতলীতে সকালের নাস্তা সারলাম। বাসায় থাকতে এ সময়ে যে পরিমাণ খাওয়া-দাওয়া করতাম এখন তার অর্ধেকও করলাম না। কারণ বেশি খেলে হাঁটতে সমস্যা হয়। বরং এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর অল্প করে খাওয়া বেশি উপকারী। তবে আর যাই হোক পানির মজুদ পর্যাপ্ত থাকতে হবে। আমার ব্যাকপ্যাকে সব সময় দুই বোতল পানি থাকতো। এছাড়া সাথে কিছু স্যালাইন আর গ্লুকোজ রাখতাম। হাঁটতে গিয়ে যদি ডিহাইড্রেশন হয়ে যায় তাহলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হবে। নাস্তা সেরে আবার পথে নামলাম।

আমরা যে পরিবেশে সব সময় থাকি তার গুরুত্ব বা সৌন্দর্য সেখানে থাকতে বুঝি না। শ্রীফলতলীতে যখন নাস্তা করছিলাম তখন আমি মহাসড়কের দিকে মুখ করে বসেছিলাম। ডানদিকে কিঞ্চিৎ বাঁক নেওয়ায় সড়কের সবটুকু আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো না। বড় বড় বাস-ট্রাক পীচ কামড়ে যার যার গন্তব্যে ছুটছিল। আর সেই বাঁকের ধারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো। সকালের রোদ তার মিষ্টি ঝাঁঝ নিয়ে সর্বময় আলোকিত করে রাখলেও বাঁকের পরে কিছুই আমি দেখছিলাম না। অনুভূতির এই অভেদ অনেকের কাছে অতি সাধারণ (silly), গুরুত্বহীন; কিন্তু আমার কাছে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা, একাকী পথের পাথেয়। সাড়ে সাতটার দিকে একটা চৌমাথায় এসে পৌঁছলাম। চৌমাথার উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে কালিয়াকৈর-ধামরাই আঞ্চলিক সড়ক। মিনিট দশেক পর উত্তর দিক থেকে কালিয়াকৈর বাইপাস সড়ক এসে মিললো। সকাল আটটা নাগাদ জানতে পারলাম (কিমি পোস্ট মারফত) যমুনা সেতু থেকে আমি আরও ৬২ কিলোমিটার দূরে আছি।

কানের পাশ দিয়ে ধূলা উড়িয়ে তুমুল বেগে সব বাস-ট্রাক যাচ্ছিলো। মহাসড়কে হাঁটতে গেলে আমাকে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। এগুলো আমি কারও কাছ থেকে বা কোথাও ভর্তি হয়ে শিখিনি। অভিজ্ঞতাই আমাকে এসব বাতলে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- আমি রাস্তার বাঁদিক দিয়ে মহাসড়কের মূল লেনের এককোণা ধরে হাঁটতাম। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করতো যে আমি কেন ডানদিকের মেঠোপথ ধরতাম না। সাধারণচোখে তাত্ত্বিকভাবে অনেকের মনে হওয়া ধারণাটাই ঠিক বলে মনে হয়। আমিও প্রথম প্রথম তাই করতাম। কিন্তু এতে বিপদ ও ঝামেলায় পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করেই বলি-
বাংলাদেশের লেন-ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। এদেশের সর্বত্র একই ব্যবস্থা বিরাজমান। বাঁদিকে থাকার ফলে বাদিকস্থ লেনের গাড়িগুলো সর্বদা আমাকে ওভারটেক করবে। আর ওভারটেক করে সামনে চলে যাবার আগ পর্যন্ত তাকে আমি দেখতে পাবো না। এতে একটা বড়সড় ঝুঁকি (risk factor)থেকেই যায়; কখন না জানি কোন গাড়ি এসে আমায় ধাক্কা দেয়। কিন্তু বিষয়টা আরও জটিল হবে যদি আমি ডানদিকের লেন ব্যবহার করি। প্রথম যুক্তি - এই মহাসড়ক বাস-ট্রাক চলার জন্য নির্মিত ও নির্ধারিত। চালকেরা এখানে সর্বেসর্বা। তারা এখানে অন্য কারও উপস্থিতি মেনে নেবে না। এখন আমি যদি ডানদিকের লেন ধরে হাঁটতে থাকি তখন ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে? ধরি একটা গাড়ি ডানদিকের লেন দিয়ে আসছে; আমিও একই লেন ধরে হাঁটছি। পরস্পর পরস্পরকে দেখছি। একে অপরকে ক্রস (cross) করার আগে কাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে? এই আমাকে। কারণ আমি জানি সে আসছে এবং আমি তার চলার জন্য নির্ধারিত রাস্তায় হাঁটছি। কিন্তু বাঁদিকে থাকলে এরকম কোন ঝামেলা নাই। সেক্ষেত্রে কেবল ড্রাইভার আমাকে দেখছে, আমাকে আর ড্রাইভারের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে না। তখন আমি আমার ট্র্যাকেই থেকে যাই, উল্টো ড্রাইভার আমাকে সাইড দিয়ে চলে যায়। এতে অবশ্য মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। কিন্তু পানিতে নেমে কুমিরের ভয় করলে তো আর চলবে না। দ্বিতীয় যুক্তি – ডানদিকে হাঁটতে হলে আমাকে প্রায়ই মসৃণ ট্র্যাক থেকে নেমে বন্ধুর মেঠো পথে হাঁটতে হতো। কারণটা আগেই বলেছি। উপরন্তু এটা ছন্দোবদ্ধ গতির প্রধান অন্তরায়। চট্টগ্রাম ট্যুরে এই করতে গিয়েই আমার পা মচকে যায়। তৃতীয় ও প্রধান যুক্তি – এদেশে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হল ওভারটেকিং। একটা গাড়ি যখন আরেকটা গাড়িকে ওভারটেক করে তখন সে পাশের লেনে চলে যায়। তাকে উভয় লেনের উপরই নজর রাখতে হয়। পক্ষান্তরে যাকে ওভারটেক করা হয় সেও এত সহজে বিষয়টা মেনে নেয় না। সে তার লেন থেকে আরও ভিতরের দিকে সরে আসে, যা কিনা বাঁদিকে থাকার ফলে আমার জন্য সুবিধাজনক। অন্যদিকে ওভারটেকিং করতেই হবে এই মানসিকতায় বাঁদিকের লেনের কোন কোন গাড়ি ডানদিকে তো চলে যায়ই, অনেক সময় রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথে নেমে আসে। অধিকাংশ দুর্ঘটনা তখনই ঘটে। এখন চিন্তা করলে বোঝা সহজ, আমি যদি ডান দিক দিয়ে চলতাম তখন ওভারটেকিংয়ের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমার অবস্থা কি হতো! তাছাড়া এর ফলে আল্লাহ্ তায়ালার রহমতে আমি একটা বিশেষ গুণ অর্জন করতে পেরেছিলাম। আর তা হল- আমার পিছনের ৩০-৪০ গজের মধ্যে কোন গাড়ি এলে আমি বুঝে যেতাম তার অবস্থান আমার জন্য বিপদজনক কিনা। খোদাপ্রদত্ত এই গুণ আজ পর্যন্ত কোথাও ব্যর্থ হয়নি।

সকাল ০৮:৩৩ মিনিটে টাঙ্গাইল সড়ক বিভাগের সাইন বোর্ড আমাকে স্বাগত জানাল। ফলে আরও একটা জেলাকে আমি পিছনে ফেলে আসলাম। ঠিক দশ মিনিট পর মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। বাংলাদেশের তৃতীয় এই ক্যাডেট কলেজ ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এটি অনেক ভিতরে হওয়ায় আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কেবল রাস্তার ধারে সাইন বোর্ড দেখে এর অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলাম। টানা দু’ঘণ্টা হাঁটার পর রাস্তার পাশেই বিশ্রাম নিতে বসলাম। আমার সামনে একটা ব্যাটারির ফ্যাক্টরি ছিল। জায়গাটা সোহাগপুরের কাছাকাছি। ঘড়ি ধরে ঠিক ছয় মিনিট পর উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর রাস্তার ধারে একটা ট্রাক পড়ে থাকতে দেখলাম। সম্ভবত আজ ভোরে বা কাল রাতে এক্সিডেন্ট করেছে। ট্রাকচালকরা হল আমার চোখে মহাসড়কের ত্রাস। এদের মতো ফাজিল আর বদমাশ প্রকৃতির মানুষ মনে হয় খুব কমই আছে। সারারাত হয় উল্টাপাল্টা কাজ করবে নয়তো যা তা খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে ট্রাক চালাবে। দুর্ঘটনায় এরা কিন্তু মরে কম। এদের অদক্ষতা আর বেপরোয়া আচরণে প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষ।

সকাল ০৯:৫৩ মিনিটে গড়াই ইউনিয়নের দেড়ুয়া রেলক্রসিং পার হলাম। পঁচিশ মিনিট পর দেওহাটা বাজারে (সাত মিনিটের) যাত্রাবিরতি করলাম। এখানে মহাসড়ক থেকে একটা রাস্তা বাঁদিকে সোজা মির্জাপুর চলে গেছে। বিখ্যাত কুমুদিনী হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোমস এই মির্জাপুরেই অবস্থিত। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মহাসড়কের ( ডানদিকে অনেক দূর দিয়ে) প্রায় সমান্তরালে উত্তরবঙ্গগামী একটা ট্রেন চলে গেলো। মধ্য সকালে রাস্তার চারপাশের পরিবেশ ছিল অসাধারণ সুন্দর। দু’ধারে ফসলি জমি, যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। মাঝে মাঝে দু’একটা বাড়িঘর চোখে পড়লো। এমন শান্ত নিস্তরঙ্গ সুখের আবাসভূমি ছেড়ে মানুষ যে কেন অবিমৃশ্যকারীর মতো শহরে এসে মানবেতর দিনযাপন করে আমি বুঝি না। ১১:২১ মিনিটে আমি মির্জাপুর ছেড়ে বাসাইলে প্রবেশ করি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে (১৫ মিনিট) আমি যখন দুল্লা মনসুর নামক স্থানে পৌঁছাই তখন দেখলাম যে এটা মির্জাপুর উপজেলারই অন্তর্গত! এখানে কিছুক্ষণের জন্য থামলাম। ঠিক বারটার সময় আবার যাত্রা শুরু করলাম। কখনো দীর্ঘ সোজা পথে আবার কখনো ডানে-বামে এঁকেবেঁকে ঘন্টায় ৪ কিলোমিটার বেগে টানা আড়াই ঘণ্টা হাঁটলাম।

দুপুর ০২:০৯ মিনিটে হঠাৎ আতরের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। আমার ধারণা রাস্তার পাশের কবরস্থান থেকেই এই সুগন্ধ আসছিলো। দিনের বেলা জায়গাটা যতই নিরীহদর্শন হোক না কেন রাতের বেলা ভয়ানক বিপদজনক। রাতে মহাসড়ক এমনিতেই নির্জন থাকে। নির্জনতার সুযোগে এসব জায়গায় তখন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে বলে শোনা যায়। আমি বাংলাদেশের এরকম কতগুলো জায়গার নাম জানি যেখানে নাকি রাতের বেলা আদমখোরের উৎপাত হয়। এরা সদ্যমৃত মানুষের লাশ খায়। অনেক সময় রাতের বেলা গাড়িতে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। ওরা এইসবের জন্য ওত্ পেতে থাকে। অসম্ভব হিংস্র প্রকৃতির হয় এরা। এদের বিষয়ে সবাইকে অনুরোধ করবো দয়া করে এদের চিড়িয়া ভাববেন না। এদের করালদর্শন যেকোনো মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

দুপুর আড়াইটা নাগাদ টাঙ্গাইলের পুলিস ট্রেনিং সেন্টারকে পাশ কাটালাম। এটি ঠিক কোথায় অবস্থিত প্রথমে বের করতে পারছিলাম না। পরে স্থানীয় একজনের কাছ থেকে জানলাম জায়গাটার নাম পূবাইল। এখানেই একটা বক্স কালভার্টের উপর মিনিট দশেক জিরিয়ে নিলাম। আমি যখন কালভার্টের রেলিংয়ে বসে ছিলাম তখন আমার পায়ের কাছে কতগুলো কালো পিঁপড়া কিলবিল করছিলো। আমি এর আগে কখনো এত বড় পিঁপড়া দেখেছি বলে মনে পড়লো না। সাধারণ বড় পিঁপড়ার থেকে আকারে প্রায় পাঁচগুণ। জুতা পরে থাকায় ওরা আমার সাথে বিশেষ একটা সুবিধা করতে পারল না। পিঁপড়াদের কখনো খোঁচাতে নেই। ওরা ক্ষেপে গেলে সর্বনাশের চূড়ান্ত করে ছাড়ে। আমিও তাই চুপচাপ বসে রইলাম। পিঁপড়া দিয়ে প্রাচীন পারস্যে এক নির্মম শাস্তি দেওয়া হতো। পারস্যের আকিমেনিড (Achaemenid) সাম্রাজ্যে এক ধরণের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ড প্রথা ছিল। সেখানে ভিক্টিমকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে হয় একটা নৌকায় (নৌকাবাইচে যে রকম সরু নৌকা ব্যবহৃত হয়) বাঁধা হতো নতুবা কোন মরা গাছের খোলের মধ্যে ঢুকানো হতো। এরপর তাকে জোর করে প্রচুর পরিমাণে দুধ ও মধু খাওয়ানো হতো (যাতে তার ডায়রিয়া হয়ে যায়) এবং সারা শরীরে মধু মাখানো হতো যেন কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট হয়। সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে ভিক্টিমকে কোন শান্ত পুকুরে অথবা সূর্যের নিচে মাটিতে ফেলে রাখা হতো। মধু এবং ডায়রিয়াজনিত সৃষ্ট বর্জ্যের আকর্ষণে ঝাঁকে ঝাঁকে পতঙ্গরা ছুটে আসতো। সবার আগে এসে জায়গা দখল করতো সেই সব পিঁপড়ার পূর্বপুরুষরা যারা টাঙ্গাইলের পূবাইলে আমার পায়ের নিচে ছিল। তাদের প্রচণ্ড দংশনে অসহায়ের মত চিৎকার করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকতো না সেই মানুষটির। অতঃপর অনাহারে আর দীর্ঘ যন্ত্রণায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো সে।

দশ মিনিট পর আবার হাঁটা আরম্ভ করলাম। বেলা তিনটা নাগাদ নাতিয়াপাড়া নামক স্থানে পৌঁছলাম। বিকাল ০৩:৪১ মিনিটে বেশ ভয়ানকভাবে বাঁক খাওয়া একটা U-টার্ন পার হলাম। বাসাইল উপজেলার বাঐখোলা মৌজার এই টার্নটা সম্ভবত সমগ্র উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক। দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত নামকরা একটা জায়গা। দিনের আলো ধীরে ধীরে কমে আসছিলো। রাতে থাকার জন্য মসজিদ (বা ফিলিং স্টেশনের নামাজঘর) খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে আমি একটা কৌশল অবলম্বন করে থাকি। সন্ধ্যা নামার দু’তিন ঘণ্টা আগে থেকেই স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসা করতে থাকি যে সামনে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে মহাসড়কের পাশে কোন মসজিদ আছে কিনা। যদিও স্থানীয়দের কথায় রকমফের থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তাদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা থাকে না।

বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ করটিয়া বাইপাস মোড়ে এসে পৌঁছলাম। রাস্তার পাশের এক ফার্মেসি থেকে কিছু ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ কিনলাম। হাত-পা কেটে গেলে এই ব্যান্ডেজ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমি অন্য কাজে এগুলো কিনলাম। হাঁটতে গেলে পায়ের আঙুলগুলো পরস্পরের সাথে ঘষা খেতে থাকে। এক পর্যায় আঙুলে পানি জমে ফুলে যায়। আর কোনভাবে যদি ঐ জায়গা ফেটে যায় তাহলেই হইছে। ভয়াবহ যন্ত্রণা করে। তাই আগেই আঙুলগুলোকে ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে রাখতাম। একই ব্যবস্থা ছিল পায়ের গোড়ালি ও পাতার যেসব জায়গা বেশি ব্যবহৃত হয় সেখানেও। বিকাল ০৪:৪৯ মিনিটে দিনের শেষ কিমি পোস্ট জানিয়ে গেল যে ঐতিহাসিক যমুনা সেতু থেকে আমি আর মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে আছি। পাঁচটা নাগাদ একটা দীর্ঘ, সোজা ও ঢালু রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। হাঁটার সময় ধ্রুব গতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। চড়াই-উৎরাই, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-বাদল যাই আসুক ছন্দোবদ্ধ একটা গতিতে সবসময় হাঁটতে হবে। বিকাল সাড়ে পাঁচটার কিছু পরে ভাতকুড়া নামক স্থানে সেদিনের মতো যাত্রাবিরতি করলাম। এবারের মসজিদ ভাতকুড়া জামে মসজিদ।

থাকার অনুমতি নিতে কিছুটা বেগ পেতে হল। বুঝতে পারলাম এখানে কোন আহমাদ ভাই নাই। বরং তার বদলে ছিল অসংখ্য পোকামাকড় আর মশা। এর মধ্যেই ক্রনিকল খুলে হিসাব করতে বসে গেলাম। আজ প্রায় ৩৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। সময় লেগেছে ১০ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এল। ধীরে ধীরে মসজিদের লোকসংখ্যা কমে আসতে লাগলো। এক সময় আমি একা হয়ে গেলাম। শুধু কলা-রুটি খেয়ে ঘুমের বন্দোবস্ত করতে লাগলাম। মসজিদের স্টোর থেকে কিছু চট এনে বিছানা তৈরি করলাম। এরকম চটে শরীর কুটকুট করে। কিন্তু সর্বময় প্রতিকূলতা জয়ের জন্যই যে আমার এই পথে আসা। সেক্ষেত্রে এইটুকু তো সহ্য করতেই হবে।

বিঃ দ্রঃ এখানে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

ধরি একটা গাড়ি ডানদিকের লেন দিয়ে আসছে; আমিও একই লেন ধরে হাঁটছি। পরস্পর পরস্পরকে দেখছি। একে অপরকে ক্রস (cross) করার আগে কাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে? এই আমাকে। কারণ আমি জানি সে আসছে এবং আমি তার চলার জন্য নির্ধারিত রাস্তায় হাঁটছি। কিন্তু বাঁদিকে থাকলে এরকম কোন ঝামেলা নাই। সেক্ষেত্রে কেবল ড্রাইভার আমাকে দেখছে, আমাকে আর ড্রাইভারের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে না।

অসম্ভব বাজে যুক্তি। ভাই দয়া করে এই কাজ করা বন্ধ করুন। আপনি সম্পূর্ণ ড্রাইভারের দয়ার উপর ভরসা করে হাইওয়ে ধরে হাঁটছেন। অযথা এই ঝুঁকি নিবেন না প্লিজ। জীবন অনেক মূল্যবান। দেখেশুনে বুঝে হাঁটুন। বরং ডান লেন ধরেই চলুন, প্রতিবার গাড়ি আসলে সরে দাঁড়ান। অথবা হাইওয়ে বাদ দিয়ে লোকাল রাস্তা দিয়ে হাঁটুন।

..................................................................
#Banshibir.

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক এর ছবি

ভাই যুক্তিটা বাজে মনে হতে পারে। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে বাজে। আমি ভাই বাস্তবে ডান দিক দিয়ে হেঁটে দেখেছি। কিন্তু এতে ঝামেলা বেশি হয়। আর বাঁদিকে হাঁটার ফলে প্রথম প্রথম বিপদ ছিল কিন্তু পরে এটায় অভিযোজিত হয়ে নিই। আর লোকাল রাস্তা ধরে হাঁটার কথা বলছেন। এটা তো আমার পক্ষে মানা খুব কঠিন। আপনাকে আমি অপমান করছি না। কিন্তু আপনিও একবার মহাসড়কে নামেন। দেখবেন কি রকম রোমাঞ্চকর সেই অভিজ্ঞতা। আমি সব আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। ইনশাল্লাহ।

রিসালাত বারী এর ছবি

আদমখোরের ব্যাপারটা বুঝলাম না। কিসের কথা বললেন? প্রসঙ্গ যখন তুলেছেন, তখন পরিস্কার করে বলাই ভালো।

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

ভাই, আদমখোরের ব্যাপারটা আমার জানতে মুঞ্চায়। আপনার উপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি - যদি নিজে দেখে থাকেন তবে রেফারেন্স এবং ঠিকানা সহ জানান। এই কথা বলার কারন হলো অতীতে এরকম 'কান নিয়ে গেল চিলের' পিছে অনেক দৌঁড়েছি; কিছুই পাইনি। তবে পাওয়ার আগ্রহ এখনও পুরোটাই আছে। কাজেই শোনা কথা না বলে (তার উপর আপনি যেহেতু প্রতি লেখার নিচেই বিঃ দ্রঃ দিচ্ছেন) আশা রাখি এরকম লেখায় নিজেরটুকুই শুধু লিখবেন। ধন্যবাদ।

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক এর ছবি

ভাই আমি তো আর রাতে হাঁটি না। হাঁটলে হয়তো তাদের দেখতাম। এদের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে না। সদ্যমৃত লাশ খায় এরা। তবে যেসব জায়গায় এদের দেখা যায় বলে আমি শুনেছি সেগুলো হল- টাঙ্গাইলের ভাতকুড়া, সাভারের আশুলিয়া, ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন মর্গের আশেপাশেও নাকি এদের কদাচিৎ দেখা যায়। অনেক আগে বাংলাদেশে খলিলুল্লাহ বলে একজন ছিল যে কিনা কাঁচা কলিজা খেত। এখন আর সে নাই। অনেক আগে মারা গেছে। আদমখোরদের আপনি হয়তো দেখতে পাবেন না। রাতের বেলা অনেকেই এদের দেখেছে বলে দাবী করেন। পৃথিবীতে এরকম অনেক রকম মানুষ পাবেন যারা অস্বাভাবিক আচরণ করে। কিন্তু তাই বলে আমরা আমজনতা যদি তাদের পাইকারি হারে দেখতে থাকি তাহলে তো বিষয়টা আমঘটনা হয়ে যায়। আর দিনের বেলা এরা খুব সাধারণ আচরণ করে।

দুপুর ০২:০৯ মিনিটে হঠাৎ আতরের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। আমার ধারণা রাস্তার পাশের কবরস্থান থেকেই এই সুগন্ধ আসছিলো। দিনের বেলা জায়গাটা যতই নিরীহদর্শন হোক না কেন রাতের বেলা ভয়ানক বিপদজনক। রাতে মহাসড়ক এমনিতেই নির্জন থাকে। নির্জনতার সুযোগে এসব জায়গায় তখন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে বলে শোনা যায়।

এই ঘটনা আমি নিজে চোখে দেখিনি কিন্তু তাই বলে আমি তো দাবী করিনি যে আমি এটা দেখেছি। এরকম জায়গাগুলোতে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে তাই উল্লেখ করেছি। আমি তো অপ্রাসঙ্গিক কোন প্যারাতে এর আলোচনা করিনি। আমি যা শুনেছি তাই বলেছি। তবে হ্যাঁ আমার জীবনে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা তো আমার এই জার্নিতে ঘটেনি। সেক্ষেত্রে সেই ঘটনা আমি এখানে কিভাবে বলি!

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক।

আশালতা এর ছবি

আপনার লেখাগুলো ক্রমশ ভালো হচ্ছে। তবে একটা জিনিষ একটু বলে নিতে চাইছি। সময়ের অনুপুঙ্খ হিসাব আপনার নিজের জন্য জরুরী বুঝতে পারি কিন্তু সেটার বারবার উল্লেখটা লেখার গতি কমিয়ে দেয়। আপনি কোথায় এগজ্যাক্টলি কয় মিনিট থামলেন বা কত মিনিট কত সেকেন্ডে একটা ঘটনা ঘটল সেটার উল্লেখ খুব প্রয়োজনীয় না। যেমন অনেকটাই অসার শেষে বি দ্র দেয়াটা। গল্প বলার মত করে বললে বোধ হয় বেশি উপভোগ্য হত জার্নিটা।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক এর ছবি

না আপু, আপনি যেমনটা ভাবছেন বিষয়টা সবার কাছে সেরকম মনে হয় না। আমি সময়ের অনুপুঙ্খ হিসাব এই কারণেই বলি যাতে কেউই এটা বলতে না পারেন যে আমি অমুক জায়গায় হেঁটে যাইনি। এটা আমি ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। আর কেউ জানতে চায় সময়ের অনুপুঙ্খ হিসাব। এই দীর্ঘ যাত্রায় আমাকে অনেক সময়েই এরকম কিছু পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিলো যেখানে এই সময়ের অনুপুঙ্খ হিসাব না থাকলে আমি ভয়াবহ বিপদে পড়তাম। সময়ের এই অনুপুঙ্খ হিসাবের জন্যই তো আমার পথের দুই ধারের সব ধরণের মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা আর শ্রদ্ধা পেয়েছি।

আর আপু, আরেকটা কথা। আমি যদি আমার ক্রনিকলের সব লিখতাম তাহলে এটা আপনারা কেন আমিই আর দ্বিতীয়বার পড়তাম না। ক্রনিকল থেকে আমি মাত্র ৩০% এর মতো সময়ের হিসাব দিই।

আর ধন্যবাদ আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবার জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।