সিটি অব লাইট

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৬/০২/২০১২ - ৩:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অবগাহন

ম্যাডোনা থেকে স্টিভ জবস কেন এসেছিলেন এ শহরে?

কিসের আশায় সকলেই এখানে ভিড় জমায়?

কেন ভূবন বিখ্যাত মানুষ গুলো এখানেই ঘুরতে আসে?

এখানে গঙ্গার পবিত্র জলে অবগাহনে কিসের শান্তি?

আমাকে সিটি অব লাইট ডাকছে। আমাকে যেতেই হবে। তাই এবারের আমার গন্তব্য বারণসী।

কলকাতা থেকে মুম্বাই মেল বারাণসী পৌঁছে দিল দশ ঘন্টায় । হাওড়া স্টেশন থেকে রাত ৯ টা ৪৫ মিনিটে রেলগাড়িতে চড়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সকাল ৮ টায় মোঘলসরাই স্টেশনে পৌছে গেলাম। সেখান থেকে আবার অন্য ট্রেন ধরে মিনিট ৩০'র মধ্যে বারাণসী স্টেশনে পৌছেই এক কাপ চা দিয়ে এ শহরের জল এবং বায়ুর সাথে পরিচিত হলাম।

( বারাণসী রেলস্টেশন - ছবি ইন্টারনেট)

পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য উত্তরপ্রদেশে এসেই গল্প জুড়ে দিলাম রেলের কর্মকর্তা উত্তমদার সাথে। বাঙ্গালী বলেই গল্পে গল্পে জানতে পারলাম ইংরেজদের শাসনকালে আগ্রা আর অযোধ্যা মিলে ইউপি (ইউনাইটেড প্রভিন্স) গঠিত হয়েছিল। ভারত স্বাধীন হবার পর নাম দেয়া হয়েছিল উত্তরপ্রদেশ। মিনিট পাঁচেকের পরিচয়ে জানিয়ে দিলেন কোথায়, কোন হোটেল, থাকার, খাবারের, দর্শণীয় স্থান কি কি ইত্যাদি ইত্যাদি। বাইরে এসে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটের উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়েই রেডিও অন করে দিলেন।

গুড মর্নিং বারাণসী... আপ শুন রাহি হে... আরজের মিষ্টি মধুর কথার সাথে সাথে বারাণসীর পথে পথে নিজেকে এই ধুলো মাখা পিচ ঢালা পথের সাথে মানিয়ে নিলাম। সবাই এখন অফিস বা স্কুল, কলেজে ছুটে যাচ্ছে। চোখে পরার মতই মেয়েদের বাইক চালানো। রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, সিগন্যাল নেই বললেই চলে। প্রায় ৪০ মিনিট পথ আসার পর চার রাস্তার এক মোড়ে গাড়ী থামিয়ে দিয়ে বললেন সোজা হেটে গেলেই দশাশ্বমেধ ঘাট। পাশেই একটি রেস্টুরেন্ট দেখে সাথে সাথে তাতেই ঢুকে আগে পেট পূজোটা সেড়ে নিলাম। গোবীকা পারাটা (ফুল কোপির পরোটা), পালং পনির (পনির দিয়ে পালং শাক), রাবরী (এক প্রকার দুধ দিয়ে তৈরি পায়েস) এবং লস্যি ( লাচ্ছি) দিয়ে সকালের এমন উপাদেয় খাবার দিয়ে জল খাবার পর্ব শেষ করে হাঁটা দিলাম দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে।

( গঙ্গার ঘাট )

পুণ্যসলিলা স্রোতস্বিনী গঙ্গার তীরে বারাণসী। হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে ডান বামের রাস্তার দু-পাশে দোকান, হোটেল আর বিভিন্ন দেশের মানুষের দেখা পেলাম। সাবাই সামনে যাচ্ছে, গঙ্গার সামনে। আমি হোটেলের খোঁজে এগিয়ে গেলাম। মির ঘাটের কাছে গণপতি গেস্ট হাউজ ইন্টারনেটে আগে থেকেই আমার কলকাতার বন্ধু ঠিক করে রাখায় হোটেল খোঁজার দায় থেকে আগেই মুক্ত ছিলাম। অলি গলির পথে হেঁটে যেতে যেতে বাড়ি ঘরের অবকাঠামো দেখে শহরের প্রাচীন দিকটা লক্ষ্য করলাম। যেন একই পথে বারবার হাঁটছি। জিজ্ঞেষ করে চলতে চলতে এক সময় আবিস্কার করলাম আমার থাকার জন্য গনপতি হোটেলটি একদম গঙ্গা ঘেঁষে। কেউ কিছু না বলে দিলে এই হোটেল বের করা যে কারো জন্যই অসাধ্য ছিল। এটা যে হোটেল তা বুঝতেও কষ্ট হচ্ছিল। কেনই বা হবে না, ভাঙ্গা বাড়ির ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে নিচের তলায় এমন সুন্দর, যে কোন হোটেল থাকতে পারে, কেউ ভাবতেই পারবে না। গণপতি গেস্ট হাউজের গঙ্গার তীরে এহেন মনোমুগ্ধকর হোটেলের নরম ভিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে ভাবলাম এই শহরে কেন বিখ্যাতদের আগমন ঘটে তা খুঁজে বের করতেই হবে।

(হোটেল গনপতি গেস্ট হাউজ)

বারণসী এর বর্তমান নাম হলেও এর বেশ কয়েকটি নাম আছে। প্রাচীনকালে কাশী বা কাশীধাম নামে এর পরিচিত ছিল। পুরাণে উল্লেখ আছে আজ থেকে তিন হাজার বছরেরও আগে সুহোত্র নন্দন কাশ্য 'কাশী' নগর গড়ে ছিলেন। কাশ্য নামের এই ব্যাক্তির নামেই এর নাম হয়েছিল কাশী। অনেকে একে আবার 'বেনারস' নামেও ডাকে। অসি ও বরুণা নদীদ্বয়ের মাঝখানে এই অঞ্চলকে বারাণসী থেকে বেনারস নামের এ রকম রদবদল তৈরি হয়।

হেঁটে হেঁটে ঘাটের কাছে এসেই ডান দিক আর বাম দিকের বিশাল প্রাসারিত ঘাটের সীমানা দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। ৮১ টি ঘাটের সমন্বয়ে বারাণসী কেন তীর্থযাত্রী ও পর্যটক উভয়কেই প্রভাবিত করে তার প্রাথমিক ধারণাটা হোটেল থেকে বেড়িয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে এসেই বুঝতে পারলাম। ঘাটের একের পর এক ধাপ গঙ্গা পর্যন্ত নেমে গেছে। সিড়ির প্রশস্থ ধাপে তালপাতার ছাতার তলায় পান্ডাদের দল চন্দন, তিলক, ফুলবেল পাতা, পুজার আয়োজন নিয়ে ভক্তদের জন্য বসে থাকে। হিন্দুধর্মের পুরান থেকে জানা যায়, এখানেই ব্রহ্মা দশটি অশ্ব দিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এর পর থেকেই এই ঘাটের নাম দশাশ্বমেধ ঘাট নামে খ্যাতি লাভ করেছে। (৮১ টি ঘাট নিয়ে পরবর্তিতে লিখার ইচ্ছা আছে)

(দশাশ্বমেধ ঘাট )

এখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মিলন মেলা বললেও ভুল হবে না। এই পথে হেঁটে হেঁটে যার সাথেই কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের সবার কাছে আমার একটি প্রশ্নই ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন এসেছেন এখানে? উত্তর শুনেছি মন দিয়ে, চেষ্টা করেছি অনুভব করার। অবশ্যই সবচেয়ে বড় অংশটার উত্তর ছিল তীর্থ যাত্রা। এর বাইরে বেশির ভাগ মানুষই বলেছিলেন "It's a holly place. To find peace I came here." আরেক দল বলেছিলেন " To learn Yoga" কিন্তু তবুও আমার মনের শান্তি আসে না। আরো হাটতে হবে, আরো জানতে হবে।

( ইয়োগা অনুশীলনের একটি বিশেষ মুহুর্ত )

বিকেলে দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গা আরতীর আয়োজন শুরু হতে থাকে, বাড়তে থাকে মানুষের ঢল। এখানে সন্ধ্যার সাথে সাথে শুরু হয় গঙ্গা আরতী। যা না দেখলে আসলেই বুঝতে পারতাম না ব্যাপারটা কি।

( দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গা আরতির একটি বিশেষ মুহুর্ত )

আমি ধর্মের ব্যাপার গুলো আলাদা রেখে শুধু এতটুকুই যদি বলি তা হচ্ছে অবগাহন। মনের চঞ্চলতা দূর হয়ে যায় এক কথায়। তাদের পুজার্চনার কলা কৌশলও দেখার মত। গঙ্গা আরতী শেষে প্রসাদ পেতে চাইলে যে কেউ তা পেট পুরে খেতে পারবেন। এ জন্যই এখানে একদল ঘরছাড়া মানুষের বসবাস। কি উঁচু কি নিচু এখানে কারো কোন ভেদা ভেদ নেই। যা আছে তার সবটুকু পরদিন গঙ্গায় বিসর্জন দেয়ার জন্য হোটেলের দিকে পা বাড়াই।

( গঙ্গায় আরতির পর প্রদীপ ভাসান )

প্রথম পর্ব অবগাহনের ইতি ( চলবে)

লেখক ও ছবি - গ্রেগরীয়ান বালক

ছবি: 
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am
06/01/2007 - 1:46am

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

চলুক আরো বিস্তারিত হলে বেশী ভালো লাগত---

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

ঠিক, ঠিক, ঠিক। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম পরের পর্বের অপেক্ষায়।

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

দেঁতো হাসি

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

ধন্যবাদ অনু। পরের পর্বে বিস্তারিত লিখবো।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

ইয়োগাও শেখায় এখানে? দারুণ তো।

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

ইয়োগার বিভিন্ন ধরনের কোর্স করানো হয় এখানে। কিছুটা ধারণা পরের পর্বে থাকবে।

তাপস শর্মা এর ছবি

ভালো লাগল। আরও বিস্তারিত ভাবে লিখুন ভ্রমণ কথা। ছবি গুলি ফ্লিকার থেকে এনে তারপর আপলোড দিলে ভালো হয়।

ছাতার তলায় পান্ডাদের দল চন্দন, তিলক, ফুলবেল পাতা, পুজার আয়োজন নিয়ে ভক্তদের জন্য বসে থাকে।

এই বেয়াদপদের সহ্য হয়না। আর ধর্মকর্ম বাদ দিলে সব ঠিক আছে হাসি

সচলে স্বাগতম। চলুক

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

তাপস আপনার কথা মনে থাকবে। ফ্লিকারের ব্যাপারটা দেখছি।
"ছাতার তলায় পান্ডাদের দল চন্দন, তিলক, ফুলবেল পাতা, পুজার আয়োজন নিয়ে ভক্তদের জন্য বসে থাকে।
পাণ্ডাদের জীবন চরম অদ্ভুতরে ভাই। পরে বলবো।
ধন্যবাদ

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

হাসি

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

চলুক ম্যাঁও

-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

ধন্যবাদ

কাজি মামুন এর ছবি

কাশীকে জানার শখ ছিল অনেক দিন ধরেই। এই লেখা সেই শখ মিটিয়েছে অনেকটাই।
গঙ্গা আরতির ছবি খুব ভাল লাগল! সঙ্গে ইয়োগোটাও। হাসি
তবে আপনি বার বার যে প্রশ্নটা করেছেন (অর্থাৎ কেন এখানে স্টিভ জবস, ম্যাডোনার মত লোকেরা আসেন), তার উত্তর কিন্তু পাঠক হিসাবে এখনো পাইনি; পরের পর্বে পেয়ে যাব আশা করছি।

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

কাজি মামুন আপনার জানার শখটা কতটা পূরণ করতে পেরেছি জানি না। আপনার মুল্যবান মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্বে আরো বিষদ আলোচনা থাকেবে সাথে উত্তরও ।

যুমার এর ছবি

চলুক

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

কিছু ছবি দুবার এসেছে, যা পড়ার গতিকে আটকে দিচ্ছে । তাপসদার কথা ঠিক । ফ্লিকার থেকে করলে এই ঝামেলা মেটানো যায় ।
আপনার চোখ দিয়ে বারাণসী দেখে ভালো লাগল ।

আর হ্যাঁ, পাণ্ডাদের উপদ্রব, জুলুমবাজী এসব নিয়ে আরেকটা লেখা দিন ।
অপেক্ষায় থাকব ।

খুব ভাল থাকুন ।
শুভেচ্ছা ।

গ্রেগরীয়ান বালক এর ছবি

প্রদীপ্তময় সাহা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। আপনাদের উপদেশ মনে রেখেই পরের লেখাটা নিয়ে আসছি।পান্ডাদের নিয়েও গপ্প থাকবে।
ভাল থাকবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।