১৪ই ফেব্রুয়ারি ও আমাদের দায়বদ্ধতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০২/২০১২ - ৫:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


বাঙ্গালীর জীবনে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি আসে ভিন্ন আবেদন নিয়ে, বিভিন্ন উদযাপন করার উপলক্ষ্য নিয়ে। সে উপলক্ষ্য হতে পারে সাংস্কৃতিক, হতে পারে রাজনৈতিক, হতে পারে এর বাইরেও। এই শেষ শ্রেনীভুক্ত বর্তমান প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয়টি হল ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে।

এইদিনে ৫টাকার গোলাপ ২০, ৩০ বা তার থেকে বেশী টাকা দামেও বিকোয়। নবীন বয়সের সবার হাতেই ফুলের দেখা মেলে। সারা দেশে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব তৈরী হয়। শাহবাগ থেকে টিএসসি, চারুকলা, বইমেলা সব জায়গায় দেখা যায় যুগলবন্দীদের ভিড়। শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনের জায়গাগুলো লাল গোলাপের ঝরে পড়া পাঁপড়িতে লাল হয়ে ওঠে। তবু এই দিনে একসাথে ঘুরে বেড়ানো প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনেকেরই অজানা থেকে যায় যে, আজ থেকে ২৯ বছর আগেকার ঠিক এই দিনেও রাস্তা রক্তাক্ত হয়েছিল। তবে সেটা গোলাপের পাঁপড়ি ছিল না, ছিল মানুষের বুকের তাজা রক্ত।

আমাদের জাতির ইতিহাসে ১৪ই ফেব্রুয়ারির গৌরবোজ্জল ভূমিকার উপর এই ভ্যালেন্টাইনস্ ডে’র প্রেম-ভালবাসা এতই জোরালোভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে যে নতুন প্রজন্ম আসল ব্যাপারটা স্রেফ জানেই না। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের প্রবর্তিত গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রতিরোধ আর তাদের অনেকের আত্মদানের মত একটি ঘটনা, এমন গর্ব করার মত একটি দিন বেমালুম হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙ্গালী জাতির জীবন থেকে।

১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ, বাংলাদেশে জারি হল সামরিক শাসন। নিষিদ্ধ করা হল সব ধরণের রাজনৈতিক দল এবং তাদের সকল রাজনৈতিক তৎপরতা। ১৭ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষা দিবস’ পালনের পোষ্টারিং করতে গিয়ে তার আগের রাতে গ্রেফতার হন তিনজন ছাত্রকর্মী। ২৩শে সেপ্টেম্বর স্বৈরশাসকের নির্দেশে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. আব্দুল মজিদ খান কর্তৃক ৮২-৮৭ সালের জন্য প্রণীত হল চরমভাবে সাম্প্রদায়িক এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন শিক্ষানীতি, যা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় ‘মজিদ খানের শিক্ষানীতি’ হিসেবে। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে বিনিয়োগনির্ভর পণ্যে রুপান্তরিত করা হয়। রেজাল্ট খারাপ হলেও মোট ব্যয়ের ৫০% বহনে সক্ষমদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। একইসাথে এই শিক্ষানীতি ছিল সাম্প্রদায়িক, প্রাথমিক স্তরে ইংরেজীর পাশাপাশি আরবি ভাষাকেও বাধ্যতামূলক করা হয়। ৮ই নভেম্বর কলাভবনের একটি মিছিলের উপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে তার পরের দিন, অর্থাৎ ৯ই নভেম্বর মধুর ক্যান্টিনে গঠিত হয় ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’।

১৯৮৩ সালের জানুয়ারী মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। এবার আঘাত আসে ভাষা আন্দোলনের চেতনার উপরে, জানুয়ারির মধ্যভাগে স্বৈরশাসক এরশাদ ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ, বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিলো শহীদ মিনার। কিন্তু আমরা দেখি সেখানে আল্পনা আঁকা হয়। এ কাজ ইসলাম বিরোধী। শহীদ আবুল বরকত আল্লাহর বান্দা, তার জন্য আল্পনা কেন, কোরানখানি হবে’। ধর্মপ্রাণ বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি নির্লজ্জভাবে ধর্মকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। জানুয়ারীর শেষভাগে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষণা করেন।

১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী মিছিল সহকারে সচিবালয়ের দিকে রওনা হয় স্মারকলিপি পেশ করার উদ্দেশ্যে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং আন্দোলনে অংশ নেয়। হাইকোর্টের মোড়ে শিক্ষা ভবনের সামনে এসে মিছিলটি ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়। কাঁটাতারের সামনে এসে ছাত্রীরা বসে পড়ে, নেতৃবৃন্দ কাঁটাতারের উপর দাঁড়িয়ে জানাতে থাকে বিক্ষোভ। এই সময় পুলিশ মিছিলের উপরে হামলা চালায়। লাঠি, টিয়ার গ্যাস, পানিকামান সহযোগে নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীর উপর গুলি চালায় পুলিশ। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে হাইকোর্ট, প্রেসক্লাব, কার্জন হল ও শিশু একাডেমী এলাকায়। এতে জাফর, জয়নাল, দীপালি, আইয়ুব, ফারুক ও কাঞ্চনসহ বহু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী হতাহত হয়।

আগের দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৫ তারিখ ছাত্রজনতা আবার রাস্তায় নামে। আবার সংঘর্ষ বাঁধে পুলিশের সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর, আমতলী, তেজগাঁ, বাহাদুরশাহ পার্ক, ইংলিশ রোড, মতিঝিলসহ সারা দেশে। চট্টগ্রামে নিহত হন মোজাম্মেলসহ আরো কয়েকজন। ঢাকা শহরে সারা রাত কারফিউ আরোপ করা হয়। ২৭ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারাদেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ আন্দোলনকে বলা যায় স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম গণআন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের পর এটাকেই বলা যায় ছাত্রসমাজের একটি স্বতঃফূর্ত অভ্যুত্থান যা পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

বই পড়ে ইতিহাস জানা গেলেও কোন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে সেটা শুনতে পারা একটা আলাদা অনুভূতি। মিঃ সাবরী খান, বর্তমানে একটি বিজ্ঞাপণী সংস্থায় কর্মরত, ১৯৮৩ সালে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকান্ডের সাথে। আমি তার জবানীতেই বর্ণনা করছিঃ ’৮১ তে একটা ইলেকশন হয়েছে, ‘৮২ র মার্শাল ল। এক বছর মার্শাল ল’র মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরে কোন নড়ন চড়ন নাই। মাঝখানে একটা চেষ্টা হয়েছিল, ’৮২ র ১৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে একটা কিছু আয়োজন করার, মিলিটারীরা সেটা হতে দেয়নি। সেইটাই আরেকটা নতুন রূপ নিল, ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। আমরা কলাভবন থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষা ভবনের দিকে চলে এসেছি। হাতের ডানদিকে কার্জন হল, বাঁদিকে শিশু একাডেমী, এরপর হাইকোর্ট। চিকন রাস্তা ছিল, এখন তো রাস্তাটা অনেক বড় হয়েছে, তখন অত বড় ছিল না, খুবই চিকন ছিল রাস্তাটা। শিক্ষা ভবন পর্যন্ত আমাদের মোটামুটি আসতে দিল। আমি মিছিলের মাঝের দিকে ছিলাম। বেলা একটা দেড়টা হবে, প্রচন্ড গুলি হল, একেবারে সোজা গুলি বলতে গুলি। একজনের কথা মনে আছে, একটা মেয়ে। ওই মেয়েটাকে দেখলাম যে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে, মাথার খুলির কিছু অংশ খুলে পড়ে যাচ্ছে, সেটা আবার মাথার সাথে লাগিয়ে নিচ্ছে। অনেক পরে জেনেছিলাম যে মেয়েটার নাম দীপালি সাহা। আবার পরে শুনেছিলাম যে, ওটা মেয়ে না ওটা একটা ছেলেই ছিল। আসলে এত দূরে না তখন ঠিকভাবে দেখারও কোন উপায় ছিল না। আমরা তখন দোয়েল চত্বরে, এখনকার মত এত সাজানো ছিল না দোয়ের চত্বর আর তখন এত দেয়ালও ছিল না চারিদিকে। এখন যেটা জাতীয় ঈদগাহ্, আমি যদি ভুল না করে থাকি, ঐখানে আলাদা আলাদা করে দুইটা পুকুর ছিল। অনেক ছেলে হাইকোর্টের ওখান দিয়ে দৌড়ে গিয়ে পুকুরের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, পুলিশের পিটানি থেকে বাঁচবার জন্য। কেউ কেউ ছুটে গেল কার্জন হলের দিকে, শিশু একাডেমীর দেওয়াল টপকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পিছনে একটা মন্দিরের দিকেও ছুটে গেল অনেক ছাত্র। জাফর, জয়নাল আরও কারা কারা ছিল, মারা গেল অনেকে। এটা হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে।

প্রথমদিন এই গোলমালের পর, পরের দিন ছাত্ররা ধর্মঘট-হরতাল ডাকল। হরতালের মধ্যে ঐদিনও গোলাগুলি হল এবং ঐদিন রাস্তায় বিডিআর নামিয়ে দিয়েছিলেন এরশাদ। আমি প্রথমদিন তেমন মার খাইনি, মনেহয় লাঠিচার্জের বাড়ি খেয়েছিলাম, দ্বিতীয়দিনে আমাদের উপরেও মারপিট চালানো হল। আসলে এই দিন বলতে গেলে নামতেই দেয় নাই, যা হয়েছে তা অনেকটা খন্ডযুদ্ধের মত। এই ১৪ এবং ১৫ তারিখ, অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আমার মনে হয় যে ঢাকায় পরবর্তীকালেও ’৯০ এর গণআন্দোলন ছাড়া, এমনকি ’৮৭ র গণআন্দোলনেও এত ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নামে নাই, সার্বজনীনতা ছিল বিষয়টাতে। মজিদ খান নামের যাকে এরশাদ সরকার শিক্ষামন্ত্রী করেছিলেন, উনি ’৮২ সালে যে ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করলেন, ঐটা নিয়েই গন্ডোগোলটা শুরু হয়েছিল। যতটুকু আমার মনে আছে আর কি, অনেক আগের কথা তো, ’৮৩ সাল মানে তো ২৯ বছর আগের কথা। এখনকার তোমরা ভাবতে পারবে না ঐ সময়ের পুলিশের তান্ডব আর সেই কারফিউ এর ভয়াবহতা কেমন হতে পারে। মনে আছে, অংশগ্রহণ করেছিলাম, আমার মত হাজারো ছাত্র। ছাত্রদের নীতি-নৈতিকতার শক্তিতে এখনও বিশ্বাস করি। শুভ কিছু করার জন্য সমাজের অগ্রসর অংশ ছাত্ররা। তাই যে দলমতই করি না কেন, ছাত্ররা তুলনামূলকভাবে চেতনার দিক থেকে অগ্রসর, তাই তাদের উপরে আস্থা রাখতেই হয়। একটা জিনিস মনে রাখার দরকার আছে যে, ’৮৩ র ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি এত স্পর্শকাতর ব্যাপার যে ছাত্রদের এই আন্দোলনের ধাক্কায় সব রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়ে গেল এবং অলিখিতভাবে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের জন্ম হল এটার পটভূমিতে। এদের মাঝে ছিল আওয়ামী লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিষ্ট লীগ, সাম্যবাদী দল, গণআজাদী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি প্রভৃতি। আমরা রাতে বিবিসি’র খবরে শুনলাম যে, ড. কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু -এই নামগুলোই মনে করতে পারছি এই মূহুর্তে, এদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইস্ ডে’র যে ব্যাপারটা, এইটা আসলে করারও কিছু ছিল না। একসময় যায়যায়দিন এর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে এরশাদের পতন পর্যন্ত সব সংখ্যাই আমার কাছে ছিল। শফিক রেহমানের যায়যায়দিন তখন আমাদের আন্দোলনের একটা হাতিয়ার ছিল, নতুন প্রজন্মের কাছে খুব জনপ্রিয়ও ছিল। সম্ভবত ’৮৫ র দিকেই শফিক রেহমান ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ‘৮৩ পরবর্তী সময়ে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে প্রতিবছর পালন করা হলেও এটা হারিয়ে গেছে অনেকটা ’৯০ তে এরশাদের পতন হওয়ার পরে। আবার এটার আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে পরবর্তীকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যেই নানান রকম ভাঙ্গন হল’।

এত বড় একটা ঘটনা, অথচ আমাদের নতুন প্রজন্মকে এটা জানতেই দেওয়া হয়নি। আজকে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরাই তৎকালীন ছাত্রসমাজের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন আর তাদের মহান আত্মত্যাগের কথা জানে না। কিন্তু এই ব্যাপারে আমি তাদের সরাসরি দোষ দিতেও নারাজ। তাদের যদি জানার সুযোগ করে দেওয়া হত, তাহলে তাদের কারও কারও চেতনায় একটা পরিবর্তন আনা অবশ্যই সম্ভব ছিল। কিন্তু ‘বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধা’র মত সেই দ্বায়িত্বটাই বা কে নেবে? ১৪ই ফেব্রুয়ারির এই দিনে আমাদের গণমাধ্যমগুলো ব্যাস্ত থাকে নতুন প্রজন্মকে মানব-মানবীর সনাতন প্রেমলীলার পাঠ দেওয়ার জন্য, দৈবাৎ এসব শহীদদের কপালে জোটে কোন সংবাদপত্রের মধ্যপৃষ্ঠার অবহেলিত একটি কোণায় দায়সারা ভঙ্গিতে লেখা কয়েকলাইন। ভালবাসা দিবসে মোবাইল অপারেটরগুলোর চমকপ্রদ সব অফার আর আর্চিস-হলমার্কের কার্ডের বন্যায় দিশেহারা আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের অতীত ভুলে তাই আজ প্রাণপনে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পেছনে ছুটছে।

১৪ই ফেব্রুয়ারি নিয়ে নতুন প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনা জানার চেষ্টাতে কথা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের ছাত্রী অণিমা’র সাথে। তার দৃষ্টিভঙ্গিটা অনেকটা এইরকমঃ ‘প্রথমত ব্যাপারটা আমি আগে জানতাম না। আর ভালোবাসা দিবস এই জিনিসটা আমার কাছে হাস্যকর ছাড়া আর কিছু লাগে না, কারন বর্তমানে সবাই ব্যাপারটাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে এখন প্রতি বিজয় দিবস, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারিকেই একেকটা ১৪ ফেব্রুয়ারি বানিয়ে ফেলেছে। আমরা এই প্রজন্ম ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া এত বড় ব্যাপারটা জানি না! কত বড় লজ্জার ব্যাপার। প্রতি বছর এই দিনে এত এত নাটক, সংবাদে বিশেষ প্রতিবেদন...কই এই ব্যাপারে তো কেউ কিছু বলে না। খুব সাবধানে ব্যাপারটা চেপে যায়। আমরা জানব কি করে? জানার তো সুযোগ দিচ্ছে না। অনেক যত্ন করে আমাদেরকে ভারতীয় আর পাশ্চাত্য সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলছে! শেষে এটুকু বলতে চাই যেন আমাদেরকে কিছু জানার সুযোগ করে দেয়া হয়। যাতে আরেকটি নতুন প্রজন্মের সামনে লজ্জা পেতে না হয় আমাদের’। এই কথাগুলো যেন মিঃ সাবরী খানের কথারই প্রতিধ্বনি-‘ছাত্ররা তুলনামূলকভাবে চেতনার দিক থেকে অগ্রসর’।

বর্তমানকালের বাস্তবতায় সনাতন প্রেমের ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাওয়াটা হয়ত কঠিন, কিন্তু আমাদের নিজেদের গৌরবের জায়গাগুলো ভুলে যাওয়াটা আসলেই হতাশাজনক। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কসমোপলিটান হওয়ার আগে আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা বাঙ্গালী। একজন কসমোপলিটান হতে হলে আমাদের একজন ভাল বাঙ্গালী হতে হবে সবার আগে, আর সেটা করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের জানতে হবে বাঙ্গালীর ইতিহাস।।

তথ্যসূত্রঃ
১। গনআন্দোলন ১৯৮২-৯০, সৈয়দ আবুল মকসুদ(মুক্তধারা)
২। আসছে ভ্যালেন্টাইন ... আসছে জয়নাল দিপালী ... প্রীতম অংকুশ, চতুর্মাত্রিক ব্লগ
৩। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩, নজরুল ইসলাম, সচলায়তন ব্লগ

বিপ্লবী স্বপ্ন

ছবি: 
08/24/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

জিজ্ঞাসু এর ছবি

প্রেমিক প্রেমিকার ভালবাসা, মা-বাবার প্রতি ভালবাসা বা বন্ধুবান্ধবদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন যেকোন দিনই হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষ্য যেমন: ঈদে-পার্বণে, জন্মদিন, বার্ষিকী ইত্যাদিতেও ভালবাসার নিদর্শনসরূপ উপহার সামগ্রী আদান-প্রদান হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস হিসেবে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ই ছিল মূল প্রণোদনা।

কিন্তু এতবড় একটা ঘটনা আমার জানাই ছিল না। বাঙলা মায়ের সন্তানদের এমন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাই নতুন নতুন কর্পোরেট ব্যবসায়ীক যাগযজ্ঞের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমাদের পথচলার শেষ অনেক দূরে। তাই আমাদের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কাজটি চালিয়ে যেতে হবে।

লেখার জন্য ধন্যবাদ।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

দ্যা রিডার এর ছবি

লেখার জন্য ধন্যবাদ।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

চলুক

ধ্রুবনীল এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।