উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা, যেদিকে দৃষ্টি নেই কারো…

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৪/০৩/২০১২ - ১১:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১০ বছরের স্কুলজীবনে ৬ টা স্কুলে পড়তে হয়েছে আমাকে, তিনটা প্রাইমারী স্কুল আর তিনটা হাইস্কুল। সবগুলোই উপজেলা পর্যায়ে। আব্বুর চাকরীর জন্যই এই ঘনঘন স্কুল পরিবর্তন। নটরডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে খুব কমই আছে আমার মত উপজেলা পর্যায় থেকে আসা। ঢাকার বাইরে থেকে যারা এসেছে বেশীরভাগই জেলার কোনো স্কুল থেকে পড়ে এসেছে। আবার এদের মধ্যে অনেককেই থাকতে হয় আরামবাগের বিভিন্ন মেসে, স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই কয়েকদিনের মধ্যে বিপথে চলে যায়, যারা ভালো করতে চায় তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করেই ভালো করতে হয়। বলাই বাহুল্য, বুয়েটেও একই অবস্থা।
উপজেলা পর্যায়ের স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা কম আসে, তার কারণ কিন্তু এটা না যে উপজেলার শিক্ষার্থীরা ভালো না। কারণ উপজেলার ভালো শিক্ষার্থীরা উপজেলায় আর থাকে না, বাইরে চলে যায়। আর যাবেই বা না কেন? উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলোতে পড়ানোর অবস্থা দেখলে অনেকেই হয়ত রীতিমত আঁতকে উঠবেন।

প্রাইমারী স্কুলের কথা আমার ভালমত মনে নেই, আর ওইসময় কোন শিক্ষক ভালো পড়িয়েছেন আর কে খারাপ পড়িয়েছেন এত কিছু বিচার করার মত বুদ্ধিও হয়নি। হাইস্কুলের কথাই বলি। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম কয়েকদিন স্কুলে যাইনি, গ্রামের বাড়িতে ছিলাম ওইসময়। প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গেলাম, ওইদিনের কৃষিশিক্ষা ক্লাস। যেই শিক্ষক ক্লাস নিতেন উনি আবার আমাদের বিজ্ঞান ক্লাসও নিতেন। তরুণ শিক্ষক, ভাবলাম ভালই ক্লাস নিবেন। উনি আমাদের দ্বিতীয় অধ্যায় পড়ানো শুরু করলেন মাটির সংজ্ঞা দিয়ে। আমার এখনও মনে আছে সেই সংজ্ঞা... “যে মাটিতে আমরা ফসল ফলাই তাকে মাটি বলে”। অনেকের কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু উপজেলা পর্যায়ের অনেক বেসরকারি স্কুলের অবস্থাই এরকম।
আমি দেখলাম যে মাটি কি সেটা সুন্দরভাবেই বইয়ে লিখা আছে। দাঁড়িয়ে স্যারকে সে কথা বললাম। স্যার বললেন হ্যাঁ, বইয়ে যেটা আছে সেটাও হবে আমারটা লিখলেও হবে। পুরো ক্লাসটাই এমন অদ্ভুত সব সংজ্ঞা আর ব্যাখ্যা লিখতে লিখতে গেল। পরে আর প্রতিবাদও করিনি, স্যার রেগে গিয়ে মারতে পারেন এই ভয়ে।
সব স্যারই যে খারাপ পড়ান, এটা বলছি না। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ের বেসরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার মান যে কতটুকু করুণ এটা ভাবলে আমারই এখন অবাক লাগে।

সেভেনে উঠার পর আব্বু ট্রান্সফার হল, বান্দরবানের একটা উপজেলায়। দুটো স্কুল ছিল ওখানে, একটা হচ্ছে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, যেখানে পড়তাম, পাশেই গার্লস হাইস্কুল। আব্বু একবার মজার এক ঘটনার কথা বলেছিল, SSC এর রেজাল্ট বের হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করছিলেন, রেজাল্ট কি আপনার স্কুলের? উনি উত্তর দিলেন, ৩৩% পাশ (অন্য বছরের তুলনায় কিন্তু ভালই)।
পরে জানা গেল, সেবার ওই স্কুল থেকে ৩ টা মেয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল, পাশ করেছিল ১ জন।
এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার হার খুবই কম, তার মধ্যে খুব কম মেয়েই SSC পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। আর আমাদের স্কুল কম্বাইন্ড হওয়ায় আর রেজাল্ট কিছুটা ভালো (?) হওয়ায় সবাই এটাতেই পড়তে আসত, ফলস্বরূপ গার্লস স্কুলের এই বেহাল দশা।

এবার আমাদের স্কুলের কথায় আসি। স্কুল লাইফের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি এখানে। আগে স্কুলটা বেসরকারি ছিল, পরে সরকারি করা হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি থাকা অবস্থায় যেসব শিক্ষকরা ছিলেন তারা রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের ক্লাসের অবস্থা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সরকারি হওয়ার পর যেসব শিক্ষক স্কুলে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন তাঁদের ক্লাস সত্যিই খুব ভালো ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছাত্র খুব কম হওয়ায় কোন শিক্ষকই বেশিদিন থাকতেন না, ট্রান্সফার হয়ে অন্য স্কুলে চলে যেতেন। আমি যখন স্কুলটাতে ভর্তি হই তখন বাংলা এবং অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত, কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলার শিক্ষক বদলি হয়ে যান অন্যত্র, আর অঙ্কের শিক্ষক বিএড করতে চলে যান। পরে ইংরেজি এবং শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক আসেন, এর মধ্যে ইংরেজির শিক্ষকও পরে চলে যান (উনিই আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক)। আমি স্কুল থেকে চলে আসার পর শুনেছিলাম এটা নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিলো, পরে শিক্ষক সমস্যার খানিকটা সমাধান হয়েছিল।
শুধু শিক্ষক নি, ছাত্ররাও থাকতে চাইত না। আমি সেভেনে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম রোল ৪ আর ৬ খালি, অন্য স্কুলে চলে গেছে। এইটে উঠার পর রোল ১, ৪, ৫ চলে যায় অন্য স্কুলে। নাইনে উঠার পর রোল ১ (আমি) আর ৫ চলে যায়। আব্বুর আরো একটা বছর ওখানে থাকার কথা ছিল, কিন্তু আমাকে কিছুটা ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য আগে আগেই বদলির ব্যবস্থা করেন।

এরপর যেই স্কুলে ভর্তি হলাম সেটাকে কক্সবাজারের সবচেয়ে ভালো বেসরকারি স্কুল বলা হত। একই উপজেলায় সরকারি স্কুলও একটা ছিল। এখানের চিত্রটা ভিন্ন। আমাদের স্কুলটার শিক্ষকরা হাই-কোয়ালিফাইড না হলেও ম্যানেজমেন্টের চেষ্টা থাকত রেজাল্ট ভালো করানোর। আর অন্যদিকে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা ভালো হলেও উনাদের কোনো প্রচেষ্টা ছিলনা ছাত্রদের যথাযথভাবে কোনকিছু শিখানোর ব্যাপারে। ফলাফলস্বরূপ আমাদের স্কুল থেকে ৪০-৫০ টা এ+ থাকলেও সরকারি স্কুলে একটিও নেই। কিন্তু আমাদের স্কুল থেকে আবার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের কাছেই প্রাইভেট পড়তে যেত। এখানে পড়ার সময় ভালো কিছু ক্লাস পেয়েছি, আমার এমন শিক্ষকও পেয়েছি যিনি ক্লাসে গ্রামার বই থেকে রিডিং পড়াতেন, আর যার প্রধান কাজ ছিল কে কে স্কুলড্রেস পড়েনি বা জুতো পরে আসেনি অথবা নীলের জায়গায় কাল রঙের প্যান্ট পড়েছে সেটা বের করা, তারপর সেই দোষে বা অনেকসময় বিনা দোষেই বেত্রাঘাত (বেতের অভাবে ক্লাসরুমের পাশের বাগানের বেড়ার বাঁশ ব্যবহার হত)। কোনো কোনো স্যার ক্লাসের মধ্যেই প্রাইভেট পড়ার কথা বলতেন। শিক্ষকদের রাজনীতি আর প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের দুরবস্থার কথা আর বললাম না... যতদূর জানি ঢাকার স্কুলগুলোতেও এই সমস্যা আছে। এবং এটা ছিল কক্সবাজার জেলায় সবচেয়ে ভালো বেসরকারি স্কুল (রেজাল্টের বিবেচনায়), অন্য স্কুলগুলোর অবস্থাতো বুঝতেই পারছেন।

শিক্ষার মান উন্নয়নে যতই ব্যবস্থা নেওয়া হোক না কেন, ঢাকা বা বড়বড় শহরের বাইরের স্কুলগুলোর ব্যাপারে কারও খুব একটা দৃষ্টি আছে বলে মনে হয়না। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির বাস্তবায়নে ঢাকার নামীদামী স্কুলগুলোর শিক্ষকরাই যেখানে হিমশিম খেয়ে যান, সেখানে উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ের শিক্ষকরা কিভাবে পারবেন? এসব স্কুলের ছাত্ররা অন্যসব সুযোগ সুবিধায় শহরের স্কুলগুলোর ছাত্রদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। অভিভাবকরাও তুলনামূলকভাবে অনেক কম সচেতন হয়ে থাকেন। পরিসংখ্যান জানি না, কিন্তু আমার ধারণা উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ের স্কুলগুলোর ছাত্রসংখ্যা শহরের স্কুলগুলোর ছাত্রসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। ওরা যদি উপযুক্ত শিক্ষা পেত, ওদের সমস্যাগুলো যদি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত, তাহলে ওদের মধ্য থেকেও আমরা হয়ত আরও হাজার নতুন মেধার সন্ধান পেতে পারতাম।

রাফি কামাল


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

আপনার লেখাটা বেশ গোছানো। নিয়মিত লিখুন সচলে।

রাফি কামাল এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি এটাই প্রথম লেখা, আপনাদের সাথে পেলে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করব অবশ্যই হাসি

সাবরির অনিক এর ছবি

উপজেলা কিংবা গ্রাম পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে,শিক্ষকের সমস্যার পাশাপাশি বড় সমস্যা ছাত্রের অভাব,অসচেতন অবিভাবক,শিক্ষাসামগ্রীর অভাব-সর্বোপরি 'স্বপ্ন' এর অভাব!!
এদেরকে স্বপ্ন দেখানোর লোকের বড়ই অভাব!!!

-সাবরির অনিক

হিমু এর ছবি

সম্ভবত আকবর আলী খানের একটা লেখায় পড়েছিলাম, উপজেলা পর্যায়ে নিযুক্ত সরকারী অফিসারদের কাছ থেকে আশা করা হতো, তাঁরা সপরিবারে দেশের একেকটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করার সময় সে এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবকাঠামোটিকেও জোরদার করার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন। কিন্তু বাস্তবতা বোধহয় ভিন্ন, তাঁদের অনেকের পরিবারই বড় শহরে বাস করেন (অবকাঠামোগত সুবিধা পাওয়ার জন্যেই)। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো এঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান আর প্রভাব থেকে কিছুটা বঞ্চিত হয়।

রাফি কামাল এর ছবি

কথাটা অনেকখানিই সত্য। আমার বাবাও সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, অনেক সরকারি কর্মকর্তাকেই দেখেছি প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডী পেরুনোর সাথে সাথেই ছেলেমেয়েদের ভালো পড়াশোনার জন্য পরিবারের সাথে ঢাকায় বা অন্য কোন শহরে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু তাদেরকেও দোষ দেওয়া চলে না, কেইবা চাইবেন সন্তানদের এ ধরণের স্কুলে পড়াতে?

ব্যঙ্গচিত্র  এর ছবি

শুধু উপজেলা না। অন্যান্য জেলার অনেক ভাল স্কুলেও এরকম বেহাল অবস্থা বিদ্যমান। আমি ছিলাম রাজশাহী ল্যাবরেটরিতে, সেখানে কৃষি শিক্ষার এক শিক্ষক ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত গণিত নিতেন। জীববিজ্ঞানের কোন শিক্ষক না থাকায় তার ব্যবহারিক সহ ক্লাস সব কিছু নিতেন এক ভূগোল এর শিক্ষক। সমাজবিজ্ঞান এর শিক্ষক নিতেন ইংরেজি। মন খারাপ

রাফি কামাল এর ছবি

জেলার স্কুলগুলোতেও যদি এই অবস্থা হয় তাহলে তো বলতে হবে অবস্থা খুবই ভয়াবহ মন খারাপ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পোস্টের সাথে সহমত।
শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত চিত্র সব জায়গা সমান পর্যায়ের হওয়া উচিত। ঢাকা ও শহরাঞ্চলে এক চিত্র আর অন্যত্র ভিন্ন চিত্র কাম্য নয়।

রাফি কামাল এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি শহরাঞ্চল এবং বাইরের শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য থাকবেই, তবে সেটা যেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে এটাই প্রত্যাশা...

পথিক পরাণ এর ছবি

মূল বক্তব্যর সাথে একমত।

আমাদের দেশে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় খুব বড় ধরণের বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে সবার অলক্ষ্যে। এক যুগেরও বেশি আগে ঢাকার ভালো কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজে মফঃস্বল থেকে উঠে আসা ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ভালই ছিল। সেই সংখ্যাটি উদ্বেগজনকভাবে কমে আসছে। ঢাকার একটা ভালো কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারলে সে ভালো ছাত্র নয়, এমনটি আমি বলতে চাইছিনা। তবে গ্রাম বা মফস্বল থেকে অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি নেবার প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।

দেশের কিছু মফস্বল এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে আমি আতঙ্কিত হয়েছি। নবম দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র নেই বললেই চলে। একেকটা বিদ্যালয়ে গড়ে ৫ থেকে ১০% ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। বাকি ছেলেমেয়েরা মানবিক অথবা বানিজ্য বিভাগে পড়ছে। পাশ করে বেরুবার পর এরা সবাই নিশ্চয়ই একটা এমএনসি/ ব্যাংকে বা সামাজিক সেক্টরে চাকরি পেতে চাইবে। কিন্তু এধরনের একই যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক শিক্ষিত লোকের চাকুরি দেবার মতন অবস্থা কি এদেশের আছে? বিজ্ঞানে ছাত্র কম কেন- অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুনলাম ছেলেরা বলছে এখন চলমান সৃজনশীল পদ্ধতির বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বেশ কঠিন। এগুলো ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেবার মতন শিক্ষকও নেই।

বিদ্যালয়ের ল্যাবে পরীক্ষণের উপকরণগুলো অযত্নে পড়ে থাকে। বিদ্যালয়ের কম্পিউটারগুলো হয়ত একটা কক্ষে আবদ্ধ, যেখানে মাকড়সা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করে না। অনেক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার শিক্ষক নেই। যেখানে আছেন, সেখানে তিনি হয়ত গনিত বা বাংলা পড়িয়ে থাকেন। ঐ যন্ত্রটি চালু বা বন্ধ করার অধিক জ্ঞান তাঁর নেই।

বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে একটা অতি ক্ষমতাধর কমিটি করা আছে। তবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া, পরীক্ষার ফি আদায় ও আদায়কৃত অর্থ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যালয়ের বৃক্ষ কর্তন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের যে পরিমাণ সজাগ দৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়, শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ে সময়মত আসছেন কিনা, ঠিকঠাক পড়াচ্ছেন কিনা, ছাত্রদের সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা ততটাই উদাসীন।

ব্যতিক্রমও আছে। গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জের শিবরাম আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা মনে পড়ছে। প্রধান শিক্ষক নুরুল আলম একাই তাঁর অনবদ্য নেতৃত্বর গুণে পাড়াগাঁয়ের এই বিদ্যালয়টিকে জাতীয়ভাবে আলোচিত পুরস্কৃত বিদ্যালয়ে পরিণত করেছেন। সদিচ্ছা এখনো ভালো কিছু করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।

----------------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ--

রাফি কামাল এর ছবি

বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সংখ্যা সম্পর্কে বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ সহমত হাসি আমাদের স্কুলে কাউকে বিজ্ঞান বিভাগে যেতে নিরুৎসাহিত করা হত, কারণ উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। শুনেছি ঢাকার অনেক স্কুলেও প্র্যাক্টিকাল ক্লাস ঠিকমত হয়না।

ব্যবস্থাপনা কমিটির সমস্যাটি আসলেই ভয়াবহ। অনেক শিক্ষকই ব্যবস্থাপনা কমিটির সুনজরে পড়ে ভালো পদ পাওয়ার জন্য দলাদলি করেন। আর অনেক ক্ষেত্রেই কমিটিতে এমন অনেক সদস্য থাকেন যাদের শিক্ষা বিষয়ে জ্ঞান খুবই সীমিত।

শিবরাম আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা শুনে ভালো লাগল হাসি

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

লেখার মধ্যে বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। আমার একটা ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি-

আমি নবম থেকে এসএসসি পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ের স্কুলে পড়েছি। স্কুলটি দুইশো বছরের পুরানো এবং ঐতিহ্যবাহী। আমার আম্মার নানাজান এবং আমার নানাজান এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলো এবং আমার বড়মামা ও মেঝোমামা এখানে শিক্ষকতা করেছে। আমাদের সময়ে স্কুলটি এর প্রাক্তন ছাত্র এবং তৎকালীন শিক্ষাসচিব কাজী আজাহার আলীর অনুগ্রহে সরকারীকরণ হয় এবং আমরাই সরকারী স্কুলের প্রথম ব্যাচ।

স্কুলটি যতোদিন বেসরকারী ছিলো ততোদিন এর অবস্থা খুবই ভালো ছিলো। শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাস নিতে হতো, দুর্দান্ত রেজাল্ট হতো প্রতিবছর। ইন্টার স্কুল ফুটবলে, ভলিবলে, বিতর্কে, সাধারন জ্ঞ্যান প্রতিযোগিতায় স্কুলটি চ্যাম্পিয়ন হতো। কিন্তু সরকারী হওয়ার কয়েকবছরের মধ্যেই স্কুলটি শনিগ্রস্থ হয়ে পড়লো।

আমি ২০০৫ সালে আমার আম্মার দাদাজানের নামে প্রদত্ত শিক্ষাবৃত্তির কিছু টাকা পৌঁছে দিতে স্কুলটিতে যাই। গিয়ে দেখি স্কুলটিতে ১৬ জন শিক্ষকের পদে আছে মাত্র পাঁচজন। যাদেরই বদলী হয় এখানে তারাই জয়েন করেই ছুটিতে চলে যায় এবং সেই ছুটি চলতে থাকে অন্যত্র বদলী না হওয়া পর্যন্ত। প্রধানশিক্ষক মহোদয় আমাদের সময়কার শিক্ষক, জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। গ্রামে আমাদের জুনিয়র যেসব ছেলে বেকার ঘুরে বেড়ায়, তাদের কেউ কেউ এসে পড়িয়ে গেলে তবে অনুপস্থিত শিক্ষকদের ক্লাসগুলো হয়। আর ক্রীড়া-সংস্কৃতি- এসব তো চুলোয় গেছে সেই কবে। কিন্তু সেই তুলনায় এলাকার বেসরকারী স্কুলগুলো ভালোই চলছে। আরও অবাক হলাম যে স্কুল কমিটির সভাপতি ইউএনও সাহেব অনুপস্থিত শিক্ষকদের ব্যাপারে ব্যবস্থাগ্রহনের জন্যে মন্ত্রনালয়ে লিখলেও কাজের কাজ কিছুই হয়না। বরং ইউএনও সাহেব অভিযোগ জানালে তাদের বদলিটা বরঞ্চ তরান্বিত হয়।

হিমু আকবর স্যারের যথার্থ কোট করেছে, উপজেলা পর্যায়ের কর্তকর্তাদের সন্তানেরা অধিকাংশই নিকটস্থ জেলাশহরে বা ঢাকায় বসবাস করে থাকে। ফলে তারা উপজেলা পর্যায়ের স্কুলে পড়লে শিক্ষার মানের ব্যাপারে তাদের অভিভাবকদের যে পরিমান মাথাব্যাথা থাকতো, সেটা আর থাকছেনা। খুবই সত্যি কথা এটা।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রাফি কামাল এর ছবি

আমি মনে করি বেসরকারি স্কুলের সাফল্য নির্ভর করে প্রধানত শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের প্রচেষ্টার উপর। কিন্তু বেশীরভাগ সরকারী স্কুলেই শিক্ষকদের প্রবণতা হয় এরকম, ক্লাস যেমনই নেই না কেন, বেতন তো পাচ্ছিই। সরকারী কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও এই প্রবণতা দেখা যায়। অনেক ব্যাতিক্রমও আছে অবশ্য, আমার প্রিয় শিক্ষকদের প্রায় সবাইই ছিলেন সরকারী স্কুলের।

rabbani এর ছবি

আমার তো মনে হয় পুরা বাংলাদেশেই শিক্ষার অবস্থা ভালো না (হয়ত আগেও একই অবস্থা ছিল কিন্তু বুঝতাম না !)।
আমরা গাইড বই পড়া শুরু করেছিলাম সিক্স থেকে, এখন দেখলাম ক্লাস টু এর ভাগ্নে গাইড পড়ে। প্রাইভেট পড়ে সেখানেও শিক্ষক গাইড পড়ান - এই হলো সৃজনশীল শিক্ষার ব্যাপার স্যাপার।
ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষা পাওয়া যায় না, আর ভালো শিক্ষকের বড়ই অভাব

রাফি কামাল এর ছবি

সহমত হাসি
আব্বুর কাছ থেকে শুনেছিলাম উনাদের সময় ভার্সিটি অ্যাডমিশনের আগে কেউ গাইড পড়ত না, এখন তো দেখা যায় ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার জন্যও অনেকে বাসায় টিচার রাখে, স্কুলে স্যাররা নাকি শুধু পড়া দিয়ে দেন, তেমন কিছুই পড়ান না।

কুমার এর ছবি

খবরে প্রকাশ দেশে সরকারি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তিন হাজার ৬৭৭টি, মাধ্যমিকে দুই হাজার ৮২০টি, প্রাথমিকে ছয় হাজার ৬৬৯টি শিক্ষকের পদ শূন্য।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩১৭ টি, শূন্য পদ ২৮২০ টি। জেলা পর্যায়ে শিক্ষকের সংকট মনে হয় ততটা না, উপজেলা পর্যায়ের জন্য এখন অংক কষা যেতে পারে। অবসর জনিত শূন্য পদ পূরণ, পদোন্নতি, অনেকে তদবিরের মাধ্যমে উপজেলা থেকে জেলাতে আসছে, ফলে উপজেলাতে সবসময় একটা শূন্যতা থাকছেই। রাফি ভাইকে ধন্যবাদ এ বিষয়ে লেখার জন্য।

রাফি কামাল এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ হাসি
যেসব শিক্ষকেরা এখন কর্মরত আছেন তারাই যদি সবাই সুযোগ্য হতেন এবং দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যেতেন তাহলেও আমাদের শিক্ষা সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হত।

মেহেদী হাসান খান এর ছবি

স্কুল জীবনে স্যার এর হাতে মার খাওয়ার ভয়ে আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। মন খারাপ

রাফি কামাল এর ছবি

যে স্যারের কথা বললাম প্রায়ই মারধর করতেন, উনার ক্লাস ছিল টিফিনের ঠিক পরের পিরিয়ডে। মার খাওয়ার ভয়ে অনেকে টিফিনের পরে স্কুলেই আসত না।

তোফায়েল মিয়াজী এর ছবি

কুমিল্লা জিলা স্কুলে আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন ওহাব স্যার, তিনি রচনা, ভাব সম্প্রসারণ লিখতে দিয়ে পুরো ক্লাস টাইমেই ঘুমাতেন। ক্লাস শেসের ঘণ্টা বাজলে ইচ্ছে মত মারধর করে চলে যেতেন।

রাফি কামাল এর ছবি

মন খারাপ মন খারাপ

নিবিড় নীল  এর ছবি

সরি, একটু দেরী হয়ে গেল পড়তে, রংপুর ভ্রমণ সংক্রান্ত কার্যাদিতে (!!!) ব্যস্ত ছিলাম, জানিস ই ত! লেখা খুবই ভাল হইসে! কবে যে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে! হাসি
বাই দ্য ওয়ে, আমারও কিন্তু ১০ বছরে ৬টা স্কুল! দেঁতো হাসি

রাফি কামাল এর ছবি

তাই? অ্যাঁ আমি তো ভেবেছিলাম আইডিয়াল স্কুলেই সবসময় পড়ে এসেছিস!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।