নয় ফুল নয় লতা, মাধবী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৪/২০১২ - ১০:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সবুজ-শ্যামলে ঢাকা মাটির কাঁচা রাস্তার এক পাশ ঘেঁষে অজস্র নাম না জানা বুনোফুল, ঝোপঝাড়, পরিচিত ঘাসফুল। তারই মাঝে বাড়ন্ত এক কদম গাছের দীর্ঘ নরম পাতার আড়ালে এক টুনটুনির বাসা। বুনোফুলের সুভাস মাখা ছায়াঘেরা মাটির এই কাঁচা পথটি চলে গেছে দূরের শহরে।

রাস্তার ওপাশে নেমে যেতেই একটি খেলার মাঠ। জল-বৃষ্টি আর কাদায় লুটোপুটি খেয়ে একটি পুরোনো ফুটবল নিয়ে খেলায় মত্ত এক ঝাঁক দুরন্ত বালক।

আকাশে মেঘ গুড়গুড় শব্দে ডেকে উঠছে। অতিকায় দানবের হুংকারে মেঘদেবতা গর্জনে দাপিয়ে যাচ্ছে মাটির পৃথিবীতে। ঝুম বৃষ্টিতে সব কিছুই আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে। বৃষ্টির এক একটি ফোটা তীরের তীক্ষ্ণ ফলার মত আছড়ে পড়ছে দুরন্ত বালকদের উদোম গায়ে। ওদিকে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওদের লক্ষ্য এর-ওর পায়ে লাফিয়ে ছুটে চলা বলের দিকে। জল-কাদার বিশাল আয়োজনে এক একটি বৃষ্টির ফোটা একটি নতুন উদ্যম। ক্লান্তিহীন, ভয়হীন প্রাণে উল্লাস আর চিৎকারে দুরন্ত বালকেরা মাটির পৃথিবী থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দিচ্ছে মেঘদেবতাকে।

মেঘদেবতা ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠছে। ঝড়ো বাতাসে বইতে শুরু করেছে। নদীতে ঢেউয়ের প্রলয় নাচন জেগেছে। গাছ-ডালপালা ভেঙে ভেঙে পড়ছে। দাপটে দরজা-জানালা ভেঙে ঢুকে যেতে চাইছে নিরাপদ আবাসগৃহে। খন্ড খন্ড ডালপালা উড়ে উড়ে এসে আছড়ে পড়ে টিনের চালে। ঝড়ো বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে নিঃসঙ্গ অসহায় বৃদ্ধা নসিমনের ঘুপরি ঘরের একাংশের টিনের চাল। মূহুর্তেই ভিজে গেছে চালের ডালা, খয়েরী রঙের সুতির শাড়ীটা। ডালার আড়ালে সদ্য জন্মানো বিড়াল ছানাও ভিজে একাকার। পানদানিটা উল্টে গিয়ে পড়েছে জল কাদায়।

আযানের ধ্বনি ভেসে ভেসে আসছে। কদম গাছের নরম ডালে বসে ভয়াবহতার রূপ দেখে আতঙ্কিত টুনটুনি দম্পতি। ছোট শিশু টুনটুনিকে ফেলে উড়ে যেতেও পারছেনা। মাতৃস্নেহে মমতার অটুট বন্ধনে ঝাঁপতে ধরে আছে অবুঝ শিশু টুনটুনিকে। বাতাসের দ্রুততায় কদমের ডাল থেকে ছিঁড়ে যেতে চাইছে সবুজ পাতায় টুনটুনির বাসা।

এরই মাঝে দুরন্ত বালকের খেলা থামিয়ে দিয়ে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে মাটির কাঁচা রাস্তার দিকে। পিঠময় খোলা চুলে লাল রঙা শাড়ীতে কাঁদতে কাঁদতে এক কিশোরী ছুটে চলছে, বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে তার পিঠময় খোলা চুল। তখনই মেঘদেবতা আলোর ঝলকানিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে দানবের হাসি হাসে। দুরন্ত বালকেরা এবার ভয় পেয়ে ছুটে যায় বাড়ির পথে।

উতাল-পাথাল এই ঝড়ের দিনে রাজ্যের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে কিশোরী পাড়ি জমায় অজানা অনিশ্চিত কোন ভাসমান জীবনে।

----------------------------------------------------------------------------------------

সেই ছোটবেলা থেকেই প্রচুর গান শুনি আমি। তখন সবেমাত্র গানের কথা উপলব্ধি করতে শিখেছি। একদিন এল.আর.বি-র আনপ্লাগড ফেরারী মন অ্যালবামটা কিনে নিয়ে আসি। মন্ত্রমুগ্ধের মত গানগুলো শুনতে থাকি। তবে একটা গান কেমন যেন এলোমেলো করে দেয় আমাকে। কোমল হৃদয়ে একটা ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই গানটি।

মাধবী। আমার নিজের ভেতরেও একজন মাধবীর বেড়ে উঠে আমারই সাথে সাথে। যতবার এই গানটা শুনি ততবারই নিজের ভেতরের মাধবী আর্তনাদে কেঁদে উঠে। হাহাকারে বুকটা ফেটে যেতে চায়। অস্ফুট চাপা যন্ত্রনায় ঢুকরে কেঁদে উঠে এই মনটা। নিজেকে বোঝাতে পারিনা আমি, কেন এমন হয়?

এল.আর.বি'র ফার্স্ট ডাবল অ্যালবামের একটি হল ‘এল.আর.বি-১/মাধবী(১৯৯২)’। এই অ্যালবামের একটি গানের শিরোনাম 'মাধবী' এবং পরবর্তী সময়ে ফেরারী মন অ্যালবামে গানটি রিকম্পোজ করা হয়।

যারা এই গানটি শুনেছেন বোধকরি আপনারা জানেন যে মাধবী নামের নারীটি ছিল একজন পতিতা (Prostitue!)!! পতিতাবৃত্তির সাথে যেকোন কারণেই আমাদের এই বাংলা মায়ের সন্তানদের কেউ জড়িয়ে যেতে পারে যে কোন ভাবে (জড়াচ্ছে তো!)। পতিতাবৃত্তি --- এটি এমন একটি পেশা যার মাধ্যমে একটি নারী টাকার বিনিময়ে তার দেহ বিক্রি করে। এল.আর.বি-র মাধবী তেমন-ই একজন নারী। হয়ত দারিদ্যের কষাঘাতে শোষিত হয়ে প্রতারক-লম্পট-দালালদের ফাঁদে পা দিয়ে এই বাংলার অনেক অনেক কিশোরী, তরুণী, নারীদের মত 'মাধবী'-ও অজ্ঞাতভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল এই পেশাবৃত্তিতে। আর সেই নষ্ট নারী 'মাধবী'কে নিয়েই এল.আর.বি-র প্রয়াস।

পাঠক-শ্রোতাদের গানটি শোনার অনুরোধ রইল। যদি অতীতে সহস্রবার শুনে থাকেন তবুও আজ লিরিকের সাথে মিলিয়ে গানটি আরো একবার শুনুন। আমি নিশ্চিত আপনি যদি সৃজনশীল ও নান্দনিক একজন শ্রোতা-পাঠক হয়ে থাকেন তবে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়া মাধবী'র জন্য আপনার মানবিক শুভবোধ গুলো জাগ্রত হবে অপরিসীম ভালবাসা ও সহানুভূতি নিয়ে। আপনি যদি সতেচন পাঠক-শ্রোতা ও সমাজকর্মী হয়ে থাকেন হয়ত কোন একদিন কলম ধরবেন বাংলার এমন অজস্র মাধবীদের নিয়ে। কোন শ্রোতা-পাঠক হয়ত নিজের অজান্তের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন মাধবী'র জন্য --- হয়ত সেই দীর্ঘশ্বাসের পরতে পরতে জমে আছে আপনার আমার এক একটি লুকানো ক্ষত।

গান- মাধবী - আইয়ুব বাচ্চু
কথা সংযোজনঃ- আইয়ুব বাচ্চু
সুরবিন্যাসঃ- আইয়ুব বাচ্চু
সঙ্গীতায়োজনঃ- এল.আর.বি
অ্যালবাম- এল.আর.বি -০১/ মাধবী

চোখে সানগ্লাস ঠোঁটে হাসি বাঁকা হাসি, তার সবকিছুতেই
বড় বেশী বাড়াবাড়ি, যে চায় সে পায় মাধবী
নয় ফুল নয়লতা মাধবী মাধবী, সে নষ্টনারী।
রাতের আঁধারে তাকে শুধু দেখা যায়, লাল নীল নানান রঙের গাড়ীতে
দিনের আলোতে তাকে মিশে যেতে দেখা যায়, সবার সাথে সবার সাথে।
কখন কোথায় সে যে কার সে নিজেও তা জানেনা।
সে শুধু জানে দেহের বিনিময় তার খাদ্য চাই, খাদ্য চাই।
যে চায় সে পায় মাধবী মাধবী নয় ফুল নয় লতা মাধবী মাধবী
সে ..................... নষ্টনারী।

তাকে সমাজ সভ্যতা এড়িয়ে চলে, আইনে শিকল তার পেছনে চলে।
ধরা পড়ে ছাড়া পায়, ফিরে আসে আবার, মানুষের কাছে মানুষের কাছে।
নষ্টনারী কেন তারে বলে, সে নিজেও তা জানে না।
সে শুধু জানে দেহের বিনিময়ে খাদ্য চাই, খাদ্য চাই।
যে চায় সে পায় মাধবী মাধবী, নয় ফুল নয় লতা, মাধবী মাধবী
সে ..................... নষ্টনারী।

নষ্ট সে হয়েছে কাদের ঈশারায়, দুঃখ অভাব আর ক্ষুধার জ্বালায়।
নষ্ট পুরুষ সব কাছে চলে আসে, তাদের দুচোখে লোভী দৃষ্টি হাসে।
মাধবী জানেনা, কেমন করে বদলে গেছে সে নষ্টনারীতে।
সংসার শান্তি এই সব কিছুই আর, নিলো না মাধবীকে আপন করে
যে চায় সে পায় মাধবী মাধবী, নয় ফুল নয় লতা, মাধবী মাধবী
সে ..................... নষ্টনারী।

সময়ের আগে তাকে চলে যেতে হয়, প্রাণহীন দেহখানি পৃথিবীতে রয়।
নষ্ট পুরুষ সব তাকে ভুলে যায়, নতুন নষ্টনারী পাওয়ারই আশায়।
মাধবীর মরণ কারো ব্যথা নেই, মরণের কষ্ট মাধবী জানে
মাধবীর দেহখানী ঝঞ্জাট হয়ে, চলে যায় কোন এক অজনায়।
আজ বলি এক সাথে, মাধবী, নয় ফুল নয় লতা, মাধবী মাধবী
সে ..................... নষ্টনারী।

দুঃখ কষ্ট যার ছিল সারি সারি, মাধবী ।।।।
মাধবী, মাধবী, মাধবী, মাধবী..............
সে ..................... নষ্টনারী।

মাধবী গানের লিঙ্ক

---------------------------
মোখলেছুর রহমান সজল


মন্তব্য

ami_bonna এর ছবি

ভাল লেগেছে লেখাটা।

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
ভাল থাকবেন, শুভ কামনা রইল।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

আবার মিউজিক নিয়ে ফিরলেন দেখে ভালো লাগছে। চালিয়ে যাবেন কিন্তু! আমি আইয়ুব বাচ্চুর ভক্ত সেই কৈশোর থেকে। আপনার কি মনে পড়ে বাচ্চুর সেই প্রথম সোলো এ্যালবাম রক্ত গোলাপের কথা যেখানে বাচ্চু মামা নিজেই সেতার/তবলাও বাজিয়েছিলো?

মাধবী আমার অসম্ভব প্রিয় একটা গান। আমরা সবসময়েই মঞ্চে এলআরবির কিছু কিছু গান করতাম। আমার মনে আছে 'গতকাল রাতে' গানটার বেইস লাইন বাজাতে গিয়ে আমার কব্জী এবং আঙুলগুলোর দফারফা হয়ে যেতো। প্রাকটিস প্যাডে তাই আমি এই গানটার সাথে বাজাতাম না, একবারেই স্টেজে মেরে দিতাম।

আর একটা কথা বলি আশাকরি কিছু মনে করবেন না, পতিতা শব্দটা আর ব্যবহার করবেন না দয়াকরে। তার স্থলে যৌনকর্মী বা সেক্সওয়ার্কার শব্দটা ব্যবহার করুন। যৌনসেবা আজ পৃথিবীতে একটা স্বীকৃত পেশা এবং কোথাও কোথাও যৌনকর্মীরা সরকারকে আয়কর দিয়ে থাকে।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

ধন্যবাদ ভাইয়া।

মিউজিক আমার ধ্যান। আর অল্প জ্ঞান যা আছে তাও এখানেই। তাই ফিরে যাবার অবকাশ নেই। দেঁতো হাসি

এবি সবকিছুতেই উস্তাদ মানুষ। মানুষ হিসেবে আমার খুব প্রিয়দের একজন। রক্ত গোলাপ অ্যালবামটি শুনেছি। তবে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে অ্যালবামটা শোনা হয়না। সিডিশপে অনেক খুঁজেছি, পাইনি কোথাও। ২০০০ এর দিকে সুন্দরী গানের মিউজিক ভিডিওতে দেখেছি ড্রামস বাজিয়ে গান করছে ! ! !

১৯৯৩ তে প্রকাশিত সুখ অ্যালবামের প্রথম গান 'গতকাল রাতে'। গীতিকার বাপ্পী খান। এই গান সম্পর্কেও আলাদা কিছু বলার নাই। তবুও বলিঃ এই গানের উপলব্ধি ও দর্শন অনেক উচু স্তরের। এ কোন কালের গান নয়। স্থান, কাল নির্বিশেষে বলা যায় এটি একটি কালোত্তীর্ণ গান। আমি মাঝে মাঝে নিজের মনে হেরে গলায় গেয়ে উঠি। পারিনা স্কেল ধরে গাইতে। এ আমার কাছে অসম্ভব ব্যাপার।

আপনার স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা শেয়ার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এখন গান করেন না কেন?

গতকাল রাতে, বিবেক আমার
স্বপ্নের কড়া নেড়ে করলো জিজ্ঞেস
আমায় ছাড়া আর কতদিন রবে?

গতকাল রাতে/এবি-এলআরবি(সুখ)

যৌনকর্মী শব্দটা ব্যবহার করাই উত্তম হত। যাই হোক, শুধরে নিলাম নিজেকে।

ভাল থাকবেন, এই শুভকামনা।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

চলুক

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।