স্বপ্নযাপনঃ সূচনা পর্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৭/০৬/২০১২ - ৮:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যেকোনো বিশেষজ্ঞের কাছে যান এবং জিজ্ঞেস করুন স্বপ্নের দৈর্ঘ্য কতক্ষণ? তিনি হয়তো বলবেন বড়জোর কয়েক সেকেন্ড। এখনি উনার কথা ঠিক ধরে নেবেন না। আপনাকে আরও একটু কষ্ট করতে হবে। আপনাকে পৌঁছাতে হবে পলাশীতে। পলাশীর প্রান্তরে না অবশ্য, ঢাকাস্থ আজিমপুরের পলাশীতে। সেখানে আছে একটা বিশ্ববিদ্যালয় যার মূল ফটক দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে আপনি হয়তো দেখবেন কিছু ছেলে মেয়ে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে হেঁটে আসছে; হয়তো সকাল আটটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস আর ল্যাব করে পর্যুদস্ত অথবা ক্লাস টেস্টে কপালে জুটেছে একটা অশ্বডিম্ব। তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন স্বপ্নের দৈর্ঘ্য কতক্ষণ; ক্লান্তি-মাখা মুখগুলোতে ফুটে উঠবে একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা। তারা বলবে স্বপ্নের দৈর্ঘ্য হচ্ছে পুরো বুয়েট জীবন।

মানুষ হিসেবে সবার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে স্মৃতিশক্তির কমজোরি। মাঝে মাঝে স্কুল, কলেজের বন্ধুরা এমন কিছু স্মৃতি রোমন্থন করে যেখানে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অথচ বেমালুম ভুলে বসে আছি। এখন যে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, ঠিক জানি সে স্বপ্নের অনেকটুকুই হয়তো ভুলে যাব সময়ের সাথে তাল মেলাতে যেয়ে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা ভুলে যাওয়ার মতো অন্যায় করা সমীচীন হবে না ভেবে ঠিক করলাম কিছু কিছু করে লিখে রাখব এই অদ্ভুত মায়াবী ঘোরলাগা সময়ের কথা। জীবন যখন খুব অর্থহীন মনে হবে তখন ফিরে ফিরে আসব এইসব স্মৃতির কাছে আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলব একদিন আমারও জীবন ছিল।

স্বপ্ন দেখার জন্য আপনাকে প্রথমে বিছানা পর্যন্ত যাত্রা করতে হবে, তাই আজ লিখতে চাই এই স্বপ্ন-তরীতে অংশ নেয়ার যাত্রার কথা। তখন বড়জোর সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। ভালো ছাত্র হিসেবে আস্তে আস্তে একটা অবস্থানও তৈরি হচ্ছে। মতামত চাপিয়ে না দিলেও মধ্যবিত্ত বাবা-মা, সন্তান প্রকৌশলী বা চিকিৎসক হলেই যে বেশী তৃপ্ত হবেন তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। বুয়েটের কথা প্রথম শুনলাম ঐ বয়সটাতেই। দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা নাকি ঐখানে পড়ে। তার মানে ঐখানে পড়তে পারলে আমাকেও সবাই মেধাবী ভাববে এই প্রলোভনটাই আমার কিশোর মনকে আকর্ষিত করে থাকবে বলে মনে হয়। আর চিকিৎসক হতে হলে অনেক বেশী পড়াশোনা করতে হবে এই আতঙ্কটাও আমার বুয়েটে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। স্বীকার করতে কোন লজ্জা নেই যে, আমি আসলেই কি হতে চাই, সেটা না বুঝেই, শুধু ভালো ছাত্র হিসেবে অবস্থান পাকাপাকি করতে আর কম খাটুনির লোভেই বুয়েট আমার লক্ষ্যে পরিণত হয়। যদিও পরবর্তীতে দু'টি আশার কোনটাই পূরণ হয় নি।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে যথারীতি ভর্তি হয়ে গেলাম বুয়েট ভর্তি কোচিং এ। প্রথম ক্লাসের কথা ভুলতে পারি না। বুয়েটের একজন ভাইয়া এসেছিলেন ক্লাস নিতে। কি তার কথার মাধুর্য আর কি তার বুঝানোর দক্ষতা। উনি ভেক্টর শেখানোর পরে মনে হল, ধুর! গত দুই বছরে তো কিছুই শিখি নি। ক্লাস শেষে তিনি আমাদের কাছে রীতিমতো তারকা। তার সবকিছুর মাঝেই তখন অর্থবহতা খুঁজে পাই। ক্লাস শেষে তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন, সেই দৃশ্য দেখেও চিরকাল সিগারেট-বিমুখ এই আমারও মনে হল, বাহ! সিগারেট খাওয়া জিনিসটা এতো সুন্দর হতে পারে? তবে বুয়েটে সুযোগ পাওয়ার পরে দেখলাম কোচিং এর সেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাদুবাস্তব কক্ষে যে ভাইকে বাঘ মনে হয়েছিল বুয়েটের প্রাণঘাতী পাঠ্যসূচীর দংশনে তিনি বিড়াল হয়ে গেছেন। কয়েকটি বিষয়ে প্রথমবারে উত্তীর্ণ হতে না পেরে এখন এককালে তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ছিল, এমন অনেকের সাথে আবার ক্লাস করছেন। মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ।

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় আমার সিট পরেছিল ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিং যা ও এ বি নামেই বেশী আলোচিত এবং সমালোচিত। সমালোচিত কারণ বিগ ব্যাং যুগের এই ভবনটি একটি মূর্তিমান গোলকধাঁধা। এর ঘুলঘুলিতে একবারও খেই হারিয়ে ফেলে নি এমন বুয়েটিয়ান খোঁজা, শাকিব খানের পৌরুষ খোঁজার মতোই নিষ্ফল কর্ম হবে। সুতরাং পরীক্ষার হল পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ একটা হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল। একটা মজার এবং কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে আমার বুয়েট জীবনের প্রথম ক্লাসটাও ঠিক সেই রুমেই হয়েছিল যেই রুমে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ক্লাস করতে যেয়ে দেখি, আমার ভর্তি পরীক্ষার রোল নাম্বারটা এখনো একটা বেঞ্চির শোভা বর্ধন করছে।

পরীক্ষা দিয়ে বুয়েটে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে একটা আত্মবিশ্বাস যদিওবা তৈরি হয়েছিল কিন্তু সুযোগ পাব কি পাব না এই দুশ্চিন্তা একেবারে সরিয়ে রাখার মতো মহামানব আমি কোনদিনই ছিলাম না। তারপর দুশ্চিন্তায় প্রলম্বিত দীর্ঘ কিছু দিন আর দীর্ঘ কিছু রাতের অবসানে একদিন এক রাত এলো। এক বড় ভাইয়ের মারফতে জানতে পারলাম সুযোগ পেয়েছি চার বছর(বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন) ধরে একটা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাওয়ার। প্রকাশ করতে যদিও একটু সংকোচ বোধ করছি কিন্তু সত্য কথা হল বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার মেধা-ক্রম আকাঙ্ক্ষার সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, ফলাফল জানার পর আশাভঙ্গের বেদনায় শিশুর মতো কেঁদেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। এখন অবশ্য সেই ছেলেমানুষি কন্নাকাটির কথা চিন্তা করলে হেসে নেই একচোট আর বুয়েট জীবনের প্রাপ্তিগুলোর কথা জাবর কেটে মনে মনে বলি,

“যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই”

(হয়তো চলবে...)

# হিল্লোল


মন্তব্য

অমি_বন্যা এর ছবি

স্মৃতিচারণ অনেক ভালো লাগলো। ফেলে আসা দিনগুলো আসলেই এমন প্রায়শই নাড়া দিয়ে যায়।
আপনার মঙ্গল কামনা করছি। ভালো থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার ভালো লেগেছে জেনে এবং শুভকামনার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

হিল্লোল

শিশির এর ছবি

চলবে----এর আগে হয়তো কেন?

ভাল পাইলাম। চাল্লু

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার লেখালেখির কোন ধারাবাহিকতা নাই। এইজন্য হয়তো

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

হিল্লোল

ফারহানা এর ছবি

০৭ ব্যাচ?

অতিথি লেখক এর ছবি

নাহ! ০৮ ব্যাচ।

ইশতিয়াক এর ছবি

হিল্লোল লেখা ভালো লেগেছে বিশেষ করে প্রথম দুই অনুচ্ছেদ এক কথায় অসাধারন। তবে শুধু বুয়েট লাইফকেই স্বপ্নের দৈর্ঘ্য হিসেবে ডিফাইন করা যায়না, এটা কেবল অংশমাত্র।
লেখা চলুক। হয়তো কেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

ঐটা আসলে বুয়েট নিয়ে বুয়েটিয়ানদের আবেগের মাত্রাটা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করছি।
হয়তো কারণ আমার লেখালেখির কোন ধারাবাহিকতা নাই। চেষ্টা থাকবে

ইশতিয়াক এর ছবি

না আপনার লেখা অনেক পরিপক্ক এবং ধারাবাহিক। আমি আসলে বলার চেষ্টা করেছি, বড় দৃষ্টিকোন থেকে যেখানে মানুষের স্বপ্নের পরিসীমা অনেক ব্যপক অনেক ক্ষেত্রে অসীম।বুয়েট বা যেকারো প্রতিষ্ঠান নিয়ে তার আবেগ ঐ স্বপ্নের একটা অংশ মাত্র, পূরোটা না। কারন বুয়েট জীবন শেষে দেখবেন স্বপ্নের নতুন মাত্রা আসবে, আসবে নতুন দৈর্ঘ্য।

বুয়েট নিয়ে আবেগের মাত্রা আমি ভালোমতই বুঝি কারন আমিও একই আবেগ অনুভব করি আপনার মত বুয়েটের জন্য। হাসি

নিঃসঙ্গ পৃথিবী এর ছবি

ওএবি তে এখনো যখনি যাই, মনে চিন্তা থাকে ঠিক পথে এলাম কিনা!
আপনার লেখার ধরণ খুবই সুন্দর। চালিয়ে যান। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ও এ বি তো চিরছলনাময়ী।
উৎসাহের জন্য ধন্যবাদ।

হিল্লোল

কৌস্তুভ এর ছবি

বেশ লাগল পড়তে। এইসব 'হয়তো চলবে' এস্টাইল বাদ্দিয়ে সটান লিখতে থাকেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অবশ্যই চেষ্টা থাকবে। ধন্যবাদ

হিল্লোল

সজল এর ছবি

OAB হচ্ছে বুয়েটের এক্সপ্লিসিট মডেল। হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি প্রথমটাতে কয়েক মিনিটের মাঝেই টের পাওয়া যায়, দ্বিতীয়টা চার/পাঁচ বছর ধরে টের পেতে হয়।

লেখা চলুক।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ বলেছেন।
ধন্যবাদ

হিল্লোল

শিশিরকণা এর ছবি

বিগ ব্যাং যুগের এই ভবনটি একটি মূর্তিমান গোলকধাঁধা।

- ও এ বির ছাদে উঠো সুযোগ পাইলে। পুরা থ্রি ডাইমেনশনাল গোলকধাঁধা। অতি ফেভারিট জায়গা। গম্বুজের নিচে যে বড় সিড়িটা আছে, তার আশে পাশে কই জানি আরেকটা সিড়ি বেয়ে আধা তলা উঠলে একটা গ্রিল দেয়া দরজা আছে, মাঝে মাঝে সেতাতে তালা লাগাতে ভুলে যায় দারোয়ানেরা।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অতিথি লেখক এর ছবি

ও এ বির দুইতলাটা সবচেয়ে রহস্যময়। আমি এজন্য সবসময় কারও সাথে সাথে থাকতাম যাতে হারায় না যাই। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

হিল্লোল

শিশিরকণা এর ছবি

উহু উহু! ছাদের কথা হচ্ছে। দুইতলার উপরে তিন তলা বলে কিছু নাই, দোতলার এক একটা রুমের ছাদ এক এক হাইটে। আবার পানির অনেকগুলা পানির টাঙ্কি, কি লফট এর মতো আছে। খুবই রহস্যময় জায়গা। আমি জুনিয়র পাইলেই বলি দেখে আসতে , এখন পর্যন্ত কেউ ঘুরে এসে রিপোর্ট ব্যাক করলো না। মন খারাপ

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

টিউলিপ এর ছবি

আমি দেখেছি, পুরাই সাইফাই মুভির মত লাগে। দোতলায় রুমও একেকটা একেক হাইটে আছে, আমাদের এক ম্যাথের স্যারের রুম খুঁজতে গিয়ে দেখি দোতলার রুমে এক্সট্রা কয়েকধাপ উঠতে হয়, সেইরকম চিপা।

ওএবি খুব মিস করি।

___________________

রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আপনার লেখার হাত খুব ভাল।
হয়তো বললে চলবে না।
চলতেই হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ উৎসাহের জন্য।

অবশ্যই চালানোর চেষ্টা থাকবে।

হিল্লোল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।