মানবতাবাদীর ডাইরীর পাতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৯/০৬/২০১২ - ৬:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত কয়েকদিন খুব ভাল ছিলাম। নিজের মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিলাম বেশ। প্রায়ই সবাই বলতো বাংলাদেশ হল অমানুষদের জায়গা। বাংলাদেশের সব লোক দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ফেসবুকে-ব্লগে-পত্রপত্রিকায় আমি শুধুই মানুষ দেখছিলাম। অনেক মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ। সবাই মানবতাবোধে ভর্তি উপচে পড়া ভালবাসা দেখাচ্ছিল- ঠিক আমার মত। আজকালকার দিনে আমাদের অবশ্য প্রায়ই ভেক ধরে থাকতে হয়- কখন নাহলে আবার ছাগু-রামছাগল-জামায়াত-সুশীল এইসব গালি শুনতে হয়। কিন্তু এইবার অনেকেই মুখ খুলেছে- আমরা আমাদের আরও ভালমত চিনতে পেরেছি। কয়েকজনকে ভাবতাম এন্টিজামায়াত, কিন্তু তারা যে আসলে ছুপা রুস্তম সেটাও বুঝতে পেরে খুব ভাল লেগেছে। ওইযে কিছু কিছু লোক বলে না, "লেঞ্জা ইজ এ টাফ থিং টু হাইড"! একদিন হবে, একদিন এই দেশ পাকিস্তান হবেই হবে। মায়ানমারে সরকার-গণতন্ত্রের অগ্নিকন্যা সমর্থিত রাখাইন বৌদ্ধরা আমাদের প্রিয় ভাই রোহিঙ্গাদের মেরে ফেলেছিল। সরকারি হিসাবে দুই পক্ষের প্রায় নব্বই থেকে একশ জন মারা গিয়েছিল। আসল সংখ্যাটা অনেক বেশি যদিও। কিন্তু আমাদের দেশের জালিম-নাস্তিকরা আমাদের মুসলমান ভাই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠাঁই দিতে চায় নাই। ওরা বুঝতে চায় না, রোহিঙ্গারা মুসলমান-তারা আমাদের আপন জন। তাদেরকে আমরা দাওয়াত দিয়ে বাংলাদেশে ঠাঁই দেয়া উচিত।

পাঁচ লাখকে যখন আমরা আগে আশ্রয় দিয়েছি তখন আরো পাঁচ লাখ দিলে কীইবা হতো? খোদা মুখ দিলে খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিতো। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নাকি বছরে ১.৫৭%; ছিঃ! দিনদিন আমাদের লোক কমতেছে। বেশরীয়তি ভাবে আমাদের জনসংখ্যা কমানোর জন্য এগুলো আমেরিকার-ইহুদি-নাছারাদের চাল। ১৫ কোটি লোক ধরলে প্রতি বছর বাড়ে প্রায় ২৪ লাখ লোক; এদের আশ্রয় দিলে আমাদের হারটা কত বাড়তো? ১.৯% এর কাছাকাছি- জনসংখ্যা বাড়তো এ বছরে ২৯ লাখ। আর রোহিঙ্গারা আমাদের মত বেশরীয়তি না। ওরা বাংলাদেশে ঢুকলে প্রতি বছর বাচ্চা জন্ম দেয়ঃ দুই বছরে ডাবল হয়ে যেত ওরা। ওদের কত কাজে লাগানো যেতো! বিদেশে পাঠিয়ে নানারকম কাজ করিয়ে ঐ জালিমদের নাম ফেলে শিক্ষা দেয়া যেতো। দেশের ভিতর জালিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-সাহায্য দিয়ে অনেক কাজ করানো যেতো। বছর বছর আমাদের ভোট বাড়তো। রোহিঙ্গাদের নাম করে বিদেশ থেকে অনেক টাকা এনে জিহাদী বানানো যেতো। আমাদের মত মানুষদের অনেক উন্নতি করা যেতো। আমাদের প্রিয় বড় ভাই পাকিস্তানীরা আর সোউদি ভাইরা আমাদের অনেক টাকা-অস্ত্র-ট্রেনিং দিতো- আমাদের ইজ্জতই বেড়ে যেত। আর রোহিঙ্গাদের দিয়ে মালাউনদের দেশে বা মায়ানমারের ভেতরে ঢুকিয়ে অনেক কাজ করানো যেত। আর তাছাড়া এইবার আমরা সাথে পেয়েছিলাম দেশের সকল মমিনদের। আরও পেয়েছিলাম কম্যুনিস্টদের। ওরা এইবার আমাদের দলে- ঠিক একাত্তরের গন্ডগোলের সময়ের মত। অবশ্য মাঝে মাঝেই ওরা না বুঝেই আমাদের সাথে সুর মেলায়। আর সবচেয়ে বড় কথা এইবার প্রথম জাফর ইকবাল আমাদের পক্ষে কথা বলেছেন। উনাকে আমরা কেউ পছন্দ করি না, সময় মত উনারে একটা সাইজ দিতে হবে, কিন্তু উনার সেই পোস্ট আমরা প্রত্যেকে দুই-তিনবার করে শেয়ার দিয়েছি। আমাদের ভাড়াটে ব্লগার-পত্রিকাওয়ালা-বুদ্ধিজীবিরা প্রাণভরে আমাদের সমর্থন দিয়েছে।

আর তাছাড়া একাত্তরে ইন্ডিয়া আমাদের কে সাহায্য দেয় নাই? আমরা ঐদেশে গিয়ে ছিলাম না? যদিও ইন্ডিয়া আমাদের জাত শত্রু কিন্তু এইবার তাদের কথা বলে আমরা ব্যাপক সহানুভূতি পেয়েছি। শুধু কিছু নাছোড়বান্দা জালিম আজাইরা কথা বলে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছিল- তারা জালিম সরকারের পক্ষে বলছিল খালি। আমরা অবশ্য ঐসব কথার একটাও জবাব দেই নি। ওরা বলছিল, মানবতার দিক দিয়ে দেখলে অবশ্যই আমাদের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া উচিত কিন্তু...! ঐ 'কিন্তু'টাই গোলমাল পাকাচ্ছিল। ঐসব কিন্তুকে আমরা পাত্তা দেই নি। শুধু বলেছি, "মেক লাভ, নট ওয়ার"। ওরা আমাদের ভাই, ওদের আশ্রয় দিতে হবে। তখন ঐ হারামীর দল বলে কিনা, আমাদের ঘরে এনে আশ্রয় দিতে! বলে, কক্সবাজার-পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকদের মতামত নিতে, বলে সেনাবাহিনীর মতামত নিতে, বলে বিদেশে বাংলাদেশী কর্মীদের মতামত নিতে। কেউ কেউ আবার প্রশ্ন করে আমাদের দেশে যেসব বস্তিবাসী-না খাওয়া ভুখা-নাঙ্গার দল আছে তাদের আমরা কেন বাসায় এনে তুলি না? তাদের কেন সাহায্য করি না? আরে আজব! তাদের সাহায্য করলে আমাদের কী লাভ? ওদের আমরা কেন আশ্রয় দিব? সব করা উচিত সরকারের। সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা, তাদের ঘর বানিয়ে দেয়া- তাদের দেখিয়ে আমাদের এনজিওগুলা কত টাকা কামাই করা যেত সেই খেয়াল আছে? এই জালিম সরকার কিচ্ছু করেনি রোহিঙ্গাদের জন্য! সরকার তাহলে আছে কী করতে? আবার কেউ কেউ বললো, আমরা কেন রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য দেই না, টাকা দেই না! আমরা কেন দিব? আমাদের কোন ঠেকা? এইটা কি আমাদের দায়িত্ব? আমরা শুধু ফেসবুকে-ব্লগে-পত্রিকাতে বলবো কী করতে হবে- কী করলে আমাদের-আমাদের দলের লাভ হবে। করার দায়িত্ব সরকার আর অন্যদের। আর তাছাড়া আমেরিকা বলেছে রোহিঙ্গাদের সাহায্য দিতে, এমনেস্টি বলেছে তাদের আশ্রয় দিতে। সোজা কথা? ওরা যখন বলেছে তখন কী দেয়া উচিত ছিলনা? বর্ডার খুলে দিলে তখন লাখে লাখে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতো। আমাদের দলের কত লাভ হতো। মায়ানমারও শান্তি পেত- ওরাতো বলেই, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী! তাহলে বাধা কেন?

আবার কেউ কেউ আরো একধাপ উপরে গিয়ে বলে, রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে আমরা যদি তাদের জন্য এত কাঁদি, তাহলে একাত্তরে নাকি আমাদের বড় ভাইরা অত্যাচার করেছিল- তখন আমরা কোথায় ছিলাম? বাংলাদেশীরাওতো মুসলমানই ছিল! এইটা কোন কথা হলো? তখন ছিল ভিন্ন সময়- ইন্ডিয়ার দালালেরা পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাইছিল। তাদেরকেই একটু টাইট দেয়ার জন্য ওইরকম করতে বাধ্য হয়েছিল ওরা। আর হাজার হোক ওরা আমাদের বড় ভাই- ওরা আমাদের একটু শাসনতো করতেই পারে! আর শেখ মুজিব আর মুক্তিযোদ্ধারা যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-নেমকহারামী করেছিল সেইটাতো ঠিক! নাকি?

যাই হোক, যদিও আমাদের দাবী সরকার মানেনি, কিন্তু আমরা একজোট হয়েছি সেটাই বড় কথা! অনেক ছুপা রুস্তমকে দলে পেয়ে ভাল লাগছে।

এখন দেশে বন্যা হচ্ছে। শ'য়ে শ'য়ে লোক মারা যাচ্ছে- পাহাড় ধ্বসেই অনেক লোক মারা গেল। এখন সেই বেয়াদবের দল বলে, মানবতাবাদীরা কোথায়? আমরা কেন বন্যার্তদের সাহায্য করছি না? আমরা কেন ব্লগে-ফেসবুকে-পত্রিকায় একটা, নিদেনপক্ষে একটা লেখাও লিখছি না ওদের জন্য! আরে এদের জন্য করে আমাদের কী লাভ? ওরা মরলেই তো ভাল। আমাদের তো কোন লোকসান নাই। তাই আমরা কেউ এই বিষয়ে একটা কথাও বলছি না এখন। কেউ কেউ বলছে ত্রাণ পাঠাতে-সাহায্য-টাকা দিতে। আরে যারা মরছে তারা কী মানুষ নাকী? হয়তো সবাই মুসলমানও না। তাছাড়া আমাদের গডফাদার সোউদিরা-পাকিস্তানী ভাইয়েরা তো আমাদের বলেনি এদের সাহায্য করতে। প্রায়ই দেখি এই মানবতাবিরোধী দল আমাদের কথা শোনাচ্ছে। আরে এখন আমরা ব্যস্ত ইউরো নিয়ে, ব্যস্ত বাজেট নিয়ে, ব্যস্ততার আমাদের সীমা আছে! আমরা, আমাদের দল, আমাদের সমর্থকরা সবাই এখন ব্যস্ত অন্য কাজে। এই বিষয়ে টাইম দেয়ার সময় কই? যাদের দরকার তারা সাহায্য করুক। আমরা কোরআন-হাদিসের বাণী পোস্ট করি, চীনে মেয়েদের পর্দা করতে বলছে সেই পোস্ট করি, জার্মানিতে সুন্নতে খৎনা করা নাকি ব্যানড করতেছে ঐসব নিয়ে আলোচনা-প্রতিবাদ করি, হটি-নটি পেজের ফটোতে লাইক মারি, সোশালক্যাম-ডেইলি মোশনে বেলেহাজ মেয়েদের কার্যকলাপ দেখি, কীভাবে রমজানে তারাবী খতম-কোরআন খতম দেয়া যায় সেইটা পোস্ট করি, আর তাছাড়া ইউরো নিয়েও অনেক ব্যস্ত আছি। এইসব বন্যা-টন্যা টাইপের ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর আমাদের দরকার বা ইচ্ছা কোনটাই নাই। বন্যাটা যদি পাকিস্তানে হইতো তাইলে একটা কথা ছিল। গত বছর পাকিস্তানে যখন বন্যা হলো তখন আমরা চাঁদা তুলে অনেক টাকা পাঠিয়েছিলাম। বাংলাদেশ বন্যার দেশ- গরীবের দেশ, বন্যাতো রেগুলারই হয় -এরা এমনেই মরবে। এইখানে মানবতা দেখানোর কোন স্কোপইতো নাই!

-নির্বোধ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

সৌরভ কবীর

অচল এর ছবি

গুরু গুরু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।