প্রস্থান-প্রথম পর্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২২/০৭/২০১২ - ২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রস্থান
সাদ মাহবুব

প্রথম পর্ব

১.
পশ্চিমাকাশ সূর্যহীন। হালকা লাল কমলা আভা। উর্ধ্বমুখে আকাশ পানে তাকালে নীল আকাশের পটে ধরা পড়ে ছোট ছোট কালো রঙ্গের পাখির ঝাঁক। অনেক উপর দিয়ে অস্থিরভাবে উড়ছে। কিচির মিচির তীব্র শব্দ তুলে ঘরে ফিরছে তারা। আজকের দিনের জন্য সব কাজ শেষ। নীড়ে ফিরে চোখ বুজবে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

বিশাল মাঠের সবুজ ঘাসের কার্পেটে পোকামাকড় গুলো তাদের উৎসব শুরু করেছে। তাদের দিন শুরু। যেসব ছেলে মেয়েরা এখনও খেলছে মাঠে, তাদের নরম ত্বকে হুল ফোটাচ্ছে তারা। তাদের জায়গা এবার তাদের জন্য ছেড়ে দিতে বলা হচ্ছে। রাতের আগমন বার্তা জানানোর জন্যই হয়ত নাম না জানা কোনো এক পোকার দল তীব্রস্বরে একত্রে রব তুলেছে। কিন্তু মন দিয়ে না শুনলে তা আবার শোনা যায় না। তাদের স্বর, পাখির কলরব আর মাঠে ছেলেমেয়েদের তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করবার অস্থির তাগাদার চিৎকারে সব শব্দ যেন মিলেমিশে একাকার।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

এই অন্যরকম সংকর শব্দ প্রতিদিন এই সময়টায় সন্ধ্যার আগমনবার্তা জানায়। মাঠের মাঝে কিশোরদের দল আর মাঠের কোণায় শিশুদের খেলা চলছে। আর আরও ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের ছোট হাতে বাবা অথবা মা’র একটি আঙুল ধরে হাঁটছে। কিন্তু সবার মাঝ কেমন যেন তাড়াহুড়া। কারণ দিনের আলো নিভে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত- এই ক্ষুদ্র সময়ের সন্ধ্যা শেষে আঁধার নেমে এল পৃথিবীর বুকে। কিশোর কিশোরীরা পড়তে বসে গেছে। বাসার গৃহীনি রান্না চড়িয়েছে চুলায়। বাসার কর্তা সংবাদপত্র রিভিশন দিতে দিতে অপেক্ষা করছে আটটার সংবাদের জন্য। ছো্‌ট্ট শিশুরা অকারণ আবদার নিয়ে বাবার কোলে অথবা কর্মরত মায়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে আর এ সময় কাজ শেষ বাড়ি ফিরছে রাকিব।

রাকিবের বয়স ১০। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরছে সে। ঘরে শুধু মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাসা বেশ দূরে। বেবী ট্যাক্সি ধরতে হবে অথবা বাস পাওয়া গেলে সেটাও ধার যায়। ক্ষিধে পেয়েছে প্রচন্ড, যেটা আগে পাবে সেটাই ধরবে।

বেবী ট্যাক্সি পাওয়া গেল। পিছনের তিন সিটে তিনজন মানুষ এবং ড্রাইভারের পাশের সিটে একজন বসা। আরেকজন বসতে পারবে ড্রাইভারের পাশে। ড্রাইভার তাই যাত্রী ডাকছে। রাকিব গিয়ে বলল, নোয়াপাড়া কত লইবা ?
- আট আনা।
- এ্যাহ ! চার আনা দিমু, যাইবা ?
-নাহ!
- ক্যান যাইবানা ? কতই বা দূর ? সবার সাথে ব্যাবসা, না ?
১০ বছরের ছেলের মুখে এমন কথা শুনে যাত্রী চার জন হেসে দিল। সাথে ড্রাইভারও। জীবন সংগ্রামে যে এই বয়সেই ছোট ছেলেটি এত পটু হয়ে উঠেছে তা দেখে সবার মনে সহানুভূতি জাগল। ড্রাইভার হেসে বলল, আচ্ছা ওঠ।
হাতের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল রাকিব। ছোট হাত দিয়ে যতটুকু সম্ভব অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল ট্যাক্সির রড। পিছনে বসা এক যাত্রী বলল, এত রাতে একা একা শহরে কি করিস তুই ?
দায়সাড়া ভাবে জবাব দিল রাকিব, এত রাত কই ? কেবল না আটটা বাজে।
এতটুকু ছেলের গম্ভীর মুখে একথা শুনে সবাই হেসে উঠল। আবার রাকিব বলে চলল, কাম শেষে বাড়ি যাইতেছি।
আরেক যাত্রী বলল, এই বয়সেই কাম করতেছিস ?
- তো কাম করতে হইবনা ? ভাত আইবো কোথা থেইক্যা ? বাপ ভাগছে না মরছে জানিনা।
কেউ এবার আর হাসলনা। একজন বলল, স্কুলে যাসনি কখনও ?
- কেলাশ থিরি পর্যন্ত পড়ছিলাম। গতবছর ছাইড়া দিলাম স্কুল। পোষায় না।
- তোরে কাম দেয় কেউ ?
- কাম দেয়, পয়সা দেবার চায়না ........... আমিও ঝাড়ি লই। পয়সা দিবিনা মানে ? খাইটা কামাইতেছিনা ! খপ কইরা ধরি। কন্ট্রাকটর দেয় তারপর কিছু টাকা। তাও পুরা না ..... চইলা যায়।
- সেটা তোরে দেখেই বোঝা যায় যে, তুই সহজে ছাড়ার জিনিস না।
সবাই হাসল। রাকিব আবার বলল, তুমি যদি চুপ কইরা থাক, কেউ তোমার দিকে তাকাব না। চিল্লাইয়া নিজের ভাগ আদায় কইরা লইতে হইব।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গুলোকে এভাবে উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে রাকিবের কথায় সবাই বেশ মজা পেল। একজন মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমরা সেটা জানি রে, কিন্তু তুই বড় তাড়াতাড়ি-ই জেনে গেলি।
সবার জন্য এটা পুরান তত্ত্ব হলেও রাকিবের নতুন আবিষ্কার, তাই কথাটা বলে বেশ তৃপ্ত দেখাল তাকে। বাকি রাস্তা আর তেমন কোন কথাবার্তা হলনা।

বাসার কাছাকাছি আসতে রাকিব দেখল, এক অপরিচিত লোক তাদের বাসা থেকে বের হচ্ছে। বাসায় ঢুকে মা’কে জিজ্ঞাসা করল, এ মা, এ লোকটা কে রে ?
- আমার দূর সম্পর্কের ভাই, তোর মামা।
- ও আচ্ছা, কিন্তু আগে তো দেখিনি ... ... ... যাহোক, ভাত দে, ক্ষিধা পাইছে।
খেতে বসে অবাক-ই হল রাকিব। খাবারের মেন্যু বেশ ভাল। বিস্মিত রাকিব জিজ্ঞাসা করল, আরেব্বাবা ! এত খাবার পা’লি কই রে মা ?
মৃদু হেসে জুলেখা বলল, খা বাপ ! পেট ভইর্যাত খা।
- আয় মা, একসাথে খাই।
কৌতুক করে জুলেখা বলল, খাবার বেশী বলে মা’য়ের জন্য খুব দরদ উঠছে আজকে, না ? অন্য সময়ে তো একা একা খেয়ে উঠে পড়িস।
সত্য ঘটনা ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জা পেল রাকিব। জুলেখা শব্দ করে হেসে, ছেলের মাথা বুকে জড়িয়ে, মাথায় চুমো খেয়ে বলল, খা বাপ আমার, খা। সারাদিন আমার বাপটা কত খাটাখাটনি যে করে !
নিজে ভাত মেখে, মায়ের মুখে আগে ভাত তুলে দিল রাকিব। বলল, আহা, নে না মা !
লজ্জা পেয়ে জুলেখা বলল, আরে আমি দুষ্টামি করতেছিলাম। আমি পরে খাবনি। তুই আরাম করে খা তো !
- না, তুই আগে নে।
চোখ ভিজে গেল জুলেখার। পর পর দুইবার খাইয়ে দেওয়ার পর জুলেখা বলল, হইছে। এবার তুই একটু আরাম করে বস দেখি।
বসার কথা বলতে না বলতেই শুয়ে পড়ে পায়ের উপর পা তুলে দিল রাকিব। জুলেখা খাইয়ে দিতে থাকল রাকিবকে। একটু পর রাকিব বলল, আহ্‌ ! নিজেকে লাটসাহেব মনে হচ্ছে।
জুলেখা মৃদু হাসল। তার মনে এখন অন্য চিন্তা। প্রচন্ড ভয় আর দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তার ইদানিং। খাওয়া শেষে ভয়ে ভয়ে কথাটা বলার চেষ্টা করা শুরু করল জুলেখা। বলল, বাবা, একটা কথা বলতাম তোকে।
- বল মা, বইল্যা ফ্যাল।
- তুই পানি খেয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু বস আগে।
মাকে এমন গম্ভীর আগে দেখেনি রাকিব । মায়ের কথামত কাজ করল সে। এরপর চৌকিতে বসে বলল, হুমম, বল এবার।
ইতস্তত করতে করতে জুলেখা বলল, বাবা, আমি যদি আবার বিয়ে করি, তুই কি রাগ করবি ?
কথাটা শেষ হতে না হতেই মাথায় রক্ত উঠে গেল রাকিবের। বিয়ে বলতে রাকিবের জ্ঞানটুকু গ্রামের ছেলেদের কুৎসিত কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিশেষ করে নিজের মা নিজের বাবার সাথে না থাকা মানেই তো খারাপ ! চোখ গরম করে সে বলল, ক্যান ! আবার বিয়ে করা লাগবে ক্যান তোর ?
মাথা নিচু করে জবাব দিল জুলেখা, বিয়ে করা কি খারাপ রে বাপ ?
হিংস্র স্বরে জবাব দিল রাকিব, তে খারাপ না ! পাড়ার লোকদের কি বলব আমি !
চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল জুলেখার। মৃদু স্বরে বলল, একলা মেয়ের জন্যে জীবনটা খুব কঠিন রে বাপ !
- মেয়ে ! তুই তো বুড়ি !
- আমি তোর মা বলে তোর তাই মনে হয়।
এবার চিৎকার করে রাকিব বলল, ক্যান তোর বিয়া করা লাগবে, ক্যান ? কিসের অভাব তোর ? আমি তোরে ভাত কাপড় দেইনা ?
হাল ছেড়ে দিল জুলেখা। রাকিবের আসলেও বোঝার বয়স হয়নি। কিন্তু যখন বোঝার বয়স হবে, তখন যে সে সত্যিই বুড়ি হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছে জুলেখা বলল, আচ্ছা বাপ, বিয়ে করবনা, যা ! তুই অনেক ক্লান্ত। ঘুমা এবার।
- কিসের ঘুম ! চোখের সামনে থেকে যা এখন।
জুলেখা রাকিবের জন্য বিছানা তৈরী করে দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ঝটকা মেরে মায়ের হাত সরিয়ে দিল রাকিব। বলল, আর আহ্লাদ দেখাতে হবেনা। নতুন বরের বিছানা কর গে, যা।
একটাই ঘর। যাওয়ার কোন জায়গা নেই। বদ্ধ ঘরে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে জুলেখার। এখনও কতটা সময় পড়ে আছে জীবনে ! এভাবে একা একা কাটাতে হবে ! এমন সুযোগ তো জীবনে বারবার আসবেনা! ঘরের বাহিরে গিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসে আকাশপানে তাকিয়ে রইল সে।

২.
ডালিয়ার বয়স ১২/১৩। তার বয়সী অনেক মেয়ের শরীরে যৌবনের ঘোষণা দিলেও তাকে দেখলে ৮/৯ বছর মনে হয়। একেবারে কালো, একদম শুকনা, চেহারায় তেমন কোন মাধুর্য নেই, সামান্য মায়া আছে শুধু। কিন্তু তার মনে সবার জন্য আছে বুকভরা ভালবাসা। এত মানুষের অবহেলার দৃষ্টি আর বাড়ির প্রায় সকলের লাঞ্চনা বঞ্চনা শোনার পরেও সে মানুষের উপর রাগ করতে পারেনা।
চুপচাপ মেয়ে ডালিয়া। তার একটাই বান্ধবী ছিল। গতমাসে বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা বেশ গরীব ছিল। বাবা মা বিয়ে দিয়ে যেন বেঁচে গেছে কোনরকম। জুলেখা খুব ভালবাসে ডালিয়াকে। সারাদিন সেলাই আর ডালিয়ার সাথে গল্প করেই সময় কাটে তার। আজ সকাল হতেই ডালিয়া জুলেখার বাসায় চলে এল। জুলেখা সারারাত ঘুমায়নি। নির্ঘুম রাত আর অনবরত কান্নায় চোখ লাল হয়ে আছে তার। একটু আগে রাকিব কাজে চলে গেছে।

ডালিয়া জুলেখার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হইছে খালা ?
- কিছুনারে মা !... ... ... বল, কি খাবি ?
ফোড়ন কেটে ডালিয়া বলল, খুব পয়সা হইছে মনে হয় ? আমি খাইয়া আসছি।
- বস।
অন্যদিনের মত হাসিখুশী দেখালনা জুলেখাকে। চুপ করে সেলাই করতে থাকল। কিছুক্ষণ পর সেলাইয়ের জামাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, উফফ ! আর পারিনা। সবসময় কষ্ট আর নিজেকে বাঁচায় চলা সবার কাছ থেকে।
কেঁদে দিল জুলেখা। ডালিয়া তার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কি হইছে খালা ? বল আমাকে।
ডালিয়ার কণ্ঠে সহানুভুতি আর ভালবাসা। জুলেখার আবার মনে পড়ল, এ গ্রামে এই মেয়েটাই তার সবচেয়ে আপন। তার উপর কারও সাথে নিজের কষ্টটা ভাগাভাগি করার ইচ্ছাটাও দমন করতে পারলনা সে। সব খুলে বলল সে ডালিয়াকে। সব শুনে গম্ভীর মুখে ডালিয়া বলল, ফাজিলটাকে আসতে দাও। আমি কথা বলব ওর সাথে।
ভয় পেয়ে জুলেখা বলল, না না মা, এ কাজ করিসনা...... বাপরে বাপ !
ডালিয়ার কথা খুব শোনে রাকিব। ডালিয়া শাসনও করে মাঝে মাঝে তাকে। সে আবার বলল, তুমি চিন্তা করনাতো খালা! খালি বল, ওই ব্যাটা কি আসলেও রাজি ?
এবার লাজুক মুখে জুলেখা বলল, সরাসরি কিছু বলেনি, কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে বলেছে। আমি রাকিবের সাথে কথা বলে রাখতে চাইছিলাম যেন এরপর বললে সাহস করে কিছু বলতে পারি।
গম্ভীর স্বরে ডালিয়া বলল, রাকিবের সাথে আমি কথা বলব। তুমি খবরদার বাঁধা দিবানা।
জুলেখা এবার চুপ করে রইল। সেলাইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে ঝাপসা চোখে নতুন ভবিষ্যতের জাল বুনতে থাকল।

বাসার সব কাজে মাকে সাহায্য করে সন্ধ্যায় আবার জুলেখার বাসায় এল ডালিয়া। অপেক্ষা করতে থাকল রাকিবের জন্য। বাইরে রাকিবের কণ্ঠ শুনতেই সে দৌড়ে বাইরে এল। ডালিয়াকে দেখে রাকিবের মুখে হাসি দেখা গেল। কিন্তু ডালিয়ার গম্ভীর মুখ দেখে চুপসে গেল সে। ধীর স্বরে বলল, ভাল আছিস ডালিয়াবু ?
এসব কথার ভিতরে ঢুকলনা ডালিয়া। দিনের আলো যতুটুকু বাকি আছে তাতেই ডালিয়াকে দেখে রাকিব বুঝল, ডালিয়া অনেক রেগে আছে। রাকিব বলল, কিছু বলবি? বল ।
- এখানে না। নদীর ধারে চল।
- আমার ক্ষিধা পাইছে।
কিছু না বলে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল ডালিয়া। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাকিব বলল, আচ্ছা চল।

পথিমধ্যে কোনো কথা বলল না ডালিয়া। বিষন্ন সন্ধ্যা শেষে রাতের দেখা দিল। নদীর ধারে দু’জন পাশাপাশি বসল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডালিয়া বলল, বল, তুই তোর বাপকে কবে দেখছিস ?
- ঢং করিস ক্যান ? জানিসই তো দেখিনি।
- শোন, ওই হারামজাদা তো তোর জন্মের পরেই ভাগছে। এক বছর হলো তুই দুই পয়সা কামাচ্ছিস। এর আগের নয় বছর তোর মা তোকে কি ভাবে দেখে রাখছে, তার খবর আছে তোর কাছে ?
রাকিব বুঝে গেল ডালিয়া কি বলতে চাচ্ছে। মা’র উপর প্রচন্ড রাগ হলো তার। কিন্তু সেই রাগ ডালিয়ার উপর ঝাড়ার সাহস নেই তার। মিনমিন করে বলল, সব মা’ই তো এমন করে।
- হ্যাঁ সব মা করে, কিন্তু তার সাথে একজন বাবা-ও থাকে। তোর মার সেটা ছিলনা। এতদিন কষ্ট করে তোকে নিজের পায়ে দাঁড় করাইছে। এখনও কি সে নিজের জীবন নিয়ে ভাববেনা?
- এখন আর ভাবার কি দারকার? এখন তো আমি বড় হয়ে গেছি।
- শোন রাকিব, তোর বয়স কম, তুই বুঝবিনা হয়ত, তাও তোকে বলি- সারাদিন তুই বাইরে থাকিস, পাড়ার সব ছেলে বুড়োরা খালি তোর বাসার সামনে আসে যখন তখন। তোর মা ভয়ে এক মুহুর্তের জন্য আমাকে ছাড়তে চায়না।
- ক্যান ভিড় করে পোলাপান ?
- উফফ আরেকটু বড় হলে বুঝবি নিজেই। এখন খালি বল, আমার উপর তোর ভরসা আছে?
- তা তো আছেই।
- তাইলে তুই গিয়ে তোর মার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবি। একসময় তুই নিজেই বুঝবি মেয়ে মানুষের জীবনের স্বপ্ন কি থাকে। তখন হয়ত তুই তোর মাকে অনুমতি দিবি কিন্তু হয়তো দেরি হয়ে যাবে।
চুপ করে রইল রাকিব। রাকিবের হাত ধরে ডালিয়া বলল, দেখবি তোরও ভাল লাগবে। তোরও একটা বাবা হবে। হয়তবা ছোট একটা ভাই বা বোন হবে। তোর আর এত কষ্ট করতে হবেনা। তোর বাবা পাশে এসে দাঁড়াবে তোর। তোর মায়ের-ও বাকিটা জীবন সুখে কাটবে। একটা সংসার হবে। তুই কাজ শেষে ফিরে তোর ছোট বোনকে কোলে নিবি। বাবার সাথে গল্প করবি। একটা অন্যরকম জীবন হবে রে। দেখবি, তোর ভাল লাগবে।
ডালিয়ার কথায় মনের ভেতর একটু স্বপ্ন জন্ম নিল রাকিবের। বলল, আসলে এভাবে চিন্তা করিনি ডালিয়াবু। এই কথা শুনে প্রথমেই মাথায় আসছে যে, আমি যে টাকা কামাই তাতে মার হচ্ছেনা, আরও দরকার। আকারে ইঙ্গিতে আমাকে মা আরও কামাইতে বলতেছে, কিন্তু আমি তো আর পারিনা। বড় বড় লোকেরা যত পাথর ভাঙ্গে আমি আমার সবটুকু দিয়েও তো তার অর্ধেক ভাংতে পারিনা। সারাদিন পর যখন কাজ শেষে উঠে দাঁড়াই মাঝে মাঝে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাব। ক্ষিধা পিপাসায় গলা পেট জ্বলে। সব ব্যাপারেই খালি মনে হয় টাকা জড়ায় আছে। টাকা ছাড়া মাথায় আর কিছু আসেনা। তাই মায়ের ওই কথা শুনে আর অন্য কিছু মাথায় আসেনি।
নিজেকে এভাবে আত্নসমর্পন ডালিয়া ছাড়া আর কারও সামনে করেনা রাকিব। জানে সে, এটাকে মানুষ দুর্বলতা মনে করে। কাজে যখন কন্ট্রাকটর তার কাজ দেখে পয়সা কম দিতে চায়, তখন ঝগড়া করে সে, আবার সবটুকু শক্তি একত্র করে কাজ করতে চায়। কিন্তু দুর্বল অভুক্ত শরীর তাও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ গুলোর কাজের সমানে যেতে পারেনা।

হঠাৎ দুর্বলতা প্রকাশ করে মনটাও নরম হয়ে এল রাকিবের। আর রাকিবের কথা শুনে চোখে পানি এল ডালিয়ার। জীবন কেন এত নিষ্ঠুর হয়? কেন এই ছোট ছেলেটার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে এক রূঢ় বাস্তব এই বয়সেই তাকে দেওয়া হল? ভেজা চোখে, হাত দিয়ে রাকিবের থুতনি ধরে নিজের দিকে ফেরাল ডালিয়া। বলল, তোর দোষ দেইনি তো রে পাগল। আমি জানতাম তোরে বুঝালে তুই বুঝবি ............. মন খারাপ করিসনা তো! বাসায় গিয়ে খালার সাথে কথা বল। ভবিষ্যত নিয়ে কথা বল। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখলে জীবনটা খুব ভালো কাটে রে ......... এই আমাকে দেখ, আমার বিয়ে হবেনা জানি, তাও তো আমি স্বপ্ন দেখি ......
ডালিয়াকে থামিয়ে দিয়ে রাকিব বলল, বিয়ে হবেনা মানে?
- আমাকে কে বিয়ে করবে?
- আরে মুশকিল! বিয়ে না করার কি আছে? আর তোর কি বিয়ের বয়স হইছে নাকি ?
- তাই! না! আমার বিয়ের বয়স হয়নি আর গতরাতে তোর মাকে তুই বললি বুড়ি ....... আচ্ছা, গত সপ্তাহে তুই খুব খুশী ছিলি নূরজাহানের বিয়ে নিয়ে। তা নূরজাহানের বয়স কেমন হবে রে?
নূরজাহান রকিবের সাথে কাজ করে। প্রচন্ড স্নেহ করে রাকিব কে। এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে সর্বহারা মানুষের-ও কোথাও না কোথাও আশ্রয় থাকে। আশ্রয় ছোট বড় হাতে পাওে, কিন্তু কখনও কখনও সেই ছোট আশ্রয়টুকুও মানুষকে বাঁচার অবলম্বন দেয়, জীবন সম্পর্কে আশাবাচক স্বপ্নের যোগান দেয়। এই নূরজাহানের স্নেহ-ই কাজের সময় রাকিবকে উৎসাহ আর ভালবাসার অনুপ্রেরণা দেয়। গত সপ্তাহে নূরজাহানের আবার বিয়ে হয়েছে। বছর দুয়েক আগে তার স্বামী সন্তান মারা গেছে। বিয়ের আনন্দে একদিন কাজে আসেনি সে। পরদিন এসে সুখবরটা দিয়ে চুপ করে মিষ্টি খাইয়েছিল সে রাকিবকে। রাকিবও আসলেই খুশী হয়েছিল নূরজাহারে আনন্দে।

ডালিয়ার প্রশ্নের উত্তরে রাকিব বলল, ৩২/৩৩ হবে।
- তোর মার বয়স কিন্তু তার চাইতেও কম।
- বলিস কি?
- জ্বি! মা তো, তাই মনে হয় বুড়ি, না ?
হাসল রাকিব। তারপর দুষ্টামি করে বলল, আর মার বিয়ের গল্প শুনে তোরও বিয়ের শখ হইছে, না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডালিয়া বলল, আমার মত পেত্নীর আবার বিয়ে! ...... এর পর দুষ্টামি ভরা মুখে আর আবেগ ভরা চোখে রাকিবকে প্রশ্ন করল, কে করবে আমায় বিয়ে! তুই করবি ?
লজ্জা পেল রাকিব। বলল, আরে আমি ক্যামনে বিয়ে করব! আর আমি তো ছোট।
কপট অভিমানে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ডালিয়া বলল, করবিনা বললেই হয়। জানতাম আমি। যাহ্‌! তোর সাথে কথা নাই।
ডালিয়ার মুখ ধরে নিজের দিকে ফেরাতে চাইল রাকিব। ডালিয়া ঝটকা মেরে রাকিবের হাত সরিয়ে দিয়ে আবার অন্য দিকে মুখ ঘোরাল।
এর একটু পর হঠাৎ চুড়ির শব্দ শুনতে পেল ডালিয়া। কেউ আসছে ভেবে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। হেসে উঠল রাকিব। সস্তা চুড়ির গোছাটা ডালিয়ার হাতে দিয়ে বলল, তোর জন্য।
বাকরূদ্ধ ডালিয়া লজ্জা কাটাতে আনন্দ মাখা স্বরে বলল, কি যে সব পাগলামি করিস তুই মাঝে মাঝে ? কেন দিস এসব আমায়? মা’কে দিসনা?
- দেই তো। আর মা’র বিয়েতে আরও অনেক কিছু দেব।
শেষ কথাটা শুনে খুশী হল ডালিয়া। এরপর চুড়ি পড়ে ঝনঝন শব্দ করতে থাকল। রাকিব হাসি মাখা মুখে তাকিয়ে আছে ডালিয়ার দিকে। হঠাৎ রাকিবের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডালিয়া। অবাস্তব ভবিষ্যতের কল্পনা ভরা চোখ দিয়ে চোখ রাখল সে রাকিবের চোখে। চুড়ির মৃদু শব্দ তুলে, এক হাত দিয়ে ধরল রাকিবের এক হাত আর অপর হাতে ছুলো রাকিবের গাল। ধকধক করা কিশোরী বুক নিয়ে এগিয়ে এল রাকিবের কাছে। এরপর দ্বিধা আর ভয় নিয়ে চোখ বন্ধ করে উষ্ণ ঠোটে রাকিবের গালে চুমা দিল সে।

রাকিবের এই আবেগ বোঝার বয়স হয়নি। কিন্তু কি যেন একটা আলাদা মনে হলো, কেমন যেন ভাল লাগা অনুভুতি। অকারণ লজ্জাও পেল সে। বলল, এটা কি হলো ডালিয়া’বু ?
হুশ ফিরে পেল যেন ডালিয়া। মুহুর্তে লজ্জা আনন্দ আর দ্বিধা মেশানো কন্ঠে বলল, জানিনা, তুই বুঝবিনা।
বলে আর অপেক্ষা করলনা সে। চুড়ির শব্দ তুলে দৌড়ে ফিরে গেল।

৩.
ভয়ে ভয়ে ঘরে অপেক্ষা করছে জুলেখা। রাকিবের দেরি সহ্য হচ্ছেনা। অস্থির পায়ে ছোট ঘরে পায়চারি করছে সে। ডালিয়া কি কড়া কিছু বলেছে নাকি? রাকিবের অনেক রাগ, যদি আর ঘরে না ফেরে ? রাকিবের জন্য ভাত বেড়ে তরকারি সাজিয়ে অপেক্ষা করছে সে। দুশ্চিন্তা সহ্য করতে না পেরে চৌকিতে একটু শু’ল সে। এর একটু পরেই রাকিব ঘরে ঢুকল। জুলেখা ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকল। রাকিব কি বলবে বোঝা যাচ্ছেনা। মা’কে ঘুমাতে দেখে রাকিব হাত মুখ ধুতে বাইরে গেল। তারপর ঘরে এসে খাবার খেয়ে, বাসনপত্র ধুয়ে, আস্তে করে এসে জুলেখার মাথার পাশে এসে বসল। ভয়ে জুলেখার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে যেন। মায়ের মাথায় আস্তে করে হাত রাখল রাকিব। বলল, আমি জানি, তুই ঘুমাসনি।
জুলেখা উত্তর দিলনা। ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকল। রাকিব বলল, জানি তো এখনও খাসনি। উঠে পড়, খেয়ে নে।
এবার উঠল জুলেখা। কিন্তু দাঁড়াল না, মাথা নিচু করে বসে রইল।

হারিকেনের মৃদু আলো ঘরে। কমলা আলোয় জুলেখা কে ভাল করে দেখল রাকিব। আসলেও তো! মায়ের বয়স তো মোটেও বেশী না। আর কি ভয়ানক সুন্দর মা আমার! সেজন্যই তো পাড়ার সবাই ভিড় করে। নিশ্চয়ই মাকে বিয়ে করার জন্য। দু’হাত দিয়ে মা’য়ের দুই গাল ধরল রাকিব। বলল, লোকটা তোরে ভাল পায় মা?
যেন কোন বাবা মেয়েকে মেয়ের প্রেমিক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। মাথা আরও নিচু করল জুলেখা। চুলে ঢাকা পড়ল মুখ। কিন্তু মায়ের লাজুক হাসি রাকিবের চোখ এড়ালনা। রাকিবের প্রশ্নের উত্তরে মাথা দুলিয়ে সায় দিল জুলেখা । রাকিব বলল, তাইলে আমাকে আর তোকে কি নতুন বাসায় নিয়ে যাবে নতুন বাবা?
এবার মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকাল জুলেখা। রাকিব মিটিমিটি হাসছে। একই সাথে জুলেখার মুখে হাসি আর চোখে জল এল, যেন অনেক বাধাঁ বিপত্তি পেড়িয়ে, অভিমানী মেয়ে প্রেমিক কে বিয়ে করার অনুমতি পেল।
ভেজা চোখে, ভাঙা গলায় জুলেখা বলল, হ্যাঁ রে বাপ, নতুন বাসায় নিয়ে যাবে।
এতক্ষণ হাঁটু গেড়ে বসে ছিল রাকিব। এবার আরাম করে বসল মাটিতে। ছেলের দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে জুলেখা বলল, তোর এই ছোট্ট হাত দিয়ে আর কষ্ট করতে হবেনা রে সোনা। তুই আবার স্কুলে যাবি।
স্বপ্নালু চোখে রাকিব বলল, আমাদের বিছানা হবে মা?
- হ্যাঁ রে সোনা, উনার অবস্থা বেশ ভাল। আমাদের আর মাটিতে শুতে হবেনা।
উত্তেজনায় মায়ের আরও কাছে সরে এল রাকিব। বলল, বৈশাখী মেলায় নিয়ে যাবে?
হাসি মুখে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল জুলেখা। রাকিব বলে চলল, আমি বাপের ঘাড়ে চড়ে হাটে যাব মা, ঠিক আছে ? .......... আচ্ছা মা, আমার বোন হবে একটা ?
লজ্জা পেল জুলেখা। বলল, বোন চাস ?
মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল রাকিব। জুলেখা বলল, আল্লাহ্‌ দিলে হবে বাবা।

এরপর সারারাত মা-ছেলে ভবিষ্যতের কল্পনায় মেতে থাকল। অনেক অবাস্তব কল্পনা করে নিজেরাই হাসল। নিজেরাই বলল, এমন হবেনা তাও যদি হত কেমন হবে? জুলেখা রাতে খাওয়ার কথা ভুলে গেল। ক্লান্ত রাকিব ভুলে গেল ঘুমের কথা। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমাল তারা। সকাল হতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল রাকিব। কাজে যাওয়ার আগে অপূর্ণ ঘুমের লাল চোখে আলো ছড়িয়ে বলল, আর তো বেশীদিন কাজে যাইতে হাবেনা। এ মা, কবে বলবি উনাকে?
মৃদু হেসে জুলেখা বলল, দেখি আজ-ই বলে দেখব। পারলে তাড়াতাড়ি আসিস বাপ।

কাজে মন নেই রাকিবের। খালি অস্থিরতা কাজ করছে, কখন শেষ হবে? কাজ শেষে টাকার জন্য লাইনে না দাঁড়িয়ে যে ব্যাক্তি টাকা দেয়, তাকে সে বলল, স্যার আজকের টাকাটা কালকে নেওয়া যাবে?
- হুমম
- আমার একটু তাড়া আছে আজকে। আমি আজ যাই, কাল নিব টাকাটা।
প্রায় দৌড়ে এসে বাস ধরল রাকিব। কিন্তু তারপরও বেশী আগে পৌছাতে পারলনা। রাকিব পৌছানোর পর সে দেখল, তাদের ঘরটা কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। কোনো আলো জ্বলছেনা ভেতরে। কি ব্যাপার! মা কি চলে গেছে নাকি বিয়ে করতে! কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পেল সে। মৃদু টোকা দিয়ে লাভ হলনা। জোরে ধাক্কানোর কিছুক্ষণ পর জুলেখা দরজা খুলল। রাকিব জিজ্ঞাসা করল, আলো কই মা ? তেল নাই নাকি ?
কোনো কথা না বলে জুলেখা আস্তে করে হারিকেনের বাতি জ্বালাল। মায়ের আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। কেন যেন গম্ভীর। বিয়ের খবর জিজ্ঞাসা করতে কেন যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকল রাকিবের। বলল, মা ভাত কই ?
দরজা খুলে দিয়ে দরজার নিচের সিড়িতে বসে আছে জুলেখা। পূর্নিমার চাঁদের আলো তাকে ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে জুলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রান্না চড়ানো হয়নি। চড়াচ্ছি দাঁড়া।
কণ্ঠে কেমন যেন হতাশা। যেন রান্না চড়ানো খুব বিরক্তিকর আর একঘেয়ে কাজ। কাজ থেকে ফিরে সাথে সাথে ভাত না পেলে রাকিবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আজ সে কিছু বললনা। হারিকেনের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে আস্তে করে দরজার কাছে এসে চিকন সিড়িটায় চাপাচাপি করে মায়ের পাশে বসল। জুলেকার চোখে পানি, নিষ্পলক চোখে এখনও আকাশপানে তাকিয়ে আছে সে। রাকিব বুঝে গেল। আস্তে করে মায়ের হাত ধরে বলল, আমাদের আর হলনা মা, না? আবার সেই পুরানো জীবন?
মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল জুলেখা। ছেলের ছোট ঘাড়ে মাথা রেখে শক্ত করে রাকিবের হাত ধরে কাঁদতে লাগল সে। রাকিবের-ও চোখে পানি এল। এইত গত রাতেই কত স্বপ্ন ছিল, আর আজ রাতে কিছু নেই। এই সাধারণ জীবনতো এক রাত আগেও একই রকম ছিল অথচ এই এক রাত পরে সেই পুরনো জীবনটা কতই না অসহনীয় ঠেকছে!

মা- ছেলে দু’জন কিছুক্ষণ নীরবে কাঁদল। এরপর রাকিব দুর্বল গলায় বলল, সমস্যা নাই মা। আগেও তো আমরা দু’জন ছিলাম। আমি আরও ভাল একটা কাজ নিব।
কথাটা বলল ঠিকই রাকিব। কিন্তু মনের ভেতর কোন দৃঢ় ইচ্ছা বা আকাঙ্খা প্রকাশ পেলনা। একটু পর চুপ থাকতে না পেরে রাকিব জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কে রে মা ?
মৃদু গলায় আঁকা বাঁকা স্বরে জুলেখা জবাব দিল, সে দিন তুই জিজ্ঞাসা করলিনা লোকটা কে, আমি বললাম তোর মামা- সে আসলে সে-ই।
- এই পাড়াতেই থাকে ?
- হুমম শরীফুল ইসলাম। নদী আর মসজিদের মাঝখানে যে বাড়িটা আছে, ওইখানে থাকে।
- এর আগে না ও তোরে বিয়ের কথা বলছিল? কি হল আবার?
আবার কেঁদে উঠল জুলেখা। বলল, কিছু না। হয়ত ইচ্ছা হইছিল, তাই বলছিল। এখন ইচ্ছা চলে গেছে।
- না, কোনো কারণ তো আছেই। তুই কি কারণটা জানিস ? জানলে বল।
এবার হঠাৎ ঝাঝালো গলায় জুলেখা বলল, কারণ আবার কি! বললাম না, এমনি।
কিন্তু রাকিব গো ধরল। বলল, না কারণ তো আছেই, বল না।
অনেক জোরাজুরির পর, নানাভাবে প্রশ্ন করে রাকিব যা বুঝতে পারল, তা হল- শরীফের জুলেখাকে বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সে নতুন করে শুরু করতে চায় জুলেখাকে নিয়ে। শুধু জুলেখার দায়িত্ব নিতে রাজি আছে সে। রাকিবকে তার পছন্দ না, বরং বলেছে, যে স্বামী নিজের ছেলেকে রেখে পালিয়ে গেছে, আসলেও সেই লোক তার স্বামী ছিল কি না কে জানে! সেই জারজ ছেলের জন্য এত দরদের কি আছে! তারা নতুন সংসার পাতাবে, নতুন ছেলেমেয়ে হবে, পুরাতন সবকিছু ছেড়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করবে।

সব শুনে রাকিবের মনে তীব্র হতাশা আর নিজের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিল। ক্ষিধা নিমিষেই উবে গেলে। সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছে কেন যেন! কথা বলার ইচ্ছাও লোপ পেল। চুপচাপ কিছুক্ষণ মায়ের পাশে বসে, শূন্য চোখে উঠানের ও পাশের কালো জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কিছুক্ষণ পর রাকিব, বলল ঘুম পাইছে মা, হাত ছাড়, ঘুমাই।
আরও শক্ত করে হাতটা ধরল জুলেখা। আকুতি নিয়ে বলল, রান্না চড়াচ্ছি বাপ! খেয়ে ঘুমা ......... আর তুই তো জানিস-ই তোকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলবেনা। কোন হারামজাদা কি বলল তাতে আমাদের কি আসে যায়? আমরা মা বেটা আগের মতই থাকব। আগে কি আমরা ভাল ছিলাম না ! ............... একটু বস বাপ, রান্না চড়াই।

জুলেখা উঠে পড়ল। রাকিব বসেই রইল। কেউ তাকে পছন্দ করেনা কেন? পাড়ার মায়েরা তার বয়সী ছেলেদেরকে তার সাথে মিশতে নিষেধ করে। কাজে নূরজাহন ছাড়া আর কি কেউ ভালবাসে তাকে? সে কি করেছে? তার অপরাধটা কোথায়? তার যখন একবছর বয়স, তখন তারা বাবা কোথায় যেন চলে গেছে। ঔটুকু বয়সে সে কি এমন করেছিল যে তার বাবার তাকে ছেড়ে চলে যেতে হল! তার আজ এই অবস্থা কি তার বাবা না থাকার কারণেই? বুকে ক্ষোভ জমতে চায়। কিন্তু যে মানুষটাকে কখনও দেখেনি, সেই নিরাকার এক মানুষের উপর ক্ষোভ ধরে রাখতে পারেনা সে। শুধু হতাশা আর অভিমান এসে জমছে তার মনে। কাকে বলা যায় একথা গুলো? কেউই তো নেই তার। কোন বন্ধু নেই, যেখানে কাজ করে সেখানে সবাই বয়সে বড়। শুধু ডালিয়া আছে, আচ্ছা তাকেই না হয় বলা যাবে।

রান্না শেষ হলে চুপ করে খেতে থাকল সে। হাঁটুর উপর থুতনি রেখে মুগ্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে জুলেখা। এ সন্তান তার একার, আর কারও না। এ বয়সে এ পাড়ার কোন ছেলের এত ধৈর্য আছে? কোন ছেলে এ বয়সেই উপার্জন করে মা’কে খাওয়ায়? এত বিরূপ জীবনের চাপে কোন ছেলেটা এখনও অভিযোগ না করে সব সহ্য করে? কোন ছেলে এই বয়সেই মায়ের মনের অনুভুতিটুকু বোঝার চেষ্টা করে? নিঠুর জীবন এই বয়সেই তাকে বাস্তববাদী করে তুলেছে। কিন্তু ছেলেটি তার বখে যায়নি, যুদ্ধ করে চলছে।
অন্যান্য দিন রাকিব যেমন গল্প করে খাওয়ার সময়, আজ কিছুই করছেনা। ভাত যেন গিলতে পারছেনা। একটু পর পর পানি খাচ্ছে। শুধু মাথাটা নীচু করে ভাত মাখছে অনেকক্ষণ ধরে রাকিব। বুকটা ফেটে যাচ্ছে জুলেখার। সে-ই তো এই স্বপ্ন দেখিয়েছিল রাকিবকে। নিজের সুখের জন্য রাকিবকেও স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছিল সে। এরপর আজ যখন শরীফ বারবার বলছিল, তুমি চল, এখনই বিয়ে করব তোমাকে। বিকেলের মধ্যে ঢাকার ট্রেন ধরব, তখন একসময় হঠাৎ তার মাথায় এসেছিল চলে যাবে রাকিবকে ছেড়ে। কিরকম স্বার্থপর-ই না হয়ে উঠেছিলাম আমি!- তীব্র অপরাধরোধ নিয়ে ভাবল জুলেখা। যে ছেলে তার জন্য এত করে, আর সে কিভাবে ভাবল ও কথা! এত লোভ কেন আমার!- নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকল জুলেখা। ঝাপসা চোখে, পরম স্নেহ নিয়ে ছেলেকে বলল, থালাটা দে বাপ, খাইয়ে দেই।
- খাওয়া শেষ মা।
একই ভাবে অনেকক্ষণ ধরে ভাত মেখে খেতে থাকল রাকিব। এবার উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের পাশে গিয়ে বসল জুলেখা। কপাল থেকে চুল সরিয়ে ছেলের কপালে চুমা খেল সে। এরপর তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরল তার একান্তই নিজের সন্তানটিকে।

৪.
পরদিন অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠল রাকিব। জুলেখা ওঠারও আগে। ফযরের আজান দিচ্ছে। যতটুকু সম্ভব শব্দ না করে কাজে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বেরিয়ে পড়ল সে। আর কিছুক্ষণ পরেই জুলেখা উঠে পড়বে। তার আগেই বেরিয়ে পড়তে চায় সে।
মসজিদে গেল সে। নামায পড়লনা, কিন্তু বারান্দায় বসে রইল। মসজিদে সবসময় কেমন যেন প্রশান্তি থাকে একটা। ভাল লাগে রাকিবের। দু’এক জন নামাযীকে জিজ্ঞাসা করে শরীফের বাসাটা চিনে নিল সে। মসজিদ থেকে বেশ কাছে। আরেকটু সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল রাকিব।

মসজিদের বারান্দায় গড়াগড়ি খেল কিছুক্ষণ। এর পর নদীর ধারে গিয়ে বসল। নদী খুব ভাল লাগে তার। অনেকদিন নদীতে বন্ধুরা মিলে গোসল করা হয়না। একবছরের বেশী হয়ে গছে বোধ হয়। সনি হীরু জামাল কালাম অমল এরা সবাই কি এখনও একসাথে নদীতে গোসল করতে আসে? ওদের সাথে দেখাও খুব কম হয়। হঠাৎ তার খুব খেলতে ইচ্ছা হল তাদের সাথে। ওরা প্রায়ই খেলে এখনও বলে। হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয় তাদের সাথে। জামাল আর অমল বলে খুব ভালো রেজাল্ট করছে পরীক্ষায় আর হীরুটা বলে আবার ফেল মেরেছে। সে ভালই ছিল ছাত্র হিসেবে। স্যাররা তাকে বেশ আদর-ই করতেন। দেখি, একদিন ছুটি পেলে সবার সাথে একটু খেলব আর খেলা শেষে নদীতে গোসল করব- ভাবল রাকিব।

বেশ সকাল হয়ে গেছে। দুরুদুরু বুকে শরীফুল ইসলামের বাসার কড়া নাড়ল সে। দরজা খুলল এক মহিলা। হয়ত শরীফের মা। শরীফের বছর ছয়েক আগে বিয়ে হয়েছে, এখন তার বয়স ত্রিশ। কিন্তু মেয়েদের পিছে ঘোরা আর প্রায়ই বিভিন্ন মেয়েদের সাথে রাত কাটানোর কারণে গত বছর বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। আসলে শরীফদের বাড়িটা ঠিক রাকিবদের পাড়ায় পড়েনা। সেজন্য রাকিবকে চিনলনা শরীফের মা। জিজ্ঞাসা করল, কি চাই ?
ভদ্রভাবে রাকিব জবাব দিল, শরীফ ভাইয়ের সাথে একটু দেখা করা যাবে?
শরীফ খুব খেলাধুলা করে। ছোট ছোট অনেক ছেলেই শরীফের ভক্ত। শরীফের মা ভাবলেন হয়ত খেলাধূলার ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছে ছেলেটি। ঝাঝালো গলায় তিনি জবাব দিলেন, ঘর সংসার নাই, খালি ফালতু কাজ। দাঁড়াও, ডেকে দিচ্ছি।

শরীফ বেরিয়ে এল। রাকিবকে আগে দেখেনি সে। গতবছর বউ চলে যাওয়ার পর এক বন্ধুর মুখে জুলেখার রূপের প্রশংসা শুনেছিল সে খুব। তখন থেকেই জুলেখার পিছনে ঘোরা এবং প্রেম। প্রেম না বলে শরীরের প্রতি লোভ বলাই ভাল। কিন্তু জুলেখা সবসময়-ই রাকিব আসার আগে শরীফকে বের করে দেয় যেন ছেলে মায়ের এই অবৈধ প্রেম সম্পর্কে কিছু জানতে না পারে। শরীফ-ও তাতেই খুশি, এসব ঝামেলার মধ্যে তার যাওয়ার ইচ্ছাও নেই। বিকালের দিকে কাজ শেষে যায়, গল্পগুজব আর বিছানায় মাতামাতি করে চলে আসে- এই ভাল।

রাকিবকে দেখে বলল, কে রে তুই ?
রাকিব বলল, শরীফ ভাই একটু ওদিকে যাবেন?
কিছুক্ষণ রাকিবের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল সে। বলল, চল।
নদীর ধারে এসে বসল তারা দু’জন। রাকিব বলল, ভায়া আমি রাকিব।
জুলেখার মুখে অনেক নাম শুনেছে রাকিবের। এছাড়া রাকিবের মুখের ছাটও জুলেখার মত। বেশ রূপবান ছেলেটি। গতরাতের জুলেখার জেদের কথা মনে পড়ে আবার বিরক্ত জেগে উঠল শরীফের। কিন্তু রাকিবের মায়াকড়া চেহারার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে পারলনা। বলল, হুমম বুচ্ছি, জুলেখার ছেলে তুই, বল।
কিভাবে বলবে বুঝে পেলনা রাকিব। কাউকে অনুরোধ করতে তার ভাল লাগেনা। নিজেকে ছোট মনে হয়, দুর্বল বোধ হয় কিন্তু মায়ের কথা চিন্তা করে সে বলার চেষ্টা করল, ভায়া, মা আপনারে খুব ভাল পায়। মা’রে কষ্ট দিয়েন না।
- শোন রাকিব, আমার বউ আছে।
এবার অবাক হল রাকিব। বলল, তা’লে ? মা কইল আপনে বলে তারে ভালবাসেন।
বিরক্তি চেপে শরীফ বলল, শোন, তুই ছোট মানুষ; এসব বুঝবিনা।
মৃদু জেদ দেখিয়ে রাকিব বলল, না বুঝব। বলেন .......... আপনি কি মা’কে দ্বিতীয় বউ হিসেবে বিয়ে করতে চান? কিন্তু আমার মা’র মত এত ভাল মানুষের সাথে কি সেটা হওয়া উচিত? আপনার আগের বউ কি এখানে থাকে?
এবার রেগে গেল শরীফ। বলল, দেখ পাকামো করিসনা। ছোট মানুষ, ছোট মানুষের জায়গায় থাক। খেলাধুলা কর।
তার আবার খেলাধূলা! রাকিব বলল, মা জানে যে আপনার বউ আছে?
- না........... আমার বউ আমার সাথে থাকেনা।
এবার উৎসাহ পেল রাকিব। আরেকটি মেয়ের অনুভুতি সে বুঝতে না পেরে বলল, তাইলে উনারে তালাক দিয়া আমার মা’রে বিয়া করেন। মা খুব কষ্ট পাচ্ছে।
শান্ত স্বরে দৃঢ় গলায় শরীফ বলল, রাকিব, বাসায় যা। তোর মা আর আমি কি করব সেটা তোর বোঝার বয়স হয়নি। যা।
শরীফ উঠে দাঁড়াল। রাকিবও তাড়াতাড়ি উঠে দাড়িয়ে, শরীফের হাত ধরে আকুল স্বরে বলল, শরীফ ভাই, আমি জানি আপনে আমারে পছন্দ করেন না। আপনি শুধু মা’রে চান। কাল রাতে আমি সারারাত ভাবছি। আমি একা থাকতে পারব, আমি চলে যাব বাসা ছেড়ে। আপনি দয়া করে মা’কে বিয়া করেন। দ্বিতীয় বউ হিসাবেও হলেও করেন ....... আমি সত্যি চলে যাব। আর কখনই আসবনা।

রাকিবের চোখে পানি। বুকে অসহনীয় ব্যাথা কিন্তু সে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্ঠা করল। এই তো আর কিছুক্ষন! এবার তো রাজি হবেই শরীফ। কিন্তু ছোট রাকিবের এখনও অনেক কিছু জানা হয়নি জীবন সম্পর্কে। সেদিন মদ খেয়ে একটু মাতাল ছিল শরীফ, আর জুলেখাকে তার প্রেমিকা হিসেবে ভালই লাগে। হাসিখুশী মেয়ে। মাঝে মাঝে আসলেও বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। সেদিন তাই আবেগী হয়ে “বউ” বলে ডেকেছিল শরীফ। সেটা জুলেখা মনে রেখেছে এবং গতকাল বিয়ের কথা বলেছে। সরাসরি “না” বললে জুলেখা হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে রাকিবের অজুহাত দেখিয়েছিল শরীফ। আর জানে কোন মা-ই এতে রাজি হবেনা। তার এ মেয়ে, ও মেয়ের পিছে ঘোরা এখন আর ভালও লাগেনা। জুলেখার সাথে তার সুন্দর সময় কাটে। কিন্তু তাকে যে সে আসলেও বিয়ে করতে চায়না সেটা সরাসরি বললে জুলেখা হয়ত তার সাথে দেখা করাই বন্ধ করে দেবে। সেজন্য জুলেখাকে তার প্রতি নিজের ভালবাসার কথা জানিয়েছে আর রাকিবের অজুহাত দেখিয়ে বিয়ে না করার কারণ দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, এ কথা জুলেখা তার ছেলেকে বলবে।

রাকিবের মায়াকড়া চেহারা আর আকুতি শুনে এবার কঠোর হাতে পারলনা শরীফ। বলল, তোকে কি তোর মা পাঠাইছে?
- না। আপনি রাজি থাকলে আমাকে বলেন, খবরদার মাকে জানায়েন না। আমি চলে যাব।
রাকিবের মুখ দেখেই শরীফ বুঝল, রাকিব সত্য কথাই বলছে। এবার সে রাকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমার বাসায় তোর মা’কে মেনে নিবেনা।
অবাক হয়ে রাকিব বলল, কেন?
- তুই ছোট, তাই বুঝিসনা আর নিজের মা সম্পর্কে এমন কিছু শুনতে ভালও লাগেনা, তাই বলতে চাচ্ছিনা।
জেদ ধরে রাকিব বলল, না বলেন।
- তোর মা’র চরিত্র ভালনা।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ শরীফের দিকে তাকিয়ে থাকল রাকিব। তার মার চরিত্র ভালনা! কেন কি করেছে তার মা?
তবে এবার রেগে গেল রাকিব। বলল, ও আচ্ছা! আমার মা’র চরিত্র ভাল না! তাইলে আপনি আপনার এক বউ থুয়ে এত বাজে মেয়ের কাছে যেতেন কেন?
এবার নিষ্ঠুর হয়ে উঠল শরীফও। বলল, তোর মা’র আপত্তি ছিলনা তাই আর সেজন্যই তোর মার চরিত্র খারাপ।
দু’টো কথা রাকিবের কাছে পরস্পর বিরোধী মনে হল। সে বলল, খবরদার বাজে কথা বলবেন না। আমার মা’র আপত্তি ছিলনা, কারণ সে আপনারে ভালবাসে তাই। বিয়ে হবে ভাবছে তাই।
বিয়ের কথারও আট/নয় মাস আগে থেকে যে জুলেখার সাথে তার সম্পর্ক, সেটা আর বলল না শরীফ। রাকিবের এই বয়সেই তার সরল বিশ্বাসটা শরীফের ভাঙতে ইচ্ছা হলনা। শুধু কঠিন স্বরে বলল, শোন, বাড়ি যা। তোর মা’রে আমি বিয়ে করবনা, ব্যাস।
কঠোর চোখে এবার শরীফের দিকে তাকিয়ে রাকিব বলল, ঠিক আছে, আপনারে যেন আর না দেখি তাইলে আমাদের পাড়ায়। দেখলে কিন্তু আমি আপনার মা’রে আর আমাদের পাড়ার বড় ভাইদের বলে দেব।

এসব চাইলে উপেক্ষা করতে পারে শরীফ। এসব মোটেই তার ভয়ের কোনো কারণ না। এক সপ্তাহ পর জুলেখাকে ভালভাবে বুঝিয়ে বললে আবার আগের মত প্রেম চালিয়ে যাওয়া যেত। শরীফের সাথে সম্পর্ক আছে বলেই পাড়ার আর কোন ছেলে জুলেখাকে উত্যক্ত করতে সাহস করেনা। কিন্তু রাকিবের সাহস আর তেজী রূপটা ভালো লাগল শরীফের। ছেলেটা হয়ত জীবনে কিছু পায়নি কিন্তু শরীফকে শাসিয়ে সে ভয় দেখাতে পেরেছে, মা’কে রক্ষা করতে পেরেছে, মা’র দায়িত্ব নিতে শিখেছে- ভেবে যদি সন্তুষ্ট হয়, তাহলে হোক। ছেলেটার আরও বহুপথ পাড়ি দিতে হবে। জীবনে আত্নসম্মান, সাহস আর নিজের প্রতি ভরসা বড়ই দরকার তার। সে ছেলেটির পিতৃত্ব নিলনা কিন্তু ছেলেটি এই বয়সে নিজের মায়ের সামান্য সুখের জন্য যে ত্যাগ টুকু স্বীকার করতে রাজি হল, তা মোহিত করল শরীফকে। জুলেখার কথা তার মনে হবে কিন্তু নতুন মেয়েও পাওয়া যাবে ঠিকই। রাকিবের কথার উত্তরে মৃদু হেসে শরীফ বলল, আচ্ছা আর যাবনা কখনও তোর মা’র কাছে ......... যা তুই, কাজে যা।

শরীফকে শাসানো রাকিবের শেষ অস্ত্র ছিল। সেটাও যখন কাজে আসলনা, সর্বহারার মত তীব্র আকুতি নিয়ে শরীফের দিকে শেষ বারের মত তাকিয়ে ফেরার জন্য উদ্যত হল সে।

ছেলেটা আসলেও একেবারে অন্যরকম। এবয়সে তার যে দ্বায়িত্ব বোধ দেখল সেটা তার নিজেরও এখনও আসেনি। হঠাৎ ঠিক করল শরীফ, সে তার আগের বউ এর কাছে ফিরে যাবে আবার। রাকিবকে বলল, রাকিব আমি মিথ্যা বলেছি। তোর মা খুব ভাল মানুষ রে। তার চরিত্রও অনেক ভালো। কিন্তু তোর মা’কে বিয়ে করলে আমার আগের বউ কষ্ট পাবে। একজনকে সুখ দিতে চাইলে যদি আরেকজন কষ্ট পায়, তাহলে কি লাভ, বল। .......... তুই তোর মা’কে ভালবাসিস, সম্মান করিস আর দেখে রাখিস।
এসব ব্যাপারে রাকিবের কোন সন্দেহ ছিলও না। আরও অনেক কিছুই বলতে পারে সে শরীফকে। কিন্তু ইচ্ছা হলনা। চোখের পানি মুছে কাজ ধরার জন্য রওনা দিল সে।

৫.
সেদিনের পর আর কিছুই ভালো লাগেনা রাকিবের। কাজ শেষে সরাসরি বাসায় আসেনা সে। এদিকে ওদিকে হেঁটে বেড়ায়। একবার নূরজাহানের বাসায়ও গিয়েছিল। দেরি করে বাসায় ফেরে রাকিব, খাবারে তেমন রুচি নেই। জুলেখা ছেলের পরিবর্তন দেখে ঠিকই কিন্তু সে নিজেও সমস্যায় আছে। শরীফ আসেনা বেশ ক’দিন হয়ে গেল। আবার পাড়ার ছেলেপেলেরা যন্ত্রনা করা শুরু করেছে। জুলেখাও কেমন যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। যা হবে হোক।

হঠাৎ রাকিবের মনে হল, অনেকদিন ডালিয়ার সাথে দেখা হয়না। সেই যে ডালিয়া চুড়ির ঝনঝন শব্দ তুলে পালাল আর দেখা হয়নি। ডালিয়ার টানেই আজ বোধহয় একটু তাড়াতাড়ি ফিরল রাকিব। বাসার কাছাকাছি আসতেই কাকে যেন দৌড়ে পালাতে দেখল তাদের ঘর থেকে। রাকিব দেখেও দেখলনা। জুলেখা দেখল, ছেলে ঘরে না ঢুকে আবার কই যেন যাচ্ছে, কিন্তু ডাকলনা সে।

ডালিয়ারা পাঁচ ভাইবোন। ডালিয়া সবার ছোট, বড় একবোন এবং তিন ভাই। পাড়ার কেউ জুলেখাকে ভাল চোখে না দেখলেও এ পরিবারটি জুলেখাকে ভালবাসে আর রাকিবকে অত্যন্ত স্নেহ করে। এটাই নিয়ম- চরম বৈরী পরিবেশেও একজন না একজন বন্ধু পাওয়াই যায়। ডালিয়ার পরিবার রাকিবের পরিবারের একমাত্র শুভাকাঙ্খী। ডালিয়াদের অবস্থাও রাকিবদের মত এত করুণ না। ঘরে তিন ছেলে এবং বাবা মিলে যা উপার্জন করে, তাতে মোটামুটি ভালই চলে যায়।

রাকিব ডালিয়াদের উঠানে এসে দাঁড়ালে সবার প্রথমে তাকে দেখল ডালিয়ার মা। বাসার সবাই খেয়ে নিয়েছে। তিনি রান্নাঘরে বাসন পত্র ধুয়ে কেবল বের হচ্ছিলেন। রাকিবকে দেখে হাসিমুখে বললেন, আরে আমাদের রাকিব বাবা যে, এতদিন পরে খালার কথা মনে পড়ল! আসিস না তো আর একদম-ই। আগে তো প্রায় প্রতিদিন-ই আসতি।
লজ্জা পেয়ে রাকিব বলল, আসা হয়না খালা, খুব ব্যাস্ত থাকি তো!
রসিকতা করে ডালিয়ার মা বললেন, ওরে বাবা! কাজ শুরু করার পর থেকে, একটু টাকা পয়সা কামাই করে সবাইকে ভুলে গেলি! খুব মরদ হয়ে গেছিস, না?
লজ্জায় মাথা নীচু করল রাকিব। ডালিয়ার মা শব্দ তুলে হেসে রাকিবের কাছে আসলেন। রাকিবের চুল ঠিক করে দিয়ে বললেন, ওরে সোনা আমার! তুই লক্ষী একটা ছেলে বাপ! বস, কি খাবি বল ।
- খাবনা খালা। এমনি দেখা করতে আসলাম।
আগে খুব সহজেই ডালিয়ার কথা বলতে পারত রাকিব। কিন্তু সেই রাতের ঘটনার পর আজ কেমন যেন লজ্জা লাগল ডালিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করতে।

বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছে। কিন্তু রাকিবের কন্ঠস্বর শুনে ডালিয়া দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। এক খুটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিন্তু বারান্দা ছেড়ে নামলনা। ফোড়ন কেটে রাকিবকে শুনায়ে মাকে বলল, কোন খাওয়া দিওনা ওকে মা। খুব পয়সা হইছে তার! এ্যাহ! কাউকে আর লাগেনা ওর।
ডালিয়াকে মৃদু শাসন করে মা বললেন, চুপ কর ফাযিল মেয়ে। তোর মত অকর্মা নাকি? বস বাপ।
পিড়ি এনে দিলেন তিনি। আর বাটিতে করে মুড়ি আর গুড় এনে দিলেন রাকিবকে।

এবার বারান্দা থেকে নেমে এল ডালিয়া। মা’কে বলল, যাও মা, তুমি শুয়ে পড়। অনেক কষ্ট করছ সারাদিন। আমি বাটি ধুয়ে রাখব।
রাকিবের গাল ধরে আরেকবার আদর করে বিদায় নিয়ে তিনি বললেন, তা আবার কবে আসবেন রাকিব সাহেব ?
- আসব খালা, প্রায়ই আসব।
- আসিস আর জুলেখাকেও আসতে বলিস।
তিনি চলে গেলেন। ডালিয়া খুব কাছাকাছি এসে রাকিবের সামনে বসল। রাকিব মাথা নীচু করে খাচ্ছে। ডালিয়া অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রাকিবের দিকে। সেটা বুঝতে পেরে অকারণেই আরও সংকুচিত হল রাকিব। একটু পর খেতে খেতেই রাকিব বলল, কেমন আছিস ডালিয়াবু?
অভিমান ভরা কণ্ঠে ডালিয়া বলল, খবরদার কথা বলবিনা আমার সাথে। থাপ্পর লাগাবো কিন্তু।
- কি করলাম আমি?
এবার অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে ডালিয়া বলল, কিছু করিসনি, তুই সাধু।
কেন যেন কথার জালে জড়াতে ইচ্ছা হলনা রাকিবের। চুপ করে খাওয়া শেষ করে উঠে দাড়িয়ে বলল, বাসনটা ধুয়ে যাই আমি।
কলের পাড়ের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই থালাটা রাকিবের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ডালিয়া বলল, ঢং করবিনা, দে আমাকে।
ডালিয়া বাসনটা ধুয়ে, যথাস্থানে রেখে আবার রাকিবের কাছে এল। কিন্তু কোন কথা বললনা। চোখের কোণা দিয়ে ডালিয়াকে একবার দেখে রাকিব বলল, যাই রাত হইছে।
ছোট একটা জঙ্গল পার হতে হয় রাকিবের নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য। জঙ্গলের ভেতর ঢুকতেই ডালিয়া দৌড়ে গিয়ে রাকিবের হাত ধরল। ফুলে ওঠা অভিমান আর তীব্র কষ্ট নিয়ে ডালিয়া বলল, কতদিন পর আসলি! দেখতে আসিস না কেন আমাকে? তোর বাসায়ও তোর জন্য অপেক্ষা করে তোকে পাইনা। দেখতে ইচ্ছা হয়না আমাকে তোর?
নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে ডালিয়ার। কেন যেন কান্না পাচ্ছে। বাসায় ইদানিং ভাবীদের খোটা আরও বেড়েছে। মা’ও কেমন যেন ভাবীদের খোটার বিপরীতে তার পক্ষ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাসার কাজ গুছিয়ে প্রায় দৌড়ে জুলেখার বাসায় যায় সে। জুলেখাও কেন যেন আর কথাবার্তা তেমন বলেনা। তবু ডালিয়া অপেক্ষা করে, রাকিব আসলে তাকে একনজর দেখে চলে যাবে সে। কিন্তু রাকিব আসেনা, রাতের খাবারের সময় হয়ে যায়, ডালিয়ার ফিরে আসতে হয়।

ডালিয়ার কথার উত্তরে রাকিব বলল, কিছু ভালো লাগেনা কেন যেন। কোন কিছু আর আগের মত মনে হয়না। আগে কাজে গেলে সবাইকে কিছু একটা দেখায় দেওয়ার ইচ্ছা হত। দেখাতে ইচ্ছা হত, আমিও ওদের মতই কাজ করতে পারি। কিন্তু এখন কেন যেন আর ভালো লাগেনা। শুধু করা লাগে বলে করি।
- আর তোর মা? তোর সাথে তোর মার কি সুন্দর সম্পর্ক ছিল।
- কি জানি! কেন যেন মনে হয়, কোন কারণে মা আমার উপর রেগে আছে। বুঝিনা। কথাও তেমন হয়না আগের মত।
- রাকিব আমি জানি, তুই শরীফ ভাইয়ের কাছে গেছিলি। আমার ভায়ের কাছে শরীফ ভাই তোর গল্প করছে। তোর অনেক প্রশংসাও করছে।
শুকনো হাসি হেসে রাকিব বলল, কি লাভ।
ডালিয়ার মনে পড়ল, রাকিব শরীফকে কি বলেছিল। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। বলল, আসিসনি কেন আমার কাছে পরেরদিন? এতটুকু মানুষ তুই, একা একা কেন পারবি এত সহ্য করতে?
চোখে পানি এল রাকিবের। ভাঙ্গা গলায় বলল, আসতে চাইছিলাম ডালিয়াবু। পরে ভাবলাম, না আসাই ভাল।
- কেন ?
- এসে কি লাভ? আমার তো একা থাকার, সবকিছু একা সহ্য করার অভ্যাস করতেই হবে। তুই তো থাকবিনা বেশিদিন। বিয়ে হয়ে যাবে তোর।
কথাটা শুনে হঠাৎ কেন যেন আনন্দ জাগল ডালিয়ার। সে জানে, রাকিব তাকে প্রেমিকা হিসেবে চিন্তা করে একথা বলেনি, কিন্তু সে এটাও জানে যে, সে চলে গেলে রাকিব দুঃখ পাবে। তার কথা ভাববে। আর বছর ৬/৭ পরে হয়ত দুঃখ পাবার কারণটাও বুঝবে। এই প্রথম তার বিয়ে না হওয়ার জন্য কোনো দুঃখ জাগলো না মনে। বরং কেমন যেন খুশী লাগল। আনন্দ মাখা স্বরে ডালিয়া বলল, আমার বিয়ে দেরি আছে আর আমাকে কেই-বা বিয়ে করবে।
খুব স্বাভাবিক গলায়, যেন সাধারণ একটা দৃষ্টি ভঙ্গি- এমন ভাবে রাকিব বলল, কেন হবেনা? কেন কেউ করবেনা? তুমি কত সুন্দর!
অভিভূত হয়ে রাকিবের দিকে তাকিয়ে রইল ডালিয়া। সে সুন্দর নাকি রাকিব তার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পায়? রাকিব নির্বিকার। এটা তার জন্য খুব সহজ সাধারণ উপলব্ধি। অস্থির লাগছে ডালিয়ার। বুকে আনন্দ ধরছেনা যেন, রাকিবের হাত শক্ত করে ধরে ডালিয়া বলল, আমার বিয়ে হবেনা ব্যাস। তুই আমাকে সব বলবি এখন থেকে, সব।
মৃদু হেসে রাকিব বলল, আচ্ছা।
এরপর মাথা নীচু করল ডালিয়া। চুল ঢেকে দিল তার মুখ। হাতের এক আঙ্গুল দিয়ে চুল গুলো কানের পিছনে সরিয়ে দিল সে। কিন্তু মাথা না তুলেই বলল, আমি অপেক্ষা করবরে পাগল। যতদিন লাগে অপেক্ষা করব।
বিমূঢ় রাকিব কিছুই বুঝলনা। বলল, কিসের অপেক্ষা?
লাজুক স্বরে ডালিয়া জবাব দিল, পরে বললব সোনা। যা, এখন বাসায় যা।

৬.
চুপ করে বসে আছে জুলেখা। রাকিবের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ গতকাল রতে ব্যাপারটা তার মাথায় এসেছে। তার জীবনে হয়ত আর সুখী হওয়া হবেনা। এই সাতাশ বছর বয়সেই যৌবনের যবানিকা টানতে হবে হয়ত। শরীফ আর আসলনা কেন কে জানে! বিয়ের কথা বলাতে কি সে এতই বিরক্ত হয়েছে ! সে ভেবেছিল, বিয়ে না করলেও হয়ত আগের মত প্রেম চালিয়ে যাবে। জুলেখা তাই অপেক্ষা করছিল শরীফের জন্য। শরীফকে তার ভাল লাগে। সমাজের বাঁধা নিষেধ উপেক্ষা করেও তাই তার সাথে দিনের অন্তত ২/১ ঘন্টা কাটাতে চায় সে। ঠিক করেছিল, একবার আসলে আর বিয়ের কথা বলবেনা সে। কিন্তু আজ ডালিয়া বলল, শরীফ বলে বউকে আনতে বাপের বাড়ি গেছে। আর সে তার মা’কে বলেছে, ভালো করে ঘর সংসার শুরু করবে এবার। শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল জুলেখা, সবার গতি হয়, শুধু তার-ই হয়না।

কিন্তু জোর করে এসব চিন্তা সরিয়ে দিল সে। যা হবেনা তা নিয়ে দুঃখ করলে কোনও দিকই পাওয়া যাবেনা। রাকিবের সাথে ভাল ভাবে কথা হয়না বহুদিন। রাকিব তাকে যতটা ভালবাসে আর তো কেউই বাসবেনা ততটা। কেন শুধু শুধু ছেলেটার সাথে দূরত্ব বাড়ানো তাহলে? নিজেকে নিয়ে আর চিন্তা না করার সিদ্ধান্ত নিল সে। তার জীবনে যা হয় হবে, কে আসবে কে যাবে এসব নিয়ে আর চিন্তা করবেনা। এখন তার মূল দায়িত্ব হলো, শুধু রাকিবের সাথে ভাল সময় কাটানো। ছেলেটা বড় হচ্ছে, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছেলেটা মানুষ হলে সেটা জীবনে একটা বড় প্রাপ্তি হবে। আর কি লাগে জীবনে! তাদের অবস্থা এখন বেশ ভালই, সে ব্যস্ত থাকার জন্য এখন সেলাই ছাড়াও ছোট খাট কাজ শুরু করেছে। রাকিবও নতুন কাজ শুরু করেছে। এটাতে টাকা বেশী। নূরজাহান প্রথমে নতুন এই কাজটায় যোগ দেওয়ার পর রাকিবকে বলেছে নতুন কাজটার কথা। অনেক সাহায্য করেছে মেয়েটা- রাকিব যেন কাজটা পায় তার জন্য। একদিন ডাকতে হবে তাকে। রাকিব খুব গল্প করে মেয়েটির।
হঠাৎ জুলেখা ঠিক করল, আজ খুব ভাল খাবার দাবার রান্না করে চমকে দেবে রাকিবকে। রাকিব যা উপার্জন করে তার বেশীর ভাগ-ই মা’কে দিয়ে দেয়। জুলেখা অল্প কিছু টাকা জমিয়েছিল, সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে দোকানে গেল সে তাড়াতাড়ি।

সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাকিব সাধারণত এ সময় আসে কিন্তু আজ আসছেনা কেন! রান্না প্রায় শেষ। ঠান্ডা হয়ে যাবে তো! ছেলের দুশ্চিন্তায় দরজার চৌকাঠে বসে রইল জুলেখা।

অপরদিকে কাজে একটু বিরতি পেয়ে নূরজাহান আর রাকিব অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছে। কাল ছুটি, এটাও একটা কারণ। রাকিব সব বলল নূরজাহানকে। নূরজাহান স্নেহের সুরে অনেক কিছু বলল তাকে। অবশেষে জিজ্ঞাস করল, তা তোর মায়ের কি মন অনেক খারাপ থাকে এখন?
- হুমম
- কিছু বলছে তোকে? তোর মা তো তোকে সব-ই বলে।
- না, মা’র সাথে তেমন একটা কথা হয়না ইদানিং।
- কেন?
- জানিনা, বুঝিনা। হয়ত আমাকে আর আগের মত ভালবাসেনা। আমার জন্যই তো বিয়েটা হলোনা।
- আহ্‌! কি বাজে বকিস! তুই তো শরীফের সাথে কথা বলছিলিই। তখন বুঝিসনি যে, এটা আসলে কোন কারণ না?
- কি জানি!
- শোন বাপ, যা হইছে ভুলে যা। তোর এখন তোর মায়ের সাথে সবসময় থাকা, আরও বেশী গল্প করা উচিৎ।
আরও অনেক কথা বলল নূরজাহান। রাকিবের ভাল লাগল কথাগুলো। ঠিক করল, আজ আগের মত আবার মা’র সাথে অনেক কথা বলবে। ফেরার পথে মা’র জন্য একটা চাদর কিনল। শীতকাল আসছে, মা’র দরকার হবে। কি মনে হতে আবার একটা আলতা কিনল ডালিয়ার জন্য।

দিন ছোট হয়ে আসছে। আঁধার তাই তাড়াতাড়ি নামে। আজ ডালিয়াও আসেনি। জুলেখা অস্থির হয়ে ঘরের সামনে পায়চারি করছে। রাকিবকে দেখতেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে। অস্থির গলায় বলল, এত দেরি হলো ক্যান বাবা?
একটু অবাক হয়ে রাকিব বলল, এমন দেরি তো আমার মাঝে মাঝে হয় মা।
- কি জানি! আজকে ভাল ঠেকছিলনা। কিছু হয়নি তো রাস্তায়?
- আরে না, কি আবার হবে!
ঘরে খাবার সাজানো। রাকিবকে চমকে দেওয়ার জন্য ঘরে ঢুকতে দিলনা জুলেখা। বারান্দায় ঝোলানো গামছা দিয়ে বলল, একেবারে গোসল করে তারপর আয়, যা।
- কেন?
মিটিমিটি হেসে জুলেখা বলল, যা না, যা বলতেছি কর ।
- আচ্ছা ব্যাগটা রেখে আসি।
রাকিবের হাতে পলিথিনের ব্যাগটা চোখে পড়ল জুলেখার। বলল, ব্যাগে কি ?
এবার মিটিমিটি হেসে রাকিব বলল, বলবনা। ঘরে ঢুকতে দে, তাইলে বলব।
মা ছেলের মধ্যে খুনসুটি শুরু হল। শেষে রাকিব বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি গোসল করে আসতেছি। কিন্তু কথা দে, তুই ব্যাগ খুলবিনা।
- আচ্ছা যা।
- মাথা ছুয়ে বল।
জুলেখার খুলে দেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ছেলের মাথা ছোয়ার পর সে ইচ্ছা ত্যাগ করতে হল।

রাকিব গোসল করে ঘরে ঢুকল। হারিকেন অন্য পাশে, তাই খাবারের আয়োজন দেখতে পাচ্ছে না। বলল, ভাত দে মা ।
- হুম দিচ্ছি বস।
রাকিব বসল। এত খাবারের আয়োজন দেখে অবাক হয়ে সে জুলেখার দিকে তাকালো। শব্দ তুলে হাসল জুলেখা। মুগ্ধ হয়ে মা’র হাসি দেখল রাকিব। কি অপূর্ব তার মা! জুলেখা বলল, সব তোর জন্য। ভাল করে খাবি, তারপর আমরা সারারাত মা-বেটায় গল্প করব। অনেকদিন তোর গল্প শুনিনা। কাল তো তোর কাজ নেই, বেলা করে ঘুমাস ।
- ঠিক আছে। কিন্তু এত তো খেতে পারবনা মা। কিছু তুলে রাখ, কাল খাবনি।
- না। প্রতিদিন তো আর করতে পারিনা। আজ একেবারে পেট ভরে খাবি।
লাফ দিয়ে উঠে পড়ল রাকিব এবার। বলল, আচ্ছা এবার তুই চোখ বন্ধ কর।
- ক্যান?
- কর না।
জুলেখা চোখ বন্ধ করল। রাকিব আস্তে করে চাদরটা বের করে মা’র গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, চোখ খোল, ক্যামন?
এবার জুলেখার অবাক হওয়ার পালা। বলল, আহ! এসব বাজে খরচ ক্যান করিস? আমার তো চাঁদর আছে।
- ওটা ছিড়ে গেছে আর বাজে খরচ মানে! বল না, কেমন লাগলো তোর?
আবেগী হয়ে উঠল জুলেখা। তার জন্ম সার্থক মনে হচ্ছে ঠিক এই মুহুর্তে। বলল, খুউব, খুব সুন্দর বাপ আমার। কিন্তু লাল আনলি কেন ? লাল পড়ার বয়স আর আছে নাকি আমার।
- কি যে বলিস মা! আর তোরে লালে সুন্দর দেখায়।
- খুব সুন্দর হইছে বাপ।
ছেলের কপালে চুমা খেল জুলেখা। এরপর তাগাদা দিয়ে বলল, নে এবার বসে পড় তো। খাবার তো সব ঠান্ডা হয়ে গেল ।
যে পলিথিনের ব্যাগ থেকে মায়ের জন্য চাঁদর বের করল, সেখানে ডালিয়ার জন্য আনা আলতাও ছিল। জুলেখা খেয়াল করল চাদরটা বের করার পর রাকিব সাবধানে নিজের পিছে ব্যাগটা লুকিয়ে খেতে বসল। জুলেখা দেখেনি এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল এবং এদিক ওদিক অযথাই কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে রাকিবের পিছে গিয়ে ব্যাগটায় হাত দিতেই মায়ের হাত চেপে ধরল রাকিব। জুলেখা বলল, কি আছে রে ভিতরে ?
কেমন যেন লজ্জা পেল রাকিব। ব্যাপারটা সে নিজেও বোঝেনা। ইদানিং ডালিয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা সে সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলতে পারেনা কারও সাথে। রাকিব জবাব দিল, কিছু না মা।
- আহা দেখিনা।
তীব্র আপত্তি জানাল রাকিব, না না।
অভিমান ভরে অপর দিকে মুখ ফিরিয়ে বসল জুলেখা। বলল, আচ্ছা যা দেখলাম না। তুই এখন আমার কাছ থেকেও কথা লুকাস!
রাকিবের পিঠের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে জুলেখা। আড় চোখে এখনও পলিথিনটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাকিব তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে থালার মধ্যে হাত ধুয়ে, থালাটা সরিয়ে মায়ের দিকে ঘুরে বসল। জুলেখা তখনও পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে। মায়ের মাথায় হাত রেখে রাকিব বলল, খাবার খুব মজা হইছে মা।
- তো কি হইছে!
- তুই খেতে বস।
- না, খাবনা ......... হাত সরা, আল্লাদ করতে হবেনা।
কিছুক্ষণ চুপ থাকল রাকিব। এরপর বলল, রাগ করছিস?
- না, রাগ করব কেন ? রাগ তো খালি তোর একার জিনিস।
এবার উঠে দাঁড়িয়ে আগের জায়গায় ফিরে গেল জুলেখা। থালায় ভাত আর তরকারি নিয়ে খাওয়া শুরু করল চুপ করে। রাকিব বলল, এ মা।
জুলেখা জবাব দিলনা। মাথা নিচু করে খাচ্ছে সে। রাকিব এবার আস্তে করে পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে কাগজে মোড়া আলতার বোতলটা বের করতে লাগল। মাথা নীচু করা অবস্থাতেই চোখ উপরে তুলে দেখতে থাকল জুলেখা। খুব ধীরে ধীরে এবার কাগজটাও খুলছে রাকিব। খোলা শেষ করে রাকিব বলল, আলতা।
এবার শব্দ তুলে হাসিতে মেতে উঠল জুলেখা। হাসি যেন তার থামতেই চায়না। বিব্রত হয়ে রাকিব বলল, হলোটা কি?
হাসির দমকে গলায় ভাত আটকে গেল জুলেখার। কোনমতে হাসি থামিয়ে পানি খেয়ে একটু শান্ত হলো সে। এর পর মৃদুভাবে কিছুক্ষণ হেসে, হাসির উপসংহার তুলে বলল, এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন তুই?
ধরা পড়ে গিয়ে অস্বীকার করে রাকিব বলল, লজ্জা পেলাম কই?
আবার হাসতে হাসেত জুলেখা বলল, এই যে আবার পাচ্ছিস।
এরপর হাসি থামিয়ে জুলেখা রহস্য ভরা কণ্ঠে বলল, আমি কিন্তু জানি তুই ওটা কার জন্য কিনছিস।
- এহ্‌! মোটেও জানিসনা।
- তাই, না? আমাকে কি তোর এতই বোকা মনে হয়। আর শোন, মেয়েরা এসব ভাল বোঝে।
- আচ্ছা এতই যখন বোঝ, তাইলে বলতো কার জন্য।
- বললে তো আবার লজ্জা পাবি।
- মোটেই না আর তুই পারবিওনা।
- শোন, ডালিয়া সারাদিন খালি তোর কথা শুনতে চায়, তোর জিনিসপত্র দেখে, তোর কাপড় চোপড় গুছায়, আরও বলব?
- না।
এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি রাকিব। চুপ করে বসে থাকল সে। জুলেখা খাওয়া শেষ করে থালা বাসন নিয়ে বাইরে গেল। রাকিব তাড়াতাড়ি উঠে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। কেন যেন লজ্জা করছে মায়ের সাথে কথা বলতে। মা আবার রাগ করেনি তো- পয়সা খরচ করে ডালিয়ার জন্য জিনিস কেনায়! ভাবল রাকিব, ভাগ্যিস আজ তবুও মা’র জন্য ও কিছু কিনেছিল। এর আগে তো শুধুমাত্র ডালিয়ার জন্য কিনেছিল। তখন ধরা পড়লে তো মা আরও মন খারাপ করত আর লজ্জা পেত।
জুলেখা ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে ছেলের মাথার কাছে এসে বসল। বলল, ওই, ওঠনা, কাল তো কাজ নাই। একটু গল্প করি, ওঠনা।
উঠে বসল রাকিব। জুলেখার চোখে মুখে আবার দুষ্টমি ফুটে উঠল। মিটিমিটি হাসছে সে। রাকিব বলল, উফফ হাসিস ক্যান?
- অনেক ভালবাসিস বাপ ডালিয়াকে?
এই ১০/১১ বছর বয়সে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে যার পর নাই লজ্জা পেল রাকিব। বলল, কি বলিস এসব তুই?
ছেলের আরও কাছে সরে এসে বসল জুলেখা। বলল, বলনা! আমি তোকে আমার প্রেমের কথা বলছিলাম না! তুই বল।
- আমি জানিনা মা।
- তা তো জানবিই না, পোলা মানুষ হইল গাধা। মানে, এসব ব্যাপারে গাধা। ডালিয়া কিন্তু তোকে খুব খুব ভালবাসে রে পাগলা।
শোনার ইচ্ছা জাগল ডালিয়া কি বলে তার ব্যাপারে। কিন্তু লজ্জার কারণে বলতে পারলনা কিছু। জুলেখা আবার বলল, তা ডালিয়াকে বিয়ে করছিস কবে ?
তীব্র আপত্তি জানাল রাকিব, মা! ভাল হবেনা বলে দিচ্ছি কিন্তু!
মুখে আঁচল চেপে হাসি আটকাল জুলেখা। আবার বলল, আমার কিন্তু ডালিয়াকে বৌমা হিসেবে খুব পছন্দ।
এভাবে তাকে নিয়ে আগে কেউ ফাযলামি করেনি। তারপরও কেমন যেন ভাল লাগছিল রাকিবের। কেমন যেন আনন্দমাখা বিরক্তি নিয়ে রাকিব বলল, উফফফ ....... আমি শুলাম।
আবার শব্দ তুলে হেসে উঠল জুলেখা। রাকিব আবার শুয়ে পড়েছে মায়ের দিকে পিঠ দিয়ে। অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে জুলেখা বলল, ঢং! পোলা মানুষের এত লজ্জা কিসের অবার?
- আরে তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলবা ..... আর আমি লজ্জা পাইলাম কখন? ....... ডালিয়াবু আমার চাইতে বড় না?
- আরে ওসব ২/৩ বছরের বড় কোন ব্যাপার না, ওঠ না, উঠে বস।
আবার উঠল রাকিব। এবার ছেলের লজ্জা ভাঙ্গানোর জন্য স্বাভাবিক স্বরে জুলেখা বলল, আলতাটা মানাবে রে ডালিয়াকে।
সরু চোখে তাকিয়ে রাকিব বোঝার চেষ্টা করল মা আর রসিকতা করছে কিনা। রসিকতার কোনো চিহ্ন না দেখে একটু সাহস করে রাকিব বলল, আসলেই ?
- হ্যাঁ ........ বড় হ, তুই বুঝবি তুই কত ভাগ্যবান।
- মানে?
- মেয়েটাকে ধরে রাখিস, খুব ভাল হবে।
কি বলবে বুঝে পেলনা রাকিব। বলল, আসলেই?
উত্তর দিলনা জুলেখা। কি যেন ভাবছে সে। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। স্মৃতির ভিতরে ডুব দিয়ে জুলেখা ধীরে ধীরে বলতে থাকল, ডালিয়াও ভাগ্যবতী। এই বয়সে প্রিয় এমন একজন মানুষের কাছ থেকে কিছু পাওয়া! ডালিয়ার বয়সে আমার বাপও এমন একটা আলতা কিনে দিছিল আমাকে। সারাদিন আলতা দিয়ে ঘুরতাম। রংটা একটু উঠে গেলেই আবার দিতাম। অভাবের সংসারেও খুব সুন্দর সময় ছিল রে তখন।
এবার মায়ের কোলে মাথা রেখে শু’ল রাকিব। জুলেখা আনমনা হয়ে ছেলের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, তোর বাপ যে ২/৩ বছর সাথে ছিল, ওই সারা সময়ে শুধু একবার একটা শাড়ি দিছিল। আমার মনে আছে, আনন্দে আমি সারারাত কানছিলাম আর তোর বাপ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল ....... সারাজীবনটা যদি পছন্দের একটা মানুষের সাথে পার করে দেওয়া যায়, তাহলে সেটার যে কি আনন্দ তুই বড় হলে বুঝবি ....... বছর কয়েক যাক, আপারে বলে ডালিয়াকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসব। তুই কিন্তু ওরে কষ্ট দিবিনা কখনও। ঠিক আছে ?
- জানিনা মা। ডালিয়াবুর তো বিয়ের জন্য খুব পাত্র দেখা হচ্ছে।
- বিশ্বাস রাখ, আমি ডালিয়াকে চিনি।
- এ মা, বছর দুয়েকের মধ্যে আরেকটা ঘর তুলতে পারব, কি বলিস?
এবার আবার দুষ্টামির হাসি ফুটল জুলেকার মুখে। বলল, ও ..... হো ..... বউকে নিয়ে মা’র সাথে তো আর থাকা যায়না, তাই না? নতুন ঘর তো লাগবেই।
কোল থেকে উঠে বসে রাকিব বলল, তুই বড়ই শয়তান।
হেসে উঠে জুলেখা। বলল, আয় না বাপ, কাছে আয়। তোর সাথে শয়তানি করব না তো কার সাথে করব!
আবার মায়ের কোল ঘেষে বসল রাকিব। বলল, বাবার গল্প একটু করবি মা? শুনি।
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনায়- কখনও হাসি, কখনও রসিকতা, কখনও অভিমান, দুঃখ, অপরিচিত সুখের কল্পনায় সারা রাত কাটিয়ে দিল জুলেখা আর রাকিব।

(চলবে)


মন্তব্য

তদানিন্তন পাঁঠা (জুন) এর ছবি

শুরুতে একটা হাতি লাগত। হাসি অর্ধেক পড়ে ইটা রাইখ্যা গেলাম... রেখে গেলাম। পড়ে পুরোটা পরে লগিন করে মন্তব্য করব।

বন্দনা এর ছবি

গতকাল্কেই লিখাটা পড়েছি, মন্তব্য করা হয়নি। আপনার গল্পটা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই এগুচ্ছে, তবে এত বড় করে না দিয়ে ছোট কয়েকটা পর্বে দিলে আমাদের পড়তে সুবিধে হয়। অনেকেই লেখার সাইজ দেখে হয়তো লেখাটা পড়েননি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ বন্দনা আপনার সাজেশান এর জন্যে।
খুব বেশী একটা লেখা হয়না আমারএখানে।
যা হোক, দ্বিতীয় পর্বটায় অল্প করে দিলাম।
এ্যাডমিন নির্বাচন করলে হয়ত ছাপা হবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।