বুয়েটে এবার বিপরীত অবস্থানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা, ইস্যুঃ টার্ম বর্ধিতকরণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/০৬/২০১৩ - ১:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুয়েটে এখন ১৪তম সপ্তাহের ক্লাস চলছে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ক্লাস চলবে আরো এক সপ্তাহ। আর নতুন ঘোষণা বলছে, আরো দুই সপ্তাহ ক্লাস বৃদ্ধির কথা। এই নিয়েই গত বেশ কয়েকদিন ধরে পরষ্পরবিরোধী অবস্থান বিরাজ করছে বুয়েটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে। একদিকে শিক্ষার্থীরা চায় না আর ক্লাস বাড়ুক, অন্যদিকে শিক্ষকরা ক্লাস বৃদ্ধির দাবিতে অনড়। এই নিয়ে কয়েক দফার বৈঠক আর আলোচনাতেও কোনো ফল না আসায় উপাচার্যের প্রস্তাব দুপক্ষের দাবির মাঝামাঝি- এক সপ্তাহ ক্লাস বৃদ্ধি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এর আগে হরতালের কারণে তের সপ্তাহের টার্ম দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে পনের সপ্তাহ করা মেনে নিলেও এবার আর এক সপ্তাহও ক্লাস না বাড়ানোর দাবিতে অনড়।

ঘটনার শুরু একটু আগে থেকে বর্ণনা করা যাক। প্রশাসনের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই আন্দোলন করেছিল ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকেরা। কিন্তু সেসময় মূল অভিযুক্ত উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়াই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে মূল্যবান পাঁচটি মাস বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। তখন শিক্ষকেরা কথা দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে বৃহস্পতি-শুক্রবার অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে হলেও শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি তারা পুষিয়ে দেবেন। কিন্তু পরবর্তীতে দীর্ঘসময় এর আশ্বাসের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায় নি। তবে হরতালের কারণে ক্লাস বিঘ্নিত হলে দুই সপ্তাহ টার্ম বর্ধিতকরণের পর অনেক শিক্ষক অফপিরিয়ড এবং বৃহস্পতি-শুক্রবারে ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করার উদ্যোগ নেন এবং অধিকাংশ শিক্ষক পিছিয়ে পড়া সিলেবাস পুষিয়ে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ সেই পরিমাণে হরতাল না থাকা সত্ত্বেও হটাৎ করেই ক্লাস বর্ধিতকরণের ঘোষণা আসে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে ক্লাস প্রতিনিধিদের মতামতের জন্য ডাকা হলেও পূর্বেই জানিয়ে দেয়া হয় সিদ্ধান্ত। আর এরপর থেকেই শুরু হয় ছাত্র-শিক্ষক বিরোধী অবস্থানের।

এবার একে একে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের যার যার দাবির পক্ষে কারণগুলো খতিয়ে দেখা যাক।

যদি ক্লাস পনের সপ্তাহে শেষ হয়, অর্থাৎ পূর্বঘোষিত রুটিনে পিএল এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে পরীক্ষা শেষ হবে একুশ রোজায়। আর যদি একসপ্তাহও ক্লাস বাড়ে তাহলে পরীক্ষা ঈদের পরে যাবে- অর্ধেক বা পুরোটাই। সেক্ষেত্রে, বুয়েটে ভেঙ্গে পরীক্ষা দেয়া খুব বিরল এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই পুরো পরীক্ষা ঈদের পরে চলে যায়। আর যদি ঈদের আগে শুরু হয়ে কিছু পরীক্ষা ঈদের পরে যায় তাহলেও কয়েক সপ্তাহ বাড়তি নষ্ট হবে কারণ ঈদের পর দুই-এক সপ্তাহ বন্ধ ছাড়া সাথে সাথে পরীক্ষা শুরু বুয়েটের বাস্তবতায় অসম্ভব বলা চলে। আর এভাবে পরীক্ষা শেষ, টার্ম গ্যাপ, রেজাল্ট সব মিলিয়ে পরবর্তী টার্ম শুরু চলে যেতে পারে কোরবাণীর ঈদের পরে। অর্থাৎ এই টার্মের মেয়াদ গিয়ে দাঁড়াবে আট থেকে সাড়ে আট মাসে। আর সেই সাথে আগামী টার্মের নির্বাচনকেন্দ্রিক চোখরাঙ্গানি তো থাকছেই!

অন্যদিকে শিক্ষকদের দিক থেকে বলা হচ্ছে যে, তারা কোর্স শেষ করতে পারেন নি। টার্ম বর্ধিতকরণ তাই আবশ্যক। এর জবাবে মিটিংয়ে জুনিয়র ব্যাচের এক ক্লাস প্রতিনিধি জবাব দেয়, “স্যার আমাদের তো অনেক কোর্সের ক্লাস শেষ। তারপরও আপনাদের কথা অনুসারে কোন স্যারের যদি উইক বাড়ানোর খুব প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি শেষ হয়ে যাওয়া কোর্সের পিরিয়ডে ক্লাস নিতে পারেন।" এর জবাবে জনৈক শিক্ষকের জবাব, "তোমরা প্রতি ক্লাসে ১০ মিনিট দেরী করে আসতে। এর ফলে প্রতি সপ্তাহে আমার ত্রিশ মিনিট লস গেছে। তাতে পুরো টার্মে সাতটা ক্লাস মিস গেছে। এখন সাতটা ক্লাস আমি কেন এক্সট্রা ক্লাস করে মেকাপ করব...”

উপরের কথাগুলো ছিল বুয়েটের বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্রদের কাছ থেকে পাওয়া। এবার একটু অফ দা রেকর্ডে আসি। ফেসবুকের মেসেজ বক্সে বুয়েটের এক তরুণ শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া। অতিসম্প্রতি সাভারের গার্মেন্টস ধ্বস হাজার হাজার শ্রমিক আর তাদের পরিবারের জীবনে অভিশাপ হয়ে এলেও পরোক্ষভাবে লাভের মুখ দেখতে যাচ্ছেন বুয়েটের শিক্ষকরা। পত্রিকার লেখালেখি আর চারদিকের সমালোচনার চাপে রাজউকে এখন ব্যাপক কড়াকড়ি। বিল্ডি, গার্মেন্টস, কারখানার অনুমোদন পেতে অনেকেই তাই ছুটছেন বুয়েটের সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে। ফলাফল বুয়েট সিভিল বিল্ডিংয়ের ডিজাইন রুমে দিনমান সিনিয়র শিক্ষকদের ভীড় লেগে থাকা। প্রতিটি ল্যাপটপে চলছে ডিজাইনের কাজ। ক্লাস নেবার ফুসরত কই এখন এই ব্যস্ত শিক্ষকদের? তাই শিক্ষকদের মধ্যে সিভিল ও এই সম্পর্কিত কাজের শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি সরব এই ক্লাস বর্ধিতকরণের দাবিতে। ক্লাস না হয় অল্প বিস্তর নিয়ে বুঝ দেয়া গেল, কিন্তু পরীক্ষা শুরু হলে তো সুযোগ মিলবে না এইভাবে রাতদিন ডিজাইন করার। কাজেই কোপ ফেল শিক্ষার্থীদের উপর। হরতালের অজুহাতে ক্লাস বাড়ালেই উপরের হিসাব মত পরীক্ষা চলে যাবে ঈদের পর। আর ততদিনে অনেকখানি গুছিয়ে আনা যাবে ডিজাইনের কাজ।

এই অবস্থায় এখনো অবসান হয় নি মতবিরোধের। প্রশাসনের সিদ্ধান্তের উপর ঝুলে আছে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া বুয়েটিয়ানদের আরো কয়েকটি মাসের ভবিষ্যৎ।

-- বাংলামায়ের ছেলে


মন্তব্য

অচল এর ছবি

জীবনে এই প্রথম শুনলাম শিক্ষকরা ক্লাশ বাড়াতে চান। কোনদিন ইঞ্জিনিয়ার-ইং পড়ার সময়, কোন শিক্ষকের মুখে এই কথা শুনি নাই। অ্যাঁ তাই লেখকের শেষ অনুযোগের বৈধতা থাকার সম্ভবনাই বেশী বলে মনে হয়।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বছরের পর বছর ধরে সেশন জটের দায় চাপানো হয়েছে শুধুমাত্র ছাত্রদের ওপর। কিন্তু সেশন জটে একমাত্র লাভবান পক্ষ হলো শিক্ষকরা। সেমিস্টারের প্ল্যান এমনভাবে করা হয় যাতে ঈদ, পুজা, বিশ্বকাপের মধ্যে পিএল/পরীক্ষা পড়ে, ক্যাচাল লাগে, বুয়েট বন্ধ হয়, খ্যাপ ও ছুটি উপভোগ করা যায়।

ছাত্ররা একটা দীর্ঘসময় কর্তৃপক্ষের/শিক্ষকদের এই চালবাজি বুঝতে পারে নাই। ছাত্রদের সচেতনতা দেখে ভালো লাগছে।

বাড়তি ২ সপ্তাহ পেলে পড়িয়ে দুনিয়া উলটানো শিক্ষক বুয়েটে নাই। যারা আন্তরিক, তারা সিলেবাস শেষ করার কথা। যারা চোথার পাতা উলটাইয়া শিক্ষক, তাদেরই ছুটিটা দরকার।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

পল্লব এর ছবি

ছাত্ররা একটা দীর্ঘসময় কর্তৃপক্ষের/শিক্ষকদের এই চালবাজি বুঝতে পারে নাই। ছাত্রদের সচেতনতা দেখে ভালো লাগছে।

বাড়তি ২ সপ্তাহ পেলে পড়িয়ে দুনিয়া উলটানো শিক্ষক বুয়েটে নাই। যারা আন্তরিক, তারা সিলেবাস শেষ করার কথা। যারা চোথার পাতা উলটাইয়া শিক্ষক, তাদেরই ছুটিটা দরকার।

চলুক

==========================
আবার তোরা মানুষ হ!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা সিভিল ফ্যাকাল্টির পুরনো রোগ। গত ত্রিশ বছর ধরে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে নানা উপায়ে তারা এই কাজ করে আসছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি এমনই দাঁড় করানো হয় যে শেষ পর্যন্ত দোষটা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপে। অথচ এসব ঘটনায় একমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

আকার-আকৃতি-ক্ষমতায় সিভিলের চেয়ে বড় কোন ফ্যাকাল্টি এখনো গড়ে না ওঠায় তাদেরকে ঠেকানো যায় না। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে যারা এই প্রক্রিয়ায় জড়িত নন্‌ তারা যদি একটু মুখ খুলতেন, উদ্যোগ নিতেন তাহলে শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় এই খারাপ ঐতিহ্যটা বন্ধ করা সম্ভব হতো।

অনেক আগেই উচিত ছিল বুয়েটের পরীক্ষা নেবার ক্ষমতাটা ডিপার্টমেন্টের হাতে ছেড়ে দেয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু বহু কাল ধরে এটা চর্চা করে অধিকাংশ ডিপার্টমেন্টে সেশনজট প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে। কয়েক দশক ধরে এই বিষয়টা আলোচিত হলেও বুয়েট কর্তৃপক্ষ কখনোই এমনটা করার উদ্যোগ নেয়নি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

উদ্ভ্রান্ত পথিক এর ছবি

চলুক

---------------------
আমার ফ্লিকার

গোরা এর ছবি

ক্লাস না বাড়ালেও ঈদের আগে সব পরীক্ষা শেষ হবে না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।