আমাদের জ্যাঠামনি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৩/০৭/২০১৩ - ১০:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“কুমুদিনী” নামটার সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্ট, কুমুদিনী হাসপাতাল,ভারতেশ্বরী হোমস এর কথা জানি। ।পরিচিত জনকে দেখি “কুমুদিনী গিফট শপ” থেকে কেনাকাটা করতে পচ্ছন্দ করেন, তাদের কে বলতে শুনি, কুমুদিনীর প্রোডাক্ট মানেই আভিজাত্য, রুচিশীলতা এবং দেশিয় ঐতিহ্যের মিশেল কিন্তু কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্টের প্রতিষ্ঠাতার কথা আমরা কি জানি ? এই দেশের অসহায় মানুষের জন্য নিবেদিত প্রান এই মানুষটার কথা হয়ত আমরা অনেকেই জানিনা বা জানলেও আস্তে আস্তে বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে , সে জন্যই মনে হল এই মানুষটাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ---- দানবীর শ্রী রনদা প্রসাদ সাহা ( আর পি সাহা) জন্ম গ্রহন করেন ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর টাংগাইল জেলার মির্জাপুর নামক গ্রামে। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা ও মায়ের নাম কুমুদিনী সাহা ।অত্যন্ত গরীব ঘরে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মা (কুমুদিনী সাহা) টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু বিনা চিকিৎসায় মারা যান ।দারিদ্রতার জন্য রনদা প্রসাদ সাহা পড়া লিখা করতে পারেন নি তাঁর যখন ১৬ বছর বয়স তখন তিনি ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় যান । তিনি “বাংলা এ্যাম্বুলেন্স কর্প “ এ সৈনিক হিসাবে যোগ দান করেন এবং প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে যান, তাঁর পোস্টিং হয় করাচীতে।তার কাজ ছিল যুদ্ধাহতদের সেবা দান করা। , চাকরিতে সুনামের কারনে সম্মান স্বরূপ ১৯১৬ সালে নতুন বাংলা রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন । পরবর্তীতে তিনি ইন্দিয়ান রেলওয়েতে যোগদান করেন । ১৯৩২ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়, তিনি কোলকাতায় ছোট খাট ব্যাবসা ( লবণ ও কয়লা ) শুরু করেন , ধীরে ধীরে ব্যাবসা প্রসার লাভ করে এবং বিভিন্ন শাখায় ছড়িয়ে জেতে থাকে, সে অনেক কথা , অন্য দিন লিখবো । আস্তে আস্তে দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা ভারতীয় উপমাহাদেশের ধনী ব্যাক্তিতে পরিণত হন এবং দারিদ্রের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন -----
১৯৩৮ সালে তিনি তাঁর নিজ গ্রাম মির্জাপুরে একটি আউট ডোর সুবিধা সহ ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৩-৪৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় তিনি তার এলাকার দুর্ভিক্ষ পিরীত মানুষের খাবার যোগান দিয়ে যান দীর্ঘ ৮ মাস । ১৯৪৪ সালের ২৭ জুলাই ৭৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল তৈরি করেন যেখানে দরিদ্র রোগীরা বিনা খরচে চিকিৎসা পাবে । হাসপাতালটির নামকরণ করেন তাঁর মায়ের নামে “কুমুদিনী হাসপাতাল” যিনি বিনা চিকিৎসায় ওষুধের অভাবে মারা গিয়েছিলেন । রনদা প্রসাদ সাহা সব সময় চেয়েছেন তাঁর মায়ের মতো আর কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় বিশেষ করে মহিলারা ।
১৯৪৭ সালে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি জনহিতকর কাজে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে “কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা” নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন ।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ---- ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী নার্সিং স্কুল, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ, টাঙ্গাইল কুমুদিনী মহিলা কলেজ, মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজ সহ আর অনেক কিছু । তাঁর ধন- সম্পদ যেন জনহিতকর কাজে ব্যাবহার করা হয় এটাই ছিল তার একমাত্র চাওয়া । তাঁর মতে “ শিশুরা হচ্ছে একটি জাতির ভবিষ্যৎ, এই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে জন্ম দেয়া থেকে লালন পালন করে বড় করে একজন মা , সেই মায়ের জাতিটা কে শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন এবং এদের চিকিৎসা ও পুষ্টি সেবা দেয়া খুবই দরকার “ সে কারনেই নারী শিক্ষা ও চিকিৎসার পিছনে তিনি তার অর্থ, শ্রম, মেধা বিনিয়োগ করেছেন , নিঃস্বার্থে, শুধু মাত্র এই দেশটার কল্যাণের জন্য । তিনি তাঁর নিজের জন্য আলাদা করে কিছুই রাখেন নি ।
এই দানবীর মানুষটাকে তথা ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের প্রিয় “জ্যাঠা মনি” কে ১৯৭১ সালের ৭ই মে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের সহযোগীরা ( রাজাকার ,আলবদর, আলশামস ) ধরে নিয়ে যায় তাঁর একমাত্র ছেলে ( শ্রী ভবানী প্রসাদ সাহা ) সহ।আর তাঁদের খোজ পাওয়া যায় নাই ।
আমি ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী , মনে আছে ছোট বেলায় জেঠী মা ( দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার স্ত্রী ) কে দেখতাম হুইল চেয়ারে ঠায় বসে থাকতেন ,কথা বলতেন না , হাটতেননা, নড়াচড়া করতেন না শুধুই বসে থাকতেন। অপূর্ব সুন্দর একজন মানুষ, আরেকটা ব্যাপার আমকে খুব নাড়া দিত সেটি হচ্ছে ফর্সা ধবধবে একজন মানুষের সিঁথিতে লাল টকটকে সিঁদুর , কপালে বড় লাল টিপ । ছোট্ট আমি ( ৬/৭ বছর বয়স ) সিনিয়ারদের জিজ্ঞাসা করতাম জ্যাঠা মনি কই ? একটু একটু করে বুঝতে শিখেছিলাম। জ্যাঠামনিকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানী ও রাজাকারেরা আর ফিরে আসেন নি আমাদের প্রানপ্রিয় জ্যাঠা মনি । জেঠিমা অপেক্ষা করছেন । তিনি তো জানেন না তাঁর স্বামীকে হায়েনারা মেরে ফেলেছে কি না। জ্যাঠামনির দেহটাকেও পাওয়া যায় নি । জ্যাঠমনির ছেলে শ্রী ভবানী প্রসাদ সাহার ( আমরা বলতাম রবি দা ) স্ত্রী, আমাদের বউদি কে দেখতাম কি বিষণ্ণ ,দুঃখী একটা মানুষ , সাথে তাঁর একমাত্র ছেলে রাজীব আমাদেরই বয়সী, মায়া ভরা চাহনি । রাজিবের নিশ্চই তার বাবাকে মনে নাই , থাকার কথাও না । ছোট্ট রাজীব কিছুইতো বোঝে না । আমাদের বৌদি অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়ে একা একা পুরোজীবন পার করে দিলেন । সৌম্য চেহারার বৌ দিকে দেখলে মন ভালো হয়ে যায় । কিন্তু বৌদির মনের কি ? আমরা কি ভাবি ?
দানবীর শ্রী রনদা প্রসাদ সাহার মত মানুষদের যুদ্ধপরবর্তী একটা দেশে ভীষণ প্রয়োজন ছিল । রাজাকার হায়েনারা এই সব মানুষ গুলাকে বেছে বেছে ধরে নিয়ে গেছে । দেশটাকে খালি করে ফেলেছে, দেশের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলেছে । আজ যখন ৪১ বছর পর রাজাকার গুলার বিচার হচ্ছে তখন রাজাকাদের বংশ ধরেরা আবার তাদের উত্তরসূরিদের মত চাল চালার চেষ্টা করছে , কিন্তু কোন লাভ নাই । একটা কথা শুধু নব্য রাজাকাদের বলতে চাই পাপে ছাড়ে না বাপেরেও ।
আজ আমাদের মাঝে জেঠিমা নেই , যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি দেখে যেতে পারেন নাই । বউদি ও রাজীব আছেন, আছেন চন্দন দা , ঝুমুর দি ( মেয়ের দিকের নাতি ) সহ আমরা জ্যাঠামনির হাজার হাজার উত্তরসূরিরা , অপেক্ষা করছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের । মাননীয় ট্রাইবুনালস লক্ষ লক্ষ মানুষ ন্যায় বিচারের আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে । আমরা চাই ন্যায় বিচার --------- শুধুই ন্যায় বিচার ।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

স্যাম এর ছবি

জ্যাঠামনিকে নিয়ে কিছু কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যদিও আলোর মুখ দেখেনি এখনো সেগুলো - ঐসময় অবাক হয়েছিলাম তার কাজের ব্যাপ্তি দেখে। একটা ঘটনা একটু মনে আছে বাঙ্গালীরা আর্মিতে চান্স পেতনা ব্রিটিশ আমলে - তিনি যখন মেডিক্যাল টিমের সদস্য হিসেবে বেশ কজন সৈনিকের জীবন বাচালেন ভারতবর্ষের বাইরের কোন এক্টা দেশে - তারপর ব্রিটিশ রাজের সম্মাননা পেলেন - তারপর প্রথম বাঙ্গালী প্লাটুন গঠিত হল। সে যাই হোক ধন্যবাদ উনাকে নিয়ে লেখার জন্য যদিও আরো তথ্যসমৃদ্ধ লেখার দাবি থাকল।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হোক।

*লেখকের নাম নাই কেন? পারলে মন্তব্যে যোগ করে দিন

লোকালয় এর ছবি

রাজাকারদের ফাসী চাই।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

তথ্যসমৃদ্ধ প্রয়োজনীয় এএকটি পোস্ট।
লেখার জন্য ধন্যবাদ। চলুক

আয়নামতি এর ছবি

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় আদৌ কার্যকর হবে কিনা সে নিয়ে মন এখন দ্বন্দে ভুগে!
তারপরও দাবী আদায়ের জোরটুকু যেন হারিয়ে না ফেলি। বলা যায় না হয়ত কোন এক অলৌকিক ভোরে
বাংলাদেশ পবিত্র হবে খুনী রাজাকার মুক্ত হয়ে। স্যাম ভাইকে ধন্যবাদ মন্তব্যে খানিকটা তথ্য জুড়ে দেবার জন্য।
লেখিকার প্রতি ধন্যবাদ শুভেচ্ছাসহ স্যামের অনুরোধটার প্রতিধ্বনি করে গেলাম। আরো লেখুন আপনি।

কল্যাণ এর ছবি

চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

তানভীর এর ছবি

শ্রদ্ধা

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

বাংলা উইকিপিডিয়ায় রনদা প্রসাদ সাহার উপরে লেখা পেলাম।
তথ্যের কিছু অসঙ্গতি পাচ্ছি। উইকিপিডিয়ায় লেখা

রণদাপ্রসাদ সাহা ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা জেলার সাভারের উপকন্ঠে কাছুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইল জেলার মীর্জাপুরে। [১]চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি মীর্জাপুর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তার পিতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। তার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মাতা সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। বিমাতার আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে রণদা'র শৈশবকাল অতিবাহিত হয়।

উইকিপিডিয়ায় রনদা প্রসাদ সাহার কোন ছবি নেই। আপনার এই ছবিটি (যদি শেয়ারেবল হয়) কী অনুগ্রহ করে দান করবেন উইকিপিডিয়ায়? আপনি চাইলে রনদা প্রসাদ সাহা নিবন্ধটি আরো সমৃদ্ধও করতে পারেন।
অগ্রীম ধন্যবাদ।

নজমুল আলবাব এর ছবি

বিষয়টা আরেকটু যত্ন দাবী করে। আশাকরি পরে যখন লিখবেন সময় নিয়ে, যত্ন নিয়ে লিখবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
ইসরাত

সুমন চৌধুরী এর ছবি

লেখকের নাম দেখতে পাচ্ছি না।

তারেক অণু এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সচলে স্বাগতম। ছবিটা পারলে উইকিতে দিয়ে দিন।
লেখকের নাম জানতে পারলে ভালো হতো।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রণদীপম বসু এর ছবি

সচলে স্বাগত জানাই।
এই দানবীরকে নিয়ে আরো তথ্যবহুল লেখা চাই। আর লেখক হিসেবে পোস্টের নিচে নামটা দিয়ে দেয়া যেতো। তবে এখন মন্তব্যে নামটা দিয়ে দিতে পারেন। আর উইকিতে যেহেতু রণদা প্রসাদ সাহা'র কোন ছবি নাই তাই এই ছবিটা উইকিতে দেয়া যাবে কিনা তা জানাবেন আশা করছি। তবে ছবির সূত্র থাকতে হবে কিন্তু।
অনেক ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

তানিম এহসান এর ছবি

সচলে স্বাগতম। আরও লিখুন।

shaylalopa এর ছবি

আসলেই তো লেখাটি লিখলাম আর নাম দিলাম না কেন । আমার নাম শায়লা আহমেদ লোপা । নিক শায়লালোপা । আমার মনেই থাকে না যে সচলের অতিথি লেখকের আলাদা করে নাম লিখতে হয় । সিরিয়াসলি মনে থাকে না । কবে যে পূর্ণ সচল হতে পারবো ? আদৌ হবো কি ?

shaylalopa এর ছবি

অবশ্যই জ্যাঠামনির উইকিতে জ্যাঠামনির ছবি দেয়া যাবে ।

কৌস্তুভ এর ছবি

মন খারাপ

আশিস এর ছবি

ধামরাই এর মাধব মন্দির উনার দানে। আজ যেখানে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় রথজাত্রা হয়। মন্দিরে উনার একটা ছবি আছে। আমরা মন্দির এ গেলে প্রনাম করতাম। অনেকদিন পর আবার মন্দির এর কথা মনে পরে গেল। কত দিন যাওয়া হয় না।

রাত-প্রহরী এর ছবি

চলুক লেখা।
দানবীর রণদাপ্রসাদ এর জন্য শ্রদ্ধা

রানা মেহের এর ছবি

অনেক ভাল লাগলো আপনার লেখা। ভারতেশ্বরী হোমসের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার অনুরোধ রইলো

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।