ডাকাতের আক্রমনে এক রাত ও সংখ্যালঘু

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৯/০১/২০১৪ - ৩:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত রোজার ঈদের ছুটিতে সকল আত্মীয় স্বজনরা তখন গ্রামের বাড়িতে। আমার অনেকগুলো চাচা থাকায় চাচাত ভাইবোনের সংখ্যাও প্রায় দুই ডজনের মত। তাই ঈদের সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি একটা বিয়ে বাড়ির মতই রূপ নেয়। মজা করার সকল আইডিয়াগুলাতেও আমরা বড় ছোট সবাইকে সাথে রাখি। সব বয়সীরাই এক হয়ে যায় আমাদের গ্রামের বাড়ি ঈদগুলোতে। গত ঈদ আগস্ট মাসে হওয়ায় চারদিকে তখন বর্ষার নতুন পানি। এখন এ পানিতে নেমে গোসল করতে ইচ্ছা না করলেও নৌকা ভ্রমন করতে নিশ্চয় কারো কোন সমস্যা নেই। প্রস্তাব করার সাথে সাথে বুড়ো থেকে বাচ্চা সবাই এক কথায় রাজি হয়ে গেল। শুধু বাকি রইল যাত্রা করার!

নৌকা ভ্রমণের পরিকল্পনা করা হল আমার বাড়ি থেকে ২৫ কিঃমিঃ দুরত্বে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একটা গ্রামে যেখানে বর্ষাকালে পুরোটা দূরত্ব নৌকা দিয়ে যেতে হয়। আমার মা-বাবা, ভাইবোন, চাচা-চাচী, চাচাতো ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়রা প্রায় ৩০ জন এককথায় নৌকা ভ্রমনের জন্য তৈরি হয়ে গেল। (বলে রাখা ভাল আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে) ঐ দ্বীপের মত গ্রামটিতে আমাদের নিকট এক আত্মীয় থাকেন। তার সাথে যোগাযোগ করার পর তিনিই নৌকাসহ অন্য সবকিছুর দ্রুত ব্যবস্থা করলেন এবং আমাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। সারাদিন ঐ দ্বীপটাতে ঘুরে বেড়াব তাই সকাল সকাল আমরা রওনা দিলাম। নৌকাপথে মাঝ দুপুরের সূর্য থাকলেও বিলের হালকা বাতাসে সূর্যের তাপ সহ্য করার মতই ছিল। তাই সবাই ইঞ্জিনের নৌকার ছায়ার উপরে উঠে বসলাম। কেউ গলা ছেড়ে গান ধরেছে, কেউ শখের ফটোগ্রাফার সেজে বিলের পাখি-ফুল-প্রজাপতির ছবি তুলতে শুরু করল, কেউ কেউ আবার গত রাতের না শেষ হওয়া গল্প শেষ করতে নৌকার এক কোনে বসে পড়েছে, মুরব্বিরাও নিজেরা গোল করে বসে নৌকার ছায়ার বড় একটা জায়গা দখল করে রেখেছে। বাংলাদেশের বর্ষাকালের চিরচেনা রূপ দেখতে দেখতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর পৌঁছে গেলাম ঐ দ্বীপে।

এ দ্বীপটির চতুর্দিকে অথৈ পানি, নৌকা ছাড়া যোগাযোগের কোন মাধ্যম নেই বর্ষাকালে। আশেপাশে অন্য গ্রামগুলোরও নৌকা দূরত্ব ঘন্টাখানেকের। তাই এ দ্বীপটাকে একরকম বিচ্ছিন্ন বলা যায়। দ্বীপটাতে প্রায় ১৫০ মত পরিবার আছে। দ্বীপে স্বভাবত ভিটের জায়গা কম থাকায় ঘরগুলো খুব কাছাছি লাগানো। কোনমতে শুধু হেটে যাওয়া যায় দুটি ঘরের মাঝখান দিয়ে। আর বর্ষায় বৃষ্টির পানি টিনের দু’চালা দু’টি ঘরের মাঝখানে পরায় সেখানে কাঁদার স্তূপ। দ্বীপের বাসিন্দারা সেই কাঁদাতে নিজেদের ডিজাইনে তৈরি ইটের ঢালাই বসিয়েছে যা দিয়ে ছন্দের তালে তালে হেটে যাওয়া যায় দুটি ঘরের মাঝখানে দিয়ে। বলা দরকার এ দ্বীপে কোন রাস্তাবিশেষ কিছু চোখে পরেনি, যেখানেই গিয়েছি এ ঢালাইয়ের উপর দিয়েই নেচে যেতে হয়েছে। এমনকি দ্বীপের বাসিন্দারা এক আত্মীয়ের বাসা থেকে অন্যজনের বাসায় কোন রাস্তায় না গিয়ে নৌকায় যেতেই স্বাচ্ছন্দ পায়।

দুপুরের খাবারের পর সবাই বেরিয়ে পড়লাম দ্বীপটি ঘুরে দেখতে, বাংলার বর্ষার আদিম ও যৌবনের রূপ দেখতে। নদীর উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বাধাই করা দ্বীপটির সীমানা প্রাচিরে। অল্প দূরেই মাছ ধরার অনেকগুলো নৌকা চোখে পড়ছে। বক আর পানকৌড়ি ডাঙার কাছাকাছি খুব সাহস করেই বসে আছে। প্রকৃতির কাছাকাছি বেড়ে ওঠা দ্বীপবাসীদের অতিথিপরায়ণতার জন্যই বেশ কয়েকজনের বাড়িতে বসতে হল চা অথবা নাস্তা খাবার জন্য। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখন দ্বীপ থেকে আমাদের বাড়িতে ফেরার পালা, সকালের নৌকাটাও প্রস্তুত আমাদের পৌঁছে দিতে। চাইলেকি সবই প্লেন মাফিক হয়! আমাদের এ সিদ্ধান্তে শক্ত দেয়ালের মত বাঁধা হয়ে দারালেন আমাদের ঐ নিকট এক আত্মীয়! নাছোরবান্দা ঐ আত্মীয় আমাদের সবাইকে একরকম বাধ্য করালেন এ দ্বীপে একরাত থেকে যেতে। আমাদের সকল সুবিধা-অসুবিধা, আমাদের ফিরে যাবার সকল প্রয়োজন-গুরুত্ব এসব কোনকিছু বুঝিয়েও তাকে খুশি করা যায়নি। আর সারাদিন তার পরিশ্রম ও আমাদের আপ্যায়ন করতে পেরে তার তৃপ্ত মুখটা আমরা মলিন করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। তাই সবাই ওই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটাতে রাত কাটানোর এডভেঞ্চার গ্রহন করি।

সারাটা দিন অসাধারন কাটল, না শুধু নৌকা ভ্রমণের জন্য না। দ্বীপটা ছিল ছবির মত সুন্দর। আর এখানকার ঘরবাড়ি বা ঘরের আসবাবপত্র দেখে বোঝা যায় তারা তিল তিল করে গড়ে তোলেছে তাদের ছোট্ট সংসার। ইটে মোড়ানো প্রাচির আর সবুজে সাজিয়েছে পুরো দ্বীপটি। বলা বাহুল্য এ দ্বীপের পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে, বঞ্চিত সকল শহুরে সুযোগ সুবিধা থেকে। বিদ্যুতের কল্পনাও কখনো করেনা দ্বীপবাসী। সন্ধ্যার পরপরই দ্রুত অন্ধকার নেমে এলো। পুরোটা সন্ধ্যা কাটল নদীর ধারের শীতল বাতাস আর ঢেউয়ের মৃদু শব্দে। রাতে বিলের মাছের বিভিন্ন তরকারি দিয়ে পেট ভরে খাবারের পর নদীর রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। রাতের খাবারের পরপরই আমাদের সাথে আসা ছোটরা ও বয়ষ্করা ঘুমিয়ে পড়েন। আমরা সমবয়সী যুবকরা অনেক ক্লান্ত থাকায় শান্তির একটা সময় ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম। রাত ১২ টার পর আমরা গাদাগাদি করে শুয়ে পরলাম চৌকি ও মেঝেতে রাজ্যের ঘুম চোখে নিয়ে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে নদীর ঝিরিঝিরি বাতাস আসছিল, আর আমাদের মধ্যে একজন আবার হালকা সুরে গান ধরল। প্রকৃতি, কল্পনা আর ঘুমজড়ান মস্তিষ্কের ধীর চিন্তায় একসময় গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম। কি শান্তির সেই ঘুম, অনন্ত কালেও যেন না ভাঙে এ নিশিন্ত ঘুম!

যতদূর মনে করতে পারছি রাত আনুমানিক আড়াইটা, হঠাৎ এক আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে। স্বপ্ন-ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা কিন্তু অল্প দূরের কিছু বাড়ি থেকে চিৎকার ও কান্নার শব্দ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে। তারা চিৎকার করে কি বলছে তা একটুও শোনা যাচ্ছেনা, তাই একদমই ধারনা করতে পারছিনা সাম্ভাব্য কি ঘটতে পারে আমার চারপাশে। কিন্তু তাদের চিৎকার থামছেইনা- এ ছিল ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ, যেন মৃত্যু তাদের তারা করছে। নতুন জায়গায় রাত কাটাচ্ছি তাই কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। ততক্ষনে আমরা সমবয়সীরা সবাই জেগে গেছি, একজন আরেকজনের মুখ দেখছি ঝিমানো হারিকেনের অল্প আলোতে। সবার মুখেই ছিল আতংক, ঘোর আর বিস্ময়ের ছাপ, না বুঝে ওঠতে পারার অসহায় ভাব। আমাদের সাথে থাকা গ্রামের ছেলেটি যখন বলল সেও কিছু ধারনা করতে পারছেনা তখন আমাদের অজানা ভয় সকল সীমা ছাড়াল। এ ভয় শুধু আমাদের নিজেদের নিয়ে নয়, আমাদের সাথে আসা ছোট ভাইবোন আর বয়স্কদের নিয়ে। তারাও নিশ্চয় এতক্ষণের জেগে ওঠেছে। বাইরের চিৎকার ক্রমেই বাড়ছে এবং কয়েকটা পুরুষকণ্ঠ ক্রমশই আরো কাছে আসছে আর্তনাদ করতে করতে। আমরা কয়েকজন সাহস করে ঘর থেকে বের হলাম। কি হয়েছে আমাদের জানতে হবে, এমনকি আমাদের সামনে কি বিপদ আসছে তাও আমাদের আচ করতে হবে। বাড়ির উঠান পেরুতেই কয়েকজন পুরুষ দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হুমড়ি খেয়ে আমাদের সামনে এসে পড়ল, হাঁপাতে থাকল, তারা যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, কিছু বলতে গিয়েও শুরু করতে পারছেনা। আমবশ্যার ঐ রাতের আধারেও তাদের দিশেহারা অস্থির চোখের দ্যুতি আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। সাংঘাতিক রকমের ভয়ার্ত এ চোখ, ইতঃস্তত মনির এ চোখ যেন ভয় দেখিয়ে মানুষ খুন করার ক্ষমতা রাখে। তারা কোন রকমে ভাংগা ভাংগা শব্দে উচ্চারন করল এদ্বীপে ডাকাত পড়েছে। ইতিমধ্যে চারদিক থেকে তারা দ্বীপটা ঘিরে ফেলেছে। ১৫-২০ নৌকায় ১০০ জনের মত ডাকাত অস্ত্রসহ হামলে পড়েছে এদ্বীপে, কারো কোখাও পালানোর জায়গা নেই পানিবন্দি এ দ্বীপে। তাদের একজন বলল ডাকাতরা নাকি তার বৃদ্ধ বাবাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে, মা আর বোনকে একটা ঘরে বন্দী করেছে। সে সৌভাগ্যক্রমে দুজন ডাকাতকে ধাক্কা মেরে ফসকে বেরিয়ে এসেছে প্রান নিয়ে। সে তার হাত-পায়ের কাঁপুনি কোনভাবেই থামাতে পারছিলনা, শুধু কান্নাজরানো গলায় বলতে চাচ্ছিল আমার মা-বাবা-বোনকে বাচান। ঠিক তক্ষুনি আমার ঘোর কাটল, মনে পরলো নিজের মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা যারা আজ সবাই এদ্বীপেই রাত কাটাচ্ছে। আমর সমবয়সী ভাইয়দের চোখে চোখ পড়ল, তাৎক্ষনাত দৌড় দিলাম পাশের বাড়িতে যেখানে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের ঘুমানোর কথা। আমরা ঐবাড়িতে গিয়ে দেখি ওঠানে ইতিমধ্যেই ছোট একটা জটলা পাকিয়ে গেছে। আর আমাদের সকল আত্মিয়রা, যারা একসাথে এসেছি তারা সবাই তাদের নিজের ছেলেমেয়েকে খুঁজছেন। আর আমরা যুবকরা কোথায় আছি সেটা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাচ্ছেন। যেন যুবকরা সকল বিপদকে প্রতিহত করতে পারবে, তারা যেন জানে সকল অনিশ্চিত প্রশ্নের জবাব।

আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, এখন আমরা সবাই জানি আমাদের পরিনতি কি হতে যাচ্ছে। আমরা আমাদের শেষ পরিনতি থেকে কয়েক মিনিট দূরত্বে আছি। ডাকাতদল উচ্চ ক্ষমতার বাতি দিয়ে ছোট্ট দ্বীপ ঘিরে রেখেছে, নৌকা নিয়ে কারো পালিয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। গ্রামে কোন গোপন সুড়ঙ্গ নেই, নেই কোন শক্ত ভল্ট। ভোর চারটার দিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যদি বিশেষ আদেশে হেলিকপ্টার দিয়েও আসে সবকিছু মিলিয়ে আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। সেই সময়তো আর আমাদের হাতে নেই। আমরা সব আত্মিয়রা গ্রামের সবচেয়ে বড় পাকা বাড়ীটাতে আশ্রয় নিয়েছি। এবাড়ীতে ডাকাতরা এখন পৌঁছুইনি, পাশের বাড়ির অন্য মহিলা-পুরুষ-শিশুও জড় হয়েছে এ বাড়ীতে; এ বাড়ীটা পাকা, মজবুত ও বড় বলে। আমরা তখন জেনে গেছি যে, ডাকাতরা ব্যাবিচারে যুবক-পুরুষকে খুন করছে, খড়ের গাদায় আগুন দিচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে পাশের বাড়ি ও অবুঝ গবাদি পশু। এও জানতে পারলাম এদ্বীপের উপর ডাকাত দলের পূর্বপুরুষের শত্রুতা রয়েছে। বিরোধটা শুরু হয়েছিল দেশ বিভাগের পরপরই। এ দ্বীপের উপর ক্ষোভ এখনও তাদের মিটেনি, তাই তারা আজ এত বীভৎস। আমরা তখন ভাল করেই জানি আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি কিনা সেটা বলার সুযোগ পাবনা, পারবোনা ওই শক্তিশালী অস্ত্রে সজ্জিত ডাকাতদলের সাথে প্রতিবাদে দাড়াতে। এ যেন পরাজয়ের আগেই তার স্বাদ অনুভব করা। চোখের সামনে মা-বাবা, আত্মিয়স্বজনের সাহায্যপ্রার্থী চোখকে দিতে পারছিনা কোন স্বান্তনা। পারছিনা দিতে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার। দূর্বল এ সময়ে একজন আরেক জনের গায়ে পাশাপাশি লেগে বসে আছি মনের অজান্তে। যেন আমাদের শরীর আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্যের কাছে, সাহস খুঁজছে অন্যের উষ্ণতায়। আমি মধ্যবয়সের যুবক হয়ে এ যেন মৃত্যু পথযাত্রি বৃদ্ধের মত অনড়-নিশ্চল দেহ নিয়ে তারাতারি পৃথিবীকে বিদায় জানাতে চাচ্ছি। এ ভারি, নিথর, অকেজো দেহ-মন নিয়ে আর একটা সেকেন্ডও যেন বেঁচে থাকতে চাইনা। নিজের চোখের সামনে মা-বাবা-ভাইবোনের অসহায়ত্ব মেনে নেয়া যাচ্ছিলনা কিছুতেই। এ পৃথিবী যেন অচেনা এক আশ্রয়হীন জায়গা হয়ে গেল। মুহূর্তেই পৃথিবী থেকে মুছে গেল মানুষ হিসেবে আমার সকল পরিচয়, আমি শুধুই একটি প্রানি এখন, শুধু প্রানসর্বস্ব একটি দেহ। মানুষ হিসেবে আমার মন থাকলে সেই মনের তাগিদে কোন সারা দিতে আমি অপারগ। তাই একমুহূর্তে জন্মটাকে বৃথা ভেবে ডাকাত আসার আগেই জীবনটাকে অর্থহীন করে দিতে ইচ্ছা করল আমার। তারপর........

..........গল্পটা এ পর্যন্তই থাক, আর লিখতে পারছি না!

..........।।

গল্পের ক্লাইমেক্স জমে উঠেছে, গল্পটার সমাপ্তি শুনতেই চাই। এরপর কি হল! আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এ গল্প সবাই শুনতে চাইলেও এ গল্পের বাস্তব চরিত্র হতে চাইবেনা কেউ। কেউ একটা রাত এমন অনিশ্চয়তায় কাটাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে চাইবেনা। আর কাউকে যদি বলা হয় প্রতিটা দিন এমন করে কাটাতে, সেটা হয়ত আমরা চিন্তা করেও কিছু মিলাতে পারবোনা।

দেশের একটা বড় অংশ, শুধু তাদের ধর্ম ভিন্ন বলে তারা এদেশে নিরাপদ না। তারা ছোট্ট দ্বীপে বনাবাসী, তারা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু শব্দটাই বলে দেয় তারা প্রথম শ্রেনীর নাগরিক নয়। সংখ্যালঘু শব্দটা দিয়েই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে তোমরা সংখ্যায় কম, তাই সংখ্যাগুরুরা তোমাদের উপর বল প্রয়োগ করবে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের প্রয়োগে সংখ্যালঘুদের বিপরিত পতিক্রিয়া বলের মান হবে অত্যন্ত নগন্য। অর্থাৎ কিছুই করতে পারবানা তোমরা। কিছুই বলার থাকবেনা তোমাদের, পিঠপেতে মার খাওয়া ছাড়া। এ গল্পের শেষ ক্লাইমেক্স এর মধ্য দিয়ে প্রতিটা দিন/রাত পার করছে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। বাচ্চা থেকে বুড়ো, মহিলা কিংবা কিশোরী, শক্তিশালী পুরুষ অথবা যুবক সবাই তাদের জীবনের শেষ পরিনতি মেনে নেয়ার অপেক্ষায় কাটাচ্ছে প্রতিটা রাত। একটু একটু করে সাজানো পুরনো সংসারের ছোট জিনিসগুলোর প্রতি জন্মানো দরদ এখন তারা ভুলে গেছে। নতুন বিবাহিত দম্পতি সাজানো বাসরের সজ্জা ভেঙে যাবে এ ভয় করছেনা। তাদের এখন ভয় প্রাণ নিয়ে, তারা জীবন মৃত্যু মাঝখানে কাটাচ্ছে প্রতিটা রাত। তারা এখন ভাবছেনা মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকায় কিনা ৫ ভরি স্বর্ণের, ভাবছেনা গত সপ্তাহে শীতের সব্জি বেঁচে কিছু নগদ টাকার গোপনীয়তা নিয়ে, ভাবছেনা সিন্দুকের মধ্যে যত্ন করে রাখা পূর্বপুরুষের কাছে পাওয়া জমির দলিলগুলো। এসবই আজ মূল্যহীন। যখনই সংখ্যাগুরুদের আক্রমনের খবর পায় সংখ্যালঘুরা তখন তাদের জীবন বা মা-বোনদের ইজ্জত বাঁচানোর খুব কম সময়ই পায়, আর তাই ভুলে যায় ছক বাঁধা জীবনের বস্তুগত জিনিসগুলো। শুধু শিংহের তাড়া খাওয়া হরিনের মত ছোট্ট একটা আশ্রয় খোঁজে এ বিশাল পৃথিবীতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের এ অসহায়ত্ব দেখে আমি কার কাছে প্রশ্ন রাখব এমন লোকও খুজে পাচ্ছিনা, তাই লিখতে বসলাম।

-রাশেদুল ইসলাম রনি

বিঃদ্রঃ নৌকা ভ্রমনের ঘটনা সত্য এবং ডাকাতের ঘটনা আমার কল্পনা প্রসূত।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হাততালি

উপমা দিয়ে গল্প বলাটা দারুন লাগলো, হৃদয়কে ছুঁয়ে গেলো। কিন্তু যাদের কে ছুঁয়ে গেলে পরিবর্তন আসবে তারা তো পড়বে কখনো, পড়লেও তাদেরকে ছুঁয়ে যাবে না। তবু লেখা চলুক চলুক

মাসুদ সজীব

রাশেদুল ইসলাম রনি এর ছবি

আশায় বাধি বুক।

নীলকমলিনী এর ছবি

ডাকাতের কাহিনী টা কল্পনা প্রসূত হলেও এই রকম ঘটনা হাওর অঞ্চলে ঘটে. আমার গ্রামের বাড়ীও ঐদিকে. ডাকাতের ভয়ে ইচ্ছে থাকা সত্বেও বহু বছর গ্রামের বাড়ীতে রাত কাটাতে পারিনা.
তিন দশকের বেশী দেশ ছাড়া. এই তিন দশকে দেশ একেবারে বদলে গেছে. মনে আছে স্কুলে থাকতে বাবার সাথে কত হালখাতা আর পুজোয় গিয়েছি. আমার ধার্মিক প্রশাসক বাবার প্রিয় ছিল পুজোর খিচুরী, লাবরা আর সন্দেশ. বাবার হিন্দু কলিগরা ঈদের সময় আমাদের বাসায় আসতেন , এমনকি কোরবানী ঈদেও. আমাদের অনেক হিন্দু বন্ধু আছেন এখানে, দেশে যখনি নির্যাতনের খবর পাই, উনাদের কাছে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে.
অনেক মুসলমান বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখিনি সাম্প্রদায়িক বলে.
মন্তব্য করতে গিয়ে মন খারাপ লাগছে খুব.

রাশেদুল ইসলাম রনি এর ছবি

আপনার মন খারাপ করে দেয়ার জন্য দুঃখিত।

সাম্প্রদায়িকতা আমারও নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।