মধ্যবিত্ত প্রথম পর্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ৩০/০৩/২০১৪ - ২:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

স্কুল থেকে ফেরার পথে আচানক বৃষ্টি নামে। অথচ সকালের আকাশটাও পরিষ্কার ছিল একদম! রোদ ঝলমলে পরিষ্কার নীল আকাশ। তবে দুপুরের পর থেকে অল্প অল্প করে মেঘ জমতে থাকে সেখানে। তারপর একসময় বৃষ্টি নামে। ঝমঝম বৃষ্টি। মাথার উপর হাতদুটো দিয়ে আনিস দৌড়ানো শুরু করে। এই অনাহুত বৃষ্টি থেকে বাঁচা দরকার তার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কাঁচাপাকা রাস্তাটার উপর দিয়ে পচপচ শব্দে দৌড়াতে থাকে সে, কোনদিকে না তাকিয়ে। শেষ পর্যন্ত একটা আশ্রয়ও পেয়ে যায়! রাস্তার একদম শেষ মাথার মুদি দোকানটা। ভিজে জবুথবু হয়ে সেখানেই দাড়িয়ে থাকে আনিস। এই বৃষ্টি কখন থামবে তার কোন ঠিক নেই। সারাবিকেল ধরেই হয়ত বৃষ্টি হবে! কিংবা সারারাত ধরেও হতে পারে! আপাতত এই মুদি দোকানের কার্নিশের নিচে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার। আনিস সেখানেই দাড়িয়ে থাকে। চুপচাপ।

স্কুলের হাফ হাতা শার্ট আর নেভী ব্লু প্যান্টটা ভিজে গেছে একদম। পায়ের কেড্‌সটার অবস্থাও ভালো না। পানি ঢুকে গেছে ভেতরে। আর কাঁদাপানিতে মাখামাখি হয়ে আরো করুন দেখাচ্ছে সেটা। আনিসের মনটা খারাপ হয়ে যায় খুব। এই জুতাজোড়া বেশ পছন্দের ছিলো তার। গত ঈদের সময় কেনা। ঈদের ঠিক আগের রাতে কেঁদেকেটে বুক ভাসানোর পর কিনে দেয়া হয়েছিলো সেটা। এই জুতাজোড়াই গত ঈদের একমাত্র কেনাকাটা ছিলো তার। কেউ হয়ত বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু এটাই সত্যি। আনিস মনে মনে ভাবে সব- এতোদিন ধরে বেশ যত্ন করেই পরে আসছিলো জুতাজোড়া। কিন্তু আর কত? সময় তো আর কম হয় নি! গত একটা বছর এটা পরেই সকাল বিকাল ক্লাস করলো! স্কুলের পিটির সময় লেফ্‌ট-রাইট করলো! টিফিন আওয়ারে করিডোরে ফুটবল খেললো! আর কত?

আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষনও দেখা যাচ্ছে না। এই মুদি দোকানটার নিচে আর কতক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে! মুদি দোকানদার মানুষটাও জানি কেমন! এতগুলো মানুষ তার দোকানের সামনে জটলা পাকিয়ে দাড়িয়ে আছে, কিন্তু তার চোখেমুখে কোন বিরক্তি নেই। সে বরং হাসি হাসি মুখ করে পুরাতন একটা পেপার পড়ায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে শুধু অন্য সবার মত মুখ তুলে বাইরে তাকায়। আনমনে বৃষ্টি দেখে। আর কি যেনো ভাবে! একটানা, চুপচাপ। কার কথা ভাবে কে জানে? হয়তো নিজের কথাই ভাবে! নিজের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবে! গলাটিপে মেরে ফেলা স্বপ্নগুলোর কথা ভাবে! অথবা অন্যকিছু। হয়তো তার অসাধারন জীবনটার কথা ভাবে! অসংখ্য প্রাপ্তির কথা ভাবে! আর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরন করে, কৃতজ্ঞতার সাথে! কে জানে? কে জানে!

দোকানের সাত আট বছরের ছোকরাটা অবশ্য মহাবিরক্ত। বৃষ্টি নামার পর থেকেই তার চোখ-মুখ কুঁচকে আছে। এমনিতেই বেচাকেনার অবস্থা ভালো না। তার উপর এতোগুলো মানুষ দোকানের সামনে দাড়িয়ে থাকলে ব্যবসাটা চলে কিভাবে? দোকানদারের উপরও মেজাজ গরম তার। ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে এই মানুষের আগ্রহ কম। তার আগ্রহ ইরাক- আফগানিস্তান যুদ্ধ নিয়ে। ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে। দোকানের চাল ডাল নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। এভাবে ব্যবসা করে তো খুব একটা উন্নতি করা সম্ভব না!

ছোকরা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে আনিসের দিকে তাকায়। দোকানের সামনে দাড়িয়ে থাকা অন্য মানুষগুলোর বয়স বেশি। তারা কেউ স্কুলে পড়ে না। তাদের দিকে চোখ কটমট করে তাকানোর চাইতে আনিসের দিকে তাকানোটাই নিরাপদ। ছোকরার বয়স কম। তারপরও আনিসের বিব্রত লাগে খুব। কতক্ষন আর এভাবে দাড়িয়ে থাকা যায়?

"ভাই, সাইডে দাড়ান। কাস্টমারের জন্য জায়গা ছাড়েন"।

আনিস সাইডেই দাড়িয়ে ছিলো। দোকানের একপাশে, কার্নিশের নিচে। তারপরও কথা শুনতে হলো তার। মুখটা কাচুমাচু করে আরো কোণায় গিয়ে দাড়ায় সে। কার্নিশের একদম বাইরেই বলা যায়। বৃষ্টির ছাঁট সরাসরি গায়ে এসে লাগতে থাকে তার। কিন্তু কি আর করা! সুযোগ পেলে সবাই এভাবে লাথি মারতে চায়। স্কুলের বেতন দিতে একটা দিন দেরী হলে কবির স্যার কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে, সবার সামনে। অংক ক্লাসে ছোট একটা ভুল করলেই গীতা আপা অপমান করে বসে, যাচ্ছেতাইভাবে। সুযোগ পেলে সবাই আসলে লাথি মারতে চায়। সবাই।

মাগরিবের নামাজের আযান দিচ্ছে বাইরে। চারপাশটা নীরব হয়ে গেছে একদম। কেমন জানি একটা বিষন্নতা ছড়ানো সবখানে। মনটা খারাপ করে দেয়। খালি খালি লাগে সবকিছু। কেনো এমনটা হয় কে জানে! বৃষ্টিটা থেমে গেছে ততক্ষনে। টিপটিপ করে পড়ছে শুধু। সেই টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই আনিস বাড়ির পথ ধরে। অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর এখনো অনেকটা পথ বাকি। বাসায় ফিরতে দেরী হলে ঝামেলা আছে অনেক। আব্বা কড়া মানুষ। কোন কথা শোনার আগেই পশুর মত পেটানো শুরু করবেন। কারো পক্ষেই থামানো সম্ভব না তাকে। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলেই থামবেন আব্বা, তার আগে না।

সন্ধ্যার পর এই রাস্তাটা নির্জন হয়ে যায় খুব। মানুষজনও থাকে না খুব একটা। রাস্তার দুইপাশে এতো বেশি গাছপালা আর ঝোপঝাড়, তাকে ছোটখাট একটা জঙ্গল বললেও ভুল হবে না। চোর- ডাকাতের ভয় আছে এখানে। তবে সবচাইতে বেশি ভূতের ভয়। গত কয়েক মাসে বেশ কজনকে ভূতে ধরেছে এখানে। খুব খারাপ এই রাস্তাটা। আনিস পা চালায়। দ্রুত পা চালায়। কোনরকমে কোয়ার্টার পর্যন্ত যেতে পারলেই হ্য়। তারপর আর ভয় নেই। কোয়ার্টারের মুখের চায়ের দোকানটাতে বসে কত মানুষ চা খায়! বড় মাঠটাতে বসে সিগারেট ধরায় আর সারারাত চাঁদের আলোয় বসে আড্ডা দেয়! কেমন জানি একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকে সবখানে। এই রাস্তাটার মত নির্জন না। ভয়ংকর না।

(চলবে...)

-এবিএম
২৯/০৩/২০১৪

আমার অন্যান্য লেখা:

যখন বৃষ্টি নামত

চোর


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

-এবিএম, ভাল লাগলো। ইংরেজি শব্দের ব্যবহার কমালে আরও ভাল লাগবে। যদিও সামান্যই। লেখার কন্সেপ্ট সুন্দর। আগামি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। হাসি

Shah Waez (শাহ্‌ ওয়ায়েজ।)
Facebook

..............................................................................................
ভাবনা আমার শিমুল ডালে লালচে আগুন জ্বালে, মহুয়ার বনে মাতাল হাওয়া খেলে।
এক মুঠো রোদ আকাশ ভরা তারা, ভিজে মাটিতে জলের নকশা করা,
মনকে শুধু পাগল করে ফেলে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ওয়ায়েজ ভাই, অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। সামনের পর্বগুলো তাড়াতাড়ি দেয়ার ইচ্ছা আছে।
ভালো থাকবেন। হাসি

---এবিএম।

এক লহমা এর ছবি

চলুক।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

চালিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে। অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। হাসি

হাসিব এর ছবি

গল্প এক পর্বে দেয়াই ভালো যাতে এক বসায় পড়ে ফেলা যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসিব ভাই, কয়েক পর্ব মিলিয়ে একটা বড় গল্প অথবা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। একবারে দিয়ে দিলে অনেক বড় হয়ে যেতে পারে। আর এতো বড় লেখা তখন সবার বিরক্তির কারনও হতে পারে। সেজন্যই ছোট ছোট পর্বে লেখার ইচ্ছা।

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ হাসিব ভাই। ভালো থাকবেন। হাসি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

এই পর্বটা চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য, তাই না? লেখার ধরণটা পছন্দ হয়েছে। মূল কাহিনির জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।

একটা টাইপো কাঁদাপানিতে -> কাদাপানিতে। যেমন: আনিস কাদাপানিতে ভিজে গিয়ে কাঁদতে লাগলো।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রোফেসর, অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য আর টাইপোটা ধরিয়ে দেবার জন্য। শুরুর দিকের পর্বগুলোতে চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা থাকবে বেশি, মনে হয়!

ভালো থাকবেন। হাসি

দীনহিন এর ছবি

চলুক

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

ভালো থাকবেন। হাসি

আয়নামতি এর ছবি

চলুক এবি হাসি
যখন এডিট করবার সুযোগ পাবেন তখন টাইপোগুলো শুধরে নেবেন মনে করে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ইচ্ছে আছে চালিয়ে যাবার। দেখা যাক কি হয়!

ভালো থাকবেন। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চালিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক কি হয়! পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

ভালো থাকবেন। হাসি

---এবিএম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।