স্বাধীনতার ঘোষণা ও একজন এম.এ. হান্নান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৩/০৬/২০১৪ - ৯:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২৫ মার্চ ১৯৭১, হঠাৎই বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা বন্ধ করে সন্ধ্যায় পাকিস্তানের কসাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করে পশ্চিম-পাকিস্তান চলে যায়।

এই পাকি কসাইয়ের আদেশে ওই রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু করে 'অপারেশান সার্চলাইট' আর এর সাথেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সর্ববৃহৎ গণহত্যা ও জাতিগত ধোলাই।

ওই রাতেই বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে।

গ্রেফতার হবার আগে বাঙালি গণহত্যা শুরু হবার পর বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ, ১৯৭১, প্রথম প্রহরে (রাত ১২ টার কিছু সময় পর) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন।

ঘোষণাপত্রটি ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সারাদেশের বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতাকে ফোন করে ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ই.পি.আর-ট্রান্সমিটার ও ওয়্যারলেস স্টেশনে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশন হতে চট্টগ্রামের নন্দনকানন অফিসে পাঠানো হয়।

এমনই টালমাতাল সময়ে চট্টগ্রামের ওয়্যালেস অফিসে বার্তাটি গ্রহন করেন ওয়্যারলেস অপারেটর মাহাতাব উদ্দিন।

বার্তাটি পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান মাহাতাব উদ্দিন। সন্ধ্যা থেকে সারা চট্টগ্রাম শহরে আর্মিদের গাড়ি চলাচল করছে। আগেই বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা হতে চলেছে। ঢাকা থেকে আসা বার্তা পড়ে বুঝলেন, সংগ্রামের শেষ নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

নিজেকে একটু ধাতস্থ করে দ্রুত একটা চিরকুট লিখে ফেললেন। চিরকুটটা চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি এম. আর. সিদ্দিকী কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

সাথে একটা দু:সাহসিক কাজ করে ফেললেন মাহাতাব উদ্দিন। তখনই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ১৯টি জেলায় ঢাকা থেকে আসা স্বাধীনতার ঘোষনার বার্তা প্রেরণ করে দিলেন।

চিরকুটটা হাতে পাবার আগেই ঢাকার সাথে যোগাযোগ হওয়ায় এম. আর. সিদ্দিকী আঁচ করছিলেন ঢাকার পরিস্থিতি আর এদিকে রাত এগারোটার পর থেকে প্রচুর গোলাগুলির শব্দ আসছে। চিরকুটটা হাতে পাবার পর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

এদিকে লীগের কিছু কর্মী এসে চট্টগ্রামে নানা এলাকায় আর্মি আর বিহারীদের যৌথ বাহিনীর বাঙালি নিধনের খবর দিল। সিদ্দিকী সাহেব ০৩ মার্চ চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ভয়ংকর বাঙালি গণহত্যার কথা ভেবে মুষড়ে পড়লেন। পাহাড়তলী, হালিশহর, শেরশাহ, চকবাজারের বাঙালিদের পরিণতি বুঝে গেলেন মুহুর্তেই।

ওই রাতেই চট্টগ্রামের আ্ওয়ামী লীগ নেতারা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে বসলেন। স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার ও যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হলো।

সকাল থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরা মাইকিং করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়টি জনগণকে জানালেন।

পরিকল্পনা অনুসারে, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ দুপুর ২.০০ টায় বেতার কেন্দ্রের রাখাল চন্দ্র বণিক ঘোষণা করেন-

একটি বিশেষ ঘোষণা।
একটু পরেই জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান।
আপনারা যাঁরা রেডিও খুলে বসে আছেন তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না।
আজ থেকে বেতার কেন্দ্রের নাম চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের বদলে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র বলে সম্বোধন করা হবে।
জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

এরপর চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নেতা এম.এ. হান্নান দুপুর ০২.১০ মিনিটে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন।


ছবি: এম.এ. হান্নান

এরপর, সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিট এম.এ.হান্নান সাহেব দ্বিতীয়বারের মত বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন।

সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো বাঙলার স্বাধীনতা ঘোষণা।শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীকার সংগ্রামের শেষ অধ্যায়।

আজ ১২ জুন।
১৯৭৪ সালের আজকের দিনে এম.এ. হান্নান অন্তিমের দেশে পাড়ি দেন।
তাঁকে পুরাতন রেল স্টেশন সংলগ্ন চট্টগ্রাম নগর বাইশ মহল্লা সর্দার কমিটি পরিচালিত বাইশ মহল্লা চৈতন্যগলি কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
এরপর থেকে তার কবর সংরক্ষণ করার কারো কোনো উদ্যোগ নেই।
অযত্ম অবহেলায় পড়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, চট্টগ্রাম আ্ওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এম,এ, হান্নানের কবরস্থান; বর্তমানে তা চেনারও কোন উপায় নেই।

এই হলো আমরা বাঙালি জাতির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নমুনা।

আমাদের ক্ষমা করবেন পিতারা...

আকন্ঠ কৃতজ্ঞতা, নতজানু শ্রদ্ধা ও বুকভরা ভালোবাসায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঠক এম.এ. হান্নানকে স্মরণ করছি।

[সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দলিলপত্র সংকলন; বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র]

______________________________________________________________________________

সাব্বির হোসাইন
sabbir.egdnc এট gmail.com

পুরোনো লেখাসমূহ:

একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড
ফিরে দেখা- বাংলাদেশ (২০০১-২০০৬)- সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতালম্বী নির্যাতন
রানা প্লাজা ও কিছু খেদোক্তি
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দুর্লভ ভিডিও ফুটেজ ও অডিও
বাঘের পোষাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিড়ালের আত্মসমর্পন

______________________________________________________________________________


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

অমূল্য তথ্য সম্বলিত লেখা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

মেজর রফিক-উল ইসলাম বীরউত্তম, মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) তার লেখা A Tale of Millions গ্রন্থের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দান করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কেন তিনি মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেজর রফিক-উল ইসলাম। একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা দিলে এই ‘আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র’ (‘Political Character of the Movement’) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থান সামরিক অভ্যুত্থান রূপে চিত্রিত হতে পারে, এই আশঙ্কায় দেশপ্রেমিক মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ঘোষণা দিলেন। তা শ্রুত হয় ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত (Rafiq-ul-Islam, A Tale of Millions, Dhaka. BBI, 1981)।

http://www.ghoshona26march.com/?p=627&single=1

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র এর ছবি

সচলায়তনে http://www.ghoshona26march.com/ -এর মত সাইটের লিংক লজ্জাজনক।
তাহলে তো কিছুদিন পর অমানুষরা স্টোরি অব বাংলাদেশের লিংক শেয়ার করা শুরু করবে; যাদের মতে আমরা পাকিস্তান আক্রমন করেছি আর ওরা বোকা মনিষ্যি, কিচ্ছু জানে না; আমাদের মেয়েরা নির্যাতিত হয়নি, ওরা নিজেরাই কাপড় খুলে পাকিদের সাথে শুতে গেছে; আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহীদকে পাকিরা মারেনি, আমরা নিজেরাই ওদের বেয়নেট নিজেদের পেটের মাঝে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করে, ওদের দোষ দিচ্ছি।

মডারেটরকে মন্তব্য ছাড়ের বিষয়ে যত্মশীল হবার অনুরোধ জানাই।

আর জনাব অতিথি লেখক,

চাঁদে দ্বিতীয় কোন মানুষ পা রেখেছিলেন?

ইতিহাস তার প্রামাণ্য বর্ণনায় কি এর বর্ণনা প্রাসঙ্গিক মনে করবে?
নিশ্চয় না।

সুতরাং, শুধুমাত্র তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বলে তার নাম আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রামাণ্য ইতিহাসে অর্ন্তভুক্ত হতে হবে, এই যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তিনি ঐতিহাসিকভাবে তৃতীয় ব্যাক্তি যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।

[সাব্বির হোসাইন]

\জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু/

এক লহমা এর ছবি

মন্তব্যকারীর নাম নেই।

মন্তব্যর উদ্দেশ্য ভাল লাগে নি।
সাইট-টির উল্লেখ অত্যন্ত বাজে লেগেছে।
গোটা মন্তব্যটির জন্য নিন্দা, ঘেন্না ইত্যাদি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

তৈ?
মদনাঘাট কৈ?
দেশপ্রেমিক
বডার ফারৈ
গৈইওগই! গৈইওগই!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এম এ হান্নানের নামে বিমানবন্দর হয়, কিন্তু এম এ হান্নানের কবরের খোঁজ নাই কারো। কী তামশা!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

তথ্য বহুল লেখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত।

অতিথি লেখক এর ছবি

যখন মাহতাবউদ্দিন মেসেজ পেয়ে জানিয়েই দিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র তার হাতে,
যখন এম.এ.হান্নান বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েই ফেললেন, তখন ঐ মেজর জিয়া (বলদ)'র নতুন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করার মানে কি ছিলো?

সেই বলদের উত্তরসুরীরা এখনও বলদীয় কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে।
তথ্যবহুল লেখা।

অনেক শুভকামনা সাব্বির হোসাইন।
ভালো থাকবেন।

--------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

মেজর জিয়া কর্তৃক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা ছিল তার চতুর এবং সুযোগসন্ধানী মানসিকতার প্রকাশ। তিনি অনুমান করেছিলেন দেশে তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব আছে; অন্যথায় তাকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করানোর কোন কারণ নেই। এই সুযোগে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে তিনি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছিলেন।

Emran

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।