ঝাঁঝের রানি সরিষার তেল

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৩/০৭/২০১৪ - ৪:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা বিজ্ঞাপন করার সুযোগ পেলাম। সরিষার তেলের বিজ্ঞাপন। মূল বিজ্ঞাপনের একদম শেষ অংশের ক্লিপ। এক সেকেন্ডের উপস্থিতি। তবে গুরুত্বপূর্ণ। হাতে সরিষার তেলের বোতল হাতে আমরা চার অভিনেতা দাড়িয়ে থাকব। সবার পড়নে পাঞ্জাবি পায়জামা। যার যার পাঞ্জাবি ঠিক করা আছে। আমার পড়েছে সবুজ কালার, হালকা কলাপাতা কালারের, সাথে সাদা পায়জামা। নতুন ঝকঝকে কাপড়। এই বিজ্ঞাপনের জন্যই কেনা হয়েছে। শুটিং শেষে সবাইকে দিয়ে দেয়া হবে। উপহার। অভিনেতাও হয়ে গেলাম উপহারও পেলাম।

বিজ্ঞাপনের শেষ অংশটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের মুখে ‘ঝাঁজের রানি সরিষার তেল, খাঁটি তেল’ কথাটি বিশেষজ্ঞ মতামতের মত শোনাবে। কাজেই অভিনয়টা নিখুঁত হতে হবে যেন সাধারণ মানুষ আমাদের কথায় আশ্বস্ত হতে পারে। আমি ঠিক করেছি মৃদু হেসে আস্থার সাথে কথাটা বলব । হাসির অভিনয় সবচেয়ে কঠিন। এক হাসি দেখে মনে হতে পারে এ আমার আপনজন, আবার আরেক হাসিতে মনে হতে পারে এ ব্যাটা ধান্দাবাজ, আমার সেই একই হাসি দেখে মনে হতে পারে কমেডিয়ান কোথাকার! আমার হাসি দেখে যেন লোকজন আমাকে আপন কেউ মনে করে। বারবার বাসায় চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।
যত সহজ মনে করেছিলাম অভিনয় ততটা সহজ না!

এক সপ্তাহ পরেই শুটিং হবে। পুরো সপ্তাহই আমি বাসায় চর্চা চালিয়ে গেলাম। বাসার লোকজন একটু অবাক। একদিন তো ইয়াকুব সাহেবর স্ত্রী খোঁজ নিতে এলেন আমার স্ত্রীর কাছে। ওনাদের বাসা থেকে আমাদের ভেতরের ঘরটা দেখা যায়। হেসে বললেন ‘ভাবী, ভাইকে ইদানিং প্রায় দেখি আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকেন, আবার বিয়ে করবেন নাকি?, আমার স্ত্রী ‘আরে ও তো একটা বিজ্ঞাপনে সুযোগ পেয়েছে, তাই ওই অভিনয় প্র্যাকটিস করে আর কি’। ভাবী সেদিন মনে হল একটু মন খারাপ করে চলে গেলেন। পরদিন ইয়াকুব সাহেব এসে হাজির ‘রফিক ভাই, আমাকে একটা নাটকের রোল দিতে হবে, আপনার ভাবী তো পাগল করে দিচ্ছে!’ বুঝলাম খ্যাতির বিড়ম্বনা একেই বলে।
রাস্তা ঘাটে বের হলে ইদানিং দেখি পাড়ার লোকজন কেমন অন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। সজিব নামের পাড়ার উঠতি মাস্তানটা সারদিন মোড়ে একটা লাল হুন্ডা নিয়ে দাড়িয়ে থাকত, আগে কখনো তাকাতোই না আমার দিকে। এখন ওই ব্যাটাও দেখি আমাকে দেখে সালাম দিচ্ছে। এরা সব জেনে গেল নাকি!

শুটিঙের দিন এসে গেল। ১০ টার সময় যাওয়ার কথা। আমি আটটার সময় স্পটে হাজির হয়ে গেলাম। পেশাগত জীবনে সময় মেইনটেইন করা খুব জরুরি। গিয়ে দেখি তখনও কেউ আসেনি। একজন মধ্যবয়সী লোক ঝাড়ু দিচ্ছে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে এক কোনায় বসে থাকলাম। একটা পেপার থাকলে ভালো হত। সময় কাটানো যেত। আমি সময় নষ্ট না করে ডায়ালগ প্র্যাকটিস করে গেলাম ‘ ঝাঁজের রানি সরিষার তেল, খাঁটি তেল’।
আস্তে আস্তে লোকজন এসে গেল। ক্যামেরা ট্যামেরা আসা শুরু হল। লং শট, ক্লোস শট দুইটাই নেয়া হবে। এগারোটার দিকে আমার ডাক পড়ল। ডিরেক্টর সাহেব চলে এসেছেন। আমার সাথের চার সহকর্মীও দেখলাম এসে গেছেন। আমাদের অংশটার শুটিং হতে নাকি একটু দেরি হবে। কয়েকটা সিকোয়েন্স বাকি আছে। একটা হল নায়িকা এক বাটি মুড়ি নিয়ে বসে আছে, সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মাখতে মাখতে বলবে ‘আমার রূপের রহস্য? আমি খাই ঝাঁজের রানি সরিষার তেলে মাখা মুড়ি’। আরেকটা সিকোয়েন্স বাড়ির কর্তা পেটে তেল মাখতে মাখতে বলছেন ‘ঝাঁজের রানি সরিষার তেল গায়ে না মাখলে আমার ঘুমই আসে না’। শুটিং শুরু হতে দেরি হচ্ছে কারণ মুড়ি আনা হয়নি। কাকে যেন পাঠানো হয়েছে, ঘণ্টা পার হতে চলল তার খবর নেই। অনেকক্ষণ পর তার খোঁজ পাওয়া গেল হাতে দুইটা পপকর্ণের প্যাকেট। কোথাও নাকি মুড়ি পায় নাই তাই সে বুদ্ধি করে পপ কর্ণ নিয়ে আসছে। ক্যামেরায় দূর থেকে বোঝা যাবে না, মুড়ি পপকর্ণ একই রকম লাগবে।
ক্যামেরা রোল করা হল। নায়িকা পপকর্ণের সাথে সরিষা মাখাতে মাখাতে বলছে ‘আমার রূপের রহস্য? আমি প্রতিদিন খাই ঝাঁজের রানি সরিষার তেলে মাখা মুড়ি’। ‘ওমা, এমন গন্ধ কেন, এই চিটচিটে তেল আমি হাতে লাগাব না’ ‘কাট! কাট!’ ‘মাডাম, এইটা তো বিউটি সোপ না, তেল তো তেলতেলা হবেই’ ‘ওই ক্যা আছস, তেলে সেন্ট মার’। ‘ইসসিরে! এই সরিষার তেল আমি মাথায় দিয়া ফালাইসি!’ ‘ও মাই গড! এখন কি হবে!’ ‘মাডাম, এই ফাঁকে একটা শ্যাম্পুর অ্যাড কইরা ফালান’।
পেটে তেল মাখার পর্বটা অবশ্য নির্বিঘ্নেই হল। আর্টিস্ট অবশ্য তেল মাখার পর ‘আমার গা জ্বলে ক্যান’ বলে একটু কু কু করছিল, ডিরেক্টর সেটা গায়ে মাখেন নাই। এত বড় আয়োজনে দুই একজনের গা জ্বলে পুড়ে না গেলে হয়!

চারটার দিকে আমাদের ডাক পড়ল। সকাল থেকে এক ডায়লগ প্র্যাকটিস করতে করতে এখন মাথা কেমন ভো ভো করছে। ঠা ঠা রোদের মধ্যে আমাদের দাড় করিয়ে সরিষার তেলের বোতল ধরিয়ে দিল। আমরা চারজন চার কালারের পাঞ্জাবি পড়ে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। হাতে তেলের বোতল। ডিরেক্টর অ্যাকশন বললেই ডায়লগ দিতে হবে‘ ঝাঁজের রানি সরিষার তেল, খাঁটি তেল’। এক টেকেই ওকে করতে হবে। জাত শিল্পী কাকে বলে আজ দেখবে স্টুডিওপাড়া!
‘লাইট! ক্যামেরা অ্যাকশন!’ শুনতেই মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল সবকিছু। সরিষার তেলের বোতলটার দিকে তাকিয়ে ভুলে গেলাম কি বলতে হবে যেন? হঠাৎ ‘হায়! হায়! কি করলাম আমি! পুরা বোতলের তেল খেয়ে ফেলেছি! কি হবে এখন! কি হবে! বলতে বলতে আমার পাশের আর্টিস্ট ঠাস করে পড়ে গেলেন। শুনছিলাম উনি কিছুক্ষণ আগে কোমল পানিয়ের বিজ্ঞাপন করে এসেছেন। সেখানে ওনার দৃশ্যটা ছিল ঢক ঢক করে বোতল সুদ্ধ পানীয় খেয়ে ফেলা। এখানেও বোতল হাতে পেয়ে, অ্যাকশন শুনে উনে ভুলে...।
এরপর হই চই, চ্যাঁচামেচি চারিদিকে। ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটোছুটি। শুটিং প্যাক আপ। আমি আর দাড়িয়ে না থেকে সবুজ কালারের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর এক বোতল ঝাঁজের রানি সরিষার তেল নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
(শুটিং পড়ে আর হয়নি। তবে ফটোশুট হয়েছিল। শহরের রাস্তায় আমাদের চারজনের পোস্টারটা এখনও দেখা যায়, সরিষার তেলের বোতল হাতে আমরা চারজন ঝলমলে চার রঙের পাঞ্জাবি পড়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছি। নিচে ক্যাপশন-
‘ঝাঁজের রানি সরিষার তেল, খাঁটি তেল’।)

মারুফ রুমি


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

হো হো হো চমৎকার চলুক

..................................................................
#Banshibir.

মারুফ রুমি এর ছবি

চোখ টিপি

তিথীডোর এর ছবি

মজারু হৈসে। দেঁতো হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মারুফ রুমি এর ছবি

চোখ টিপি

মারুফ রুমি এর ছবি

হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

‘মাডাম, এইটা তো বিউটি সোপ না, তেল তো তেলতেলা হবেই’
‘ওই ক্যা আছস, তেলে সেন্ট মার’।

হো হো হো

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

শাব্দিক এর ছবি

হো হো হো গড়াগড়ি দিয়া হাসি গুল্লি

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

মারুফ রুমি এর ছবি

চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক গুল্লি

এই রাত দুপুরে মুখ চেপে হাসতে হলো হো হো হো গড়াগড়ি দিয়া হাসি

কিন্তু ভাইজান পাড়ার মাস্তান বানিয়ে ফেললেন আমায়? পাড়ায় তো সবাই আমারে ভেদকা মাছ বলে জানে খাইছে

মাসুদ সজীব

মারুফ রুমি এর ছবি

আমারও সজিব নামের এক বন্ধু আছে, আপনার মতই নিরীহ, গোবেচারা। কি জানি কেমন করে মাস্তান হয়ে গেল!?
পরের গল্পে হয়ত নায়ক হয়ে আসবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

খাসা হয়েছে বন্ধু, আশা আরো বেড়ে গেলো। নিয়মিত লিখবি এটাই প্রত্যাশা।

- সজীব

নীল_অপরাজিতা এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

দেঁতো হাসি

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

Sohel Lehos এর ছবি

ব্যাপক আনন্দ পাইলাম চলুক

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

হা হা হা খুবমজা পাইলাম ঝাঁঝের লেখা।।।দম আছে

দেবদ্যুতি এর ছবি

দারুণ ঝাঁঝের লেখা তো!!

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।