১৫ই অগাস্ট ও আমার বাবা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৫/০৮/২০১৪ - ৯:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-রোল নাম্বার থার্টি টু।
-ইয়েস স্যার।
-কিরে গতকাল স্কুলে আসস্‌ নাই ক্যান?
-স্যার, বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল।
-ঐ হারামজাদা! শেখ মুজিব কবে তোর বাবা হইল! এদিকে আয়, ক কাইল কই আছিলি? সত্য বলবি নাইলে পিটাইয়্যা পিঠের ছাল তুইল্যা ফালামু।
-স্যার, সত্যি কাল আমার বাবার মৃত্যু বার্ষিকী ছিল, গতবছর এইদিনে উনি মারা গেছেন।
-আগে কবিতো, যা বস্‌, মন খারাপ করিস না, বাবা কারো চিরদিন বাইচা থাকেনা।

উপরের সংলাপটি কল্পিত নয়। আমার জীবনে সত্যি সত্যি ঘটা ঘটনা। কয়েক কাঠি সরেস কেউ কেউ আবার এমনটাও বলেন,
- ও, তোমরা বুঝি পাঁড় আওয়ামী লীগার পরিবার! তাই ১৫ই অগাস্ট মৃত্যুবার্ষিকী পালন করো।
জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার জন্য যে কারো পাঁড় আওয়ামী লীগার হবার দরকার পড়েনা সেটি এদের বোধের বাইরে। আর নিজের পিতার মৃত্যুদিবসের কথা তাদেরকে নাই বা বললাম।

১৯৯০-এর পরবর্তীতে যে বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলনা সেই বছরগুলোতে ১৫ই অগাস্ট সাধারণত হরতাল আহ্বান করা হতো। ১৯৯২ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় সেবার ১৫ই অগাস্ট হরতালের মধ্যে বহু কষ্টে মুমূর্ষু বাবাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে। তারপর তিনি যখন সব কষ্টের ঊর্ধ্বে চলে গেলেন তখনও তাঁকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। ’৯২ পরবর্তী সময়ে যতদিন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল ততদিন পর্যন্ত হরতালের দরুণ আত্মীয় পরিজনেরা মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমাদের বাসায় আসতে পারতেন না। অন্য দিকে আমাদের শহরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ভালো থাকায় সারা শহরজুড়ে তাদের আয়োজিত কাঙ্গালী ভোজের দরুণ আমাদের বাসার অনুষ্ঠানে খাওয়াবার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক ভিখিরীর খোঁজও পাওয়া যেত না। সেই থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নেই বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ১৫ই অগাস্টের পরিবর্তে তার পরের কোন শুক্রবারে পালন করার। আমার মা কোথা থেকে যেন একদল অন্ধ ভিখিরীর সন্ধান পেয়েছিলেন। দুই দশক ধরে ঐ দিনে বাবার পছন্দের খাবারগুলো মা তাদেরকে নিজে রেঁধে খাওয়ান।

যাকে নিয়ে এই লেখা, মানে আমার বাবা, তাঁর জীবনটাই ছিল ১৫ই অগাস্টময়। প্রথম, ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট মাধ্যমিকে পড়া আমার বাবা সদ্য স্বাধীন দেশে আবিষ্কার করেন ধর্মের নামে দেশ দুই ভাগ হয়ে গেছে। আর শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাঁর জন্মভূমি নাকি আর তাঁর দেশ নেই। তাঁকে চলে যেতে হবে ‘পাকিস্তান’ নামের একটা অজানা, অচেনা দেশে। বাবা আর তাঁর পরিবার চেষ্টা করেছিল যাতে নিজ ভূমিতে থাকা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যখন অসহ্যকর হয়ে যায় তখন তিনি বাধ্য হন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ চলে আসতে।

দ্বিতীয়, ১৯৭২ সালের ১৫ই অগাস্ট সদ্য স্বাধীন দেশে বাবা একজন পুত্র সন্তান লাভ করেন। আমার অগ্রজের জন্ম বাবার জীবনের একমাত্র ১৫ই অগাস্টিয় সুসংবাদ।

তৃতীয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট ঘটে যাওয়া ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে পারি তাঁর লেখা ডায়েরি থেকে। ষাটের দশক থেকে শুরু করে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বাবা তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনাবলীর বাইরে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়েও নিজের প্রতিক্রিয়া লিখে রাখতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশকে হাজারো সমস্যা জর্জরিত অবস্থা থেকে উত্তরণ কালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার ব্যাপারে তাঁর ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর প্রতিক্রিয়ায়।

চতুর্থ ও সর্বশেষ,১৯৯২ সালের ১৫ই অগাস্ট আমাদের কাউকে বিশেষ কিছু করার সুযোগ না দিয়ে খুব দ্রুত তিনি ইহলোক ছেড়ে চলে যান।

জন্মের পূর্বেই পিতৃহীন এই মানুষটি তিন বার, তিনটি দেশেএকেবারে একা আক্ষরিক অর্থে ফুটপাথ থেকে জীবনসংগ্রাম শুরু করে সততা আর নিষ্ঠা দিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন। কখনো রাজনীতির নিষ্ঠুর চালে, কখনো আত্মীয় পরিজনের বিশ্বাসঘাতকতায় বার বার তিনি প্রতারিত হয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন। তবু তিনি উদ্যম হারাননি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। আবারও নতুন উদ্যমে সব শুরু করেছেন। ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতককে না চাইতেই ক্ষমা করেছেন।

আগামীকাল বাবা চলে যাবার ঠিক ২২ বছর পূর্ণ হবে। এই দিনটা আসলে মনে হয়, বাবার যোগ্য সন্তান আমি নই, তাঁর গুণ অর্জন করতে পারিনি, সফলতাও আমার অধরা। তবু সত্য আর ন্যায়ের পথ থেকে আজো বিচ্যুত না হবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কে জানে চেষ্টা চালিয়ে গেলে একদিন হয়তো বাবার মতো জীবনসংগ্রামেও সফলতার মুখ দেখতে পাবো।

অভিমন্যু
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

সমবেদনা ও শুভকামনা। ভাল থাকুন।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সম্মিলিত শোকোচ্ছ্বাসের নিচে চাপা পড়ে কাঁদে ব্যক্তিগত শোক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক সেটাই। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

সুবোধ অবোধ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেল আপনার ব্যক্তিগত ঘটনাটি পড়ে মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

shamsun nahar eva  এর ছবি

জিবন এ মাঝে মাঝে কিছু দুঃখ সামাজিকতার রোষানলে পিষ্ট হয়। বাস্তবতা কে বড়ই অসহায় দেখায়

অতিথি লেখক এর ছবি

জানেন আমরা কিন্তু প্রথম প্রথম মন খারাপ করতাম পরে বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিয়েছি।
ধন্যবাদ সমব্যাথী সবার জন্যে

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

হুম পাণ্ডবদার মন্তব্য থেকে জেনেছিলাম আগস্ট মাসের ব্যক্তিগত দুঃখের কথা, আপনার থেকে ভালভাবে জানতে পারলাম। এখানে তো শুভকামনা জানানোর কোন উপায় নেই, সমবেদনা জানিয়ে গেলাম।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

এই বাইশ বছর আমাদের পরিবার আপনি বা আপনাদের মতো অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীকে পাশে পেয়েছি তাই বা কম কিসে।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

মাসুদ সজীব এর ছবি

সফল কিংবা ব্যর্থ হওয়ার চেয়েও বড় বোধহয় মানুষ হতে পারা, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারা, সত্য আর সুন্দরকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারা। আপনার মনের সবটুকু আলো ছড়িয়ে যাক আপনার আশেপাশের চেনাজানা জগতে, এইটুকু চাওয়া থাকলো আপনার কাছে। আপনি নিশ্চয় সেটুকু করতে পারবেন, ভালোথাকুন।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিকই বলেছেন, তিনিও তাই চাইতে, তাই আজো আমরা প্রত্যেক ভাইবোন সত্য ও ন্যায়ের পথে চলারই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর সফলতার ব্যাপারটা হচ্ছে তিনি প্রতিকুল পরিবেশে তিন তিনবার শূন্য থেকে শুরু করে সফল হয়েছেন তাঁর সন্তান হিসেবে একবার নিশ্চয়ই তা পারাটা আমাদের উচিত।
ধন্যবাদ পড়া ও মন্তব্যের জন্য।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শুরুতে উল্লেখিত ঘটনাটির অনুরুপ একই ঘটনা ঘটে চলেছে নিরন্তর।

আজ সকালে ছাত্রদের র‍্যালিতে নিয়ে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে কর্মস্থলে ঢোকার মুখে মাঠে ক্রীড়ারত এক ছাত্র চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করল আমার বুকপকেটে কালো ব্যাজ কেন? জাতীয় শোক দিবসের কথা বলতে না বলতেই পেছন থেকে আরেক ছাত্রের ফোড়নঃ "হ আইজকা আম্লীগের কি জানি কি দিবস, ছারে মনে হয় আম্লীগ করে", আপনি মাস্টারের হাতে ঠ্যালা খেয়েছিলেন, আমি উল্টোটা মন খারাপ

আপনার জন্য শুভকামনা রইল, ভাল থাকুন

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ এমনতাইতো হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তি ২০ বছর এ দিনটা শুধু আওয়ামী লীগ পালন করেছে বাকিরা করেছে আনন্দ তাই তখন থেকেই জাতীয় শোক দলগত শোকে রূপ নিয়েছে, তাই ঐ বাচ্চাদের কোন দোষ নাই কারন আমরা ওদের সত্যের সন্ধান দেইনি।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

অতিথি লেখক এর ছবি

সমবেদনা জানবেন।

ভালো থাকুন।

---------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

এক লহমা এর ছবি

শ্রদ্ধা

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

এক লহমা এর ছবি

হাচলাভিনন্দন!
হাততালি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নজমুল আলবাব এর ছবি

আপনার বাবা ভালো থাকুন

অভিমন্যু . এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হাচলাভিনন্দন!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাসুদ সজীব এর ছবি

হাচলে অভিনন্দন হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অভিমন্যু . এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।