ছোট্টো ফ্রি লাইব্রেরী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২১/০৯/২০১৪ - ৫:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাসা থেকে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য সবসময় শাটল বাস সার্ভিসই ব্যবহার করা হয়। বেশি দূর না অবশ্য, হেঁটে যেতে ২৫ মিনিটের মত লাগে। কিন্তু বাস থাকলে ২৫ মিনিট হাঁটার হ্যাপা কে পোষায়? কিন্তু আজ হাঁটতে হলো।

ইউনিভার্সিটি লেভেলের ফুটবল আমেরিকাতে চরম জনপ্রিয়। যেদিন খেলা থাকে, সেইদিন ইউনিভার্সিটি আর মেলার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। নিজ ভার্সিটির বিশেষ রঙের জামা পড়ে সবাই বের হয় ঐদিন, খেলা শুরুর ঘণ্টা সাতেক আগেই। তাঁবু খাটিয়ে স্থান দখল করে গান-বাজনা করে। বার্গার, স্যান্ডউইচ, হট ডগ, ফ্রাইড চিকেন, সফট ড্রিংকস, বীয়ার এর ব্যাপক আয়োজন থাকে। কে আসছে, কে খাচ্ছে, এটাও অনেক সময় দেখা হয়না। সবাই এখানে স্বাগতম! এই উৎসবটার নাম, Tailgating. যেদিন খেলা থাকে, ঐদিন বাস চলে না। বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। বাকি রাস্তাগুলোতে গাড়ির এতো জ্যাম থাকে যে, ২৫ মিনিট হাঁটার আইডিয়াটা হঠাৎ করে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। Tailgating শেষ করে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ করে, রাস্তার পাশে একটা কেইস আবিষ্কার করলাম।

কাছে গিয়ে দেখি, ভেতরে কিছু গল্পের বই রাখা! আর নিচে লেখা, Little Free Library.

কাগজের মধ্যে যা লেখা, সেটাকে সংক্ষেপে বাংলা করলে দাঁড়ায়, "এখান থেকে বই নিন। এখানেও ফেরত দিতে পারেন, আবার নিকটস্থ যে কোনো লাইব্রেরীতেও ফেরত দিতে পারেন।"

আমি ওখান থেকে দুটো বই নিলাম। নিয়ে নীরবে বাসার দিকে হাঁটা ধরলাম। কিন্তু মাথার ভেতরে শত শত চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। এমন কিছু আমি আর কখনো দেখিনি। এটার সবচেয়ে কাছাকাছি যে ঘটনাটা আমি দেখেছি, তা হলো - ডিপার্টমেন্টের লবি'তে রাখা টেবিল, যেখান থেকে ইচ্ছেমত নেয়া যায়, এমন বেশ কিছু বই রাখা থাকে। কিন্তু ওটা একটা বিদ্যা নিকেতন, এটা একদম রাস্তার পাশে। বাংলাদেশে আমরা অনেকে বই ধার দিতে চাইনা, কারণ অনেকের মধ্যে বই ফেরত দেয়ার অভ্যাস থাকেনা। কিন্তু, এখানে বই ফেরত দিলাম কি দিলাম না, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। বই ছড়িয়ে দেয়ার এমন একটা প্রচেষ্টা দেখে মনটা কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেলো।

কিন্তু সেই চিন্তাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা, কষ্টকর কিছু চিন্তা এসে মন দখল করে নিলো। বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে - এটা বললে মনে হয়না খুব একটা ভুল বলা হবে। ফেসবুকে মুভি সংক্রান্ত গ্রুপগুলোতে ২৫/৩০ হাজারের ওপরে সদস্য থাকে, কিন্তু বইয়ের গ্রুপে এতো মেম্বার পাওয়া যায়না। মুভি দেখা খারাপ না মোটেই, আমি নিজেও প্রচুর মুভি দেখি। কিন্তু তাই বলে সেটা কি বইয়ের বিকল্প হতে পারে?

ডিভিডি, ব্লুরে, আর ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থাকা নতুন এ প্রজন্ম কি বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এগুলোতে বইয়ের চেয়ে বেশি উপযোগ পাচ্ছে? হয়তো পাচ্ছে। আমার ছোটো ভাইটাকেই তো অনেক বলেকয়েও বই পড়ার অভ্যাসটা ধরাতে পারলাম না। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটা খেলা শুরু হয়েছিলো। দশটা প্রিয় বইয়ের নাম বলে আরো দশজনকে একই কাজ করার জন্য ট্যাগ করতে হবে। ট্যাগ করতে গিয়ে দেখি, বই পড়ে এমন লোকজনের সংখ্যা তো তেমন বেশি নেই! বইয়ের প্রতি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আরো আগ্রহী করার জন্য কী করা যেতে পারে? Little Free Library এর টেকনিক বাংলাদেশে কাজে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু যে লাইব্রেরীগুলো আছে, সেগুলোকে কি আরো বেশি কর্মক্ষম করে তোলা যায়না? স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে কি আরো বেশি বেশি বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়না?

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কতটুকু অংশ বই পড়ার অভ্যাস ধারণ করবে, সেটার দায়িত্ব আমাদের ওপরেও বর্তায়। নিজ নিজ জায়গা থেকে কিছুটা হলেও সেই দায়িত্ব পালন করলে লাভ আমাদেরই।

ফরহাদ হোসেন মাসুম
স্টুডেন্ট, লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

সচলে অতিথি লেখকদের লেখার শেষে নাম/নিক জানানোর নিয়ম।
ইউনির নাম উল্লেখ করতে এক আপনাকেই দেখলাম।

ফেসবুকে বই নিয়ে দশজনকে ট্যাগ করতে গিয়ে সমস্যা হবে তখন, যখন আপনার বন্ধুতালিকা ঐরকম পড়ুয়াদের নিয়ে নয়। কাকে বাদ দিয়ে কাকে যে নেবো, আমার সেটা ডিসাইড করতে কষ্ট হয়েছিল বরং।

বলেকয়ে যেটা তৈরি হয়, সেটা রুটিন। ভাল লাগা থেকে যেটা তৈরি হবে, সেটা নেশা। বইয়ের চেয়ে সাংঘাতিক নেশা আর কী আছে!

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কতটুকু অংশ বই পড়ার অভ্যাস ধারণ করবে সেটার দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের ওপরই বর্তায়। যেটা দেখেছি, মনে হয় যেকোন ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয় মূলত পরিবেশ থেকে। ঘরের শেলফে যদি গল্পের বই থাকে, বড় ভাইবোনকে যদি সেগুলো পড়তে দেখে, বাচ্চারা পড়তে আগ্রহী হবে না কেন? শপিঙে গেছেন, বায়না ধরলে গাড়ির বদলে বই কিনে দিন, জন্মদিনে গেমসের ডিভিডির বদলে বই। রাতে ঘুমানোর সময় গল্প বলুন বই থেকে, ক্লাসে ফার্স্ট হলে ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার বদলে বাতিঘর বা পাঠক সমাবেশে নিয়ে যান, কিনে দিন সামর্থ অনুযায়ী বই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হলে তাকে বকাঝকার বদলে উৎসাহ দিন। পড়ার অভ্যাস তৈরি তো হবে এভাবেই।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সাফওয়াত আবেদীন এর ছবি

চলুক চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ট্যাগ করার সমস্যাটা মনে হয় আমি ক্লিয়ার করে লিখিনি। ১০ জন এর অনেক বেশিই বই পড়ে, এবং আপনার মত হিমশিম আমিও খেয়েছি। কিন্তু আমার আশ্চর্য হওয়ার জায়গাটা ছিলো, এদের মধ্যে কতজন বই পড়ে না, সেটা নিয়ে। ভুল ফ্রেজিং ছিলো আমার!

বাসাতে বই আছে অনেক, ছোটো ভাই আমাকে বই পড়তেও দেখেছে, গিফট দিতে হলেও বইই দিয়েছি। কিন্তু কেন যেন ওর মধ্যে এটা এলোনা। কিন্তু এক কাজিনের মধ্যে এটা চলে এলো এমনিতেই। বাসায় এলেই বই নিয়ে যেতো।

ফরহাদ হোসেন মাসুম

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা -গুড়- হয়েছে
যেমন পোষ্ট তেমন হয়েছে ছবিগুলো।

(আমাদের পানি ফ্রি খাওয়ার গ্লাসটি চেইন দিয়ে ঝালাই করে আটকানো। পাড়ার পান-বিড়ির দোকানে সিগারেটের লাইটার, রিসেপশন ডেস্কের কলম ফিতা দিয়ে বাঁধা ইত্যাদি ভেবে মনটা কিঞ্চিত খারাপও হয়ে গেল।)

মন মাঝি এর ছবি

শুধু সিগারেটের লাইটার না, এমনকি দিয়াশলাইয়ের বাক্সের কাঠি বের করে সেই কাঠি পুরনো খালি কন্ডেন্সড মিল্কের কৌটায় রেখে সেই কৌটা দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। ন্যান এইবার একটা একটা করে কাঠি! গড়াগড়ি দিয়া হাসি

****************************************

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

লন, এইহানে টিপি দ্যান দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অভিমন্যু . এর ছবি

চলুক

________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমাদের পাবলিক লাইব্রেররিগুলোতে ফ্রি পড়তে গিয়েই বই প্যান্টের চিপায় লুকিয়ে নিয়ে আসে নয়তো ভেতর থেকে পৃষ্ঠা কেটে নিয়ে চলে যায়। অতএব এই আশা করে লাভ নেই।
পোস্ট নিয়ে যা বলার তিথীডোর সুন্দর করে বলে দিয়েছে। আর নতুন করে কিছু বলার নেই।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বই পড়ার অভ্যাস বিষয়ে দু-একটা কথা বলি। আমাদের মা-খালারা ছিলেন একেবারেই খাঁটি গৃহিণী। ছোটবেলায় তাঁদের দেখেছি, সংসারের কাজকম্ম সেরে পড়ন্ত বেলায় খাটে হেলান দিয়ে কোন একটা বইয়ে চোখ বোলাতে। সে বই অবশ্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শরৎবাবুর লেখা। আমাদের কৈশোরে, যৌবনেও বই পড়ার যথেষ্ট চল ছিলো। আমার জীবনের মধ্যবেলায় যখন টেলিভিশন বিশেষকরে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল চালু হলো তখন দেখেছি ছেলে-বুড়ো সবারই কেমন যেন পড়ার অভ্যেসটা মিইয়ে গেল। আর কিছুকাল হলো, ইন্টারনেটের কারণে এখনতো আম ছাত্র-জনতা আর পড়েনা। তা সে খবরের কাগজও না। এখন মানুষ পড়ার চেয়ে শুনতে চায় বেশী আর শোনার চেয়ে বেশী চায় দেখতে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলবোনা। আমার দেখা-জানা ভুলও হতে পারে বটে।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। মানুষের জীবনে কতকিছুই অজানা-অদেখা রয়ে যায়! হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।