পরিচয়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৯/১১/২০১৪ - ৩:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি প্রথমে গেটের সামনে এসে থমকে গেলাম।

দেশে আসার পর থেকে এখন আমি যাই দেখেছি তাতেই অবাক হয়ে গিয়েছি, আমার এই অবাক হওয়াটা অবশ্য মোটেও অস্বাভাবিক নয়। দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর যারাই দেশে আসে আমার ধারণা এখন এদেশটা দেখলে সত্যি ভড়কে যাবে। আমার অনেক সহকর্মী বাংলাদেশ বলতে একটা দরিদ্র দেশকে বুঝে, যেখানে হাড় জিড়জিড়ে শিশুরা শহরের ডাস্টবিনে খাবার খুঁজে বেড়ায়। তাদেরকে আমার এই দেশটা এখন দেখাতে ইচ্ছে করে, এখন দেশটা যে খুব উন্নত হয়েছে তা জোর দিয়ে বলতে পাব না, তবে এই বিশ-বাইশ বছর পর আমি যা দেখছি তাতে আমার অবাক হওয়াটা প্রতিদিন বেড়েই চলছে।

রাজধানী ঢাকার কথা বাদই দিলাম, আমার নিজের শহর রংপুর কি বদলে যায় নি? আমি স্কুলে যেতাম রিকশায়, চেয়ে চেয়ে দোকানপাট রাস্তাঘাট ডেখোটাম। পরের দিকে বাবা একটা গাড়ি কিনেছিলেন বটে তবে আমি ওটায় চড়ে স্কুলে যেতে খুব লজ্জা পেতাম। আমি মার সাথে রিকশায় করে স্কুলে যেতাম আর সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখতাম। আজ বাইশ বছর পর রিকশায় করে নিজের শহর দেখতে বেড়িয়ে মনেই হচ্ছে না এটা আমার শহর, বাইশ বছর আগে যা দেখেছিলাম।

তখন আমাদের পরিবারটা ছিল রংপুরের সবচেয়ে সভ্রান্ত পরিবার। দাদু ছিলেন শহরের সবচেয়ে নামকরা উকিল, আর বাবারা তিন ভাই মিলে যে প্রেসটা করেছিলেন সেটাও ছিল উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বড় ছাপাখানা। যত ছাপার কাজ সব এই “নবাব প্রেস”-এ হত। বাবারা তিন ভাই প্রেসটাকে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। আমাদের পরিবারটার সবাইকে শহরের সব মানুষ চিনত। এ নিয়ে কৈশোরে আমার আফসোসের শেষ ছিল না। প্রথম প্রথম শৈশবে এই সম্মান খুব ভাল লাগতো আমার। যেখানেই যেতাম, লোকজন ডেকে বলত, “এ তুমি হাশেম উকিলের নাতি না? বিপ্লবের ছেলে?” আমি হেসে মাথা নাড়তাম। কিন্তু স্কুলে ক’বছর যেতে না যেতেই টের পেলাম এর বিপত্তি। আমার বন্ধুগুলো- সাকলাইন, তানভীর, রাব্বীরা যেখানে খুশি যেতে লাগল, অথচ আমি আটকা পড়ে যেতাম। স্কুল পালিয়ে কোথাও যেতেও পারতাম না, টিচাররা নালিশ তো করতোই বাইরের কেউ দেখলেও নালিশ করত।

অনেকের ধারণা ছিল, বড়লোকের ছেলেগুলো লাফাঙ্গা হয়, বখে যায়। তবে আমি ছিলাম এর পুরোপুরি ব্যতিক্রম। বড়চাচার ছেলে আরেফিন ভাইয়া ওরকম হলেও আমি হতে পারি নি। এর একমাত্র কারণ মার কড়া শাসন। চাকর-বাকরদের সামনেও কিছু করলে ঠাস করে চড় লাগায় দিতো। আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে দাদুকে গিয়ে নালিশ করতাম। কারণ দাদু ছিল আমাদের পরিবারের কর্তা। তার উপরে কেউ কোন কথা বলত না। কিন্তু দাদুর কাছে গিয়েও কোন ফল পেতাম না, কারণ দাদু মা’কে খুব মানতো। শুধু দাদুই না, অন্যরাও মানতো- এমনকী আমার দাদীও। এর কারণ একমাত্র মা-ই ছিল আমাদের বাসায় কর্মজীবী মহিলা। বড় চাচী, ছোট চাচীরা যখন সকালে উঠে ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, মা তখন গোসল শেষ করে ভাল শাড়ি পড়ে আমাকে নিয়ে স্কুলে যেতেন। কি সুন্দর স্নিগ্ধই না লাগতো মাকে! আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তিনি চলে যেতেন গার্লস স্কুলে। গার্লস স্কুলের কড়া টিচার আনোয়ারা ম্যাডাম, যিনি আমার মা! মা চাকরি করেন এ জন্য মাকে দাদু খুব পছন্দ করতেন। যেকোন ব্যাপারে বাড়ির মহিলাদের মধ্যে একমাত্র মা-র মতামতই নিতেন। আমি যখনই মার নামে নালিশ করতাম দাদুর কাছে দাদু মাকে ডেকে বলতো, “কেন বৌমা টগরকে মেরেছো?” ও আমার কাছে এসে কাঁদছে।”

মা ক্ষিপ্ত গলায় বলছে, “আব্বা আপনি ওর পক্ষ নেবেন না, আপনাদের আদর পেয়ে ও মাথায় উঠেছে।”

- “কি করেছে ও ?”

- “আপনার মুহুরী আব্দুল, আমিই লোকটাকে আপনি করে বলি- কত পুরোনো! আপনার নাতি ওর সামনে একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। নামাতে বললাম আর আমায় বলে কি না- ও তো চাকর ! উনার সামনেই !”

দাদু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। মা বলেই চলছে, “কী ভীষণ লজ্জায় ফেলেছিল আপনার নাতি ! আমি তো উনার দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। দ্রুত ক্ষমা চেয়ে নিলাম, উনি কিছু মনে করেছেন কি না কে জানে। তারপর এসে দিয়েছি শয়তানটাকে একটা চড়।”

দাদু আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ছি দাদু এভাবে বলবে না আর।”

আমি মাথা নাড়ালাম লক্ষী ছেলের মত। আমার শৈশব, কৈশোর দুটোতেই আমি লক্ষী ছেলে হয়েই ছিলাম। আরেফিন ভাইয়াটা বখে যাওয়ায় আমরা ছোটদের উপর নেমে এসেছিল কড়া শাসন। আমি আর আমার বোন চুমকী, ছোট চাচার পিচ্চি অনিক। পরে অবশ্য ওর একটা বোন হয়েছিল। প্রতিদিন মা’র সাথে আমি স্কুলে যেতাম। মা আমাকে রিকশায় নিয়ে যেতে যেতে প্রতিদিন উপদেশ দিতেন এটা করবে, ওটা করবে না- আমি চুপ করে শুনতাম। চুমকি আর অনিক ছিল সমবয়সী। আমি স্কুলে যেতে বের হলেই দুজনে সমানে কান্নাকাটি করত স্কুলে যাবার জন্য। আমি খুব হাসতাম। কী বোকা ওরা! স্কুলে যে কি কড়া কড়া স্যাররা আছে ওরা কি জানে?

আমাদের সবচেয়ে কড়া স্যার ছিল মোশাররফ স্যার। গণিত করাতেন। কেউ অংক না পেলে কিছু বলতেন না ঠিকই, কিন্তু বেয়াদবী করলে প্রচন্ড মারতেন। স্যারের দুটা বেত ছিল। আমরা নম্বর দিয়েছিলাম এক নম্বর দু নম্বর। দু নম্বরটা ছিল একটু মোটা। ওটাই বেশি ব্যবহার হত। আর এক নম্বরটা ছিল একটু চিকন। আর লম্বাও। ওটায় যখন কাউকে সপাং সপাং করে মারতো অন্যরাও ভয়ে কেঁদে ফেলত। আর যে মার খেত তার তো কথাই নেই। আমাকে কেউ মারত না। প্রথমত আমাদের পরিবারকে সবাই চিনতো আর আমি ছাত্র হিসেবেও ছিলাম তুখোড়। সবাই খুব পছন্দ করত আমাকে। একবার একটা নতুন স্যার এসে বিনা দোষে আমায় বেত দিয়ে মেরেছিল- তাও আবার এক নম্বর দিয়ে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিলাম। দুদিন জ্বরের মধ্যে ছিলাম। দাদু মাকে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন এটা শুনেছি। তারপর প্রিন্সিপালকে কি কি বলেছেন আমি জানি না। তবে দুদিন পর স্কুলে গিয়ে দেখি সবাই আমার দিকে কেমন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। স্যার-ম্যাডামরা কথা বলছে অত্যন্ত কোমল গলায়। তানভীরের কাছে শুনলাম বিনা দোষে আমকে মারার কারণে ওই নতুন স্যারকে নাকি অনেক বকা হয়েছে। উনি চাকরি ছেড়েছেন না উনার চাকরি চলে গিয়েছে কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার- সেদিন থেকে আমাদের স্কুলে বেত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে! এটার জন্য আমার যে পরিচিতি বেড়েছিল সেটা শেষ দিন অবধি ছিল। তবে আমার পরিচিতি আমি নিজেই তৈরি করেছিলাম। খেলাধূলোতে অবশ্য পারতাম না। কেননা আমাদের বাড়ির ছোটদের সেভাবে বাইরে যেতে দিত না। আর আমাদের আশেপাশের যে মাঠগুলো ছিল সেখানে অনেক বড় ছেলেরা খেলত। তাই জায়গা পেতাম না খেলার। তবে আমি ছবি আঁকতাম খুব ভাল ছিলাম। আর্টের প্রতিযোগিতায় আমি ডিসি সাহেবের কাছ থেকে সেকেণ্ড প্রাইজ নিয়েছিলাম। তবে আমি বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেবার আমাদের বাসায় সব টিচারকে খাওয়ানো হয়েছিল।

আমি গানও গাইতাম খুব ভাল। মা গান গাইতে পারতেন বলে আমাদের দু ভাইবোনের গানের গলা ছিল অনেক মিষ্টি। আমার অবশ্য শেখা হয় নি, চুমকি ওস্তাদ রেখে শিখেছিল। স্কুলের যেকোন ফাংশনগুলোতে আমি গান গাইতাম। সবাই আমাদের হেড মাস্টার হরিহর স্যারকে ভয় পেলেও আমি পেতাম না। যেকোন সমস্যায় আমি ছুটে যেতাম উনার রুমে। ছাত্রদের কারো কোন সমস্যা হলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হত কথা বলার জন্য।

এই স্কুলটায় আমি আমার অনেক স্মৃতি রেখে গিয়েছি দশ বছরে। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন। টিচারদের কথা বাদ দিলাম, আমার ধারণা প্রতিটা ইটেও যেন আমার স্পর্শ লেগে আছে। আজ এতদিন পর স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আমি এতটাই বিস্মিত হয়েছিলাম যে নড়বার শক্তিটুকু ছিল না।

কী দেখছি আমি? এটা আমার স্কুল ! আমি হা হয়ে গেলাম। বিশাল বড় গেট। গেটে আবার সিকিউরিটি ক্যামেরা। চার চারটা ইউনিফ্রম পড়া গার্ড দাঁড়িয়ে। আমার মনে পড়ে গেল আমাদের সময়ে দারোয়ান মজিবুরের কথা। একটা নোংরা লুঙ্গি পড়ে টুলে বসে ঝিমাতো আর কান চুলকাতো সবসময়। আমাদের ধারণা ছিল ওর কানে পোকা আছে।

সেই মজিবুরকে এখানে কল্পনা করা যায়? যে বড় প্রাচীরটা দেওয়া আছে আয়তনে সেটা আমাদের স্কুলের চারগুণ। আমাদের স্কুলটা সেই সময়ে উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত স্কুল ছিল। সরকারি না হলেও এর জৌলুশ এতটুকু কম ছিল না, সেখানে শহরের বড় ঘরের ছেলেরা পড়ত। সরকারি না হওয়ার কারণেই এটা ফুলে ফেপে এত বিশালাকার হয়েছে? এতো পুরোই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মত। আমাদের সময়ে কলেজ ছিল না, এখানে কলেজও আছে। কো-এডুকেশন সিস্টেম। ছোট ছোট পরীর মত মেয়েরাও আমাদের স্কুলটায় এখন পড়ে। অথচ ছেলে-মেয়ে যে একসাথে বড় স্কুলগুলোয় পড়তে পারে এটা ছিল আমার ধারণার বাইরে। এটা আমি ঢাকায় এসে কলেজে উঠে দেখেছিলাম।

বিশাল বিশাল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আমার স্কুলের সামনে। এখন হয়তো এটাকে আমার “আমার স্কুল” বলাটা ঠিক হবে না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলাম।

- “অ্যাই যে স্যার, কোথায় যাবেন আপনি?” একটা গার্ড বাঁধা দিল আমাকে।

- “ভেতরে ঢুকব।”

- “আপনার বাচ্চা আছে ভেতরে? গার্জিয়ান কার্ড বের করেন। না হলে ঢোকা যাবে না।“

- “আমার বাচ্চা নেই। আমি এমনিই ঢুকতাম।”

- “এমনি ঢুকতাম মানে? ফাজলেমী করেন?” গার্ডের গলা উঁচুতে ওঠায় আরও দুজন এগিয়ে এল।

- “কি হয়েছে রে?” আরেকজনের প্রশ্ন

প্রথম গার্ডটা বলল, “আরে এই লোকটাকে অনেকক্ষণ দেখছি উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এদিকটায় দেখছে । শালার কিডন্যাপার নাকি আল্লাহ জানে ! ভাল মানুষের মত এসে বাচ্চাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাওয়াই তো এদের কাজ।”

কিডন্যাপার! আমার মনে হল আমার গালে কেউ কষে দুটা থাপ্পড় দিয়েছে। আমার বয়স এখন উনচল্লিশ। আমেরিকার একটা ভাল কোম্পানির চাকরি করে প্রচুর ডলার কামাচ্ছি। আমার চেহারার মধ্যেও একটা ভারিক্কি বোধ আছে বলে জানতাম। সেখানে আমায় কেউ কিডন্যাপার বললে সত্যিই হোঁচট খেতে হবে। হতে পারে আমার ফতুয়া আর জিন্স দেখে আমায় একটু মামুলি গোছের কেউ মনে করেছে ! এখানে এই বয়সে এরকম ক্যাজুয়াল পোশাক কেউ পড়ে না মনে হয়।

এর মাঝেই এরা কাকে যেন ডেকে এনেছে। প্রথমে টিচার ভেবেছিলাম, পরে বুঝলাম টিচার ন। গার্ডদের সর্দার বলা যেতে পারে। বেশ কোট-টাই ভদ্রলোক। উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললেন, “আপনি কে? কি চান?”

আমি বললাম যে এই স্কুলের প্রথম দিকে আমি পড়তাম। তারপর সংক্ষেপে আমার কথা, পরিবারের কথা জানালাম।

ভদ্রলোকের মনে হয় একটু মায়া হল। তবে আমার পরিবারকে চিললেন না। একটু কেশে বললেন, “দেখুন এভাবেই তো আর ঢুকে পড়া যায় না, এটা অ্যালাউড না। তবে আপনি যদি আসলেই পুরানো স্টুডেন্ট হয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে পুরোনো ছাত্রদের ‘অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন’ এ যোগাযোগ করতে পারেন। সেখানে প্রেসিডেন্টের পারমিশন আর আমাদের প্রিন্সিপালের পারমিশন পেলেই আপনি ভেতরে ঘুরে দেখতে পারেন। আজকে আর সম্ভব নয়।”

এবার সত্যিই মেজাজ খারাপ হল আমার। প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলতে চাইলে ভদ্রলোক বলল, “আজ স্যার প্রচণ্ড ব্যস্ত-অন্য কোনদিন।”

আর কিছু বললাম না, ওরা আমাকে ঢুকতেই দিলো না। এক কালের এই স্কুলের সেরা ছাত্রটাকে আজ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক সামান্য কর্মচারীর কাছে পারমিশন চাইতে হল- তাও পেলাম না। আরো বড় জায়গায় পারমিশন নিতে হবে। এই স্কুলকে যে তার মায়ের মত ভালবাসতো, এই স্কুলটা দিয়েই যে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল- সেই টগরকে আজকে অন্য মানুষের কাছে পারমিশন নিতে হবে। আমার খুব খারাপ লাগছিল, খুব। আমি হাঁটতে পারছিলাম না। আমার বুক ঠেলে কান্না আসছিল। সামলানোর অনেক চেষ্টা করছি। অভিমানের কান্না।

এর মধ্যে একটা বয়স্ক দাড়িওয়ালা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। আমি ঝটকায় সরায় নিতে যাব দেখি আরও জোর করে চেপে ধরেছে। ভিক্ষা চাইবে ভাল কথা কিন্তু হাত ধরবে কেন? আমি ধমক দিতে যাব দেখি লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে বলে, “আব্বুজি আমাকে চিনতে পাচ্ছো না?”

আমি হতভম্ভ। বুড়ো বলে কি! লোকটা মুখ নিচু করে বলে, “তোমার মুকুল মামাকে মনে নাই?”

মুকুল মামা! আমি উত্তেজনায় কথাই বলতে পাচ্ছিলাম না ! আমাদের মুকুল মামা! সেই কবে আমাদের স্কুলের সামনে চটপটি-ফুচকা বিক্রি করতো, সাথে ঝালমুড়ি- আচারও । কতদিন এনার কাছে বাকিতে খেয়েছি! তখন একদম বাচ্চা বাচ্চা দেখতে লাগতো উনাকে। তারপর উনি নতুন বিয়ে করলেন। বৌ সব বানিয়ে দিত। আমরা প্রায়ই উনাকে ক্ষেপাতাম,

“কি মুকুল মামা! বিয়ে করে দেখে তোমার ব্যবসা ভালোই বাড়ছে। তোমার এই চটপটির গাড়ি রঙ করে আরও চটপটে বানাইছো !”

সেই মুকুল মামা ! ছোট খাটো মানুষটা। গায়ে শতছিন্ন পাঞ্জাবী। মাথায় চুল পড়ে গিয়েছে, মুখে বিশাল বড় দাঁড়ি। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মুকুল মামাকে ওর গাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে ওর ঐ ভাঙ্গা গাড়িটা দেখালো একটু দূরে, যেটা প্রতিদিন মামা ঠেলে নিয়ে আসতো, এখনও নিয়ে আসে।

আমি মুকুল মামাকে নিয়ে ওর গাড়ির ওখানে গেলাম। খুব খারাপ অবস্থা। রঙ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখনও উপরে দেখলাম লেখা, “মুকুলের ফুচকা ও চটপটি।” যেটা দেখলেই আমাদের মন ভাল হয়ে যেত।

মুকুল মামা জানালো, মামী বেশ ক’বছর আগে মারা গিয়েছেন। একটাই মেয়ে- বিয়ে দিয়েছেন। এখনও ধুঁকতে ধুঁকতে তার এই দোকানটা চালাচ্ছেন। স্কুলের লোকজন তার আশেপাশে দোকানটা রাখতে চায় না, একবার তো ভেঙেই দিতে চেয়েছিল। পা-টা ধরে সরে এসেছেন স্কুলের কাছ থেকে।

মামাকে বললাম, “তা তুমি দোকানটা অন্য কোথাও নিয়ে গেলেই তো পারো। এখানে আছো কেন?”

মামা প্রথমে জবাব দিল না। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “মায়া পড়ে গিয়েছে স্কুলটার জন্য।”

আমি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। আমি একটু আগে যে অভিমান করেছিলাম আমার স্কুলের জন্য আমার অধিকার নিয়ে তা নিমেষেই উবে গেল। এই মানুষটা গত পঁচিশ বছর ধরে একই জায়গায় আছেন, কোন অধিকার দাবী না করেই। শুধু মায়ায়, ভালোবাসায়।

ভাবছিলাম মামাকে কত টাকা দেবো। আমাকে অবাক করে মামা আমার হাতে একটা ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা ধরায় দিলেন। বললেন, “খাও, দূর থেকে তোমাকে দেখতেছিলাম। চেনা চেনা লাগলো। কাছে আসতেই চেহারা পরিষ্কার হইল আমার কাছে। কত ছাত্ররে যে দেখলাম, কাউকে মনে আছে, কাউকে মনে নাই। তবে তোমাদের সময়কার ছেলেগুলারে এখনও মনে আছে।”

ঠোঙ্গাটা হাতে নিলাম। মনে হল, এই ঝালমুড়ির দাম আমি কখনই শোধ করতে পারব না, এটা আমার দ্বারা সম্ভব না।

মামার কাছে বিদায় নিয়ে আসলাম। আমি ঠিক করলাম মামাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব। আমি একটা চেকবই নিয়ে এসেছিলাম আমার স্কুল ফান্ডে কিছু কন্ট্রিবিউট করব বলে। স্কুলের হুলস্থূল অবস্থা দেখে বুঝলাম আমার সাহায্যের কোন দরকার নেই তার। পুরোটা দিয়েই মামার সাহায্য করবো।

এখন মনে হচ্ছে, স্কুলের জন্য যা করেছি তা আমার প্রাপ্তি না-এই বৃদ্ধ আমাকে মনে রেখেছে এটাই আমার প্রাপ্তি, এটাই পরিচয়।

রাসিক রেজা নাহিয়েন


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

পড়তে পড়তে আমার পুরনো স্কুলের কথা মনে পড়ছিল। নস্টালজিক হচ্ছিলাম। শেষটায় অদ্ভুত মন খারাপে আক্রান্ত হলাম। খুউব ভাল লেগেছে স্মৃতিচারণ বা গল্প। শুভকামনা।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

শাব্দিক এর ছবি

লেখার ধরনটা ভাল লেগেছে। লিখতে থাকুন আরো।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। নিয়মিতভাবে লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

মরুদ্যান এর ছবি

এটা কি গল্প না স্মৃতিচারণ?

যদি স্মৃতিচারণ হয়:
আপনি ভাল ছাত্র, অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের, এবং কর্মজীবনেও সাফল্যের শীর্ষে আছেন ভাল কথা। কিন্তু লেখাটাতে বারবার এই প্রসঙ্গ গুলো ঢালাও ভাবে আড়ম্বরের সাথে উঠে এসেছে, যা চোখে লাগছে!

এক কালের এই স্কুলের সেরা ছাত্রটাকে আজ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক সামান্য কর্মচারীর কাছে পারমিশন চাইতে হল- তাও পেলাম না

অফ যা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালন করছে, স্কুলের ২০-৩০ বছর আগের সবার ঠিকুজি জেনে রাখা তার কাজ না।

গল্প হলে উপরের মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক। হাসি
লেখা চলুক।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

এটা গল্পই, আমি নিজেও এখনও কলেজে পড়ি। যে প্রতিষ্ঠানে আমি স্কুল কলেজ মিলিয়ে বার বছর ধরে আছি সেটা যে আমাকে মোটেও মনে রাখবে না এই অনুভূতিটা থেকেই গল্পটা লিখেছি। তবে আমার কাঁচা হাতের লেখায় গল্পটা হয়ত দূর্বল হয়ে গেছে। আপনাদের বিশ্লেষণই সেই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠব আশা রাখছি।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।