পানকিভিয এই ফার্মেসীটি পান তার বাবার কাছ থেকে। জন্মসূত্রে তিনি ক্যাথলিক হলেও সেকালের পোলিশ ক্যাথলিকদের মতো কট্টর তিনি ছিলেননা কোনও কালেই। ফার্মেসীর দোকানটি ব্যবসা হলেও সেটিকে সেটিকে তিনি বরাবর জনমানুষের সেবার পন্থা হিসেবেই দেখেছেন। এ গুণটিই তার বাবা তাকে শিখিয়ে গেছেন এই ফার্মেসী তার হাতে তুলে দেবার সময়। আর তাইতো তিনি তার ফার্মেসীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঘেঁটোর নিপীড়িত মানুষগুলোর কাছ থেকে মুঠোতে ভরা অর্থের চেয়ে একটুকরো স্বস্তির হাসিতেই বেশি তৃপ্তি বোধ করতেন।
৪০’র শেষ থেকেই ক্র্যাকও শহরে দখলদারি নাৎসি বাহিনী নির্দেশ জারি করে শহরের অধিকাংশ ইহুদীকে সরে যেতে হবে ভিস্তুলা নদীর ওপারে তাদের জন্যে নির্মিত ঘেঁটোতে। অল্প এক চিলতে জায়গায় রাতারাতি দেয়াল তুলে গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে দেয়া হল সারা শহরের ১৭,০০০ ইহুদীদের। এই পশু-খামাররুপী স্থানটিই পরবর্তী দু’বছরের জন্যে হয়ে ওঠে তাদের ঠিকানা। ঘেঁটোর আশেপাশের পোলিশ ক্যাথলিক বাড়ির মালিক বা ব্যবসায়ীদের বলা হল সে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। সবাই চলে গেলেও রয়ে গেলেন ব্যতিক্রমী পানকিভিয। নাৎসিদের বলে কয়ে পাশ জোগাড় করে নিলেন এ এলাকায় দোকান চালাবার। চাইলে তিনিও পারতেন নিজের পিঠ বাঁচিয়ে অন্য কোথাও ব্যবসা স্থানান্তর করতে। কিন্তু তিনি ভাবলেন আর সবার মতো তিনিও যদি ঘৃণার খাতায় নাম লেখান, যদি চলে যান বাবার গড়ে তোলা এই এতকালের ফার্মেসী ছেড়ে, তবে এই হাজার হাজার মানুষ আপদে-বিপদে ওষুধের প্রয়োজনে যাবেটা কোথায়? অন্তরে লালন করা মানবতা-বোধই সেদিন তাকে বাতলে দিল সঠিক পথটি। তিনি রয়ে গেলেন। শুধু তিনিই নন, রয়ে গেলেন তার তিন সহকারীও।
অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার স্পিলবার্গ নির্মিত “শিন্ডলার’স লিস্ট” চলচ্চিত্রের কল্যাণে আমরা অনেকেই জানি শিন্ডলার সাহেবের কথা, যিনি তার সমরাস্ত্র কারখানায় কাজ দেবার নাম করে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বহুসংখ্যক ইহুদির প্রাণ। সেই কারখানাটি কিন্তু এই ফার্মেসী থেকে খুব বেশি দূরে নয়, মাইলের হিসেবে মাত্র আধ মাইল। শিন্ডলার সাহেবের মতো প্রত্যক্ষভাবে হয়তো পানকিভিয অনেকের প্রাণ বাঁচাতে পারেননি, কিন্তু সেই ঘোর অমানিশার অন্ধকারময় দিনগুলোতে তিনি ঘেঁটোর মানুষদের জন্যে যা করেছেন, মানবতার মাপকাঠিতে সেটিও কম নয় কোনও অংশে। বিনামূল্যে ওষুধতো তিনি সরবরাহ করতেনই, নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাবার আর খবর এই দু’ই তিনি পৌঁছে দিতেন ঘেঁটোর মানুষদের কাছে।
ছবিঃ ফার্মেসিতে ঢোকার মুখের কাউন্টার
এবার আসা যাক ফার্মেসীর ভেতরের অঙ্গসজ্জার কথায়। চেরি কাঠের ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই অভ্যর্থনা জানায় বিশাল এক কাউন্টার টেবিল। এ টেবিলের এক ধারে সে আমলের “আনকের”কোম্পানির এক গণনা যন্ত্র, যেটি ব্যাবহার করে হিসেব রাখা হত রোগীদের পরিশোধ করা অর্থের। আর অন্যধারে, এইমাত্র কে যেন পাতা উল্টে গেছে, এমন ভঙ্গিতে রাখা যুদ্ধের সেই সব দিনের কোন এক খবরের কাগজ। এ ফার্মেসীতে যে সবাই কেবল পথ্য নিতেই আসতেন, তেমনটি নয়। অনেকেই আসতেন কেবল ওই খবরের কাগজের লোভে, বাইরের পৃথিবীকে জানার একমাত্র উপায় ছিল ওই কাউন্টারের ওপর রাখা সংবাদপত্রগুলো। কাউন্টার টেবিলের ঠিক পেছনের কাঠের আলমারিটি রকমারি চিকিৎসা পথ্যে ঠাসা, হয়তোবা ফার্মেসীর নামের সাথে মিল রাখার জন্যেই এ আলমারির মাথায় শোভা পাচ্ছে একটি ওক কাঠের ঈগল পাখি।
ছবিঃ আনকের কোম্পানির গণনা যন্ত্র
অভ্যর্থনা-কক্ষ পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকলে চোখে পড়ে ছোট্ট এক কামরা, যেটি ব্যবহৃত হতো আগত রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেবার জন্যে। এ ফার্মেসীতে ভিন্ন কোন চিকিৎসক ছিলেন কিনা তা জানা যায়না, তবে খুব সম্ভবত পানকিভিয মশাই নিজেই সময়ের সাথে ডাক্তারি-বিদ্যা কিছুটা রপ্ত করেছিলেন, আর তারই হয়তো কিছুটা চর্চা করতেন এই কক্ষে।
ছবিঃ এ কক্ষে সংরক্ষিত কিছু চিকিৎসা সামগ্রীর নমুনা
এ কক্ষের ঠিক উল্টো দিকের ঘরটি ব্যবহৃত হতো নানা পদের ওষুধ আর তার কাঁচামাল মজুদের জন্যে। কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজানো কাঁচের বয়ামগুলো সে যুগের সেই ওষুধগুলোর প্রতিনিধিত্ব বহন করছে। জার্মানির ডার্মস্টাডে তৈরি “ডরিল” বা কোলন শহরে তৈরি ক্লরামিন পাউডারের মতো অসংখ্য জার্মান ওষুধ নজরে এলো এ ঘরে। জার্মানদের সাম্রাজ্য বিস্তারের অন্যতম কারণ যে ছিল তাদের উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজার তৈরি করা সেটা অনেকখানি এখান থেকেই আন্দাজ করা যায়। এ ঘরের পেছনের দিকে একটি দরজা, যাকে আসলে গুপ্ত-দ্বার বলাই ভালো। কারণ ঘেঁটো থেকে কেউ যখন অর্থ, খাবার বা আশ্রয়ের খোঁজে পানকিভিযের কাছে আসতেন তখন পেছনের এই গুপ্ত-দ্বারটি রাতের আঁধারে ব্যাবহার করাই শ্রেয় বোধ করতেন।
এই সংরক্ষণ কক্ষের লাগোয়া আরেকটি এক চিলতে কক্ষ ব্যবহৃত হত ওষুধ প্রস্তুতের কাজে। নানা আকারের পাতন যন্ত্র, পেয়ালা, ফানেল ছড়ানো এ কক্ষের টেবিল জুড়ে। সেকালে আসলে বিভিন্ন রোগের জন্যে বিশেষায়িত ওষুধের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল, আর তাই এ ধরণের ফার্মেসিতে মূল কাঁচামাল থেকে অনুপাত মোতাবেক আলাদা আলাদা ওষুধ বানিয়ে নেয়া হতো।
ছবিঃ বিভিন্ন ওষুধের কাঁচামাল আর সংরক্ষিত ওষুধ
১৯৪৩ সালের মার্চ মাসের এক সকাল। অন্য সব দিনের চেয়ে সে দিনটি একটু আলাদা। অন্যসব দিনে এ সময়টাতে পানকিভিয মশায়ের তিন সহকারী তুমুল ব্যস্ত থাকে দোকানের কাজে-কর্মে, কিন্তু সেদিন সবার মনই যেন এক অব্যক্ত উৎকণ্ঠায় ভরা, যে মানুষগুলোকে তারা আগলে রেখেছিলেন আগের দুটি বছর ধরে, তাদের প্রায় সবাইকে আজ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোন এক অজানা যমালয়ের উদ্দেশ্যে। এই ফার্মেসী ভবনের বা’ দিকের কোণের রুমটি পানকিভিয মশায়ের ব্যক্তিগত রুম, এখানে তিনি বিশ্রাম নেন, অবসরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু বইপত্র পড়েন, কিংবা কখনো তামাকের পাইপে আগুন ধরান। সেদিনের সে সকালে পানকিভিয নিজেকে পুরোটা সময় বন্দী করে রাখলেন সে ঘরে। রাস্তার ধারের বড় জানালার কাছে গিয়ে ভারী পর্দা সরিয়ে তিনি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সামনের খোলা চত্বরের মানুষগুলোর অগস্ত্য যাত্রার পানে। এ দিনটি তার বড় কষ্টের দিন, এ দিনের গ্লানি তিনি আর কখনও ভুলতে পারেননি জীবনের বাকি যে’কটা দিন তিনি বেঁচে ছিলেন।
ছবিঃ পানকিভিযের বিশ্রাম কক্ষ
সেদিন যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো আউসভিতয কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, মার্চের প্রগাঢ় শীতের সেই সকালে তারা অপেক্ষা করছিলেন বিহ্বল আর ক্লান্ত চিত্তে এই ফার্মেসির সামনের খোলা জায়গাটিতে। তাদের স্মরণে আজ সেই চত্বরে বানানো হয়েছে কিছু চেয়ারের ভাস্কর্য। না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সেই মানুষগুলো যদিবা কখনো ফিরে আসে তবে এই চত্বর যেন তাদের স্বস্তি-দানের ঋণ শোধ করতে পারে, সেই অপেক্ষায় এই চত্বর আর তার ভাস্কর্যগুলো উন্মুখ হয়ে থাকে বছরের পর বছর।
ছবিঃ অপেক্ষায় থাকা সেই ভাস্কর্যগুলো
‘বোহারতেরো গেটা’সড়কের এই “ঈগল ফার্মেসি”থেকে বেরিয়ে হাতের বাঁয়ে খুঁজছিলাম ঘেঁটোতে ঢুকবার সেই প্রবেশদ্বারটি, যেই দ্বারটির সাথে জড়িয়ে ছিল ১৭,০০০ মানুষের দিন যাপনের কথকতা। বৃথা প্রচেষ্টা আমার। সেই দ্বার তো বটেই, গোটা ঘেঁটোটিরই খোল-নলচে পালটে ফেলা হয় পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে। পোল্যান্ডের মানুষদের মনে তখনো বিদ্যমান তীব্র ইহুদী-বিদ্বেষ বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা ঘেঁটো আর সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনার স্মৃতি মুছে ফেলতে ভূমিকা রাখে। শুধু এই ঘেঁটোই নয়, পঞ্চাশের দশকে পানকিভিযের “ঈগল ফার্মেসি”কে রাষ্ট্রায়ত্ত করে এটিকে রূপান্তর করা হয় এক পানশালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ধরণের স্থানগুলোর মূলত পুনঃ-সংরক্ষণ শুরু হয় সমাজতন্ত্রের পতনের পর।
ছবিঃ আজকের এই বাড়িগুলো ছিল সেদিনের সেই ঘেঁটোর অংশ
পানকিভিয আর শিন্ডলারের মতো মানুষেরা শুধু যে মানবতাবাদীই ছিলেন তা নয়, তারা ছিলেন অসম সাহসী এবং বীর। জার্মান বাহিনীকে ধোঁকা দিয়ে ইহুদীদের সাহায্য করার পরিণামে ধরা পরলে যে পেতে হতো কপালে সীসার বুলেটের ছোঁয়া, তা তাদের অজানা ছিলোনা। কিন্তু সে ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে তারা এগিয়ে গিয়েছিলেন বলেই আজও তারা কিছু মানুষের স্মৃতিতে চির অম্লান।
জীবনযুদ্ধ
মন্তব্য
ছবি আপলোড করার পর দেখবেন তালিকার পাশের চেকবক্সটায় টিক চিহ্ন চলে আসে। টিক চিহ্নগুলো তুলে দিয়ে পোস্ট সংরক্ষণ করতে হবে।
ধন্যবাদ হিমু ভাই, পরের বার পোস্টের সময় বিষয় টা মাথায় রাখবো
জীবনযুদ্ধ
ধন্যবাদ। কিছু অজানা তথ্য জানা গেল।
ধন্যবাদ প্রৌঢ় ভাবনা
জীবনযুদ্ধ
বেশ লেখা, আরো আসুক।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ , হ্যা আরো আসছে, দেখি এই ছুটির ভেতরই আরো কিছু লিখার ইচ্ছে রইলো
জীবনযুদ্ধ
এখন কি এটা প্রদর্শনী এর জন্য উন্মুক্ত?
ধন্যবাদ , হ্যা এটি এখন প্রদর্শনীর জন্যে উন্মুক্ত
জীবনযুদ্ধ
লেখা চলুক।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
গুডরিডস
স্মৃতিবিজড়িত ব্যাপারগুলো পড়তে ভালো লেগেছে। ছবি গুলোও যেন সেইসব দিনের চেহারাটা আরো স্পস্ট করে তুললো।
অপর্ণা মিতু
গুডরিডস
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
গুডরিডস
আরো বেশি বেশি লিখুন
ধন্যবাদ , চেষ্টা তো করছি
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন