ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অবদানের অজানা তথ্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২১/০২/২০১৫ - ৩:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভাষা আন্দোলনে (১৯৫২—১৯৫৬ ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের মিলিত সংগ্রাম ছিল এ’কথা কারো অজানা নয়। কিন্তু সে সময় ছাত্রীদের গ্রেফতার ও তাদের কারাবাস বিষয়ক ঘটনাটি প্রায় নেপথ্যে রয়ে গেছে। সে বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করে সে সময়কার ভাষা সংগ্রামীদের ও ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। সে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারি ড. হালিমা খাতুন,তালেয়া রহমান ও প্রতিভা মুৎসুদ্দির সাথে সরাসরি আলোচনায় বা তাদের লেখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ঘটনাটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল অভাবিত। কেননা সে যুগের মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে ছাত্র ছাত্রীদের পারষ্পরিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নাজুক। আজ থেকে তেষট্টি বছর আগের সমাজচিত্র অবলোকন করলে ছাত্রীদের অবস্থানটি যাচাই করা সহজ হবে। সে সময় সচ্ছ্লও আধুনিক বাবা মা তাদের মেধাবী কন্যাকে সমাজের চোখ রাঙানীর তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতেন । তাই ছাত্রীদেরকে তাদের পারিবারিক কঠোর অনুশাসন ও মূল্যবোধের ছবক মেনে চলতে হত । সুতরাং ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বাক্যবিনিময়েও ছিল অলিখিত নিষেধ । ১৯৫২এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র ছাত্রীদের অবাধ অংশগ্রহণ এতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে সমাজব্যবস্থাও সেখানে ছিল নতজানু । সেসময় ছাত্রীদের বেশ কয়জন প্রতিনিধি ছাত্রদের সর্বদলীয় ভাষাকমিটিতে যোগ দেয়। এই প্রতিনিধিরা কলেজ ও স্কুলের ছাত্রীদেরকে উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করে মিছিলে নিয়ে আসত।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে প্রধানতঃ দু’ভাগে ভাগ করা যায় । প্রথম ধাপ, ১৯৪৮ সালের কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর “উর্দু এবং উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্টভাষা “ এই ভাষণের পর থেকে ১৯৫২এর ২১ ফেব্রুযারী পর্যন্ত । ১৯৫২এর ২১শেতে ছাত্র ছাত্রীদের অংশগ্রহণ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও ছাত্রদের শাহাদাত বরণ ইত্যদি ছিল যুবসমাজের অনন্য চেতনার পরিচায়ক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যেসব ছাত্রীরা অংশ নেয় তাদের মধ্যে ড. হালিমা খাতুন , রওশন আরা বাচ্চু ,ড. সুফিয়া আহামেদ, ড. সাফিয়া খাতুন ও সুফিয়া খানের নাম উঠে এসেছে । সেদিন ১৪৪ ধারা ও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ছেলেদের সাথে রাস্তায় ছাত্রীরাও নেমেছিল এবং টিয়ারগ্যাস ও লাঠি চার্জয়ের মোকাবেলা করেছিল । সেদিনের ঘটনায় ছাত্রদের কয়েক জন রাজপথে শহীদ হয় এবং বহু ছাত্র আহত হয় ।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপটি হল (১৯৫৪ -১৯৫৬ ) , ছাত্র ছাত্রীদের চলমান বিভিন্ন প্রতিবাদ ,প্রতিরোধ ও কারাবরণ । আন্দোলনের এই দ্বিতীয় ধাপটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ’৫২এর আন্দোলন নানা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মধ্যদিয়ে বিকশিত হয়ে এই প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে । দীর্ঘ দু ‘বছর বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মাঝে পাকিস্তান সরকার অনেকটা নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলীমলীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে । ৩ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয় । ফলে ৭মে গণপরিষদ অধিবেশনে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । কিন্তু দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ৩১ মে কেন্দ্রীয় সরকার, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল , গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্রীপরিষদ বাতিল করে দিয়ে প্রদেশটিতে গভর্নর শাসন চালু করেন । এরপরেও আরো দু’বছর এই আন্দোলন অব্যাহত থাকে ।

১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে এই আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় একশ । সর্বদলীয় ছাত্রকমিটির সঙ্গে ছাত্রী প্রতিনিধিদের বৈঠকে ২১ উদযাপনের পরিকল্পনা পর্যালোচনার সাথে সাবসিডিয়ারি পরিক্ষার্থীদের সভায় যোগ না দেয়ার কথাও স্থির হয় । এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ২১ এর প্রস্তুতি সভায় একমাত্র পরীক্ষাথী ছাড়া সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সব ছাত্রী উপস্থিত হয় । হঠাৎ সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । প্রতিভা মুৎসুদ্দির ভাষ্য মতে (রোকেয়া হলের পরবর্তী ভিপি ) এই খবর শুনে চামেলী হাউজ (তখনকারএকমাত্র ছাত্রী হোস্টেল, সলিমুল্লা মুসলিম হলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল) পরীক্ষার্থীরা তার নেতৃত্বে মিছিল করে এসে দুসারি মিলেটারি ও পুলিশের মাঝখান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আমতলার সভাস্থলে প্রবেশ করে । একজন বক্তার বক্তৃতা চলার মাঝে হঠাৎ লাঠি চার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছোড়া শুরু হয়, যে যেদিকে পারে ছুটে চলে যায় । এরপর ছাত্রদেরকে খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করে পুলিশভ্যানে উঠাতে থাকে। ছাত্রীরা ছুটে গিয়ে লাইব্রেরী ও কমনরুমে আশ্রয় নেয় ,পরে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পুলিশেরর হাতে ধরা দিবে, এরপর দলগত ভাবে তারা প্রায় ৩০ জন ছাত্রী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে।এবং পুলিশের আদেশ অনুযায়ী তারা পুলিশভ্যানে উঠে ।ছাত্রদের সাথে তাদের এই একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমে সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের ভুমিকা প্রশংসিত হয়। সরকার হয় বিচলিত ও আন্দোলন হয় বেগবান । এরপর তাদেরকে লালবাগ থানায় নিয়ে সবার নামে নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে তদেরকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় ।এদের মাঝে ছিল প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কামরুন নাহার লাইলি ,তালেয়া রহমান , জহরত আরা ,ফরিদা বারি মালিক ও অন্যরা। এইসব বন্দীরা কারাগারে রাজবন্দীদের দেখা পায় ও তাঁদের দ্বারা প্রশংসিত হয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও এস এম হলের প্রভোস্ট তাদেরকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন । এস এম হল থেকে এদের জন্য খাবার পাঠানোর কথাও শোনা যায়। মফস্বলে উতলা, উদ্বিগ্ন ও সন্ত্রস্ত বাবা মার কথা মনেকরে তারা জেলখানায় মাঝে মাঝে বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত। সেই মানসিকতা কাটাতে তারা কোরাস গান ধরত। সকালটা দেশাত্মবোধক গান দিয়ে শুরু করত তার মধ্যে ছিল –

১) ভুলবনা ,ভুলবনা সেই একুশে ফেব্রুয়ারী ,লাঠি ,গুলি টিয়ার গ্যাস ,মিলিটারি আর মিলিটারি । ২)বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা ।৩)কারার ঐ লৌহ কপাট,ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট ৪) জাগো অনশন বন্দী উঠ রে যত---- ইত্যাদি ।

পরে সরকার পক্ষ নমনীয় হয়, যাদের পরীক্ষা ছিল তাদেরকে ১৫ দিন ও অন্যদেরকে একমাস পর ছেড়ে দেয়।

অতঃপর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তনের গণপরিষদ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।এব্ং ২৬ ফেব্রুয়ারী তারিখে উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যদা দিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে লেখা হয় —উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ।(The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali )

আজ বাংলাদেশে নারীর যে ক্ষমতায়ন, নারী নেতৃত্ব ও নারীর যে প্রগতি প্রবহমান তার উন্মেষ ঘটেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব ভাষা কন্যাদের কল্যাণে, একথা বলাই বাহুল্য।

নভ থেকে নীড়ে


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট। ভালো লাগলো।

স্বয়ম

মুক্তমন এর ছবি

অজানা তথ্য জানালেন৷ধন্যবাদ৷

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

এক লহমা এর ছবি

চলুক ভালো লাগল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভাল লাগলো। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রইল। লেখকের জন্য শুভকামনা।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক নতুন তথ্য, ভালো পোস্ট...

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার অনুভূতি জেনে ভাল লাগল।

রণদীপম বসু এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট ! ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

তানিম এহসান এর ছবি

গুরুপত্বপূর্ণ পোস্ট। আপনাকে ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সকল ভাষাকন্যার প্রতি শ্রদ্ধা। লেখককে ধন্যবাদ।

ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম একবার, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বয়সেও তিনি যেন তরুণ বয়সে ফিরে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ সময় বিস্তারিত বলেছিলেন সে দিনের কাহিনী, একবারে গা শিউরে ওঠে শুনলে। শেষ অনুচ্ছেদটির সঙ্গে বিশেষভাবে সহমত।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সত্যানন্দ।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অজানা ব্যাপার জানা হল। প্রতি ক্ষেত্রেই নারীর অবদান অবদান আছে। নরীর অবদান ছাড়া অনেক কিছুই সম্ভব হত না। ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ন একটি পোস্ট দেয়ার জন্য।

আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ

অতিথি লেখক এর ছবি

যাহা জানা ছিল না তাহা জানা হইলো । ইতিহাসকে গহব্বরে হারিয়ে দিতে নেই ।সময়ান্তরে আমাদের উত্তরসূরীদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে এই ইতিহাসমালা।

----------
রাধাকান্ত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।